মানস প্রতিম দাস
বইয়ের শুরুতে উৎসর্গপত্রে লেখা ‘আমার বাবা, কল্পবিজ্ঞানের প্রথম প্রজন্মের অকালপ্রয়াত লেখক, দিলীপ রায়চৌধুরীকে’। মন চলে যায় সময়ের সরণি বেয়ে, ইচ্ছে জাগে সীমিত পরিসরে খানিক টাইম ট্র্যাভেল করার। টু অ্যান্ড ফ্রো জার্নি।
ষাটের দশকে পৌঁছে ওল্টাই বারোয়ারি গল্পের পাতা। গল্পের নাম ‘সবুজ মানুষ’। এ গল্পের একটা শুরু আছে এবং শেষও আছে। সে অর্থে গল্পটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বটে কিন্তু আদতে তা নয়। এই একই নামে চারটে গল্প রচিত হয়েছিল বা বলা যেতে পারে চারটে অধ্যায় রচিত হয়েছিল গল্পটার। কিন্তু সব অধ্যায়ই স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে প্রত্যেকটাই একটা আলাদা গল্প। সত্যজিৎ লিখেছিলেন গল্পের চতুর্থ অধ্যায়। শুরুটা করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারপরে অদ্রীশ বর্ধন এবং তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক হিসাবে পাই দিলীপ রায়চৌধুরীকে। কেউ কাউকে নাকি আগে থেকে বলেননি যে কী লিখতে যাচ্ছেন তাঁরা। তবে সবুজ মানুষদের পৃথিবীর শত্রু বলে উল্লেখ করেছেন প্রত্যেকে। প্রেমেন্দ্র মিত্র বাদে ‘রামকান্ত ভক্ত’ নামে একজন চরিত্রের উল্লেখ করেছেন বাকি লেখকরা। যাই হোক, এমনি-এমনি অবশ্য লেখা হয়নি গল্পটা। আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচার করার জন্য তাঁদের এই উদ্যোগ। সালটা ১৯৬৬, আগের বছর এমন একটা প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল। সত্যজিৎ ছাড়া বাকি তিনজন মিলে লিখেছিলেন ‘মহাকাশযাত্রী বাঙালি’। দুটোই পাঠ করার জন্য লেখা, পাঠ হয়েছিল ‘সাহিত্য বাসর’ অনুষ্ঠানে। ভালো লেগেছিল শ্রোতাদের। এমন গল্পের উপাধি হয়েছিল ‘বারোয়ারি’।
ফিরে আসি বইয়ের পাতায়। ‘ভূমিকা’ শব্দটা কেউ তেমন ব্যবহার করেন না আজকাল, তার বদলে থাকে নানা ধরনের শিরোনাম। এ বইতে রয়েছে ‘কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে আমার আশ্চর্য সম্পর্কগুলো’। সামান্য উদ্ধৃত করা যাক, ‘… কিছু লেখা নিছক সেন্টিমেন্টাল। যেমন সবুজ মানুষ নতুন করে বই হিসেবে বার করার সময়ে, মূল সবুজ মানুষের পঞ্চাশ বছর পূর্তির সময়ে, ফ্যানফিকশন হিসেবে লিখেছিলাম ‘সবুজ মানুষ ইনকর্পোরেটেড’ গল্পটি। অতি প্রিয় বিষয়ে লেখার মজাই আলাদা। গল্প হিসেবে উতরেছে কি উতরোয়নি তা পাঠক বলবেন।…’
ফের অতীতের টান, সবুজ মানুষ। দিলীপ রায়চৌধুরীর গল্পের অংশ নিয়ে আসব এখানে।
… কয়েক মিনিট পরে মর্গানথাও এসে পৌঁছতেই আমি প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম। টিম মর্গানথাও যেন সেরকোভিচের প্রতিবিম্ব। কি বাহুর দৈর্ঘ্যে, কি তামাটে গায়ের রঙে।
আমার বিস্ময়াবিষ্ট ভাবটাকে আমল না দিয়ে টিম মর্গানথাও ততক্ষণে শুরু করেছেন:
গুড মর্নিং জেন্টেলমেন, আপনাদের রিসার্চ এ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে। আমরা এমন একটা ওষুধ চাই যা পৃথিবী থেকে জাতিবিদ্বেষ একেবারে মুছে দেবে। এটা ট্র্যাংকুইলাইজার-জাতীয় হওয়া চাই। তাহলে আজকের দুনিয়ায় চালাতে বেগ পেতে হবে না। গুড লাক। আমি চলি।
ভদ্রলোক বেরিয়ে যাবার সময়ে একটা জিনিস লক্ষ করলাম। মর্গানথাও-এর গালে তামাটে ভাবটা একটু কম। ফিকে সবুজ আভা যেন সেখানে। মনে কৌতূহল রয়েই গেল।…
আলোচ্য বইয়ের পাতায় প্রত্যাবর্তন। ‘সবুজ মানুষ ইনকর্পোরেটেড’ একেবারে ছোট গল্প নয়, বারোয়ারি ‘সবুজ মানুষ’ থেকে অন্তত দৈর্ঘ্যে কিছুটা বড়। এখানে ইঙ্গিতের জায়গা নিয়েছে খুঁটিনাটি, গল্পকাররা যেটাকে ডিটেইলস বলতে পছন্দ করেন। এ গল্পে রহস্যের সূত্রপাত যেমন আছে তেমনি আছে যবনিকাপাত। সেটা হয়ত যুক্তিসঙ্গত, পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর পরে পৃথিবীর শত্রু সবুজ মানুষরা অনেকটা গুছিয়ে নিয়ে কাজে নেমে পড়েছেন, তাদের পরিকল্পনা রূপায়ণের চিহ্ন এখন দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। অতএব একেবারে দক্ষিণবঙ্গের চেনা সেটিংসে সেই পরিকল্পনা বা অসৎ উদ্দেশ্য উদ্ঘাটনের ইচ্ছে লেখকের থাকা সমীচীন।
এবার কথা হল গল্প হয়ে ওঠা নিয়ে। যশোধরা রায়চৌধুরীর লেখা এবং অনূদিত গল্পের সঙ্কলন ‘অঙ্কিটের বুদবুদ’ প্রাথমিকভাবে উতরে যায় গদ্যের সচলতার জন্য। পাঠক কোথাও হোঁচট খাবেন না তা বলা যায় না, কল্পবিজ্ঞানের গল্পে হোঁচট তো স্বাগত, কিন্তু শব্দের ঠাসবুনোট ধরে রাখে পাঠকের মনোযোগ। কবি হিসাবে বেশি পরিচিত যশোধরা জানেন আকর্ষণীয় গদ্য রচনার সূত্রগুলো। বোঝেন যে কোথায় বাঁক নিয়ে একঘেয়েমি ভাঙতে হয়, কোথায় চমক উপস্থিত করে রহস্য ঘনীভূত করার কাজটা সমাধা করা যায়। তাঁর রসবোধটাও বেশ পোক্ত। এ বইয়ে যশোধরার আর একটা দক্ষতার প্রকাশ বিদেশি গল্পের অনুবাদে। অনূদিত কিছু গল্পকে ভারতীয় পটের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাল্টে নিয়েছেন এমনভাবে যে তাঁর দাবি অনুযায়ী সেটা তাঁরই সৃজন। মানতে আমাদেরও খুব একটা আপত্তি নেই। আসলে মূল বিদেশি ভাষায় লেখা কল্পবিজ্ঞানের গল্প থেকে অনুবাদের স্বাদ নেওয়ার তেমন সুযোগ হয় না আমাদের, ইংরেজি থেকে যাও বা অনুবাদ হয়, অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা থেকে অনুবাদ বিরল। ফলে এ নিয়ে কূট বিশ্লেষণের যোগ্যতা তৈরি হয়নি সম্ভাব্য সমালোচকদের। কিছু কিছু ভালো কাজ অবশ্যই রয়েছে। রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন অমল দাশগুপ্ত, পোল্যান্ডের ভাষা বা ফ্রান্সের ভাষায় রচিত কল্পবিজ্ঞান থেকে অনুবাদ করে আমাদের পড়ার সুযোগ দিয়েছেন অধ্যাপক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন আরও কয়েকজন আছেন এই ক্ষেত্রে, তবে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জায়গাটা অতি বিশিষ্ট নানা কারণে। স্তানিসোয়াভ লেম রচিত যুগ্ম উপন্যাসের অনুবাদের ভূমিকায় তিনি কল্পবিজ্ঞানের প্রতি মূল ধারার সাহিত্য-পাঠকদের মনোভাব তুলে ধরেছেন:
এটা, সত্যি, বেজায় অদ্ভুত যে পৃথিবীর প্রায় কোথাও কল্পবিজ্ঞান কাহিনির লেখকদের খুব-একটা গুরুত্ব দেয়া হয় না— তাঁদের ভাবা হয় ছেলেমানুষি গাঁজাখুরি বইয়ের লেখক হিসেবে, আজগুবি সব বিষয় নিয়ে সব লেখাপত্র তাঁদের, তাঁদের কারবার গ্রহ-গ্রহান্তর, অন্য জীবরূপ আর অন্য-সব সভ্যতা নিয়ে— পুরোটাই বানানো, অলীক, কৃত্রিম— নেহাতই কারু উর্বর মস্তিষ্কের উত্তেজিত চেতনাতরঙ্গের অপ্রয়োজনীয় ফসল।…
কল্পবিজ্ঞানে মজে থাকেন যাঁরা তাঁদের মাথায় অবশ্য ঘাম জমে না গ্রহণীয়তা নিয়ে ভাবতে গিয়ে। সৃজনের আনন্দে তাঁরা ভরপুর। যেমন যশোধরার বইয়ের প্রকাশক কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস। কয়েক বছর আগে পথ চলা শুরু করে কল্পবিশ্ব পত্রিকা ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়েছে কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি প্রকাশের জন্য। পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের প্রকাশেও উদ্যোগী তারা, জন্ম হয়েছে কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনসের। অন্য কোনও বইয়ের আলোচনাতে এসব প্রসঙ্গ না আনলেও হত, নেকনজরের অভাবে ভোগা কল্পবিজ্ঞানের জন্য এসব আলোচনা জরুরি। যাই হোক, অনুবাদ গল্পেও আগ্রহী কল্পবিশ্ব আর তাই যশোধরার অনূদিত ছটি গল্প ঠাঁই পেয়েছে সঙ্কলনে। রয়েছে জেন রাইসের গল্প ‘দ্য উইলো ট্রি’র ছায়া অবলম্বনে ‘কাঁঠালতলা’, ট্রয় কেলারের ‘দ্য রিঙ্কলস’-এর ছায়া অবলম্বনে ‘কপালের ভাঁজে’, জেনা হেন্ডারসনের ‘ফুড টু অল ফ্লেশ’-এর ভাবানুবাদ ‘জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি’, ক্যাথারিন লুসিল মুর-এর ‘দ্য ব্রাইট ইলিউশন’-এর অনুবাদ ‘উজ্জ্বল বিভ্রম’, শার্ল বোমঁর রচিত ‘দি এলিজি’র অনুবাদ ‘শোকগাথা’ এবং নাম অপরিবর্তিত রেখে রিমি বি চ্যাটার্জির ‘মেরিলিন’-এর অনুবাদ। এগুলো আগে প্রকাশিত হয়েছে অন্যত্র, বইয়ের জন্য নতুন করে লেখা নয়। গোত্রের দিক থেকে সব গল্পই অ্যাপোক্যালিপ্স বা পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্স ধরনের, যেখানে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য গেছে বিলুপ্ত হয়ে বা পৃথিবী গ্রহটাই হয়ে পড়েছে বসবাসের অযোগ্য, বিবর্তিত হয়ে বুদ্ধিমান যন্ত্র উঠে এসেছে মানুষের সমকক্ষ হওয়ার দৌড়ে। মানুষ-যন্ত্রের সঙ্ঘাত, যন্ত্রের সাহায্যে ক্ষমতাসীন জোটের মানুষ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি এখানে অতি স্বাভাবিক ব্যাপারস্যাপার। এমন কল্পদশায় পৃথিবী ছেড়ে মানুষ যায় মহাবিশ্বে অন্য কোনও আশ্রয়ের খোঁজে, মুখোমুখি হয় অনভিপ্রেত এক পরিবেশের। কাঙ্খিত বা আদর্শ ভূমি ইউটোপিয়ার বিপরীতে এই ডিসটোপিয়ার গণ্ডিতেই পৃথিবীর হাজার-হাজার কল্পবিজ্ঞান-কাহিনির বসবাস।
রিমি বি চ্যাটার্জির গল্পে যন্ত্রের অনুভূতিশীল হয়ে ওঠার চেনা প্রেক্ষিত, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের হাত ধরে বেড়ে ওঠা কল্পকাহিনিতে যার ছড়াছড়ি। তবে লাটাই থেকে সুতো ছাড়ার প্রক্রিয়াটা খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে করা হয়েছে এই গল্পে, অনুবাদ অন্তত তাই বলে। অনেকের বক্তব্য, ফিকশন রচয়িতার স্বাধীনতা সীমাহীন, তিনি যেমন খুশি কথা বলিয়ে নিতে পারেন তাঁর চরিত্রের মুখ থেকে। মানবীয় আবেগ, অনুভূতির সবটাই তিনি নিয়ে আসতে পারেন সিলিকন, ইস্পাত আর কম্পোজিটের ঘেরাটোপে। এ নিয়ে আপত্তি করার কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু বলা বাহুল্য, এটা কোনও অলঙ্ঘনীয় সূত্র নয়। ভারতের অন্যতম দুজন কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা, পদার্থবিদ জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকর এবং তাঁর স্ত্রী গণিতবিদ মঙ্গলা নারলিকর মনে করেন যে কল্পবিজ্ঞান যেন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পরিচিত সীমার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ না করে। জয়ন্তবিষ্ণু তাঁর গল্পে বিজ্ঞানটাকে গুরুত্ব দেন, বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াকে কিছু পরিমাণে বিশদ করেন। কিন্তু ‘হার্ড ফিকশন’ তকমা লাগিয়ে এই ধারা থেকে সরে দাঁড়ান ফ্যান্টাসি রচয়িতারা, বিজ্ঞানের পরিভাষাগুলোর দু-চারটে বজায় রেখে কল্পনার উড়ানকে প্রাধান্য দেন তাঁরা। এঁদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন আর তাই জ্ঞানের অভাবটা তাঁদের পছন্দ তৈরির কারণ হতে পারে না। পাঠক মজানোর মতো করে বিজ্ঞান পরিবেশনের জন্য যে দক্ষতা লাগে সেটা হয়ত সবার থাকে না। আবার, বাজারের মনোভাব পড়ে নিয়ে বিজ্ঞান-আশ্রিত গল্পে বিজ্ঞানকে বাদ দেওয়া হয়, এটাও ঠিক। এই সব লেখকরা এমন চমৎকার সংলাপ ব্যবহার করেন যা মূল ধারার সাহিত্যে ব্যবহার করা কার্যত অসম্ভব। ফলে কল্পবিজ্ঞান তাঁদের কাছে একটা লোভনীয় আশ্রয়। রিমি বি চ্যাটার্জির গল্প বা অনূদিত সব গল্পই এই ধারা অনুসারী। তবে মেরিলিন গল্পের পরিণতি, ছোটগল্প থেকে চালু যে প্রত্যাশা তা পূরণ করে না। শোকগাথা গল্পের প্লট দুর্দান্ত কিন্তু সেখানেও পরিণতির আভাস মাঝপথেই পেয়ে যান বিচক্ষণ পাঠক। কাঁঠালতলা গল্পের পরিণতি তুলনায় তুচ্ছতর কিন্তু তৃপ্তিকর। উজ্জ্বল বিভ্রম অবশ্য ভিন্ন, দানা বাঁধে সম্পূর্ণ অন্য এক পথে। তবে মূল গল্পের গুণমান বিচার করার জায়গা এটা নয়, বরং অনুবাদ বা ভাবানুবাদ করতে গিয়ে যশোধরা যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন এবং বাধা অতিক্রম করেছেন, সেটাই বিবেচ্য। আগের কথার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে বলি, তরতর করে এগিয়েছে অনূদিত গল্পগুলো। বিদেশির বর্ণিত রূপকল্প বুঝে লেখিকা বাংলায় তার বর্ণনা করেছেন স্বচ্ছন্দভাবে, পাঠক আরাম পাবেন গল্প পড়ে।
আসা যাক যশোধরার স্বরচিত গল্পগুলোয়। সবুজ মানুষ ইনকর্পোরেটেড নিয়ে আলোচনা হয়েছে আগেই। এছাড়াও রয়েছে দশটা গল্প। ‘মৌলিক কল্পবিজ্ঞান’ শিরোনামে অঙ্কিটের বুদ্বুদ, যন্ত্র-না, যন্ত্রণানিরোধক যন্ত্র, নৈয়ায়িক বটকৃষ্ট, টিট্টিভ, জানালা, সূর্যশেখরের ধাঁধা, সবুজ মানুষ ইনকর্পোরেটেড, হরিহরবাবু ও সেই রোবো, মাঠের আড্ডা এবং ওয়াই টু কে ফর্টি স্থান পেয়েছে। বইয়ের নাম যে গল্পের নামে সেই অঙ্কিটের বুদ্বুদ পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্সের প্রেক্ষাপটে বুদবুদে বন্দি অঙ্কিটের মানবিক সুখ খুঁজে পাওয়াকে তুলে ধরেছে। কিন্তু অঙ্কিটকে বৃষ্টিভেজার সুখে স্নাত করানোর জন্য পরিবেশে দূষণের বিন্যাস নিয়ে বেশ কিছুটা কসরৎ করতে হয়েছে লেখিকাকে। সবটা যে গ্রহণযোগ্য হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে গল্পের প্রকাশ-ইতিহাস দেখে বোঝা যাচ্ছে যে অপরিণত কিশোর-কিশোরীদের জন্য এ গল্প লেখা হয়েছিল। সেখানে এত খুঁটিনাটি না দেখে লেখিকার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়াই ভাল। আবার একটা তথ্য নিয়ে হয়ত কোনও পাঠক সরব হতে পারেন, সেই যেমন ভুলটা করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। গল্পের এক পঙক্তিতে লেখা, ‘… মানুষকুল কোন জেনেটিক বিবর্তনেই বাঁদরে পরিণত হয়েছে।’ এ কথার মানে কি এই নয় যে বাঁদরকে মানুষের পূর্বপুরুষ বা পূর্বনারী ধরে নেওয়া হয়েছে? আসলে এককোষী প্রোটোজোয়াও মনুষ্যকুলের পূর্বে পৃথিবীতে আসা জীব, অগ্রে বা পূর্বে আবির্ভূত, কিন্তু সেখানে লিঙ্গভেদ নেই তাই পুরুষ বা নারী বলা চলবে না। কিন্তু একেবারে কাছাকাছি আত্মীয় বলতে যেগুলো রয়েছে সেগুলোকে বলা হয় ‘গ্রেট এপ’। শিম্পাঞ্জি, গোরিলা, ওরাংওটাং ও বোনোবো— এরাই আমাদের পূর্বপুরুষত্ব দাবি করতে পারে। বাঁদরের বিবর্তন যে শাখায় সেটার থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি অনেক আগেই। লেখিকা এই তথ্যটা জানেন না এমন বিশ্বাস করার কোনও কারণ দেখি না। হয়ত কোনও বিশেষ ভাবনায় এই তথ্যের সমাবেশ বা হয়ত পড়ে বুঝতে পাঠকের ভুল। এ তথ্যবিভ্রান্তি অনেকের হাতেই হয়ে যায়, সত্যজিৎ এই ভুলটাকে জায়গা দিয়েছিলেন তাঁর গল্পে। আবার কল্পবিজ্ঞান লেখক সত্যজিতের এমন ‘ছোটখাট’ বৈজ্ঞানিক ভুল নিয়ে সরব হয়েছিলেন যাঁরা তাঁদের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার ও কল্পবিজ্ঞান লেখক সিদ্ধার্থ ঘোষ। সত্যজিতের গল্পের মানবিক আবেদন না দেখে এই সব ত্রুটি নিয়ে চর্চা করা অনুচিত বলে রায় দিয়েছিলেন তিনি। সে প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল কল্পবিশ্ব পত্রিকায়। রায় নিয়ে সবাই চিন্তিত নন একেবারেই। প্রফেসর শঙ্কুর মনোরম পাঠের পাশাপাশি নজরকাড়া বৈজ্ঞানিক ভুল নিয়ে কথা বলার অধিকার পাঠক কোনওদিনই ছাড়বেন না।
লেখিকার রসবোধের উল্লেখ করেছি আগেই। নৈয়ায়িক বটকৃষ্ট-তে তা উদ্ভাসিত। কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা যন্ত্রকে দিয়ে যা খুশি বলাতে পারেন, ভাবাতে পারেন। যশোধরা এনেছেন ‘১৮৫০ সালের মডেল’, পৈতেধারী, শ্লোক উচ্চারণ করা বটকৃষ্টকে। সংস্কৃত ভাষায় দখল থাকায় লেখিকা শ্লোকের প্যারডি তৈরি করতে পারেন, বটকৃষ্ট মাতিয়ে দেন সঠিক-বেঠিক শ্লোকে। শেষে অবশ্য যে ধরনের ঘরে বটকৃষ্টকে মানুষরূপ থেকে রোবটরূপে বদলে যেতে দেখা গেল সেটা আমাদের এক ধরনের সুপ্ত প্রত্যাশাকে ফুটিয়ে তোলে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশাল পরিকাঠামো, বিরাট যন্ত্রপাতি, বিশালকায় ল্যাবরেটরির প্রতি ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা থাকে আমাদের। অনেক সময় কল্পনা করি, অতশত ঝামেলা বাদ দিয়ে নেহাৎ ব্যাকইয়ার্ডে একটা আস্ত একটা উদ্ভাবন হয়ে যাচ্ছে! আমজনতার মন বুঝে স্যাটিসফ্যাকশন আনতে তেমন কিছু দৃশ্যের ব্যবস্থা রাখা হয় বলিউড বা টলিউডে। খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা ‘বিজ্ঞানী’র হাতে বটকৃষ্ট দেবশর্মার উদ্ভাবনও তেমন ধরনের কাজ। এই গল্পে আবার অ্যাজিট-প্রপের ছোঁয়া। সংস্কৃত ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে বটকৃষ্ট অ্যাসেমবেল্ড হয়েছে প্রতিবাদী যন্ত্রবিদের হাতে, নেহাৎ লোক দেখিয়ে গঙ্গায় অবগাহন করার জন্য নয়। পড়ে মজা পাওয়া যায়। মজা রয়েছে অন্য গল্পেও, যেমন হরিহরবাবু ও সেই রোবো। ডাকাতদের আচমকা আঘাতে রোবট খিটকেলের বিকল হওয়া এবং পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে চারপেয়ে হয়ে পোষ্য কুকুর ডিংগোর সহযোগী হয়ে ঘুরে বেড়ানো উপভোগ্য।
যশোধরার স্বরচিত বা অনুদিত গল্পগুলো যে খুব নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনায় সঙ্কলিত করা হয়েছে তা মনে হয় না। প্রকাশের বছরের নিরিখে যেমন তা শ্রেণিবদ্ধ নয় তেমনই অপরিণত বা পরিণত পাঠকের কথা ভেবে আলাদা করা নয়। তবে যেভাবেই সঙ্কলিত হয়ে থাকুক না কেন যশোধরা রায়চৌধুরীর এই বই পাঠককে আমোদ দেবে, ভিন্নতর বোধের ঝলক দেখাবে, উপভোগ্য গদ্যের স্বাদ দেবে।
অঙ্কিটের বুদ্বুদ
যশোধরা রায়চৌধুরী
কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস
প্রথম প্রকাশ: নভেম্বর ২০২১
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২৭১
মূল্য: ৩৫০ টাকা