বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
চড়ুইবেলা
১.
পিসি এলে শানুর কদিন খুব ফুর্তি। মায়াপিসি বাবার থেকে বছর পাঁচেকের বড়। তাই যে কদিন পিসি থাকে পরমেশের হাঁকডাক কম। বরং পিসি বাবাকে ধমকাবে। দেখে বেশ মজা লাগে শানুর। পিসি বলে, ছোটবেলায় মার আদরে তোর মাথাটা বিগড়ে গেছে বাবু। কেন ভাবিস সব কিছু তোর হুকুম মতন হবে? এ কথাটা পিসিকে আগেও বলতে শুনেছে। শুনলেই বাবার কেমন কান লাল হয়ে যায়। শানু পরে মার কাছে বাবাকে বলতে শুনেছে, এই একটা ব্যাপারে দিদি আমাকে ছোটবেলা থেকে হিংসা করত। মা আমাকে অন্ধের মত ভালবাসত, সেটা কি আমার দোষ? দিদিকে কি বাসত না? আমি জন্মানোর আগে পাঁচ বছর তো দিদিই ছিল একমাত্র সন্তান। ভালবাসা পায়নি কি?
কিন্তু পাঁচ বছরের বড় দিদির মুখে মুখে কিছু বলতে পারত না পরমেশ। পিসি এমন কি সুতপাকেও বলত, জানো তো তপা, বাবুর আমার মতন একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়া উচিত ছিল। তাহলে সারাক্ষণ এমন ছড়ি ঘোরাতে পারত না তোমার উপর।
সুতপা তাড়াতাড়ি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করত। কী যে বলো না দিদি, তোমার ভাই আমাকে খারাপটা কি রেখেছে? দেখো না ওর আদরে আমি বরং দিন দিন হাতিটি হচ্ছি।
শানু জানে কথাটা সত্যি নয়। বাবা রাগলে চণ্ডাল, সারা বাড়ি তছনছ করে তবে শান্ত। মাকে একদম তটস্থ করে রেখে দেয়। রাগ করে শানুকে যখন গোবেড়েন দেয়, মার চোখে আকুতি থাকলেও হাত বাড়িয়ে যে আটকাবে সে ক্ষমতা হয় না। পরমেশ খুব রেগে থাকলে শানুর একবেলার খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ। চোখের জল ফেলতে ফেলতে তার মধ্যেও সুতপাকে স্বামীর সঙ্গে বসে ভাত মুখে তুলতে হয়।
শানু পিসিকে ভালবাসে তার গল্পের জন্যও। মায়ার বুকে কত গল্প যে জমে আছে, বলার মত কেউ তো নেই, তাই সব শানুকে। পরমেশ অত কথা বলে না, নিজের ছোটবেলার কথাও নামমাত্র। শানু সব শুনেছে পিসির মুখে। পরমেশের পেয়ারাগাছের ডাল ভেঙে পড়ে যাওয়ার গল্প শুনে শানু বুঝতে পারে কেন বাবা তাকে কিছুতেই গাছের ডগায় চড়তে দেয় না। হাত ভেঙে বসেছিল বাবু তিনমাস। কিন্তু তোর বাবা খুব শক্তপ্রাণ, আসলে আমার দুই ভাইই তাই। মুখ দিয়ে টু শব্দটি করেনি। বয়স তখন কিন্তু মোটে দশ। শুধু খুব চুলকালে আমাকে বলত, দিদি চামচ দিয়ে ভিতরটা খুঁচিয়ে দিবি? বলতে বলতে পিসির দুচোখ সুখস্মৃতিতে নিবিড়। মায়ার চোখ আনন্দে যখন তখন ছলছলায়, দুঃখে চোখ মরুভূমি। শানু পিসিকে দেখত আঁচল টেনে আনন্দাশ্রু মুছতে। মায়া শাড়ি পরে বাংলা মতে, শাড়ির আঁচল ফেরতা করে বুকের উপর দিয়ে, পিছনে ঝোলানো চাবির গোছা। মায়ার কালোপাড়ের শাড়ি, সোনালি ফ্রেমের চশমার আড়াল থেকে হাত বাড়ানো ভালবাসার চোখ শানুর মনের উথালপাথালে গর্জনতেল ঢালার প্রশান্তি এনে দেয়। পিসিকে যেমন জড়িয়ে ধরতে পারে যখন তখন, মাকেও পারে না শানু। তাকে শক্ত করে তৈরি করার আদেশ পালন করতে করতে মা যেন সেভাবে বুকে টানতে পারে না কিছুতেই। মায়ার কাঁধ ছাড়িয়ে নেমে আসা চুলের ঢলে নাক ডুবিয়ে শানু আদুরে গলায় বলল, তোমার এত চাবি কেন পিসি?
–অত বড় বাড়িটা ফেলে আসি, সব দিকে তালা দিতে হয় রে মনি। শুধু মুরগির খাঁচাটা বাইরে, নাড়ু আসে রোজ খাবার দিতে।
শানু পিসির সঙ্গে সেই বড় বাড়ির একেকটা দরজা খুলতে খুলতে যায়, আর গল্প শোনে। ঠাকুরদার গল্প, দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার কথা, ঠাকুরদার পিঠে চেপে পিসি যার অন্য হাতের মুঠিতে বাবা। কাকু ঠাম্মার কোলে। মায়ার গল্প বলার গুনে শানু সেই শেষ স্টিমারের ভোঁ শুনে দেশ ছাড়ার কাঁপুনি অনুভব করে। কোনওদিন যেতে পারবে না তো সেখানে। বাবার হাত কি সেই দেশের বাড়িতে ভেঙেছিল পিসি?
–না না, সে অনেক পরে। আমরা ততদিনে বসিপোতায়, বাবা একটা স্কুলে মাস্টারি নিয়েছে। এই বাড়িটা তখনও হয়নি তো। উঠোনে একটা পেয়ারাগাছ ছিল, আর বেলগাছের ডালে ঝোলানো দড়ির দোলনা। আমি দোলনায় ঝুলতাম আর তোর বাবা আমাকে পেয়ারাগাছের ডগায় বসে পেয়ারা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিত।
মায়ার গল্পের ঝাঁপিতে শানুর জন্য অনেক গল্প। স্কুলের দিদিমণি মায়া গরমের সময় সপ্তাহ দুয়েক ভাইয়ের বাড়িতে থেকে যায়। নিজের ছেলেপুলে নেই, বিধবা হয়েছিল বিয়ের বছর পাঁচেকের মধ্যে। বয়স ছিল, বিয়ে যে মায়া করতে পারত না তা নয়, কিন্তু করেনি। নিজের চোখে দেখেনি, তবে শানু মায়ের কাছে শুনেছে পিসে খুব ভালবাসত পিসিকে। সেই যুগে নিজের জাত ছেড়ে বিয়ে করেছিল বলে, বাবা মা কোনওদিন মেনে নেয়নি। মেয়ে জামাইকে বাড়িতে ঢুকতেও দেয়নি। জামাই মারা যাবার পর মেয়েকে আবার বিয়ে করার জন্য বোঝাতে গিয়েছিল, কিন্তু মায়া শুধু যে নাকচ করে দিয়েছিল তাই নয়, এরপরও নিজের বাড়িতে পা দেয়নি। সেটা করেছিল অনেক বাদে যখন শানুর দাদুর কঠিন অসুখ। বাবাকে বাঁচাতে পারেনি কিন্তু তারপরে মাকে দেখাশোনা করার জন্য বাড়িতে ফিরে আসে। পরমেশ তখন বিদেশে আর ছোট ভাই কুমারেশ কলেজ হোস্টেলে। কে দেখবে মাকে?
চশমার কাচ মুছতে মুছতে মায়া শানুকে বলত, জানিস তো শানু, আমাদের দেশে মেয়েদের কেউ পোঁছে না, মায়েরা সব ছেলে ছেলে করে পাগল। অথচ দ্যাখ বাবা মা দুজনকেই শেষযাত্রায় আমার হাতেই শেষ জলটুকু খেয়ে যেতে হল।
–কেন পিসি, কাকুও ছিল না?
এমন যে শক্ত মায়া, কুমারেশের কথা উঠলেই চোখটা ছলছল করে ওঠে। গভীর আবেগ আপাত কঠিন মুখের রেখাগুলোয় আঁকিবুঁকি কাটতে থাকে। জানলার কাছে উঠে গিয়ে বাইরে থেকে ছিটকে ঢোকা রোদ শুষে নিতে নিতে নিজেকে একটু ধাতস্থ করে মায়া। বুঝলি শানু, তোর কাকুও পড়াশোনায় তোর বাবার মতই ভাল ছিল। হয়তো আর ভালো, কিন্তু পড়াশোনার চেয়েও অন্য কাজে তার মন ছিল বেশি। আর ছিল তেমনি সাহস। সব কিছুতে সবার আগে, সব কিছুতে সবার সাথে। আখেরে ওই ওর কাল হল।
শানু অনেকদিন কাকুকে দেখেনি। বাড়িতে কাকুর কথা তোলা বারণ, তাই জানতেও পারে না কেন কাকুর সঙ্গে আর দেখা হয় না। অ্যামেরিকা থেকে কোন ছুটিতে বাড়ি এসেছিল, আবছা মনে আছে কাকু কীভাবে হা হা করে হাসতে হাসতে তাকে নিয়ে লোফালুফি খেলেছে, ভয় আর মজার অদ্ভুত মিশ্রণে শিহরিত হয়েছে শানু। আজ এই সুযোগে জিজ্ঞেস করল, কাকু কোথায় পিসি? আমরা দেশে ফিরে আসার পর কাকু কেন আসেনি একদিনও?
মায়া গভীর মমতায় শানুর মাথায় হাত বোলান। তোকে দেখি, আর আমার ছোটবেলার সোনার কথা মনে পড়ে যায়। সোনা মানে কুমারেশ, শানুর কাকু।
পিসির কাছে ঘন হয়ে বসে শানু। কেন পিসি, কাকু কি আমার মতন দেখতে ছিল ছোটবেলায়?
–অবিকল। আর সেই জন্যেই তো তোর বাবা ভয় পায় তুই যদি তোর কাকুর পথ নিয়ে ফেলিস।
এমন কথাটা শানু কোনদিন শোনেনি তো। কাকু কোন পথ নিয়েছে পিসি?
–তার মানে বাবু তোদের কিচ্ছু জানায়নি ওর বিষয়ে? মায়ার মুখটা এখন রাগে থমথম করছিল। বাবুর ওই দোষ… কিছু একটা বলতে গিয়েও মাঝপথে রাশ টানল মায়া। হ্যাঁ, তোর কাকু জেলে আছে। কিন্তু সেটা কি চোরছ্যাঁচোড় বলে যে তার কথা বলা যাবে না? নিজের জীবন বিপন্ন করেছে লোকের ভাল চেয়ে। নাহলে আজ ও হয়তো কত বড় চাকরি করত, বাবুর মত।
শানুর কীরকম ভয় লাগছিল। নার্ভাস লাগলে ওর বাঁ হাতটা থিরথির করে কাঁপে। কাকু জেলে আছে, পুলিশ কি কাকুকে মারে? কেন জেলে গেছে কাকু?
মায়া ঠিক করল বলবে। নিজের কাকুর কথা শানুর জানা উচিত। তোর কাকু এই শহরেই পড়তে এসেছিল, তোর বাবা যে কলেজে পড়ায় সেই কলেজেই। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত সোনা।
–কাকু এইখানে থাকত? এই শহরেই। খুব অবাক লাগলে শানুর।
–হ্যাঁ দুর্গাপুরে। তবে তখনও তোরা আমেরিকা থেকে ফিরিসনি। সোনা প্রথম থেকেই যে রাজনীতি করত তেমন নয়। অন্তত আমার জানা নেই। ওদের কলেজে তো ছাত্রদের পলিটিক্স করার উপরেই নিষেধ ছিল। কিন্তু একবার ওদের কলেজে খুব গণ্ডগোল হয়। সোনা আর একটা ছেলে ক্যাম্পাসের ঠিক বাইরে বোধহয় দোকান থেকে কিছু কিনতে গেছিল। ওখানে এক ট্র্যাফিক পুলিশের লোক এক ট্রাকড্রাইভারকে ধরে হেনস্থা করছিল। জানিস তো তোর কাকুকে। অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করবেই। ওরা গেল পুলিসকে আটকাতে। ব্যস, ওদেরকে হাজতে নিয়ে গেল।
শানুর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। পুলিশ কেন এত খারাপ হবে? আর শুধু এর জন্য সেই অতদিন ধরে জেলে আটকে রেখেছে?
–না রে বাবা, তেমন নয়। ওদের হাজতে নেওয়ার খবর যেই কলেজে পৌঁছেছে, সব বাচ্চা বাচ্চা ছেলে তো, মাথা গরম। হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে দলবল বেরিয়ে পৌঁছে গেছে থানায়। সে নাকি এক বিশাল হাঙ্গামা। শয়ে শয়ে পুলিস এসে গেছে। ছাত্রদের দাবী তোর কাকু আর ওর বন্ধুকে— কী যেন বেশ নাম ছিল ওর প্রবাল না কী যেন, তক্ষুনি ছেড়ে দিতে হবে। পুলিসও দেবে না। এর মধ্যে এক পুলিস ইন্সপেক্টরকে ধরে ছাত্ররা কলেজের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছে। ওদের দাবী সোনাদের ছাড়ুক, ওরাও ইন্সপেক্টরকে ছেড়ে দেবে। অনেক বচসা বিবাদের পর এরাও ছাড়ল, ওরাও ছাড়ল। তোর কাকু আবার হস্টেলে ফিরে এল।
–তাহলে? তবে কাকু কেন জেলে?
–শোন না তুই, তারপর কী হল। ছাত্ররা তো ওই পুলিশের লোকটাকে কিছু করেনি, কিন্তু তাতে কী হয়, পরদিন পুলিস এসে সারা হস্টেল ঘিরে ফেলল। বন্দুক চালাল, সবাই হুটপাটি পালাচ্ছে। যাকে হাতের কাছে পাচ্ছে, পিটাচ্ছে। তোর কাকুর হাত ভেঙে যায়। আর একটা ছেলে তো গুলি লেগে মরেই গেল।
শানু ভয়ে ততক্ষণে মুখে হাত চাপা দিয়েছে। ওতো রোজ ওই কলেজের পাশ দিয়েই যায়। মাত্র কবছর আগেই এমনটা হয়েছে?
–তারপর কী হল পিসি? ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছিল শানুর। বাঁ হাতটা আবার তিরতির করে কাঁপছে।
পরমেশ পাশের ঘর থেকে কিছু শুনতে পেয়েছিল। হ্নতদন্ত হয়ে হাজির। দিদি, এসব কথা তোর বলার কী দরকার ছিল শানুকে? কী করবে এসব জেনে?
–নিজের কাকুর কথা জানার অধিকার ওর আছে, জানা উচিত। মায়ার গলা শান্ত অথচ দৃঢ়।
পরমেশের গলা চড়ছিল। বড় মুখে বলার মতন এমন কিছুই ও করেনি। জেলে গিয়ে দেশের কোন উদ্ধারটা ও করেছে শুনি?
পরমেশের গলার জোর সুতপাকে থামাতে পারে, কিন্তু মায়াকে দমাতে পারে না। শানু অবাক হয়ে দেখছিল, যে বাবাকে সে যমের মত ভয় করে, পিসি কী অবলীলায় তাকে দাবড়ানি দিচ্ছে। চুরি ডাকাতি করে ও জেলে যায়নি বাবু। স্বাধীনতার আগে হলে বিপ্লবীর সম্মান পেত, তার কথা লুকিয়ে রাখা হত না।
সাধারণত পরমেশ তার দিদির সঙ্গে গলাবাজি করে না। কিন্তু আজ থামল না। শোন দিদি, আমি রাজনীতি করি না, কিন্তু বুঝি। আমেরিকা কম্বোডিয়ায় আক্রমণ করল কী না করল তাতে পশ্চিমবঙ্গের লোকেদের কী ক্ষতি হয় বল তো? তা না স্ট্রাইক করে সাধারণ ছেলেদের পড়াশোনার ক্ষতি করা। তার পান্ডা কে, না তোমার প্রাণের প্রিয় ছোটভাই।
মায়া পরমেশের বিদ্রুপকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল। কী দরকারে করে জানিস? মানবিকতা, মূল্যবোধ। সেটা ওর ছিল। তাই করেছে। শুধু নিজের আখের গোছানোর থাকলে করত না।
–তাই বুঝি? তবে মধুসুদন বলে ছেলেটাকে পিটিয়ে মারা হল কলেজ ক্যাম্পাসে, তার বেলা? কোন মূল্যবোধ থেকে সেটা করেছে শুনি?
মায়া একটু দম নিল। জানত এই কথাটা আসবে। নিজেও যখন শুনেছিল, তার বুক ফেটেছিল। কোন মায়ের বুক খালি করে চলে গেল তো একটা ছেলে, সে যেই দলেরই হোক। পড়াশোনা করতে এসে এমনভাবে কাউকে কেন মরতে হবে। ধীর গলায় বলল, আমি জানি সেটা, কিন্তু সেটা সোনা করেনি। অনেক ছাত্র মিলে করেছে। কারণ আগে এই মধুসুদন ছেলেটা এইভাবেই অনেক ছাত্রকে মেরে হাত পা ভেঙে দিয়েছিল।
–ও তাহলে গুন্ডারাজটাই ভাল। সেটাই সমাজের জন্য মঙ্গলজনক, তাই না দিদি?
–আমি সেটা বলিনি। এটাকে সমর্থনও করি না। যা ঘটনা সেটা বললাম। সোনা আমায় বলেছে, ও করেনি কিছু।
–আর কী করবে, সে লিডার। উস্কানি দিয়েছে। তাছাড়া যদি কিছু না করে তো পালাল কেন ক্যাম্পাস থেকে?
–ও সেই সময়েই পার্টির হোলটাইমার হয়ে গ্রামের দিকে চলে যায়। তুই জানিস সেটা। নিজের ছোট ভাইয়ের নামে বদনাম করিস না বাবু।
–যা সত্যি তাই বলছি। তুমি ওর প্রেমে অন্ধ তাই সত্যিটাকে দেখতে পাও না।
–পাই বাবু, পাই। একদিন লুকিয়ে বাড়িতে ফিরেছিল, কী রোগা হয়ে গেছে ছেলেটা। একমুখ দাড়ি। কতদিন খায়নি ভাল করে। ডাল আর গোটাসেদ্ধ ছিল, তাই হাপুস হুপুস করে খেল। কোথায় আছে কিছু বলল না। কিন্তু আমার বুকে এই কথাটা কুরে কুরে খাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করায় আফসোস করছিল। বলছিল, ভুল হয়ে গেছে। আমার গিয়ে আটকানো উচিত ছিল, অন্তত চেষ্টা করতে পারতাম। পারিনি। ভুল মানুষেরই হয় বাবু, কিন্তু ভাল কাজ করারই চেষ্টা করে ও।
ফু ফু করে উড়িয়ে দিল পরমেশ। এভাবে ভাল কাজ হয় না দিদি। ওদের পথটা ভুল। নকশাল হয়েছে, গ্রামেগঞ্জে গিয়ে আর কটা লোককে মেরেছে তার ঠিক নেই। পুলিস কী সাধে ওকে ধরে নিয়ে গেছে ভাবো? মোদ্দা কথা, আমি কোনও নকশালপন্থীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না।
এত কথার মধ্যেও মায়া শানুর হাত ধরে একইভাবে বসেছিল। এই কথায় বসা থেকে সোজা উঠে দাঁড়াল। রাখিস না তুই, যদি বলিস তো আমিও এই বাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। এখুনি।
সুতপা চেঁচামেচি শুনে এসে গেছিল। শুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল, ছি ছি দিদি। কী কথার কী। তুমি কেন কোথাও যাবে?
–কোথাও যেতে আমি বলিনি। কিন্তু এই বাড়িতে সোনাকে নিয়ে আর কোনও কথা হবে না। নকশালদের এই বাড়িতে কোনও ঠাঁই নেই। তুমি জানো, কলেজে যদি জানতে পারে কুমারেশ আমার ভাই, কী হতে পারে? আমার চাকরিটাও হয়তো হত না। এখনও যদি খবর রটে, কী হবে জানি না। আর তুমি এইসব কথা বাচ্চা ছেলেটার কানের কাছে তুললে। কোথাকার জল কোথায় দাঁড়াবে তুমি জানো?
এবার মায়ার গলায় বিদ্রুপের ঝাঁঝ। তাই ভাবি, তোর কেন এত রাগ ওর উপরে। নিজের চাকরি বাঁচাবি বলে। তার জন্য নিজের ভাইকেও ত্যাজ্য করতে পারিস। ছি ছি বাবু।
–রাখো তোমার ছি ছি। শুনতে খারাপ লাগে। কিন্তু আমার একটা পরিবার আছে। তাছাড়া আমি নকশালদের কাজকে সমর্থন করি না। ছোটবেলার সোনার জন্য আমার অনেক ভালবাসা জমে আছে, এখনও। কিন্তু কমরেড কুমারেশের জন্য নেই। যে ফিলোজফিতে আমার বিশ্বাস নেই তার জন্য আমি গিয়ে আসানসোল জেলে ধরনা দিতে পারব না। গেছিলে তো তুমি, কিছু কী হয়েছিল? দেখা করতে পেরেছিলে? বরং পুলিশের কাছে হেনস্থা হয়ে ফিরেছ।
এতক্ষণে মায়ার গলা একটু বুঁজে এল। ভেজা গলায় বলল, কী করব বল? চার বছর জেলে পচছে। ওর দুই কমরেড তাপস আর আনন্দকে জেলের মধ্যেই মেরে ফেলেছে। ভয় হয় না বল? বিশ্বাস করিস আর নাই করিস, দাদা হিসেবে তোর কোনও দায়িত্ব নেই?
–-এই ব্যাপারে নেই। একদম নেই। নিজের বুদ্ধিতে যা করেছে, তার দায়িত্ব পুরোপুরি ওর। আমি নিজের বুদ্ধিতে অ্যামেরিকা গেছিলাম। পোষাল না, চলে এসেছি। নিজের বুদ্ধিতে বিয়ে করেছি, ছেলে আছে। আমি এমন কিছু করব না যাতে ওদের গায়ে কোনও আঁচ লাগে। আর একটা কথা দিদি। সরকার বদল হয়েছে, শুনছি বামফ্রন্টের সরকার সব নকশাল জেলবন্দিদের ছেড়ে দেবে। সোনাও ছাড়া পাবে হয়তো। আমি চাই না ও এই বাড়িতে এসে আমার ছেলেটার মাথা খাক। দেখা হলে সেটা ওকে বলে দিও।
পরমেশ গটগট করে বেরিয়ে গেল।
মায়া এবার আর দু সপ্তাহ পুরো থাকল না, কদিন আগেই ফিরে গেল নিজের বাড়ি। কুমারেশ ক মাস বাদে ছাড়া পেলেও তার সঙ্গে আবার দেখা হতে শানুর লেগে গেছিল অনেকগুলো বছর।
২.
বৃষ্টির শব্দে ঘুম আরও নিবিড় হয়।
সন্ধ্যা থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি, ক্রমশ বাড়ছে। রাত আটটার খবরে আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর থেকে জানাল নিম্নচাপ এবং প্রবল বৃষ্টির সম্ভাবনা। শুনেই বিমল বলল, তাহলে এ বৃষ্টি আর বেশিক্ষণ চলবে না রে! আলিপুরের খবর তো উল্টো ছাড়া সোজা হয় না কক্ষনও। একচোট হাসাহাসি হল।
কিন্তু প্রথমবারের মত আলিপুরের সম্মান বজায় রেখে বৃষ্টি হয়েই চলল অঝোর ধারায়। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া, কী ভীষণ আওয়াজ। একটা গাছও বোধহয় ভেঙে পড়ল।
রূপা, হীরক আর চিনু এক ঘরেই শোয়। রূপা একটা চৌকিতে, হীরক আর চিন্ময় আরেকটায়। দুই মশারির ভিতর কথা চলছিল অনেক রাত অবধি। রূপা অবশ্য মাঝে বকার চেষ্টা করেছে, ঘুমো তোরা, কালকে স্কুলে যেতে হবে না?
চিনু মৃদুস্বরে প্রতিবাদ করল, কালকে আর স্কুল হবে না রে দিদি। আমি জানালা থেকে উঁকি দিয়ে দেখেছি উঠোনে এক বিঘতা জল জমে গেছে।
–ধুর, এক বিঘতা জলে হাইস্কুল বন্ধ হয় না, তোদের নার্সারি বন্ধ হতে পারে।
চিনু মোটেই নার্সারিতে পড়ে না আর। কিন্তু এরকম অপমানে প্রতিবাদ না করে গোঁজ হয়ে রইল খানিক।
রূপা বুঝতে পেরে নরম গলায় বলল, তোর ঠান্ডা লাগছে না তো রে চিনু? পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা টেনে নিস নইলে।
আদরের ভাষা শুনে চিনুর গলাটা আবার উঁচু হল, মা যে বলছিল এবার দুর্গা গজে আসবে। বেশি বৃষ্টি হলে হাতি আটকে যাবে না তো?
হীরক খিক খিক করে হেসে উঠল। ধ্যাত, পঞ্জিকা ঠিক আলিপুরের মত। যা বলে তার উল্টোটা হয়।
–চিন্তা করিস না চিনু, জল বেশি হলে দুর্গা মা এবার নৌকায় আসবে।
মা কীসে এসে পৌছাবে সেটা নিয়ে চিনুর অত চিন্তা নেই, যেভাবেই হোক যেন পাড়ার প্যান্ডেলে এসে হাজির হতে পারে। নাহলে তো বছরটাই নষ্ট।
বৃষ্টি একটা উৎসবের মতন। চিনু এবার দাদাকে খোঁচা মারল। কালকে যদি ইস্কুল বন্ধ থাকে, আমাকে নৌকা বানিয়ে দিবি রে দাদা।
–সে হবে খন। আগে দ্যাখ বৃষ্টি কতক্ষণ থাকে। বলেই মনে হল একবার দেখে এলে ক্ষতি কী। মশারির কোনা উঁজিয়ে মেঝেতে পা রাখল। জানালা একটু খুলতেই মুখে বৃষ্টির ছাঁট। সঙ্গে প্রবল হাওয়া। জানালার পাট খুলে রাখা যায় নাকি! উরিত্তারা! কী পাগলা বৃষ্টি রে রূপা!
–জল জমেছে দাদা? চিনু এবার বিছানায় উঠে বসেছে।
অন্ধকারে বাইরে ঠাহর করা মুশকিল। তবু রাস্তার হলদে আলোয় যেটুকু মাপা যায় হীরকের মনে হল এক ফুট তো হবেই। মুখে বলল, সারা রাত এমনি চললে নৌকায় হবে না রে চিনু, জাহাজ বানাতে লাগবে।
–তুই জাহাজ বানাতে পারিস? কাগজ দিয়ে? চিনু উৎসাহে টগবগ করছিল। কে বলবে রাত এগারোটা বেজে গেছে?
–ধুর বোকচন্দর, ওটা তো এমনি বললাম।
অন্য ঘর থেকে এবার নীলিমার গলা ভেসে এল— তোরা এখনও ঘুমাসনি কেন রে? কালকে স্কুল আছে না? শুনেই হীরক লাফ দিয়ে বিছানায়। চিনু কাঁথাটা মাথা অবধি টেনে নিল। চারদিক শান্ত হতেই রূপা চাপা গলায় গাইতে শুরু করল— আজি ঝরোঝরো বাদল দিনে। বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ, ব্যাঙের ডাক আর রূপার গান মিলে এক সুন্দর ঘুমপাড়ানি গান তৈরি হচ্ছিল, চিনু আর হীরুর চোখ বুঁজতে তাই দেরি হল না।
সকালে উঠে দেখা গেল বৃষ্টি থামার কোনও নাম-নিশান নেই। অক্লান্ত ধারায় ঝরে চলেছে। জানালা খুলে কোথায় রাস্তা শেষ হয়েছে আর কোনখানে নালা শুরু এখন আর বোঝা যায় না। ঘোলা জলের সঙ্গে ফুল পাতা, ভাঙা টুকরোটাকরা ভেসে চলেছে। রূপা জানালার গরাদে থুতনি লাগিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হীরক বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করল খুব জল নাকি রে রূপা?
মুখে জলের ছিটে নিয়ে রূপা মুখ ফেরাল। একেবারে থইথই। উঠে কী করবি এত তাড়াতাড়ি, এইরকম বৃষ্টিতে স্কুল হবে না তোদের।
হীরকও জানালায় চলে এল। রাস্তায় জল হাঁটু ছাড়িয়েছে। তার মধ্যে সুরেনকাকুকে দেখা গেল মাথায় ছাতা দিয়ে চলেছে। হীরক জিজ্ঞেস করল, রাস্তায় যাওয়া যাচ্ছে কাকু?
সুরেন ছাতার থেকে মুখ বাড়াল। না রে হীরু, যাওয়া খুব কঠিন। কেউ বেরোতে পারছে না। দেখছিস না জলের কী স্রোত, যেন নদী বয়ে যাচ্ছে। মোড়ের মাথায় একটা নিমগাছ আড়াআড়ি পড়ে রাস্তা আটকে দিয়েছে শুনলাম, লোকজন ডেকে সরাতে হবে।
–তাহলে কী স্কুল বন্ধ থাকবে?
–স্কুল কী রে, সবকিছু বন্ধ। শুনলাম জল বেড়ে গেছে বলে দামোদরের বাঁধ থেকে জল ছাড়ছে। দ্যাখ না চোখের সামনে এই জল বুক সমান হয়ে যাবে। দেখতে চলেছি নিচু জমিতে লোকেদের কী অবস্থা।
সুরেন কাকু চলে যেতেই রূপা মা, মা শুনেছ বলে নীলিমার খোঁজে রান্নাঘরে গেল। হীরকের মনে হচ্ছিল, এই জলে কী সাইকেল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে? হয়তো শুধু তাদের গলিটাতেই এমন, বড় রাস্তায় এমন নাও হতে পারে। নীলিমাকে সেকথা বলতেই খেঁকিয়ে উঠল, মাথা গরম করাস না হীরু। তোরা সব কটা বাপের ধাত পেয়েছিস। আমার গা পিত্তি জ্বলে যায়!
–কেন বাবা কী করেছে আবার? বিমলকে দেখা যাচ্ছে না যদিও। গেল কোথায় বাবা?
–আর কোথায়? জল বাড়ছে দেখে ওনার মনে হল বেশি জল হওয়ার আগে প্ল্যান্টে পৌঁছালে ভাল। তোর বাবা সকাল পাঁচটায় বেরিয়ে গেছে আজ। জল ঢুকে তার মেশিন যাতে খারাপ না হয় তার তদারকি করতে হবে।
–মা, এরকম যদি জল হয় তাহলে তো দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাবে।
–সেটা তোর বাবাকে কে বোঝাবে? কোথায় দরকারি কটা জিনিস কিনে বাড়িতে বোঝাই করবে তা নয় উনি গেলেন মেশিন তদারকি করতে। এখন মাসের শেষ, সদাই আনা হয়নি। এই মড়ার বৃষ্টি কদিনে ধরবে কেউ জানে? অন্তত চাল ডাল আলুটার একটা বন্দোবস্ত করা যেত না?
হীরক অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছিল বৃষ্টিতে একটু জল মেপে আসার। মার কথা শুনে লাফিয়ে উঠল। আমি গিয়ে নিয়ে আসি মা?
–পাগল নাকি? এই বৃষ্টিতে আমি তোকে পাঠাব?
–মা, তোমার মত আরও অনেকেই ভাবছে জিনিস কিনে আনার কথা। আর বাবা কখন ফেরে ঠিক নেই। তখন নরেনের দোকান খোলা থাকলেও মাল আর থাকবে কি না কে বলতে পারে।
নরেন সাহার মুদিদোকান গলির একদম শেষে। নীলিমা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে হীরকের দিকে চেয়ে রইল। কী দেখছ এমন করে?
–ভাবছি তোকে পাঠালাম, আর তুইও বৃষ্টির মধ্যে টহল মারতে বেরিয়ে গেলি।
–এই বৃষ্টিতে কোথাও টহল মারতে আমার বয়ে গেছে। পাঠাতে হয় টাকা দাও, নিয়ে আসছি। আমার কী? সম্পূর্ণ একটা নিরুৎসাহ ভাব মুখে ফুটিয়ে হীরক উল্টোদিকে হাঁটা মারল।
–আচ্ছা, আচ্ছা। যা তবে। কিন্তু যাবি আর এক ছুট্টে আসবি। ছাতা নিয়ে যা। শুধু পাঁচ কেজি চাল— কাঁকড় ছাড়াটা, কেজি খানেক মুসুরের ডাল, একটু মুগও আনিস খিচুরি চাপাব ভাবছি। সরষের তেলের একটা বোতল আনিস, গনেশ মার্কা। হাতে থাকুক। ওদের কাছে আলু রাখে। কেজি দুয়েক নিয়ে আয়। এর বেশি তুই কিছু পারবিও না। সাবধানে যাস বাবা, তুই না ফেরা অবধি বুকটা ধুকুরপুকুর করবে।
পিছন থেকে নীলিমা আবার ডাক দিল। শোন ছাতায় মাথাটা ভাল করে ঢেকে যাস। এ পাড়ার লোকগুলো যেমন, ছোট ছেলে দোকান যাচ্ছে দেখতে পেলে তোকে আবার কিছু আনতে বলে দিল।
হীরকের তখন আর কিছু কানে ঢুকছিল না। পরনের হাফ প্যান্টটাকে দু ভাঁজ মুড়ে নিয়েছে। তবু জল হাঁটু ছড়িয়ে উঠে প্যান্ট ভিজিয়েছে। জলে তেজ খুব, তার ওপর মাথার উপর থেকেও তো জল পড়ছে। শুধু জল হলেও হত। জলের সঙ্গে কত কিছু যে ভেসে আসছে! শুধু লতাপাতা নয়, একটা সাপও ভেসে যেতে দেখল, জ্যান্ত। পুরনো স্যান্ডাল, কলার খোসা কী নেই! এর মধ্যে আবার হীরু হীরু ডাক।
রেখা ডাকছে ওদের বারান্দা থেকে।
–এই বৃষ্টিতে কোথায় যাচ্ছিস হীরু? স্কুল হবে নাকি আজ?
–ধুর! স্কুল অবধি কীভাবে যাবো। আমি তো যাচ্ছি নরেনদার দোকানে চাল ডাল কিনতে।
–এই বৃষ্টির মধ্যে আনবি কী করে? মুখে খুব চিন্তার ভাব নিয়ে বলল রেখা। দেখিস রাস্তায় কোনও গর্তে পা না পড়ে যায়।
–তাই তো ভাবছি। মনে হচ্ছে ব্যাগ মাথায় করে আনতে হবে। তোর কিছু লাগবে? মা যদিও আর কারও কাছ থেকে কোনও ফরমায়েশ নিতে বারণ করেছে, রেখার ব্যাপারটা আলাদা।
ততক্ষণে পিছন থেকে মাধুরী এসে গেছে। ও বাবা হীরু, দোকানে যাচ্ছিস একটা জিনিস এনে দিবি?
–মা, হীরু নিজের বাড়ির জিনিস কীভাবে নিয়ে যাবে তাই জানে না, তুমি আবার কী চাপাচ্ছ? বাবা তো একটু আগেই নিয়ে এল সব। রেখাকে মায়ের উপর খবরদারি করতে দেখে মজা পাচ্ছিল হীরক। মাধুরীকাকিমাকে ওরা সবাই খুব সমীহ করে চলে।
–ওইটাই তো মুশকিল হয়েছে রে। কটা মোমবাতি এনে রাখতে পারলে ভাল হত। কেরোসিন বেশি নেই যে হ্যারিকেন জ্বালব। যদি কোনওভাবে লাইন খারাপ হয়ে আলো চলে যায়, তখন লাগবে। তোর বাবাকে আবার পাঠাতে গেলে এত রেগে যাবে!
–ঠিক আছে কাকিমা, আমি না হয় চারটে মোমবাতি নিয়ে আসব। ও আর এমন কী? রেখা তুই জানালার ধারে টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস, আমি তোর হাতে দিয়ে যাব।
ভাগ্যিস হীরক দোকানে এসেছিল। সকাল থেকে অনেক লোক মাল নিয়ে গেছে। তার উপর বৃষ্টির জল আরও বাড়ার আগেই দোকান বন্ধ করে নরেন সাহা পালাবার ব্যবস্থা করছে। মাল তো দেব খোকা, কিন্তু নেবে কী করে?
–মাথায় নেব কাকু।
–ভারি হবে যে বড্ড। আর জলে পড়ে গেলে কী হবে? সব তো তখন নষ্ট।
খোকা বলে ডাকায় হীরক মনে মনে চটলেও লোকটা ভালো। সমস্ত কিছু ব্যাগে ঢুকিয়ে একটা প্লাস্টিক জড়িয়ে কষে বেঁধে দিল। শুধু মোমবাতি চারটে রইল বাইরে। দেখো, এরকমভাবে দিলাম যাতে জল লেগে নষ্ট না হয়। কিন্তু তোমাকে মাথায় ব্যালেন্স করে নিয়ে যেতে হবে একদম।
আসাটা যদি কষ্টের ছিল, ফেরাটা আরও কঠিন। মাথার উপরে সাত আট কেজির বোঝা, তারও উপরে উঁজিয়ে রাখা ছাতা। জামার পকেটে চারটে মোমবাতি। এইসব নিয়ে জল পেরিয়ে এইটুকু রাস্তা যাওয়াটাও কী যে ঝকমারি!
রেখা দাঁড়িয়েছিল বারান্দায়। হীরক ভাবছিল গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মোমবাতি কটা গলিয়ে চলে যাবে, রেখা বলল, না। মা বলেছে তোকে দাঁড়িয়ে যেতে। লুচি বেগুনভাজা করছে, দুটো খেয়ে যাবি।
লুচির নাম শুনে লোভ হয়েছিল। মুখে বলল, ধ্যাত! এখন কী আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব নাকি লুচি খাওয়ার জন্য। মাথায় এই ওজন নিয়ে সুস্থির দাঁড়িয়েও থাকা যাচ্ছে না।
–হাবা, রাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে লুচি খাবি নাকি? বারান্দায় উঠে আয়, দরজা খুলে রেখেছি।
দোনামনা করছিল হীরক, মা যে বলেছে তাড়তাড়ি ফিরতে।
–ন্যাকামি করিস না তো হীরু, তুই যেন কাকিমার ভয়ে উল্টে যাচ্ছিস একেবারে। সাবধানে আয়, মাঝখানে নালা আছে সেটা ভুলে আবার ওটার মধ্যেই পা ঢুকিয়ে দিস না।
হীরক বারান্দায় উঠতে উঠতে লেখা লাফাতে লাফাতে হাজির। হীরুদা আমাকে একখানা কাগজের নৌকা বানিয়ে দাও না।
–দাঁড়া লেখি, হীরুদার অবস্থা দেখেছিস? ভিজে ঢোল।
–তোদের বারান্দাটা এক্কেবারে ভিজে গেল রে।
হীরক মাথার থেকে ব্যাগটা বারান্দায় রাখতেই রেখা একটা গামছা বাড়িয়ে দিল। আগে তোর মাথাটা মোছ তো। মাথায় ব্যাগ, তার ওপরে ছাতা। কী করে এমন ভিজলি বল তো?
মাথাটা দিয়ে কী হবে, কোমর অবধি জল? তাছাড়া কীরকম হাওয়া চলছে দেখেছিস? ছাতা এদিকওদিক যাচ্ছে, বৃষ্টি আটকায় নাকি? কিন্তু এমন কিছু ভিজিনি, কিচ্ছু মুছতে লাগবে না।
–বেশি ওস্তাদি মেরো না তুমি। বলে নিজেই গামছা নিয়ে হীরুর মাথা মুছতে লেগে গেল। প্রথমে মোটেই ভাল লাগেনি হীরকের, কিন্তু খারাপ লাগাটা খুব দ্রুত চলেও গেল।
–এই লেখি, মার কাছ থেকে হীরুর লুচির প্লেটটা নিয়ে আয় তো। আর কতক্ষণ দাঁড়াবে ও? দেরি হলে কাকিমা বকবে না?
হীরু তুই চোখ বুজে আছিস কেন রে? মাথায় গামছা ঘষতে ঘষতে হাসল রেখা। যেন বিবেকানন্দ ধ্যান করছেন। হীরক লজ্জা পেয়ে চোখ খুলতেই ঠিক মুখের সামনে রেখার মুখ। বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে নিজেকে উঁচু করে হীরকের চুল মুছে দিচ্ছে। কোনও কাজ মন দিয়ে করার সময় মুখে এক ধরনের আলো ফোটে, হীরক রেখার মুখে সেই আলো ঝলকাতে দেখল।
–কী লাভ হল এতসব মুছে? একে তো জামা কাপড় ভিজে সপসপে। এরপর আবার রাস্তায় নামব, আর ভিজে যাব।
রেখা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর এত্ত বড় জিভ বের করে ভেঙাল। তুই একটা হাবা! কিচ্ছু পারিস না।
কী পারার কথা ছিল সেটা হীরক বুঝে ওঠার আগেই মাধুরী হাতে লুচির প্লেট নিয়ে হাজির। মোমবাতি কটা এনে দিয়ে কী উপকারটাই যে করলি হীরু। অন্তত রসদ থাকল। এই কটা লুচি খেয়ে নে।
লেখা ঝাঁপিয়ে পড়ে আর কী! মা আমাকে দেবে না?
তোর জন্য বানাচ্ছি তো, এখনই লোভীর মত জিভ বের করছিস কেন? খুব বিরক্ত হল মাধুরী। ছেলেটা কত কষ্ট করে জিনিসগুলো নিয়ে যাচ্ছে, একটু শান্তিতে খেতে দে দেখি।
–আয় আমার সঙ্গে খাবি? হীরকের কথায় লেখার কোনও না নেই। মাথা উপরে তুলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
লেখার দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে হাসি চাপতে পারছিল না রেখা। কী হ্যাংলা হয়েছিস রে লেখি?
–আমি করলেই দোষ, না? জানো মা দিদি এখুনি হীরুদার মাথা মুছিয়ে দিচ্ছিল।
–অন্যায়টা কী হয়েছে লেখি? পাকা পাকা কথা না বলে ঘরে যা তো।
–আচ্ছা হীরু, চিনুটাও কি এরকম বকবক করে? এই মেয়েটা সারাদিন কথা বলে আমাদের কানের পোকা নড়িয়ে দিয়েছে একেবারে।
ইস চিনুটা বোধহয় নৌকা বানাবার অপেক্ষায় বসে আছে। হীরকের মনে পড়ে গেল ভাইকে কথা দিয়েছে সকাল সকাল নৌকা বানিয়ে দেবে। তাড়াতাড়ি লুচির শেষটা মুখে পুরে হীরু আবার মাথায় বস্তা তুলে নিল।
–একটু জল খেয়ে গেলে পারতি হীরু।
–ঠিক আছে কাকিমা, তেষ্টা পেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে নেব নাহয়। আবার জলের জন্য দাঁড়ালে মার কাছে আছে আজ। ঠিক বলবে বাবু পাড়া টহল দিয়ে ফিরল।
হীরক ফিরতেই চিনু দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির, দাদা, আমাদের ক্যারাম বোর্ডটা গেছে।
–কেন, কী হল?
–সিঁড়ির ঘরে রাখা ছিল। ওখানে জল ঢুকে গেছে, ক্যারাম বোর্ড এতক্ষণ জলে ভাসছিল। ঠিক যেন নৌকো। ফুলে ঢোল। উত্তেজনায় চিনুর চোখ চকচক করছিল।
নীলিমা আর রূপা মিলে এতক্ষণ সিঁড়ির ঘর থেকে সব জিনিস বারান্দায় তুলে আনছিল। নীলিমার মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে আছে। হীরককে দেখেই ফেটে পড়ল। সেই কখন গেছিস, এতক্ষণে পাড়া বেরিয়ে ফেরার সময় হল? একজন সেই সকালে বেরিয়েছে, কখন ফিরবে ঠিক নেই। বাড়িতে একটা পুরুষমানুষ নেই দুটো হাত লাগিয়ে সাহায্য করে। যা রূপার সঙ্গে বাকি জিনিসগুলো সরিয়ে তোল। গজগজ করতে করতে নীলিমা রান্নাঘরের দিকে যেতেই রূপা বলল আজ বাবা ফিরলে মায়ের হাত দুর্ভোগ আছে ঠিক।
হীরক পুরুষমানুষের পদমর্যাদা পেয়ে খুশিত চিত্তে সিঁড়ির ঘরে দাঁড়ানো জলের ভেতর থেকে পুরনো রঙের ড্রামে রাখা জিনিসপত্র সরাতে লেগে গেল।
চিনু তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছিল। আচ্ছা দাদা, এইভাবে জল বাড়লে আজকে রাত্রে শোওয়ার ঘরে জল ঢুকে যাবে?
–এতে আনন্দের কী আছে রে চিনু?
–না, মানে বিছানাটা যদি ক্যারাম বোর্ডের মত ভাসতে থাকে, মজা হবে না?
–আর একখানা ব্যাং দেখলি তোর ঠিক কপালের মধ্যিখানে লাফ দিয়ে উঠে হিসু করে চলে গেল। বলতে বলতেই রূপা হেসে গড়াগড়ি।
–হ্যাঁ, তোকে বলেছে। মশারি থাকবে না? চিনুর মুখ থেকে আনন্দের বাতিটা নেভানো গেল না।
দুপুরে সবাই মিলে খিচুরি খাওয়ার সময় নীলিমার চিন্তাটা বাড়তে শুরু করল। তোদের বাবাকেও বলিহারি। গেলে এত সকাল সকাল, ফিরে আসো তাড়তাড়ি। উনি যাবেন সবার আগে, ফিরবেন সবাইকে বিদায় করে।
আসলে ফিরতে চাইলেও ফেরা অত সোজা ছিল না। বিমলের সেদিন ফিরতে বেশ দেরিই হয়েছিল। সকালে যখন গেছিল তখন কোনওমতে যাওয়া গেছে। ফেরার সময় রাস্তার যা অবস্থা কোনও বাস চলার অবস্থায় নেই আর। ভিজে কাকের মত যখন এসে পৌছাল তখন অন্ধকার নেমে আসছে। দেখা গেল বিমলের হাতে একটা থলে। সেটা আবার লাফাচ্ছে।
বকতে গিয়েও থমকে গেল নীলিমা। হাতে ওটা কী?
বিমলের মুখজোড়া হাসি। মুচিপাড়া মাছের বাজারের দিক দিয়ে ফিরছিলাম। ভাবলাম দেখি যদি মাছ পাওয়া যায়। শোল আর পুঁটি মাছ পেলাম, নিয়ে নিলাম।
–সে মাছ এখনও লাফাচ্ছে?
হাসিটা এবার আরও বিস্তৃত হল বিমলের। সে আরেক কাণ্ড। জল ঠেলে ঠেলে আসছি, পায়ে কত কিছু ঠোক্কর মারছে। মাছও। একবার খপ করে হাত দিলাম, উঠে এল একটা পাকা কই। ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছি, ও ব্যাটা তখন থেকে তিড়িং লাফ দিচ্ছে।
–বাবা তুমি হাত দিয়ে কই মাছ ধরলে?
–তো? ছোটবেলায় খেপলা ফেলে কম মাছ ধরেছি? জলের দেশের মানুষ আমরা, জলকে ভয় পাই না।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ খুব বীরত্ব দেখানো হয়েছে। এবার জামাকাপড় ছেড়ে আগে স্নান করো তো দেখি। যত রাজ্যের গু ঘেঁটে ফিরেছ, ওই পায়ে একদম ঘরে ঢুকবে না। মাছ দেখে নীলিমার মনটা প্রসন্ন হয়েছিল। তাই যত গর্জেছিল, তত বর্ষাল না।
গোটা রাজ্য জুড়ে ভয়াবহ অবস্থা। গ্রাম কে গ্রাম ভেসে গেছে। হাজারে হাজারে বাড়ি জলের তলায়। কাঁচা বাড়ি হলে তো একেবারে মাটিতে মিশে গেছে। গরু বাছুর জলের টানে কোথায় যে ছিটকে গেছে কেউ জানে না। মানুষেরই খোঁজ রাখা যাচ্ছে না। এমন কী কলকাতা শহরও বন্যার কবল থেকে নিস্তার পায়নি।
দুর্গাপুরেও ক্ষতি কিছু কম হয়নি। জল ঢুকে স্টিল প্ল্যান্টগুলো তো বন্ধ হয়েছেই, এমনকি পাওয়ার প্ল্যান্ট শাটডাউন হয়ে গেল। যারা কক্ষনও ভাবেনি নিজেদের বাড়ি ছাড়তে হতে পারে, তাদেরও আর বাড়ির মধ্যে থাকার উপায় রইল না। বিমলের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না মোটেই। কিন্তু জল শোওয়ার ঘরে ঢুকে গেছিল, তার ওপরে জল বেড়েই চলেছে। রাস্তায় কলার ভেলা আর রাবারের নৌকা চলতে শুরু করেছে।
ভেলায় ঘুরে ঘুরে এইসবের তদারকি করছিল সুরেন। আজকাল সে এলাকার মাথা। বিমল জিজ্ঞেস করল, সুরেনদা, আপনি কী বলেন? বাড়ি কি ছাড়তেই হবে?
–এখন আর চিন্তা করে দেরি কোরো না বিমল। যেটুকু সঙ্গে না নিলে নয় ব্যাগে ভরে ফেলো। স্কুলের দোতলা দালান, ওখানেই ব্যবস্থা হয়েছে। বাইশটা ঘর, যতজন পারা যায় থাকার জোগাড় করছি। ঢালাও খিচুড়ি। আর আসল হচ্ছে জল, এখন ফুটিয়ে ছাড়া খাবে না। যত তাড়তাড়ি পারো, দরজায় তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ো। নৌকা আর ভেলা আসছে বাচ্চা আর মেয়েদের তুলে নেওয়ার জন্য। ছেলেরা পায়ে হেঁটে কি সাঁতরে নিজেরাই চলে যাক।
সুরেন সবার বাড়ি বাড়ি খবর দিতে দিতে গেল।
স্কুলবাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। দুটো গলি পেরোলেই। নীলিমা একটা বেডিং বানিয়ে ফেলেছে। ওখানে চাদর বালিশ তো আর থাকবে না। সঙ্গে দুটো করে জামাকাপড়। রূপার হাতে একখানা বাক্স। সেটায় আরও কিছু দরকারি জিনিস, জ্বরজারির ওষুধ। দরজায় তালা আটকানো হল। জল তো আটকাবে না, কিন্তু এই দুর্দিনে চোরছ্যাঁচোররা ওঁত পেতে বসে আছে। খোলা পেলেই ঘরে ঢুকে জিনিস হাপিস করে পালাবে না তার গ্যারান্টি কোথায়?
বীরু একটা রাবারের নৌকায় জল কেটে এসে উপস্থিত। দুই বাড়ি থেকে পাঁচজনকে উঠিয়ে নিয়েছে। দাঁড় বাইছে টকাই, সে আবার সুরেনের চেলা। বীরু হীরকের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল। শুধু বাচ্চা আর মেয়েদের নেওয়া হচ্ছে। হীরু তুই এখন কোন দলে পড়িস?
হীরকের ইচ্ছে ছিল নৌকায় করে যায়। রাগ করে বলল, তুমি কোন দলে বীরুদা?
–আমি তো রেস্কিউ স্কোয়াডে, আমি আর টকাইদা মিলে তোদের সবাইকে স্কুলবাড়ি পৌঁছে দেব।
হীরকের ইচ্ছা হল সেও এরকমভাবে সবাইকে রেস্কিউ করে নিয়ে যেতে পারত যদি। মুখে বলল, আমি জল পেরিয়ে চলে যেতে পারব।
–ভেবে দ্যাখ। চাইলে তোকে নিতে পারি। কিন্তু হীরকের আঁতে লেগেছে, এখন সাধলেও যাবে না।
ততক্ষণে বিমল কোলে করে নিয়ে চিনুকে নৌকায় বসিয়ে দিয়েছে। নীলিমা বেডিং নিয়ে উঠে গেল, পিছন পিছন রূপা।
–হ্যাঁরে বীরু, কতজন নিবি, নৌকা উল্টে যাবে না তো?
–একেকবারে বারো-চোদ্দ জনকে নিচ্ছি, কোনও চিন্তা নেই কাকু।
টকাই দাঁড় বাইতে শুরু করে বলল, দুবার পারাপার করা হয়ে গেছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, শুধু বেশি নড়াচড়া লাফালাফি করলেই মুশকিল।
নৌকা এগিয়ে গেল। বিমল আর হীরক জল ভেঙে চলল। জল এখন হীরকের বুক অবধি, টানও খুব। এইটুকু রাস্তা যেতেও অনেক সময় লাগবে।
–আর কতজন ওঠাবে টকাইদা?
টকাই সবার হাতের জিনিস চোখ দিয়ে মেপে নিল। আর তিন-চার জন বেশি হলে।
–তাহলে এবার রতন ঘোষের বাড়িটায় দাঁড়াও। ওই যে হলদে বাড়ি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রতনকাকু।
নৌকা বারান্দার দেওয়ালের কাছে এসে লাগতেই হাতে ব্যাগ, বাক্স নিয়ে মাধুরী, রেখা, লেখা বেরিয়ে এল।
–আমরা আঁটব এটায়? উল্টে যাবে না তো রে? মাধুরী বীরুকে জিজ্ঞেস করল।
বীরু ততক্ষণে নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়েছে। কোনও চিন্তা নেই কাকিমা। আপনারা তিনজন অনায়াসে উঠতে পারেন। আমাকে আপনার ব্যাগটা দিয়ে দিন।
–বাবা বীরু, তোমার কাকুর উপর এত বড় একটা কাণ্ড হয়ে গেল। সবই তো জানো। এই জলে ওকে যদি হেঁটে যেতে হয়…
–টকাইদা, চারজন হয়ে যাবে না?
–সুরেনদা বলেছিল শুধু বাচ্চা আর মেয়েদের…
–এটা স্পেশাল কেস টকাইদা। দরকার হলে আমি এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকব না হয়। রতনকাকু তোমাকে হেল্প করবে।
–না, না চলে আয়। হয়ে যাবে।
মাধুরী কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল বীরুর দিকে। খুব উপকার করলি বীরু। ওকে নিয়ে আমার এত চিন্তা হচ্ছিল।
নীলিমা চুপচাপ দেখছিল এতক্ষণ। এবার বলল, তাড়তাড়ি এসো মাধুরী। ভয় লাগছে কখন নৌকা উল্টে না যায়। নীলিমার রাগ হচ্ছিল, তার ছেলেটা কষ্ট করে জল সাঁতরে আসছে আর এখানে রতনবাবুর জন্য আলাদা ব্যবস্থা হল। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। দুঃসময়ে ছোটকথা বুকে চেপে রাখাই ভাল। বীরু সবাইকে হাত ধরে ধরে উঠিয়ে দিচ্ছে সেটাও চোখ এড়ায়নি নীলিমার। তাদের তো নিজে নিজেই উঠতে হয়েছে।
বীরু লেখাকে বলল, আয় তোকে কোলে করে নামিয়ে দিই, নয়তো উল্টে যাবি।
–আর দিদিকে?
বীরুর একগাল হাসি। তোর দিদি রাজি থাকলে আমার কীসে আপত্তি। কিরে রেখা, তোকে কোলে করে বসিয়ে দিই নৌকায়?
রেখা মুখ লাল করে কটমট করে তাকাল বোনের দিকে। একবার পৌঁছাক ওখানে, তারপর লেখার হচ্ছে। মুখে বলল, না বীরুদা, তার দরকার নেই। শুধু এই ব্যাগটা নৌকায় রেখে দাও আগে।
বীরু খপ করে হাত পাকড়ে ধরল। লজ্জার কী আছে রে। কোলে নয়, তোকে হাত ধরে তো অন্তত উঠিয়ে দিই।
রেখা বীরুকে মোটেই পছন্দ করে না। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারল না। নৌকায় উঠে নীলিমাকে জিজ্ঞেস করল, কাকিমা হীরু এল না?
বীরু ততক্ষণে নৌকায় উঠে পড়েছে। মুচকি হেসে বল, বলেছিলাম তো ওকে উঠতে। মেয়েদের সঙ্গে বাচ্চাদেরও নিয়ে যাচ্ছি তো। কিন্তু ও গোঁ ধরল হেঁটে আসবে।
–ওই তো পিছনে আসছে রেখা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখাল নীলিমা। বিমল আর হীরক, এখন অনেকটা দূর পড়ে গেছে। জল পার হয়ে আসছে।
–আহা রে হীরকটাকে কেন নৌকায় নিল না? এ বড় অন্যায় নীলিমা। তুমি ছেলেটাকে কেন জল ঠেলে আসতে দিলে বলো তো? রতন নৌকায় করে চলেছে আর হীরুটা জল ভেঙে আসছে, সেটা ভেবে একটু লজ্জা পেয়েই বলল মাধুরী।
–ঠিকই আছে মাধুরী। বড় হচ্ছে। একটু শক্তও তো হতে হবে। মুখে বলল বটে কিন্তু নীলিমার চোখ পড়ে রইল ওদের দিকে। গলিটা ঘুরতেই ওরা চোখের আড়ালে চলে গেল। স্কুলবাড়িতে ওরা যতক্ষণ না পৌঁছায়, চিন্তা লেগেই থাকবে।
(আবার আগামী সংখ্যায়)
লেখা ভালো হচ্ছে। শেষ হলে কমেন্ট করব