প্রবুদ্ধ বাগচী
ঊনিশশো ষাট সালে কলকাতার অল্পপরিচিত প্রকাশনা ডিএনবি ব্রাদার্স থেকে একটা বই বেরিয়েছিল। লিখেছিলেন নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বইয়ের নাম ‘বিপ্লবের সন্ধানে’। বই আকারে প্রকাশের আগে এই লেখা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল ‘মাসিক বসুমতী’র পাতায়। লেখক নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন প্রাক-স্বাধীনতা যুগের স্বনামধন্য বিপ্লবী জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়ের শিষ্য। গত শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় স্বদেশি আন্দোলনের প্রথম যুগের আরেক উল্লেখ্য বিপ্লবী ডাক্তার যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর দীর্ঘ আত্মকথা ‘বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি’-তে নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখ করেছেন। ফলে মনে হয়, এই লেখকের সঙ্গে বেশ অনেকটা সময় জুড়েই বিপ্লবীদের যোগ ছিল। কিন্তু কথাটা সেটা নয়। কথা হল, এই বইয়ের এক জায়গায় দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের কিছু স্মৃতি আছে। সেখানে দেখা যায়, ভোটের দিন একজন শ্রমিককে ‘জাল ভোট’ দেওয়ার জন্য তৈরি করে পাঠানো হচ্ছে একটি শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে। তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর আসল নাম যাই হোক, ভোটের বুথে ঢুকে তাকে নিজের নাম বলতে হবে ধরা যাক সুবল চন্দ্র মালিক আর বাবার নাম ধরা যাক পূর্ণ চন্দ্র মালিক। এখন সেই লোকটি পথে যেতে যেতে নিজের মনে আউড়ে চলেছে, আমার নাম সুবল চন্দ্র মালিক, বাবার নাম পূর্ণ চন্দ্র মালিক। অবশেষে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে সেই নাম-বদলানো ভোটার দিব্যি ভোট দিয়ে চলে আসে। এ হল, বলতে গেলে একটা ইতিহাসের তথ্য।
দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে নিজেদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, স্বাধীনতার আগে ও পরে সমান সত্যি। খোদ কলকাতায় কংগ্রেসের সুভাষচন্দ্র বসুর গোষ্ঠীর সঙ্গে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের গোষ্ঠীর লড়াই কখনও কখনও আক্ষরিক অর্থেই সংঘাতের চেহারা নিয়েছে। শোনা যায়, দুইপক্ষেরই কিছু কিছু বাহুবলী সমর্থক ছিল। মেদিনিপুরের ভূমিপুত্র বীরেন্দ্রনাথ শাসমল কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নামলে তাঁর জাতিগত পরিচয় তুলে (তিনি ছিলেন জাতিতে ‘কেওট’) তাঁকে আক্রমণ করা হয়। আজকের জাতপাতের রাজনীতি থেকে সে কতকাল আগের কথা!
রাজনৈতিক দলের মধ্যে তথাকথিত ‘সমাজবিরোধী’দের অনুপ্রবেশ নিয়ে অন্য একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনে বরানগর কেন্দ্র থেকে তৎকালীন কমিউনিস্ট দলের প্রার্থী জ্যোতি বসু জয়লাভ করার পরে সিঁথি সার্কাস ময়দানে একটি বিজয় উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেই সভার বক্তৃতায় জ্যোতিবাবু দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আমাদের দলে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সমাজবিরোধী ঢুকে পড়েছে, এদের সম্বন্ধে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন একজন বাম সাংস্কৃতিক কর্মীর মুখে এই কথা আমি শুনেছি তার অনেক বছর পরে, যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতি বসু অবসৃত। লিখিত তথ্যের বাইরে মুখের কথা থেকে ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা এখন একটা স্বীকৃত প্রথা বলেই জানি। অবশ্য এই ‘সমাজবিরোধী’ প্রসঙ্গে বাংলার রূপকার বিধান চন্দ্র রায়েরও যে খুব সুনাম ছিল এমন নয়। ছেচল্লিশ সালে কলকাতা শহরে যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হয় সেই সূত্রে মধ্য কলকাতায় গণেশচন্দ্র এভিনিউ, মলঙ্গা লেন, বউবাজার স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্কোয়ার এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ত্রাতা হিসেবে দেখা দেয় জনৈক গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, যার বাবা ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা যোদ্ধা অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পূর্বতন ‘প্রিন্সেপ স্ট্রিট’ আজ যার নামে নামাঙ্কিত। গোপাল চন্দ্র, শোনা যায় সশস্ত্র পথে এলাকার হিন্দু নাগরিকদের নাকি সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করে রাতারাতি ‘সমাজসেবী’ হিসেবে নাম কিনে ফেলে। পাড়ার ছেলে হিসেব এই গোপাল ক্রমে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে বিধান চন্দ্রের। পরবর্তীকালে এলাকার নির্বাচন পরিচালনার গুরুদায়িত্ব বিধানচন্দ্র তার উপরে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতেন। অনেকেই জানেন, পরে এই গোপালের পরিচয় হয়ে ওঠে ‘গোপাল পাঁঠা’— কারণ আর কিছুই নয়, বউবাজারের মোড়ে এর একটি পাঁঠার মাংসের দোকান ছিল যার মধ্যে অধিষ্ঠিত করা হয় এক কালীমূর্তি। নিষ্ঠাবান হিন্দুরা ওই দোকান থেকে পরম ভক্তিভরে মাংস কিনতেন। দোকানটি আজও স্বস্থানে আছে যার নাম লোকমুখে হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘গোপাল পাঁঠার দোকান’। এহেন বিধানবাবু মহা মুশকিলে পড়েন দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে (১৯৫৭) যখন তার বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান মহম্মদ ইসমাইল, ব্যক্তিগত জীবনে যিনি ছিলেন ট্রাম কোম্পানির শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ও পেশাগতভাবে ট্রামের কন্ডাক্টার। ভোটগণনার শেষ পর্বে তখনও বিধান চন্দ্র পিছিয়ে আছেন। তখনকার গণনাকেন্দ্র রঞ্জি স্টেডিয়ামে টানটান উত্তেজনা। এমন এক ক্রান্তিকালে বিদ্যুৎ চলে গেল গণনাকেন্দ্রে, অতএব গণনা স্থগিত। কিছু সময় পরে বিদ্যুৎ এল, গণনা শেষে দেখা গেল পোস্টাল ব্যালট নিয়ে অত্যন্ত অল্প ব্যবধানে বিধানচন্দ্র জিতেছেন! শোনা যায়, জয়ের পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নাকি বিধানবাবু বলেছিলেন, আরেকটু হলেই ট্রাম কন্ডাক্টারটা আমায় হারিয়ে দিচ্ছিল! একেই বোধহয় বলে ইতিহাসে ট্রাজিক উল্লাস।
আমরা সকলেই জানি নির্বাচনে এইসব টুকরো টুকরো কারচুপি পরে কী প্রকাণ্ড আকার নেয়। ১৯৭২ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে নির্বিচার ভোট লুঠ ও বুথ দখল নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘রিগিং’ শব্দকে পাকাপাকিভাবে প্রতিষ্ঠা দেয় যা শাঁসে জলে আরও পরিপুষ্ট হয়েছে পরের অর্ধশতকে। অবশ্য, এই সূত্রে আরেকটা ঘটনার কথা না বলে পারছি না। সেটা অবশ্য ঠিক বিধানসভার ভোটের কাহিনি নয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সিন্ডিকেটের ভোট। এটা ষাটের দশকের কথা। তখন সিনেট সিন্ডিকেটের ভোটের দায়িত্বে থাকতেন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষরা। একবার তেমনই এক সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের প্রতিষ্ঠানের ভোট গুনতে গিয়ে দেখা গেল এমন দুজন অধ্যাপকের ভোট পড়েছে যাদের একজন সেইসময় বিদেশে গবেষণারত, আর একজন প্রয়াত। হইহই পড়ে যেতে রাজ্যের শিক্ষা দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সেই অধ্যক্ষকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, আরে মশাই এর ভোট ও দিয়ে দেয় এসব আমরাও হামেশাই করে থাকি, কিন্তু মৃত ভোটারের ভোট দিয়ে দেওয়া… এতদূর তো আমরাও যাইনি! যা করবেন একটু দেখেশুনে করবেন তো! মনে পড়ে গেল মাস কয়েক আগে বিধাননগরের পুরসভা নির্বাচনে এক প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পীর ভোট অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছিলেন বলে কাগজে খুব শোরগোল উঠেছিল। আজকের ইতিহাস এভাবেই বোধহয় বহন করে চলে অতীতের নানা ছেঁড়াখোড়া কাহিনির।
যেমন আজকাল স্কুলে-কলেজে শিক্ষক নিয়োগ ঘিরে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির অভিযোগে সংবাদমাধ্যম ছয়লাপ। কিন্তু স্বাধীনতার আগে তো বটেই তার পরের অন্তত পঞ্চাশ/ষাট বছর অবধি স্কুল-কলেজের চাকরি নিতান্তই সুপারিশ বা চেনাশোনার খাতিরেই হত। ১৯৩৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাশ করা ভবতোষ দত্ত যখন কলকাতার রিপন কলেজে (আজকের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) শিক্ষকের চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন তখন তাঁকে বলা হয়েছিল, তাঁকে শিক্ষক পদে নেওয়া সম্ভব নয়— কারণ, কলেজ কর্তৃপক্ষের ইতিমধ্যেই মনোনীত প্রার্থী আছে। সেই ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই বিখ্যাত বক্সার জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁদের পরিবারের জামাই যোগেশ চৌধুরী। বিদ্যাসাগর কলেজেও তাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছিল একইরকম, সেখানেও অধ্যক্ষ জানিয়ে দেন, তাঁদের প্রার্থী ঠিক করা আছে। পরে অবশ্য ভবতোষ দত্ত রিপন কলেজে অধ্যাপক হিসেবে কাজ পান ও একটানা ন বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। তবে সেটা ভিন্ন গল্প।
স্বাধীনতার পরে, রাজ্যে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ তৈরি করে তাঁদের আওতায় সমস্ত স্কুলকে নিয়ে আসা হয়, স্কুলের নিয়োগও হত তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। তবে তখন যেহেতু স্কুলের শিক্ষকদের বেতনের পুরো দায়ভাগ সরকারের ছিল না, তাই স্কুল কমিটি নিজেদের পছন্দের লোক নিতে পারত। তার মধ্যে সকলেই যে যোগ্য ছিলেন তা নয়, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির সঙ্গে খাতির থাকলে কেউ কেউ সুযোগ নিতেন ও পেতেন। অবশ্য মধ্যশিক্ষা পর্ষদ মনোনীত কাউকে পাঠালে স্কুল কমিটি তাঁদের উপেক্ষা করতে পারত না। একেবারে ব্যক্তিগতভাবে সামনে বসে শুনেছি কবি রাম বসুর কথা। তিনি সেই সময় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের উচ্চপদে চাকরি করতেন। তাঁর পরিচিত দুই বামপন্থী তরুণ তখন সদ্য এজি বেঙ্গল থেকে তাঁদের চাকরি খুইয়েছেন— তাঁদের ‘অপরাধ’ ছিল তাঁরা ১৯৫২-র সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্ট প্রার্থীর হয়ে প্রচার করেছিলেন। সেই সময় কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ‘রুল ফাইভ’ নামে একটি দানবীয় আইন ছিল যার সুযোগে কমিউনিস্ট-সংসর্গ প্রমাণিত হলে তাঁর চাকরি চলে যেত। বলা বাহুল্য এটা নেহেরুজির অবদান। প্রদীপ মুখোপাধ্যায় অভিনীত ‘দৌড়’ চলচ্চিত্র যারা দেখেছেন তাঁদের বিশেষভাবে মনে থাকবে সেই ফিল্মের নায়ক যিনি আয়কর বিভাগে চাকরি করতেন, এই আইনবলে তাঁর চাকরি হারান। চাকরি-হারা এই দুই তরুণের ক্লিন্ন অবস্থা দেখে রাম বসু জিজ্ঞাসা করেন, তাঁরা স্কুলে চাকরি করতে রাজি আছেন কি না। হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো তাঁরা সম্মতি জানান। অনতিবিলম্বেই তাঁরা দুজন স্কুলে চাকরি পান। এই দুজনের মধ্যে একজন পরবর্তীকালে প্রখ্যাত সঙ্গীতশিক্ষক ও গায়ক আর অন্যজন বিখ্যাত কবি ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জামাতা। একথা বলতে চাই না, এঁদের কারও যোগ্যতার ঘাটতি ছিল— তবে এইভাবে চাকরি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বহুদিন অবধি চালু ছিল। অবশ্য, স্বীকার না করে উপায় নেই, এইসব যোগাযোগ ও চাকরি পাওয়ার সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের কোনও সম্পর্ক সেকালে ছিল না। সাম্প্রতিকের বিপুল আর্থিক লেনদেনের ‘অভিযোগ’ নিয়ে যখন আমরা স্তম্ভিত ও বিচলিত তখন মনে হয়, স্বজনপোষণের ইতিহাস সাবেকি হলেও হালের ইতিহাস তার নিজের নিয়মেই লাফিয়ে অনেক ধাপ এগিয়ে এসেছে। হয়তো বা এইরকমই হওয়ার কথা ছিল!