নির্মাল্য সেনগুপ্ত
১
ঘুণ ধরা কাঠের কতগুলো তক্তা পাশাপাশি দড়ি দিয়ে বাঁধা। বৃষ্টির জলে ভিজে সেগুলোর অর্ধেকই এতটাই নরম হয়ে গিয়েছে যে হালকা চাপে যে কোনওদিন ভেঙ্গে পড়তে পারে। কিছু কাঠের ফাটল দিয়ে নিচের নরম জংলী গাছ আর কচুরীপানার সবুজ চোখে পড়ে। বৃষ্টির দিনে জলের ফোঁটাগুলো আধপচা দড়ির গা বেয়ে এদিক ওদিক করে মাঝে এসে জড়ো হয় তারপর টুপ করে ঝরে পড়ে নীচের খালে। এরপর মাঝে মাঝে ঝড় আসে। তখন আরও অসহায় দেখায় সাঁকোটাকে। হাঁসফাঁস করে টেনে ধরতে চায় শক্তপোক্ত থাকার দিনগুলোকে। তারপর ধীরে ধীরে ঝড় থামে। মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরে আসা রোগীর মতো আধাচোখে আকাশের দিকে চায় সে। আবার শুরু হয় দিন গোণা।
বলরাম চাটুজ্জে রোজই নিজের জীবনের মিল খুঁজে পান সাঁকোটার সাথে। তাই ঘুম থেকে উঠে দাঁতন করার সময়, প্রাতঃকৃত্যের সময়, খাওয়ার সময়, খারাপ দিনের সময় তাকিয়ে থাকেন সাঁকোর দিকে। ভারী মিষ্টি একটা নামও দিয়েছেন তিনি সাঁকোটার– ‘নির্ভয়া’। যদিও এই নামটার কথা কেউ জানে না। বলরামের স্ত্রী কণিকাবালাও নয়।
একাত্তরে দেশের ভিটেমাটি ছেড়ে এই হরিহরপুরে বলরাম যখন এসেছিলেন তখন সাঁকোটা ছিল তরতাজা যৌবনে ভরপুর। হেঁটে গেলে জুতোর মচমচ আওয়াজ শোনা যেত। মাঝে মাঝে একটু দুলে উঠে সে সোহাগ দেখাত কখনও। মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে থাকলে কাব্যি আসত প্রাণে। বায়োস্কোপের মতো, দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা ছবির মতো, গল্পের মতো দেখাত তাকে তখন। গ্রামের দু’ভাগকে জুড়ে রাখত একাই সে সগর্বে। সাইকেল, গরুর গাড়ি, মানুষ, ভেড়ার পাল অনায়াসে গেছে এপার থেকে ওপার। বিকেলবেলায় খালের জলে সোনালী আলোর ছটা দেখতে দেখতে দুরু দুরু বুকে আলাপ করেছে কত যুবক–যুবতী। এই তো যেন সেদিনের কথা বলে মনে হয়। আজ সে যুগ গেছে। বৃদ্ধা ‘নির্ভয়া’ আজ তাই যমেরও অরুচি। কেউই আর তেমন ব্যবহার করে না তাকে। আধ মাইল দূরের পোক্ত ব্রিজ দিয়ে যায়। হৃদ-যুগলেরা স্থান নেয় বাঁশবাগানে বা ঝিলপারে। তবু সাঁকোর প্রেম ছাড়তে পারে না বলরাম। যে প্রেমে একদিন ঘর বসিয়েছিলেন তারই সম্মুখে, ঘুম থেকে উঠে জানলা দিয়ে প্রথমেই যাকে দেখা যেত, অবসরের বেশিরভাগ সময় কেটেছে যার বুকে, তাকে ভুলে যাওয়া এত সহজ নাকি! ভরসা এখন একটাই। বলরামবাবুর পুত্র জয়ন্ত চ্যাটার্জী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতায় সস্ত্রীক তার বাস। বড় বড় ব্রিজ, রেললাইন বানাতে সে ওস্তাদ। প্রতিবারই সে এসে বাবা মাকে কলকাতার বাড়িতে নিয়ে যেতে যায়। কিন্তু বলরাম যাবেন না। তাই কণিকাবালারও যাওয়া হয় না। গত পরশু ভোর ছ’টা নাগাদ যখন বলরাম ঘুম থেকে উঠে সাঁকোর ধারে উবু হয়ে বসে দাঁতন করছিলেন, কোথা থেকে জয়ন্ত এসে হাজির।
“কীরে তুই এত সকালে কোথা থেকে?”
“পাশের গোপালপুরে একটা প্রোজেক্ট পড়েছে। তিনদিন ধরেই আছি সেখানে। রোজই আসব আসব করছিলাম। আজ সকাল সকাল চলে এলাম। দুপুরে ফিরব।”
“অ। তা তোর মা তো এখনও ওঠেনি। বস। মুড়ি খাবি?”
“না কিছু খাব না এখন। শরীর কেমন?”
বলরাম কিছু না বলে সাঁকোর দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন।
“ওইটে দেখছিস? ওটার মতনই অবস্থা আমার। ঝুলে আছি ঠিকই। শুধু বিস্তর ফাঁকফোকর এসে গেছে শরীরে।”
“কলকাতা চলো। দুদিনে সাঁকো থেকে ব্রিজ বানিয়ে দেব।”
“না রে। এই ঠিক আছি। তুই একটা আধমড়া গাছকে শিকড় শুদ্ধ উপড়ে নিয়ে অন্য মাটিতে লাগালে কি আর পুষ্টি পাবে? পুরোই মরে যাবে। তার চেয়ে এই মাটিতেই কিছুটা সার দে দেখি।”
“কী লাগবে বল? কিছুই তো বলো না তুমি। প্রতিবারই তো জিজ্ঞেস করি কী কী প্রয়োজন। তা না তুমি বলো, না মা।”
“তুই তো ইঞ্জিনিয়ার। সাঁকোটাকে সারিয়ে দে না।”
“সারিয়ে দেব মানে? এটা কেমন কথা? সরকারের জিনিস। সরকারের সারাবার ইচ্ছে হলে সারাবে নইলে ফেলে দেবে। তাহলে পঞ্চায়েতের সাথে কথা বলতে হবে, মিউনিসিপ্যালিটিকে দরখাস্ত জমা দিতে হবে। তারা খতিয়ে দেখবে প্রয়োজন আছে কিনা? তারপর প্রোজেক্ট তৈরী হবে। তারপরে সারানোর কাজ শুরু।”
“ও বাবা! তাহলে ছাড়। আর কী। এভাবেই থাকুক।”
জয়ন্ত ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর “ঠিক আছে, দেখছি।” বলে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল মা’কে ডাকতে।
বলরাম তাকিয়ে রইলেন সাঁকোর দিকে। ঘাসের উপর দুটো ফড়িং মারপিট করছে। গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটা ‘বউ কথা কও’ উড়ে এসে বসল দড়িতে। তারপর একটা পালক ছেড়ে রেখে উড়ে গেল পাশের আকাশমণি গাছের ডালে। বলরাম দেখলেন একটা বুড়ো কুকুর সাঁকো ধরে ওই পার থেকে এপারে চলে এল নির্ভয়ে…
২
সমীর হাঁড়িটা উলটে দেখল গাঢ় কালো রঙে ঢেকে গেছে অ্যালুমিনিয়ামটা। অমাবস্যার রাতের আকাশের মতো কালো। এবার না বদলালেই নয়। দু’দিনে ফুটো হয়ে যাবে। তারপর ফ্যান চুঁইয়ে পড়ে উনুন নিভিয়ে, নোংরা হয়ে যা তা অবস্থা। একটা হাঁড়ির দাম কত হতে পারে? একশো? দেড়শো? উফফ, এভাবে একা থাকা যায় নাকি? ঘরে একটা মেয়েমানুষের কত দরকার। ফটিক ঘটক কবে থেকে বলে যাচ্ছে “ওরে সমু হেইবার একখান বিয়া কর। পহা তো কম জমাইলি না…”। সত্যি, বিয়ে করাটা এবার প্রয়োজনের মধ্যে এসে যাচ্ছে। কিন্তু উপায় কি…
গোলাপাড়া রিক্শা স্ট্যান্ডে সমীরের নামডাক যে কতটা একবার কেউ গিয়ে নাম করলে বুঝতে পারবে। সমীরের মত রিক্শা চালানোর ক্ষমতা কারও নেই। না বেগ নয়, সমীরের পারদর্শিতা অন্য জায়গায়। প্রথমত সমীর টানা বারো ঘণ্টা রিকশা চালাতে পারে। দ্বিতীয়ত একসাথে আটজনকে নিয়ে রিক্শা চালানোর রেকর্ড আছে তার! এছাড়াও বিভিন্ন গতিতে, বিভিন্ন কায়দায়, যেমন ধরো, দু’হাত ছেড়ে দিয়ে মোড় ঘুরে যাওয়া কিংবা অফিসবাবুদের সময়ের মধ্যে ট্রেন ধরিয়ে দেওয়ায় তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। যেন রিকশাটি তার পোষা কুকুর, প্রভুর মনের কথা পড়ে কাজ করে। তারপর হ্যান্ডেলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করে রিকশা চালানো। এরকম নানা কীর্তি শোনা যায় তার নামে। এমনকি সমীর তন্ত্রসাধনা করে মন্ত্র ফোঁকে রিকশায় এমন গুজবও শোনা যায়। তবে আগেই বলে দিই এ কথা সত্যি নয়। পুরোটাই সমীরের কৃতিত্ব। এভাবে সমীর পয়সাও কম রোজগার করেনি। গোলাপাড়ার সবাই চায় সমীরের রিকশায় যেতে। এমন কিংবদন্তী রিকশাচালকের সংস্পর্শে আসতে কে না চাইবে। এভাবেই দারুণ কাটছিল সমীরের দিনকাল, অর্থ যশ সবই ছিল। বাদ সাধল তার পেয়ারের পিতৃদত্ত রিকশাখানি। তার বয়সও কম হল না। বহুদিন প্রভুর কথামতো চলেছে। এখন বয়সের দোষেই হোক, কি বিভিন্ন কসরতের কারণে, আর মানতে চাইছে না। দুদিন অন্তর চেইন পড়ে যায়, গিয়ার আটকে যায়, বল বেয়ারিং-এ গণ্ডগোল হয়। চাকাগুলোও উপবৃত্তাকৃতি হয়ে এসেছে। এবার বদলাতেই হবে। যদিও এতদিনের সঙ্গীকে হাতছাড়া করতে মন মানেনি সমীরের। কিন্তু তাকে যেদিন দেখেছিল সব ঘেঁটে গিয়েছিল। মনতোষের দোকানে। রিকশা নয়, তাকে পক্ষীরাজই বলা চলে। দৈর্ঘ্যে সাধারণ রিকশার থেকে অনেকটাই বড়। চাকার বেধ, চেইনের দৃঢ়তা সবকিছুই বেশি। তবে দামটাও একটু ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। তাই সমীর এখন একটা টাকাও খরচা করতে চায় না। রোজ রাতে স্বপ্ন দ্যাখে ওই পক্ষীরাজে করে রাজার মতো গোলাপাড়ার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। বুকে লাগছে মৃদু হাওয়া, নাকে আসছে গ্রামের মিঠা খুশবু, চারিদিক ভীষণ সবুজ, ভীষণ সুন্দর। সে কথা মনে পড়তেই হাঁড়িটা নামিয়ে রাখল সমীর। দু’টাকার গুঁড়ো সাবান কিনে আনতে হবে।
উঠোনে বসে রিকশায় মোবিল দিতে দিতে সাত পাঁচ ভাবছিল সমীর। বাবা মা চলে গেছে বছর তিনেক হয়ে গেল। এই রিকশাটাও তার বাবার। ছোটবেলায় বাবার রিকশায় উঠে যখন স্কুল থেকে ফিরত তখন থেকেই তার মনে হয়, বাবার জায়গাটা এই গদির থেকে অনেক বেশি সুখের। বসে বসে টাকা উপার্জনের জন্য রিকশা ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় কি? মুদি দোকানেও বসেই কাজ। কিন্তু সে বড় আটকে থাকা এক জায়গায়। রিকশার স্বাধীনতা কোথায়? তার মতো সারা গোলাপাড়ার প্রত্যেকটা মাটির টুকরো আর কেউ চেনে না। এরপর যখন পক্ষীরাজ আসবে তখন এক লাফে তার বুকে নিঃশ্বাসের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
ভাবনায় হঠাৎ বাঁধা পড়ল একটা নারীকণ্ঠে।
“সমীরদা…”
সমীর মাথা তুলে দেখল ঝিমলি। জগৎ দত্তের মেয়ে। স্ট্যান্ডের পঞ্চাশটা রিকশার মালিক জগৎ দত্ত।
“হ্যাঁ রে বল।”
“বাবা তোমায় সন্ধের দিকে একবার দ্যাখা করতে বলেছে। এসো কিন্তু। নইলে আমি বকা খাব।”
অন্য কেউ এসে এই কথাটা বললে সমীর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠত। জগৎ দত্ত চায় সমীর তার অধীনে কাজ করুক। উপার্জনের অনিশ্চয়তা নেই। বাঁধা মাইনেতে কাজ। রিকশার সারাইতেও উপরি খরচা নেই। এই সমস্তই বলার জন্য প্রতি মাসে দু’বার করে ডাক পড়ে সমীরের। সে মাঝে মাঝে যায়, মাঝে মাঝে যায় না। কিন্তু ঝিমলিকে কোনওবারই না বলতে পারে না সমীর। ভীষণ মিষ্টি হয়েছে মেয়েটা। এতটুকু দেখেছে তাকে সমীর। হঠাৎ করে কখন যেন বড় হয়ে গেছে। সমীরের খুব শখ পক্ষীরাজ হাতে আসার পর ঝিমলিকে চড়িয়ে একবার সারা গোলাপাড়া দেখাবে সে। পয়সা নেবে না একটাও।
ঝিমলি চলে গেল। সমীর হাসিমুখে চেইনে তেল লাগাতে শুরু করল আবার। একটু জোরে টান পড়তেই হল বিপত্তি। চেইনটা ছিঁড়ে দু’টুকরো। বিরক্তিতে মুখটা ভরে গেল সমীরের…
৩
গফুর এক মনে তাকিয়েছিল ইঁটের পাঁজাটার দিকে। সরু সরু সরকারি ইঁট। অনান্য ইঁটের থেকে এগুলোর মজবুতি অনেক বেশি। দাম কাছাকাছি তবে বেধের ঘাটতির জন্য পরিমাণ বেশি লাগে। হিসেব ঠিক আছে। এক্ষুণি এসে পড়বে সিমেন্টের গাড়ি। বস্তাগুলোর হিসেব নিতে হবে। তারপর লিস্ট বানিয়ে যেতে হবে ছোট সাহেবের কাছে। তারপর যেতে হবে বাড়িতে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে চাঁদ মাথার উপরে উঠে যাবে। আজ সকালটা বেশ মেঘলা মেঘলা ছিল। সারাদিন বৃষ্টি না হলেও রাতের দিকে ভাসাতে পারে। আজ রুনার অঙ্ক দেখাতে হবে। নইলে খুব ঝামেলা করবে। মেয়েটা বড় বাপন্যাওটা হয়েছে। মা-হারা বলেই বোধহয়।
লিস্ট বানিয়ে গফুর ছুটল ছোট সাহেবের কেবিনের দিকে। কেবিন তো নয়, ছোট্ট একটা ছাউনি। চারটে মাটির দেওয়ালের ওপর খড়ের চাল। গোপালপুরের এর থেকে বেশি দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ছোট সাহেব একমনে ব্লু-প্রিন্ট দেখছিল। গফুর তার মুখের দিকে তাকাল। কত বয়স আর হবে ছোট সাহেবের? তার বড় ছেলের থেকেও ছোট। কলকাতা থেকে ভাল কলেজে পড়াশুনা করে চাকরি পেয়ে গেছে। গফুরের সমান জ্ঞান পেতে গেলে একে আরও কুড়ি বছর গতর নাড়াতে হবে। গফুরের মনে পড়ল একটা বয়েসে তার খুব ইচ্ছা ছিল কলকাতায় গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং শিখবে। বড় বড় ইমারত, ব্রিজ, বাঁধ বানাবে একের পর এক। শহরে নয়, গ্রামের জন্যই সে সমস্ত কাজ করবে। রোজগার যাই হোক, গ্রামের উন্নতি করাই হবে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কিছুই হয়নি। ভালো করে পড়াশুনা করার সুযোগও পায়নি গফুর। গ্রামের স্কুলের শিক্ষকরা অর্ধেক জিনিসই জানে না। স্কুলের বেড়া টপকাতে না টপকাতেই তাকে ঢুকে যেতে হয়েছিল কাজে। ইঞ্জিনিয়ারের নয়, শ্রমিকের। এখন অভিজ্ঞতার জোরে শ্রমিকদের দায়িত্ব তার ওপরে থাকলেও আজকাল আর উন্নয়ন নয়, রোজগারের চিন্তাটাই বেশি দানা বাঁধে বুকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসল গফুর। ছোট সাহেব চমকে তাকাল তার দিকে।
“আরে গফুর মিঞা যে! আসুন আসুন। বসুন।”
গফুর একটু ইতস্তত হয়ে বসল ছোট সাহেবের সামনের চেয়ারে। ও বুঝেছে এই লোকটা বেশ ভাল। অন্যান্য বেড়েপাকা ইঞ্জিনিয়ারদের মতো নয়। কাজ শেখার ইচ্ছে আছে। গুরুজনদের সম্মানও করতে জানে।
“কয়েকটা বস্তায় ফুটো বেরিয়েছে। অনেকটা মাল কম। এছাড়া বেশ কয়েকটা ইঁটের কোণা ভাঙ্গা। কাজে আসবে না। স্বপনকে বলেছি মালগুলো এক জায়গায় করতে। তারপর লিস্ট করে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। তবে ডিসপুট যা আছে তাতে কাজের অসুবিধে হবে না বলেই মনে হয়। কম করে চারদিন কাজ টেনে দেওয়া যাবে।”
“আজ রাতে কি করছেন?”
প্রশ্নটাতে গফুর যারপরনাই অবাক হল। কথাটার কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না।
“আজ্ঞে?”
“আজ সন্ধেবেলা কাজ শেষের পর আমার কোয়ার্টারে আসুন। সাপ্লাইয়ের অরুণ তো আপনার বাড়ির পাশেই থাকে। ও আপনার বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দেবে।”
“কিছু গোলমাল হয়েছে নাকি সাহেব?”
“না না, একটু দরকার আছে আপনার সাথে। চলে আসবেন।”
উঠে পড়ল গফুর। কেন এই তলব সে বুঝতে পারছে না এখনও। মেয়েটাকে আজও অঙ্ক দেখানো হল না। মেয়েটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর খুব স্বপ্ন গফুরের। বাপের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ছিল অজ্ঞাতে। গফুর চেপে দিল।
ছোট সাহেবের কোয়ার্টারের দরজায় যখন পৌঁছল গফুর, চাঁদ তখন দেখা যাচ্ছে না। দু’তিনটে জলের ফোঁটা গফুরের চুলে কানে আর চোখের পাতায় পড়ে গেছে ইতিমধ্যে। দরজার কড়া নেড়ে আকাশের দিকে তাকাল গফুর। আজ বেশ বড়সড় ভাসাবে আকাশ।
ছোট সাহেব দরজা খুলল। “আসুন আসুন গফুর মিঞা। আপনার অপেক্ষাই করছিলাম।”
গফুর বুঝতে পারছিল না চটিটা কোথায় খুলবে। ভিতরে খোলাটা অসৌজন্যের হবে, আবার বাইরে খুললে বৃষ্টির জলে ভেসে যেতে পারে। তখন হবে আরেক বিপত্তি। এতটা রাস্তা খালি পায়ে যেতে হবে। কাঁকড় ফুঁটবে পায়ে। প্রচণ্ড ব্যথা হবে। নতুন চটি কিনতে ছুটতে হবে হাটে। এর জন্যও দায়ী তার ছোটবেলায় পড়ার সুযোগ না পাওয়া। বড় কলেজ থেকে পাশ করলে এখন আর এ বিষয়টা নিয়ে এত ভাবতে হত না। আবার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোতে চাইছিল, ছোট সাহেবের আওয়াজে আটকে গেল।
“এখানে জুতোটা খুলুন। হ্যাঁ, ওখানে, আসুন ভিতরে আসুন।”
একটা ছোট টেবিল। দু’দিকে দুটো চেয়ার। সরকারি কোয়ার্টারগুলোও বড় মলিন হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। গফুর বাইরের দিকের চেয়ারটায় বসল।
“কাজ ভালোই এগোচ্ছে বুঝলেন। এখানকার লেবাররা বেশ ভালো। পরিশ্রমী। আর আপনি থাকতে আমার আর চিন্তা কী। আমায় সরকার বেকার পয়সা দিচ্ছে। আপনিও জানেন যে আমি না থাকলেও আপনিই সব সামলে নিতে পারতেন।”
কথাটা যে খুব একটা ভুল নয় তা বিলক্ষণ জানে গফুর। শুধু একটা ডিগ্রীই যা নেই তার কাছে। মুখে “কি যে বলেন সাহেব…” বলে হাত কচলাল গফুর।
ছোট সাহেব উঠে দাঁড়াল। সামনের আলমারি থেকে একটা বিলিতি মদের বোতল বের করে এনে রাখল টেবিলের ওপর।
“চলে আপনার?”
গফুর চোখ কপালে তুলে বলল “না না একদম না। আপনি খান। আমি শুনছি। কোনও অসুবিধে নেই।”
“ধর্মে নিষেধাজ্ঞার জন্য কী? নাকি লজ্জা পাচ্ছেন?”
“না না, সেরকম ব্যাপার নেই, মানে…”
ছোট সাহেব আলমারি থেকে এবার বের করে আনল দুটো কাঁচের গ্লাস। শৌখিন নয়। একেবারে সাদামাটা জল খাওয়ার গ্লাস। দুই গ্লাসেই সোনালী তরল ঢালল। পাশে রাখা জলের বোতল থেকে মাপ মতন জল ঢেলে একটা গ্লাস এগিয়ে দিল গফুরের দিকে।
“আজ আমাদের মধ্যে ধর্ম, কর্ম, পদ কিছুই যেন না থাকে বুঝলেন? আপনি আমার দাদা, আমি আপনার ছোট ভাই। সাহেব বলবেন না, আমার নাম জয়ন্ত। জয়ন্ত বলে ডাকবেন।”
গফুর কি বলবে বুঝতে পারল না। শুধু মাথা নাড়াল। গ্লাসে হাত দিল। তুলল না।
“নিন তুলুন, চিয়ার্স…”
ঠোঁটে গ্লাসটা ঠেকিয়ে চুমুক দিল গফুর। এমনিতে মদ সে তেমন খায় না। ধর্মের খাতিরে নয়, বিশাল ধর্মপ্রেমী নয় সে। গফুরের কাছে কাজই ধর্ম। তবে নিয়মমাফিক নামাজটা পড়ে। মদ না খাওয়ার কারণ গফুরের পয়সা নষ্ট বলে মনে হয়। ওই মাঝে সাঝে ছুটির দিনে এলাকার বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারলে দু’এক পেগ। চুমুক দিতেই গলাটা একটু জ্বালা করে উঠল। সাহেব জল কম দিয়েছেন।
গ্লাসটা শেষ করে নামিয়ে রেখে জয়ন্ত বলল, “বুঝলেন গফুর মিঞা, মানুষ ভাবে সে নানা কারণে বেঁচে আছে। কাজ করার জন্য, টাকা কামানোর জন্য, সংসার, প্রেম, ফূর্তি এইসব মিলেই মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। আসলে একদমই তাই নয়। প্রত্যেক মানুষের বাঁচার শুধুমাত্র একটা কারণ থাকে। সেটা আবার অনেকে জানতেই পারে না যে কোনটা মুখ্য কারণ। অন্য কারণগুলোর জন্য অনেক সময় আবার মুখ্য কারণটা চাপা পড়ে যায়। তখনই শুরু হয় মানুষের অসুখী জীবন। তখনই মানুষ ভুলভাল কাজ করে বসে।”
গফুরের মাথায় কিছুই ঢুকল না। ছোট সাহেব কথা বলতে বলতেই দ্বিতীয় পেগটা তৈরী করে ফেলেছেন। গফুর গ্লাসটা টেনে নিল। তখনই বুঝতে পারল বাইরে অঝোরধারে শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি।
জয়ন্ত কিছুক্ষণ চুপ থেকে পর পর দুটো পেগ শেষ করল। চার নম্বর পেগটা বানিয়ে হাতে তুলে আবার বলতে শুরু করল, “আবার কিছু কিছু মানুষ এমন হয় জানেন, তারা ওই গৌণ কারণগুলো পাত্তাই দেয় না। মুখ্য কারণটাই তার কাছে সব। তার জন্য বাকি সবকিছু হারাতেও সে রাজী। আচ্ছা আপনার বেঁচে থাকার মুখ্য কারণ কী? আপনি জানেন?”
গফুর মাথা নাড়াল। তার জীবনের সবথেকে বড় ইচ্ছাটা তো পূর্ণই হয়নি। তবু তো সে বেঁচে আছে। ভুলভাল কাজ না করেই।
“সত্যি জানেন না আপনি? একটু ভেবে বলুন না। আপনার প্রিয় জিনিসটি কী?”
মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে গফুরের। আবেগ ঠেলে আসছে। এই জন্য মদ খেতে চায় না গফুর। পয়সা দিয়ে আবেগ ঠেলে আনার কী দরকার মানুষের? নাকি প্রত্যেক মাতাল আদপে দুঃখবিলাসী?
“একটা মেয়ে আছে আমার সাহেব। নাম রুনা। খুব ইচ্ছে সেটাকে আপনার মতো ইঞ্জিনিয়ার বানাই।”
“রুনা হিন্দু নাম না?”
“উঁহু, উর্দু শব্দ, মানে হল জোৎস্না…আমার বাবা নাম দিয়েছিলেন…”
“বাহ, ভালো ভালো, তা পড়ান না। বয়স কত?”
“এবার মাধ্যমিক দেবে। গ্রামে পড়িয়ে তেমন লাভ নেই সাহেব। ভাবছি শহরে পাঠাব। কিন্তু শহরে খরচা অনেক। একা তো থাকতে পারবে না। আমাকেও যেতে হবে। দু’জনের শহরে থাকার খরচা…”
“খরচা নিয়ে ভাববেন না। মাধ্যমিকের পর কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আপনার মেয়ে আমার বোনের মতন। ফাঁকা কথা দিচ্ছি না। মাধ্যমিকটা দিতে দিন আগে।”
গফুর রীতিমত অবাক হল আবার। মদ তো সাহেব বেশি কিছু খাননি যে এমন আবেগপ্রবণ কথা বেরোবে। তবে কারণ কী?
জয়ন্ত ফাঁকা গ্লাসটা নামিয়ে রেখে ঠোঁটের উপরটা মুছে নিয়ে বলল, “তবে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে আপনাকে। যার জন্য আজ আপনাকে ডাকা।”
গফুর চোখ ছোট করল। এমন কী কাজ থাকতে পারে যার জন্য ছোট সাহেবের তাকে দরকার পড়ল?
জয়ন্ত বলল “পাশের হরিহরপুর গ্রামটা চেনেন তো? আমার জন্ম ওখানেই। এখন কলকাতাতে থাকলেও আমার বাবা মায়ের বাস এখনও হরিহরপুরে। একটা সাঁকো আছে বুঝলেন। পচা কাঠের তৈরি। ইউসলেস। জাস্ট ঝুলে আছে। সারানোর প্রয়োজনও নেই কোনও। গ্রামের কারও কাজে লাগে না পাকা ব্রিজ তৈরী হয়ে যাওয়ার পর। কিন্তু ব্যাপারটা হল ঐ সাঁকোটার সাথে জুড়ে আছে আমার বাবার ইমোশন। বাবার জন্য কোনওদিন তেমন কিছু করতে পারিনি বুঝলেন। বাবার দাবিও কোনওদিন কিছু ছিল না। বড় নিরীহ মানুষ। ওনার একটাই ইচ্ছা ওই সাঁকোটাকে আবার ব্যবহারযোগ্য করে তোলা। আমি পঞ্চায়েত, মিউনিসিপ্যালিটি সব জায়গায় চেষ্টা করলাম। প্রোজেক্ট পাস করল না। ভীষণ বিপজ্জনক কন্ডিশনে আছে। আমি চাই আপনি আমাকে হেল্প করুন ওই সাঁকোটা সারানোর জন্য। আমি জানি আপনি চাইলেই পারবেন। ব্যাস এটুকুই। পারিশ্রমিক যা লাগে আমি দেব। করবেন?”
গফুর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। সাহেব পিতৃভক্ত। নিজের বাবার আশ মেটানোর জন্য আরেক বাবাকে সাহায্য দিতে চায়। প্রতিদানস্বরূপ যা দিতে চায় তাও লোভনীয়। কাজটাও এমন কিছুই নয়। মেয়েটার হিল্লে হয়ে যাবে। জীবনের শেষ ইচ্ছেটা পূর্ণ হবে তার। গফুর মাথা নাড়াল।
“তাহলে পরের সপ্তাহ থেকেই শুরু করব কাজ। আমাদের প্রোজেক্টের ফাঁকে ফাঁকে। কাজটা বেআইনী হচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে করতেই হবে বুঝলেন? আরে আরে উঠছেন কোথায়? বৃষ্টির জল বন্দুকের গুলির মত ছুটছে। আজ রাত এখানেই থাকছেন আপনি। নিন, গেলাস ধরুন। বোতল এখনও অর্ধেকও হয়নি। চিয়ার্স…”
৪
সাঁকোটার কাছে এসে একমনে তাকিয়েছিলেন বলরাম চাটুজ্জে। দু’তিনবার হেসে উঠলেন। সকাল থেকে মনে হচ্ছে একি ছেলেমানুষি করছেন! একটা কাঠের জড়বস্তুর প্রতি একি মায়া! তারপরই ভাবলেন এই যে মানুষ তার শরীরের উপর এত মায়া ধরে, আত্মা ছাড়া সেও তো নিপাট একটা জড়বস্তুই। আর নির্ভয়ার কি সত্যিই প্রাণ নেই? ওই যে কোণার দিকের ভেজা কাঠে একটা দুটো ছোট্ট নয়নতারা গাছের চারা গজিয়েছে, তার তো প্রাণ আছে। সকাল হলেই যে পিরিং পিরিং শব্দ তুলে বাবুই পাখিটা এসে দড়িতে বসে তড়িৎ চোখে এদিক ওদিক তাকায়, আবার উড়ে যায় শাবকদের কাছে সে তো জীবিত। এই যে তাঁর অর্ধ জীবনকালের গল্প বয়ে চলেছে যে জড়বস্তু, সেকি একটু প্রাণ খুঁজে পায়নি?
শক্তিপদবাবু যাচ্ছিলেন একটা সাইকেল করে, হ্যান্ডেলে বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে। বলরামকে দেখে থামলেন।
“কী হে বলরাম? কী দ্যাখো অমন করে?”
বলরাম একগাল হেসে বললেন, “এই একটু প্রাকৃতিক দৃশ্য। আপনার খবর কী? বাড়ির সবাই ভাল তো?”
“ভাল আর কী? গিন্নীর কোমর ব্যথা সারে না। ছোট ছেলেটা মাছ ধরতে গিয়ে গলায় মাগুরের কাঁটা খেয়েছে। সপ্তাহ ধরে বিছানায়। ছাদের টালি সরে গিয়ে আলো বাতাস ঢুকছে ঘরে। তা গতকাল বৃষ্টিতে দু’বালতি জলও ঢুকে বিছানা ভিজিয়ে দিয়ে গেল। তার ওপর কাল নগেন জ্যোতিষী বলল সামনেই বড়সড় একটা মৃত্যুযোগ আছে এলাকায়। না হে, ভাল কিছুই আর তেমন মাগনায় পাওয়া যাচ্ছে না। তোমার খবর কেমন?”
বলরাম সাঁকোর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, “আমার অবস্থা এই সাঁকোর মতন। একাল আর ওকালের মাঝে ঝুলছি। একদিক হাল ছেড়ে দিলেই অন্যদিকের ঘাড়ে গিয়ে পড়ব।”
শক্তিপদবাবু চলে গেলেন। বলরাম ঘরের দিকে এগোলেন। কণিকাবালা শাড়ি শুকোতে দিচ্ছিলেন দড়িতে।
“হ্যাঁগো, খোকা যে সেদিন এল, বলছিল এবার থেকে মাঝে মাঝেই আসতে হতে পারে। কেন বলছিল গো?”
“সে মা-বাবা প্রিয় মানুষ। ভক্তি শ্রদ্ধা টিঁকে আছে এখনও তার রক্তে। তাই আসবে।”
“না গো, তাই নয় খালি। বলছিল বাবা একটা কাজ দিয়েছে। সেটা যদি করতে পারি, তবে পিতৃঋণ কিছুটা চোকাতে পারব। কী কাজ দিয়েছ তুমি?”
বলরাম আনমনা হয়ে গেলেন। জয়ন্তর বহু কাজ। তার সাথে তার শহুরে সংসারের দায়দায়িত্ব। বয়সই বা কত হয়েছে তার। এই তো সেদিন জন্মাল। হাতে একটা একরত্তি লাল মাংসের দলা নিয়ে যখন কণিকাবালা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখিয়েছিল, তখন নতুন একটা খেলনা পাওয়ার মতো আনন্দ হয়েছিল তার। আজ সেই খেলনাই বড় হয়ে বাপের আরেক খেলনা সারানোর কথা ভাবছে। নাহ, বেশি দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে ওইটুকু ঘাড়ে। পরের দিন সে এলে বারণ করে দিতে হবে।
বলরাম কণিকাবালার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “আচ্ছা, এই যে তুমি আমি চল্লিশের বেশি বছর কাটিয়ে দিলাম এইখানে, তোমার এ জায়গা ছেড়ে গেলে সবথেকে বেশি কী মনে পড়বে?”
কণিকাবালা অবাক হয়ে বললেন, “ছেড়ে কোথায় যাচ্ছি আবার? তুমি কি কলকাতায় খোকার বাসায় গিয়ে ওঠার কথা ভাবছ?”
বলরাম স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন “ক্ষতি কী? হল তো অনেকদিন এখানে। খোকাও দুঃখ করে তার সাথে থাকি না বলে। এছাড়া সেখানে বৌমা, খোকার ঐটুকুন বাচ্চাটা। বেশ মজাই হবে বলো। তুমি খোকাকে কাছে পাবে, আমি খোকার ছেলেবেলাটাকে। এখানে কীই বা আছে আর? মাঝে মাঝে না হয় ঘুরতে আসব। কি বলো? খোকা খুব খুশি হবে কিন্তু।”
কণিকাবালা মাথা নেড়ে বললেন, “সে তুমি যেতে চাইলে চলো। আমার আর কী। তুমি ন্যাজে বেঁধে যেদিন বাপের ঘরছাড়া করেছিলে সেদিন থেকেই জানি যেখানে তুমি যাবে আমাকেও যেতে হবে। সে তাতে আমার কোনও দুখখুও নেই। তবে কী জানো তো? এই সম্পর্কগুলোও তোমার ওই বুড়ো সাঁকোর মত। দূর থেকে দেখলে খুব সুন্দর, খুব মায়াময়। কিন্তু ওপরে গিয়ে চাপতে গেলেই ভেঙ্গে পড়তে পারে।”
বলরাম আর কথা না বাড়িয়ে বাইরে চলে এলেন। সন্ধে হয়ে আসছে। নির্ভয়ার বুকে এখন নিরক্ষরেখার মতো আলো-আঁধারি। তার নিজের ভাগ্যের মতোই অর্ধেক জীবন, অর্ধেক মৃত্যু। কিন্তু তবু যেন তার কোনও ভয়ডর নেই। হাসিমুখে বুক পেতে আছে। বলরাম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এ ভালবাসা অত সহজে মিটে যাওয়ার নয়।
৫
রাত প্রায় তিনটে। হালকা কুয়াশায় বিষণ্ণতার চাদর জড়িয়ে ঢেকে আছে চারিদিক। পাতার উপরে শিশিরের ফোঁটাগুলো কারুকার্যে মগ্ন। সমীর চারিদিক দেখে নিল। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সমীরের হাতে তার বহু অপেক্ষিত পক্ষীরাজ। স্নেহের চোখে তার দিকে তাকিয়ে লাল ভেলভেটের সিটটায় মুখ মোছার রুমালটা একবার বুলিয়ে নিল। চাঁদের আধো আলোয় সেটি চকমক করে উঠল আবার। সমীর অপেক্ষা করছে একজনের। যে এলে আজ ষোলকলা পূর্ণ হবে।
সমীর জগৎ দত্তের বাড়ি গিয়েছিল সেদিন। অন্যবারের মতন সেদিনও তিনি একই প্রস্তাব রাখেন। সমীর মানেনি। দু’দিন পর একদল ছেলে এসে সমীরের পিতৃদত্ত রিকশা ভেঙ্গেচুরে দিয়ে তার সাথে সমীরকেও মেরে মাথা ফাটিয়ে চলে যায়। দু’দিন তীব্র জ্বরে আচ্ছন্ন থাকার পর সমীর যখন চোখ মেলে তখন দেখে তার মাথার সামনে পাশের বাড়ির বিশাখা খুড়ি আর ঝিমলি বসে। ঝিমলির চোখে জল ছিল।
বিশাখা খুড়ি এক গামলা মুড়িমাখা সামনে রেখে চলে যায়। সমীর ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করেছিল ঝিমলিকে…
“তুমি কেন এসেছ? তোমার বাবা পাঠিয়েছে?”
ঝিমলি ধরা গলায় বলেছিল, “না সমীরদা। বাবা জানে না আমি এখানে এসেছি। জানলে মেরে ফেলবে। আমার জন্যই তোমার এরকম হল।”
সমীর কিছু বলেনি। এরপর ঝিমলি যেটা বলেছিল তাতে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সমীর।
“আমায় বিয়ে করবে সমীরদা?”
সমীর অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ঝিমলির দিকে। তারপরে বলেছিল, “তুই জানিস তোর বাবা যদি জানতে পারে কী হবে?”
“জানি আমি। আমি তোমাকে ভালবাসি সমীরদা। তুমি আমাকে বিয়ে করে পালিয়ে চল এখান থেকে।”
তখনই সমীর ঠিক করে, আর দেরী নয়, এবার সময় হয়ে গিয়েছে।
তিনদিনের মাথায় সমীর জমানো সমস্ত টাকা খরচ করে কিনে ফেলে পক্ষীরাজকে। তেঁতুলবেড়িয়ার হরেন নাগ তার বন্ধু। তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করে একটা বাড়ি ঠিক করে। ঠিক হয় আয় শুরু করলে প্রতি মাসে হরেনকে দু’শো টাকা করে দেবে। এরপর ফিরে এসে একদিন গোপনে ঝিমলির সঙ্গে দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলে।
আজ এসে গেছে সেই দিনটি। চারটেয় ঝিমলি আসার কথা। সে এলেই রাতারাতি পাড়ি দেবে তাদের নতুন আশিয়ানার পথে। জগৎ দত্ত শুধু হাত কামড়াবে। তাদের টিকিটিও খুঁজে পাবে না। যতদিনে পাবে ততদিনে সমীরের তেঁতুলবেড়িয়ায় লবি তৈরী হয়ে যাবে। হরেন বেশ নামজাদা লোক সেখানে। জগৎ দত্তের লোক যদি কোনওদিন খোঁজ পেয়ে সেখানে আসে, পুরনো একটা ঋণ শোধ করা হবে। ভাবতে ভাবতে মাথার কাটা দাগে হাত রাখে সমীর।
ক’টা বাজে এখন? বহু পুরনো হাতঘড়িটায় চোখ রাখল সমীর। পৌনে পাঁচটা। বাবার একমাত্র স্মৃতি ঠিক সময় দেখাচ্ছে তো? ঝিমলি এত দেরি করছে কেন? একটু পরেই ফরসা হয়ে আসবে আকাশ। যত সময় যাবে ধীরে ধীরে তত কমে আসবে সুযোগ। সমীর ছটফট করতে থাকল।
“সমীরদা…”
সমীর চমকে পিছনে তাকাল। ঝিমলি দাঁড়িয়ে আছে। পরণে একটা লাল শাড়ি।
“মা’কে বলে এসেছি। শাড়িটা মা’ই পরিয়ে দিল। তাই দেরী হয়ে গেল একটু।”
সমীর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সেদিকে। এই মুহূর্তের সাক্ষী রইল একটা নতুন স্বপ্নযান, একটা আবছা চাঁদ, কিছু মেঘে ঢাকা তারা, কয়েক পশলা শিশির আর গায়ে লেগে থাকা কুয়াশা। এদেরকে সাক্ষী রেখেই ঝিমলিকে মনে মনে বিয়ে করে ফেলল সমীর। এর থেকে বেশি কিছু আর লাগে না বিয়ে করতে।
লাজুক মুখে ঝিমলি উঠে বসল রিকশায়। সমীর এক গাল হাসি নিয়ে প্যাডেলে চাপ মারল।
বেলা প্রায় দশটা। ঝিমলি রিকশায় বসে ঘুমাচ্ছে অকাতরে। সমীরের কপালের ঘাম গড়াতে গড়াতে কণ্ঠনালী পৌঁছচ্ছে প্রায়। এখনও তিনটে গ্রাম পেরোলে তেঁতুলবেড়িয়া। স্বজনডাঙ্গা, হরিহরপুর, গোপালপুর, তেঁতুলবেড়িয়া।
স্বজনডাঙ্গা পেরনোর পথে কাঁকন মাঝির সাথে দেখা হল সমীরের। কাঁকন আগে গোলাপাড়ায় রিকশা চালাত। জগৎ দত্তের অত্যাচারে এখন স্বজনডাঙ্গায় ঘর বেঁধেছে।
কাঁকন সমীরকে দেখে দাঁড় করাল।
“কি রে? তুই যে কেলেঙ্কারী বাঁধিয়েছিস। জগৎ দত্তের মেয়েকে নিয়ে কেটেছিস তুই? সারা এলাকায় যে ঢ্যারা পড়ে গেছে।”
সমীর কিছুটা অবাক হল। এরমধ্যেই স্বজনডাঙ্গায় খবর এসে গেছে! মুশকিলের ব্যাপার তো। নাহ, ঝিমলির মা’কে জানিয়ে আসাটাই বোধহয় কাল হল।
কাঁকন বলল, “খবর আছে ব্রিজের কাছে জগৎ দত্তের লোকেরা তোকে ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে গেলে যে ধরা পড়বি। সব নাকি দাঁ, শূল নিয়ে খাঁড়া। পেলেই তোর গলা নামিয়ে দেবে।”
সমীর ঢোক গিলল। “বাঁচিয়ে দাও কাঁকনদা। তোমার উপগার মরণ অবধি মনে থাকবে।”
কাঁকন মাঝি একটু ভাবল। তারপর বলল, “স্বজনডাঙ্গা পেরোতে হলে তো ওই এক ব্রিজই রাস্তা। তবে এক কাজ করতে পারিস। পটাশ ছাউনির ভেতর দিয়ে যদি যাস, একখান সাঁকো আছে। একটু ঘুরপথ পড়বে। তবে ওইদিক দিয়ে আজকাল আর কেউ যায় না।”
সমীর হাতজোড় করে বলল, “বাঁচালে কাঁকনদা। মনে রাখব তোমার কথা। পটাশ ছাউনি উইদিকে তো?”
“হ্যাঁ। বাহ, বৌমা খুব মিষ্টি হয়েছে। এই অ্যাতোটুকু দেখেছিলাম। বজ্জাত বাপের কড়ে আঙ্গুল ধরে আসত। বাচ্চা মেয়ে।”
সমীর লাজুক হেসে বলল, “সারা রাত ঘুমায় নাই। তাই এখন একটু চোখ লেগে গেছে। ডেকে দেব?”
কাঁকন শশব্যস্ত হয়ে বলল, “না না, ঘুমোক ঘুমোক। বড়লোকের মেয়ে তো। অ্যাতো হ্যাঁপা পোষায় নাকি। আদরযত্নে রাখিস রে। ভাব ভালবাসা বেশিদিন টেকে না কিন্তু। অভাবের বড় জ্বালা…”
সমীর মাথা ঘুরিয়ে একবার তাকাল ঝিমলির দিকে। কী নিষ্পাপ এ ঘুমিয়ে থাকা। কী শান্তির এ নিদ্রা। মৃত্যুর আগে যেন সারা পৃথিবীর মানুষ এ সুখ পায়। কী সুখ এখন তার মনেও। বহু কষ্টের অবসানের পর শান্তির পৃথিবী মাত্র এক সাঁকো দূরে…
সমীর বিদায় জানাল। পাড়ি দিল পটাশ ছাউনির পথে। কাঁকন মাঝি স্নেহের চোখে দেখল সে পানে খানিকক্ষণ। তারপর চেঁচিয়ে বলল, “তবে সাবধানে চালাস। সাঁকোটা বড় দুর্বল…”
৬
আজ ঘুমটা একটু তাড়াতাড়িই ভাঙ্গল গফুরের। বিছানা থেকে নেমে দেখে মেয়েটা পড়ার বইয়ের ওপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশের পিদিমটা জ্বালানির অভাবে মনখারাপ করে কখন নিভে গেছে কে জানে! গফুর সে দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। নাহ, আজ আর কষ্ট হচ্ছে না। আজ বড় সুখের দিন। ছোট সাহেব গতকাল হাজার দশেক টাকা দিয়েছে। এত টাকা কিসে লাগবে বুঝে উঠতে পারেনি সে এখনও। তবে সবার আগে বিদ্যুৎ আনতে হবে বাড়িতে। রাতে পড়াশুনা করতে রুনার আর কষ্ট হবে না। কিন্তু গোপালপুরে বিদ্যুৎ এনেও কি খুব একটা লাভ হবে? একটু দূরেই হৃদয় মণ্ডলের বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে। তা সে নাকি অর্ধেক দিনই থাকে না। দেখা যাক কী করা যায়…
গফুর মাজন সেরে নিয়ে রুনাকে ঘুম থেকে তুলল। ছোট সাহেব বারবার বলে দিয়েছে আজ রুনাকেও আনতে সাথে। দুপুরের কাজের শেষে ছোট সাহেবের বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া। ছোট সাহেবের বাবা মাও নাকি খুব ভাল মানুষ। তারা রুনাকে দেখলে খুশি হবে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই জয়ন্ত পৌঁছে গেল গফুরের বাড়ি।
“কী গফুর মিঞা? তৈরি তো?”
“জী সাহেব। রুনা কাপড় পরছে। মজুরদের খবর দিয়ে দিয়েছি। তারা অপেক্ষা করছে বুড়ো মালি বাগানের সামনে।”
“তাহলে আর দেরি কেন? বেরিয়ে পড়া যাক সদলবলে। বাবা খুব অবাক হবে কিন্তু।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বেরিয়ে পড়ল গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। মাথার ওপর তখন ঝিমিয়ে রয়েছে সূর্য। গফুরের বুকে আজ আর কোনও দীর্ঘশ্বাস নেই, ঠোঁটের কোণে লেগে রয়েছে হারিয়ে যাওয়া হাসি…
বলরাম নির্ভয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলেন একমনে। ঘরে কণিকাবালা ভাত বসিয়েছে। গরম ভাতের মিঠে গন্ধ বয়ে আসছিল নাকে। আজ সকালে রোদ্দুর নেই তেমন। ঘোলাটে আকাশ কিসের বার্তা বয়ে আনছে কে জানে। আচমকা একটা হইহুল্লোড়ের আওয়াজ শুনে চমকে উঠলেন বলরাম। মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন একদল লোক আসছে এদিকেই। ব্যাপারখানা কী? সবার সামনে কালো মতন লোকটার পাশে ওটা কে? জয়ন্ত না?
জয়ন্তই এগিয়ে এল বলরামের কাছে। হাসিমুখে বলরামের হাতদুটো ধরে বলল, “তোমার বান্ধবীর চিকিৎসা করতে এলাম…”
বলরাম অবাক হয়ে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে জিজ্ঞেস করল, “মানে? এরা কারা সব? কে বান্ধবী?”
“এরা মজুর বাবা। আর ইনি গফুর মিঞা। এর তত্ত্বাবধানেই সাঁকোর মেরামতি হবে আজ থেকে। দু’দিনে আবার শক্তপোক্ত হয়ে উঠবে সাঁকোটা। আর এইটি হল গফুর মিঞার মেয়ে রুনা। খুব ভালো পড়াশুনায়। তোমাদের দেখতে এসেছে।”
বলরাম আনন্দে কেঁপে উঠলেন যেন। রুনার গালে হাত বুলিয়ে বললেন, “বেঁচে থাকো মা। খুব বড় হও।” তারপর জয়ন্তর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এনারা দুপুরে খাবেন তো?”
জয়ন্ত বলল, “হ্যাঁ বাবা, গফুর মিঞা আর রুনা এখানেই খাবে। তুমি রুনাকে সাথে রাখো। আমাদের কাজে নামতে হবে…”
বলরাম রুনাকে চেপে রইলেন। গফুর গর্বের চোখে একবার তাকাল মেয়ের দিকে। তারপর শশব্যস্ত হয়ে জয়ন্ত ও মজুরদের নিয়ে এগিয়ে গেল সাঁকোর দিকে।
কণিকাবালা চোখ বড় বড় করে এগিয়ে এলেন বলরামের দিকে।
“খোকা না? এরা কারা সব? কী জন্য এসেছে?”
বলরামের চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। একদল ব্যস্ত শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “খোকার লোকজন। বাবার শেষ ইচ্ছা পুরণ করতে এসেছে…”
কণিকাবালা অবাক হয়ে সমস্ত কাণ্ডকারখানা দেখতে থাকলেন। বলরাম বললেন, “তুমি তাড়াতাড়ি রান্নাবান্না করো। এটি হচ্ছে রুনা। গফুর মিঞার মেয়ে। খোকার বন্ধু উনি। ওরা দুপুরে এখানেই খাবে।”
কণিকাবালা যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন, “গফুর মিঞা! মুসলমান? মুসলমান খাবে আমাদের পাতে?”
বলরাম মাথা নীচু করলেন। বললেন, “ওনার মনে হয় না তাতে কোনও অসুবিধে আছে। তুমি রান্না বসাও।”
কণিকাবালা মুখ কালো করে চলে গেলেন ভেতরে। বলরাম বাবু হয়ে বসলেন। রুনা তার দিকে চেয়েছিল। বলরাম তার একটা হাত ধরে বললেন, “কিসে পড়ো মা?”
“ক্লাস টেনে। এবার মাধ্যমিক দেব…”
“বাহ, বাড়িতে কে কে আছে?”
“বাবা আর দাদা।”
“তোমার বাবা কেমন লোক?”
“খুব ভালো।”
“বাহ, তুমি বাড়িতে ভালো মেয়ে হয়ে থাকো তো?”
“হ্যাঁ থাকি তো। আমাদের বেশি পয়সা নেই। তাই খুব কষ্ট। বাবা বলেছে ভাল হয়ে না থাকলে আরও কষ্ট হয়…”
বলরাম সাঁকোটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, “জানো ওখানে কী হচ্ছে?”
রুনা মাথা নাড়াল।
বলরাম বললেন, “এই যে সাঁকোটা দেখছ, ওর খুব সাহস। অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। আজ তাই হাঁপিয়ে গেছে। সেইজন্য তোমার বাবা আর আমার ছেলে ওকে সারিয়ে তুলছে।”
রুনা জিজ্ঞেস করল, “তার মানে ওর আর কোনও কষ্ট থাকবে না?”
“না, আবার কষ্ট পাবে। আবার সেরে উঠবে। সবাই কষ্ট পায়। সেরেও ওঠে। দরকার শুধু সাহসের। ওর নাম তাই ‘নির্ভয়া’। তুমিও সাহস রাখো। তোমার সব কষ্ট একদিন সেরে যাবে।”
রুনা বলরামের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে আমার নামও নির্ভয়া হবে?”
বলরাম হাসিমুখে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তখনই একটা কানফাটা আওয়াজ এল। চারিদিকের সৌন্দর্য, নিস্তব্ধতা, আন্তরিকতা সব ধুলিসাৎ করে দেওয়া আওয়াজ। বলরাম চমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর ছুটে গেলেন সাঁকোর দিকে।
প্রচণ্ড কুয়াশার পর যেমনভাবে শীতের পরশ তেমন আর গায়ে লাগে না, বসন্তের শুরুতে দখিনা হাওয়া যেভাবে পুরনো কিছু গন্ধ দিয়ে যায়, দমফাটা গরমেও কখনও যেমন গায়ে শীতকাঁটা দিয়ে ওঠে, সেরকম একটা অনুভূতি ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। কিছু আর্তনাদ পল্লীগানের মতন ভেসে আসছে নীচ থেকে। বুনো ঝোপঝাড়ের উপর চুঁইয়ে পড়া রক্ত আলপনা এঁকে দিচ্ছে পরম নিষ্ঠার সাথে। ওপারের একটা নুয়ে থাকা শিকড়ে আটকে আছে একটা লালরঙা শাড়ির ছেঁড়া আচল। অবসান হল বহু কষ্টের। বলরামের মনে হল যেন বহুদিনের বোঝা কেউ কাঁধ থেকে নিয়ে নিল তার।
হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে কেউ একটা উঠে এল ঘাস, পাতা আঁকড়ে ধরে। বলরাম তাকিয়ে দেখলেন জয়ন্ত। সারা গায়ে কাঁটা ছেঁড়ার চিহ্ন। কপাল থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।
“বাবা তুমি সরে দাঁড়াও। এক্ষুণি অ্যামবুলেন্স ডাকতে হবে। বেশ কয়েকজন মারা গেছে। একটা রিকশা, একটা লাল শাড়ি পরা মেয়ে, উফফ কি যে হল, বুঝতে পারছি না কিছু…গফুর মিঞা…”
জয়ন্ত রুনার দিকে তাকাল। ভয়ে মেয়েটার মুখখানি এতটুকু হয়ে গেছে।
জয়ন্ত বলরামের দিকে তাকিয়ে বলল, “গফুর মিঞা নেই। আমার হাতেই মারা গেলেন। তুমি রুনাকে সামলাও। আমি আসছি…”
চোখের সামনে এক অসীম শূন্যতা। আর্তনাদের কোলাহল, পিছন থেকে কণিকাবালার কান্না, দূরে কোথাও শাঁখের আওয়াজ সব মিলিয়ে কিছু যেন একটা তৈরি হচ্ছে। বলরাম রুনার দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, ওই তো, ওই তো তৈরি হচ্ছে আরেকটা সাঁকো। আরেকটা নির্ভয়া…
কণিকাবালার কান্না থামছিল না। আরও দু’তিনজন নীচ থেকে উঠে এসেছিল উপরে, রক্তাক্ত হয়ে। তারা দেখল কমলা রঙের একটা আকাশ, পাথুরে জমি, সেখানে হাতে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে এক বৃদ্ধ আর এক বালিকা। নীচে পরম তৃপ্তিতে ঘুমিয়ে আছে এক সুখী দম্পতি। এদের কারোরই দুঃখ, কষ্ট, চিন্তা, ভয়ডর কিচ্ছু নেই, আছে চাওয়া ও পাওয়ার মাঝে মাত্র এক সাঁকো দূরত্ব…
(ছবি-সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়)