শ্রীরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়
নিবন্ধকার, সমাজকর্মী
মহা আড়ম্বরে উদযাপিত হল ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’৷ শুধু কি একদিনের মহোৎসব, আমরা রয়েছি রীতিমতো ‘অমৃতকাল’-এ! গত বছর ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, স্বাধীনতার শততম বছর পর্যন্ত আগামী ২৫ বছর ধরে চলবে এই ‘অমৃতকাল’৷
এদিকে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-এর ২০২১ সালের রিপোর্ট বলছে, সবচেয়ে ক্ষুধাতুর ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০১ নম্বরে৷ আগের বছর দেশ ছিল ৯৪ নম্বরে৷ যে দ্রুতহারে নিম্নগতি ঘটছে, তাতে খুব শিগগিরই অন্তিম স্থানটি আমরা দখল করব, এ কথা বলাই যায় বোধহয়৷
কিন্তু সাবধান! স্বাধীনতার পরম পবিত্র ‘অমৃতকালে’ এ সব নিয়ে কোনও কথা বলবেন না যেন! এক্ষুণি দেশদ্রোহের দায়ে জেল হতে পারে৷ বরং খুশি মনে যোগ দিন স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’-এর উল্লাসে৷ দেশভক্তি জাহির করতে তিনদিন ধরে প্রত্যেক ভারতবাসীকে প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঘরে জাতীয় পতাকা তুলতে বলেছেন৷ দেশের যে ২০ কোটি মানুষের থাকার কোনও ঘরই নেই, তারা পতাকা তুলবে কোথায়— ভুলেও কিন্তু সে প্রশ্ন তুলবেন না৷ মনে রাখবেন, আমরা রয়েছি স্বাধীনতার পরম পবিত্র ‘অমৃতকালে’৷ মানুষের ভালোই তো চান দেশের শাসকরা! আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘এফএও’–র হিসাবে দেশের যে চরম দরিদ্র ১৯ কোটি মানুষের পেটভরা খাবার জোটে না, এই মোচ্ছবে হয়ত তারা কাঙালিভোজনের সারিতে বসে ভালমন্দ খেতে পাবে৷ উৎসবে মাতিয়ে কোটি কোটি বেকার তরুণ–তরুণীকে, ছাঁটাই হওয়া কোটি কোটি মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও হয়ত বেকারত্বের যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়া যাবে। ঋণের দায়ে জর্জরিত চাষি ভুলতে পারবে ফসলের দাম না পাওয়ার দুশ্চিন্তা৷ কোটি কোটি অভিবাসী শ্রমিক, একশো দিনের কাজ না পাওয়া অসংখ্য ঠিকাকর্মী, এমনকী খাবার জোটাতে শরীর বেচতে বাধ্য হওয়া নারী— একদিনের জন্য হলেও সকলকেই মাতিয়ে তোলা যাবে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে৷ কী আনন্দ! দেশ জুড়ে বেশ বইতে থাকবে খুশির হাওয়া!
কীসের খুশি জানতে চাইছেন? কেন, অমৃতকালে অমৃতের কি ঘাটতি পড়েছে? দেশের হাতে গোনা পুঁজিপতির ভাগ্যে দেদার অমৃত কি জোটেনি? সরকার তো এঁদেরই জগৎসভায় ভারতের মুখ মনে করে! তাই এই অমৃতকালে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বদান্যতায় অমৃতের ভাণ্ড লুটে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর পরম ‘মিত্রোঁ’ সেইসব শিল্পপতিরাই। বিশ্বের কাছে তাঁরা যাতে দেশের মুখোজ্জ্বল করতে পারেন, সে জন্য দেদার আইনি-বেআইনি সুযোগসুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁদের। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ব্যাঙ্কঋণ আর কর মকুব করা হয়েছে। শোধ না হওয়া ১০ লক্ষ কোটি টাকার বিপুল ঋণ গত পাঁচ বছরে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে স্রেফ মুছে দেওয়া হয়েছে। কর্পোরেট করের হার ব্যাপকভাবে কমানো হয়েছে, রাজকোষের বিপুল ক্ষতি স্বীকার করেও। ফলে, গত দু-বছরে ভারতে ১০০ কোটি ডলার কিংবা তারও বেশি পরিমাণ সম্পদের মালিকের সংখ্যা পৌঁছেছে ১৪২–এ। এই কালকে শিল্পপতিরা ‘অমৃতকাল’ ছাড়া আর কী বলবেন?
এই ‘অমৃতকালে’ই এশিয়ার সবচেয়ে ধনী আদানি সাহেব বিশ্বের ধনীতমদের মধ্যে চতুর্থ স্থানে পৌঁছেছেন৷ সরকারের কাছ থেকে আদানি কী কী সুবিধা পেয়েছেন, তার তালিকা তৈরি করলে থই পাওয়া যাবে না৷ প্রধানমন্ত্রী যেসব দেশে সফর করেছেন, সফরসঙ্গী আদানি সেইসব দেশের নানা সংস্থার সঙ্গে প্রতিরক্ষা, লজিস্টিক্স ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে ব্যবসার জন্য ১৫টিরও বেশি চুক্তি করার সুযোগ পেয়েছেন। কম সুদে বিপুল পরিমাণ ঋণের জোগান দিয়েছে দেশের ব্যাঙ্ক। পুঁজিপতিদের সুবিধা দিতে নরেন্দ্র মোদি সরকারে বসার দু মাসের মধ্যে সরকারি ব্যাঙ্কগুলি ধার শোধের সময়কাল ১৫ বছর বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে আদানির কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে ৫ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছিল, আচমকা সে সবও ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রীজির পরম মিত্র আদানিজির জন্য এই তো পরম ‘অমৃতকাল’!
এই অমৃতকালেই দুনিয়ার ধনকুবেরদের মধ্যে ১১ নম্বরে থাকা মুকেশ আম্বানির দৈনিক আয় ১২২ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। রিলায়্যান্স জিও–র ব্যবসা থেকেই প্রধানত আম্বানির এই লক্ষ্মীলাভ। সেই ব্যবসা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অবদান কি ভোলার মতো! প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও রীতিবহির্ভূতভাবে জিও-র বিজ্ঞাপনে নিজের ছবি ব্যবহার করতে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। টিআরএআই-এর ওপর প্রভাব খাটিয়ে আম্বানির ব্যবসায় সুবিধা করে দেওয়া— প্রিয় ধনকুবের মিত্রটির জন্য কী না করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী! এঁদের জন্যই তো মোদিজির ‘অমৃতকাল’!
কোভিড অতিমারির সময়টাকেও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কাজে লাগিয়েছে হাতে-গোনা পুঁজিপতিদের সিন্দুক ভরাতে। ১৪টি সরকারি সংস্থাকে বসিয়ে রেখে মাত্র দুটি বেসরকারি কোম্পানিকে টিকা তৈরির বরাত দিয়ে বিপুল মুনাফার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে তাদের জন্য৷ এয়ার ইন্ডিয়ার ঋণের বোঝা জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে রেখে সংস্থাটিকে তুলে দিয়েছেন টাটাদের হাতে। ফলে দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা ছাড়াও শিব নাদার, সাইরাস পুনাওয়ালা, লক্ষ্মী মিত্তাল, সাবিত্রী জিন্দালরা ‘ফোর্বস’-এর তালিকায় শতকোটি ডলারের মালিক হিসাবে নিজেদের নাম তুলতে পেরেছেন। অমৃতের ভাগ তো জুটেছে এঁদেরই ভাগ্যে!
পুঁজিবাদী নিয়মে চলা এই রাষ্ট্রে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চরম গরিবি-বেকারি-অশিক্ষা-অসুস্থতায় ডুবে জীবনযন্ত্রণার গরলে জর্জরিত হবে, আর অল্প কয়েকজন পুঁজিমালিক বৈভবের চূড়ায় বসে সম্পদের অমৃত পান করবে— এটাই নিয়ম। সুষ্ঠুভাবে যাতে এই ব্যবস্থা চলতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব শাসক পুঁজিপতিশ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার সরকারের। কেন্দ্রের বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেই কাজটাই করে চলেছে। তাই বিপুল রাজস্ব ক্ষতি করেও পুঁজিপতিদের জন্য দেদার ছাড় দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট করে। অথচ রুজির অভাবে রুটি না জোটা মানুষের সংখ্যা দেশে ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও, গুরুত্বপূর্ণ এনরেগা প্রকল্পের অর্থবরাদ্দ না বাড়িয়ে উল্টে তা ছাঁটাই করা হচ্ছে। সেইসব খেতে না-পাওয়াদের আর্তনাদ চাপা দিতেই কি ‘স্বাধীনতার অমৃতকাল’-এর এই মহা–জৌলুস? প্রশ্নটা থাকছেই৷