নীতীশ কুমার-ছাড়া বিহার?

শঙ্কর রায়

 



প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক

 

 

 

 

জনতা দল (ইউনাইটেড)-এর প্রধান ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার প্রশ্নাতীতভাবে অতি বিতর্কিত রাজনৈতিক নেতা যিনি রাজনৈতিক ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে লক্ষণরেখা মানেন না। মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতার দড়ি-টানাটানিতে তিনি একাধিকবার এপাশ-ওপাশ করেছেন, যা বিরক্তিকর ও সে কারণে সমালোচনার্হ। কিন্তু বিহার রাজ্যে এতদিন কেউ মুখ্যমন্ত্রী থাকেননি (কয়েক মাস এক মহাদলিত নেতার মুখ্যমন্ত্রিত্ব ব্যতিরেক)। তার কারণ একটিই, হিন্দি বলয়ে যা ‘সুশাসন’ নামে পরিচিত। কারণ মুখ্যমন্ত্রী পদে তাঁর পূর্বসূরিদের অনেকে দুর্নীতির পাঁকে ডুবে গেছেন, নীতীশ কুমারের দেড় দশকের বেশি মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে তাঁর বিরুদ্ধে তেমন কোনও অভিযোগ ওঠেনি, স্বজনপোষণের অভিযোগও খাটে না তাঁর বিরুদ্ধে।

নীতীশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালের প্রথম দু বছরেই (২০০৬-২০০৮) প্রায় ৬০০০ অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৮০ জনেরও বেশি দাগি আসামিকে আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে, যা ভারতের কোনও রাজ্যেই ঘটেনি। পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন বাম সরকারও পারেনি এত দাগি আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড রায়ের প্রয়াস নিতে। এ নয় যে বাম-শাসনকালে দাগি আসামি ও খুনি এ রাজ্যে ছিল না। জ্যোতি বসু যখন মুখ্যমন্ত্রী এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্বরাষ্ট্র ও তথ্য-সংস্কৃতিমন্ত্রী, বিধানসভায় প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলা হয় যে বামফ্রন্ট আমলের প্রথম বিশ বছরে ২৮০০০-এরও বেশি মানুষ খুন হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক হত্যা। প্রাক্তন রাজ্যসভা সদস্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার এই তথ্য লিখিতভাবে বলেছেন ও সেই নিরিখে দাবি করেছিলেন যে বামফ্রন্ট আমলে ৫৫০০০-এরও বেশি মানুষ খুন হয়েছেন।

বিহারে খুনের হার এর চেয়েও বেশি— হিন্দি বলয়ের ওয়াকিবহাল সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের এমনই ধারণা— অন্তত নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে যা দেখেছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে বিহার সম্পর্কে এই ধারণা বাস্তব। পাটনায় ১৯৯০-দশকের মাঝামাঝি যেতে হয়েছিল সাংবাদিকতার কাজে। তিনতারা হোটেলে ছিলাম। হোটেলের সবাই বলেছিলেন যে রাত আটটার মধ্যেই হোটেলে ফিরতে, কারণ তারপরে রাজধানী পাটনাও রক্তচোষা সমাজবিরোধীদের দখলে চলে যায়। সাড়ে সাতটার মধ্যেই হোটেলে ফিরলাম। রাত নটার আগেই বোমা-বন্দুকের আওয়াজ ও ভয়ার্ত চিৎকার। একটি আঞ্চলিক হিন্দি দৈনিকের ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল পাটনায় আসার পথে। বলছিল পাটনায় রাত কাটানোর ঝুঁকির কথা, কারণ কিছু কিছু হোটেল গুণ্ডা-সমাজবিরোধীরা চালায়। আমি তাকে বললাম, আমার সঙ্গে থাকতে পারে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাজি হল। ছেলেটি প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণে যায়। সেদিন বেরিয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যেই কাঁপতে কাঁপতে ফিয়ে এল। অদূরেই সে দেখেছে দুটো কাটা হাত পড়ে আছে। সেই পাটনায় ২০০৯ সালে গেলাম কোশী নদী পরিক্রমায়। প্রসিদ্ধ নদীবিশেষজ্ঞ ডঃ দীনেশ মিশ্রের আমন্ত্রণে। রাত দশটায় দেখলাম মহিলারাও নিরাপদে পাটনা শহরে। নীতীশ কুমারের সুশাসনের আঁচ পেলাম।

সুশাসন মানে গুণ্ডা ও সমাজবিরোদীদের শায়েস্তা করাই নীতীশ কুমারের একমাত্র সাফল্য নয়। তাঁর পরিচালিত সরকার ২০১০ সালের মধ্যেই দুটি আইন পাশ করিয়েছিল, যা ভারতে অভূতপূর্ব। একটি হল স্পেশাল কোর্ট অ্যাক্ট, ২০০৮— যার বলে, যদি কোনও সরকারি আধিকারিক/কর্মচারীর বার্ষিক ব্যয় তার ঘোষিত বার্ষিক আয়ের চেয়ে বেশি হয়, তার স্থাবর সম্পদ (প্রধানত রিয়েল এস্টেট) সরকার বিনা ক্ষতিপূরণে বাজেয়াপ্ত করতে পারে। আর সেই ব্যবহৃত বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি লেখাপড়া তথা স্কুলের জন্য বা শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত হবে। সেইমতো অনেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে গত দশ বছরে। অন্যটি পরিষেবার অধিকার আইন (রাইট টু সার্ভিস অ্যাক্ট ২০১১)। এই আইন অনুসারে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে জাত, চরিত্র, চিকিৎসা বা জন্ম বা মৃত্যুর শংসাপত্র ও পাসপোর্ট আবেদন পাবার এক/দেড় মাসের মধ্যে প্রদান করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট অধিকারী কর্মচারীর আর্থিক জরিমানা হবে যা বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে। এই আইন অন্য কোনও রাজ্যে অচিন্তনীয়। বিজেপি পরিচালিত মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ইত্যাদি দলিত অধ্যুষিত রাজ্যেও নয়।

নীতীশ কুমার ২০১০ সালে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড দৈনিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এই আইনগুলির কথা। বলেছিলেন দুর্নীতিবিরোধী আইন প্রণয়ন ও চালু করার কথা। এই আইনের বলে রাজ্য সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে স্কুলে পরিণত করতে পারে। “আমরা বিশেষ আইন প্রণয়ন এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ বিধান প্রণয়নে সক্রিয়। আমরা একটি পরিষেবার অধিকার বিলের খসড়া তৈরি করছি (রাইট টু সার্ভিস অ্যাক্ট ২০১১)। স্থানীয় সংস্থায় দুর্নীতি দমনে লোকপাল নিয়োগ করার কথা ভাবা হচ্ছে। আমরা দুর্নীতি দমনের একটি কাঠামো গড়তে চাই।” ওই সাক্ষাৎকারে নীতীশ কুমার জাতপাতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের রূপরেখাও ব্যাখ্যা করেছিলেন।

এই প্রেক্ষাপট মনে রাখলে বিহারে জনতা দল (ইউনাইটেড)-এর ভারতীয় জনতা দল (বিজেপি)-র সঙ্গে গাঁটছড়া ছিন্ন করে লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) সঙ্গে আরেকবার মৈত্রী বন্ধন করে নতুন সরকার গঠনের তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে। লালু-পুত্র তেজস্বী যাদব উপ-মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন ও আরজেডি দলকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছে, নীতীশ কুমারের দলের চেয়েও আরজেডি প্রাধান্য পেয়েছে। আগামী তিন বছর আরজেডি দলের অগ্নিপরীক্ষা। যার অর্থ সুশাসন কায়েম করা। আরজেডি দলের অতীত রেকর্ড অবশ্য ভালো নয়, সেই দুর্নাম ঘোচানোর কাজ আরজেডি মন্ত্রীদের ঔচিত্য।

নীতীশ কুমারের এই মহাগঠবন্ধন ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিরোধী দলের পক্ষে খুব ইতিবাচক। প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে উপযুক্ত মনে করেন— প্রাইম মিনিস্টার মেটেরিয়াল। তিনি অবশ্য বলেই দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রিত্ব তাঁর লক্ষ্য নয়। কিন্তু অনেকের (যাঁরা চান নরেন্দ্র মোদি রাজত্বের অবসান হোক) কাছে নীতীশ কুমারেরই প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত। সেটা অবশ্য পরের কথা। এখন এই মোর্চা গড়া বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক সমাবেশকে জোরদার করার প্রথম সোপান।

অনেকের মনে থাকার কথা যে, নীতীশ কুমারই একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী যিনি ১৯৭৪-৭৫ সালে লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ ঘোষিত ‘ভ্রষ্টাচার’-বিরোধী কর্মসূচি রূপায়ণে দায়বদ্ধতা কাজে-কর্মে দেখিয়েছেন। তিনি কাগজেকলমে ন্যাশনাল ডেমক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) সরকার চালালেও তাঁর সরকার অন্য কোনও এনডিএ প্রাদেশিক সরকারের পথেই চলেনি। আর নীতীশ কুমার নিম্নবর্গের কথা সীমিতভাবে হলেও ভেবেছেন, ভাবেন এবং কাজেও রূপায়ণ করতে চেষ্টা করেছেন।

বিরোধীরা (বিশেষত কংগ্রেস ও বামেরা) গত দশকে তাদের প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ হারিয়েছে। তারা ক্রমাগত দাবি করতে পারত ওই দুটি আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর করা হোক। কারণ আমলাতন্ত্র এতই কায়েমি যে আইন দুটি কার্যকর করা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

নীতীশ কুমার এই মহাগঠবন্ধন ঘোষণার পরে তিন কমিউনিস্ট দল— সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন, সিপিআই(এম) ও সিপিআই দল নীতীশ কুমারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। লিবারেশন-এর ১২ জন এবং সিপিআই(এম) ও সিপিআই উভয়ের দুইজন করে বিধায়ক আছেন বিহার বিধানসভায়। লিবারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য ১২ জন দলীয় বিধায়ক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন, বৈঠকও করেছেন। নীতীশ কুমার তাঁদের জানিয়েছেন, নতুন সরকার উপর থেকে তদারকির জন্য একটি কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করবে।

দেখা যাক এই নিরীক্ষা কোনদিকে ও কতদূর যেতে পারে। তবে অনেকেই আশাবাদী। স্মরণ থাকতে পারে, ২০১৩ সালে বিজেপির চিন্তন বৈঠকে যখন তদানীন্তন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করার সিদ্ধান্ত হয় (২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে দল নিশ্চিত ছিল কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স সরকারের পরাজয় ঘটতে চলেছে), নীতীশ কুমার প্রকাশ্যে আপত্তি জানিয়েছিলেন।

সুতরাং নীতীশ কুমার গোড়া থেকেই নরেন্দ্র মোদিকে মেনে নিতে পারেননি। শুনেছি, নিজের খুব কাছের কয়েকজনকে বলেছিলেন যে ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় মোদিজির প্রথম দু-তিনদিন নিষ্ক্রিয় থাকার কথা আগে জানলে তখনই তাঁর মতো একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রতিবাদ করতেন। নীতীশ কুমার মোদির মত মুসলমানদের দাবিয়ে রাখা ও সন্ত্রস্ত করার পক্ষে ছিলেন না, বরং বিরোধীই ছিলেন। পাশাপাশি একথাও বলা যাবে না যে নীতীশ কুমার ভাবনার দিক থেকে সঙ্ঘী ভাবধারার জন্য পরিচিত ছিলেন না। বিহারে ১৯৭৪-৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধি-অপসারণ আন্দোলনে সামিল হওয়ার আগে থেকেই সোশালিস্টদের মধ্যে থেকে তিনি যখন রাজনৈতিক পরিপক্কতা অর্জন করেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতাবাদ থেকে দূরে থেকেছেন ঠিকই, কিন্তু জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বাধীন এই সংগ্রামে জনসঙ্ঘী সুশীল মোদি তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, যেমন ছিলেন লালু যাদব। আগামী দিন বলবে, এই রাজনৈতিক পরিপক্কতা কি শুধুমাত্র নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ার উজ্জ্বল করার কাজেই ব্যবহার করবেন নীতীশ, নাকি দেশজুড়ে ফ্যাসিস্ট শাসকবিরোধী শক্তির সফল সমীকরণ নির্মাণে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও থাকবে?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...