অর্পণ গুপ্ত
ক্রীড়াপ্রেমী, গদ্যকার
‘ভাল মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে…’— এমন প্রবল দায় কাঁধে চাপিয়ে বড় বিড়ম্বনায় ফেলে গেছেন রবি ঠাকুর। সত্যকে এত সহজ করে নেওয়া সহজ নয়। ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ (এমন এককেন্দ্রিক ভাষার আগ্রাসনেই ভারতের স্বাধীনতা উদযাপনের স্লোগান বেঁধেছেন দেশের কেষ্টবিষ্টুরা)-এর হুল্লোড়ের মাঝে ময়দানে নেমে আসে শেষ শ্রাবণের মেঘ। ময়দান এখানে গড়ের মাঠ পেরিয়ে হায়দ্রাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম, মণিপুরের পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট সবুজ মাঠ অবধি একটা বৃত্ত জুড়ছে কেবল। আজকাল মনে হয় এই উপমহাদেশের ফুটবল এক রহস্য। ১৯২৮ সালে আমস্টারডাম অলিম্পিকে দেশ থেকে হকি দল পাঠানোর জন্য যে ফুটবল ক্লাবদের শরণাপন্ন হতে হয়, সেই দেশেই একশো বছর পর নেমে আসে ফিফার ব্যান। অবশ্য এই একশো বছরে দেশের ফুটবল যে অতলে তলিয়ে গেছে তা নিয়ে সংশয় নেই। তাই ফিফার এই ব্যান আকস্মিক ঘটনা নয়, বিচ্ছিন্ন সঙ্কটও নয়, একটি ধারাবাহিক প্রবাহের নিয়তি। তুলসীদাস বলরামের একটি সাক্ষাৎকার মনে পড়ছে খুব। এশিয়াডজয়ী ভারতীয় দলের কিংবদন্তি স্ট্রাইকারের নাম পদ্মশ্রীর জন্য মনোনীত হয় নয়ের দশকের গোড়ায়। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুতির সময়ে কোনও অজ্ঞাত কারণে বাদ পড়ে যান তিনি। নিশ্চুপ ত্থাকেন দেশের ফুটবলকর্তারা। পড়ে থাকে কিছু ইতস্তত দীর্ঘশ্বাস— “আমি তো পদ্মশ্রী নই। দেশের ফুটবলকে সব দেওয়ার পরেও আমাদের নিয়তি এই…”
‘থাকে শুধু অন্ধকার’। দেড়শো বছরের ইতিহাসের মুখোমুখি বসিবার আগে একটি আদালতের সওয়াল-জবাব দৃশ্যের দিকে ফিরে যাই। জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের ডিভিশন বেঞ্চে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের আইনজীবী গোপাল শঙ্করানায়ানান জানাচ্ছেন ভারতীয় ফুটবলের জন্মলগ্ন থেকে কতজন খেলোয়াড় (পুরুষ ও মহিলা) দেশের হয়ে খেলেছেন ফেডারেশনের কাছে তার কোনও সুস্পষ্ট তালিকা নেই! কোনও এমন ডেটাবেস নেই যেখান থেকে একটি তালিকা প্রস্তুত করে নেওয়া যায়। এমন স্টেটমেন্ট আজকাল আর অবাক করে না। তবে বাধ্যবাধকতা কিছু থেকে যায়। কোর্টের আদেশে তৈরি হয় একটি অসম্পূর্ণ তালিকা যেখান থেকে অবলীলায় বাদ পড়ে যান ঐনেম বেমবেম দেবীর মতো ফুটবলার যাঁর ঝুলিতে রয়েছে পদ্মশ্রী ও অর্জুন পুরস্কার।
মাস তিনেক ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাই। প্রফুল্ল প্যাটেল ও ফেডারেশনের সমস্ত আধিকারিকদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট। সঙ্গত কারণ অবশ্যই ছিল। ২০২০ সালেই হিসেবমতো প্রফুল্ল প্যাটেলের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফিফার সংবিধান অনুযায়ী ফিফার অনুমোদন পাওয়া প্রতিটি দেশেরই ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থাকে ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাদের নিজস্ব নিয়মানুযায়ী (ফিফার অনুমোদন সাপেক্ষে) গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করতে হবে। ফেডারেশন ২০২০ সালের পর থেকে কোভিডের কারণ দেখিয়ে স্থগিত রাখে নির্বাচন প্রক্রিয়া। ক্ষমতাসীন থেকে যান প্রফুল্ল প্যাটেল। ফলে ফিফার সংবিধান লঙ্ঘন বিপদ ডেকে আনতে পারে ভেবে সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নেয় প্রফুল্লের কমিটিকে অপসারণের। গড়া হল কমিটি অফ আডমিনিস্ট্রেটর্স (সিওএ)। তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় এআইএফএফ-এর সমস্ত কাজ দেখার। সংস্থার নতুন নিয়ম তৈরি করার দায়িত্বও দেওয়া হয় তাদের। সেইমতো সিওএ জানায় সেপ্টেম্বরেই ফেডারেশনের নতুন সংবিধান কার্যকর হবে। এর কারণ অবশ্যই অনূর্ধ্ব-সতেরো মহিলা বিশ্বকাপ। ভারতের মাটিতে আয়োজিত হতে চলা এই ফিফা ইভেন্টের আগেই ফেডারেশনের নতুন সংবিধান ও নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ না হলে ফিফার রোষানলে পড়তে হতে পারে এআইএফএফ-কে।
কিন্তু এক্ষেত্রে এসে যায় একটি বড় প্রশ্ন, ক্রিকেটে বিসিসিআই-এর অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দুর্নীতিকে এককথায় মেনে নিয়েই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গড়া হয়েছিল লোধা কমিটি। ফুটবল ফেডারেশনের এই ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতা তো নতুন নয়, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির আমলের অনেক আগে থেকেই ফেডারেশন একের পর এক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। তবে এই অসহায়তা স্বীকার করে নিতে এত দ্বিধাগ্রস্ততা কেন? বেশিদূর তাকানোরর দরকার নেই। ২০২২ এশিয়ান উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে বায়ো-বাবল ব্রিচ হল। ভারতের স্বপ্ন শেষ। একসঙ্গে উনিশজন কোভিড-আক্রান্ত হলেন। ফেডারেশন-এএফসি দোষ চাপানোর খেলা চলল কিছুদিন। অথচ ফেডারেশনের এক কর্তা কার্যত মেনে নিতে বাধ্য হলেন যে দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় পাঠানো দল, তাই ফেডারেশনের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতীয় ক্রীড়ামন্ত্রক এই ক্যালেন্ডারবর্ষে এআইএফএফ-কে পরিষ্কারভাবে জানায় তাঁদের খারাপ পারফরমেন্সের কথা এবং এই মর্মে জাতীয় ফুটবলে পঁচাশি শতাংশ বিনিয়োগও কমিয়ে দেয়। নোটিসে স্পষ্টভাবে তারা জানায় তৃণমূল স্তরে ফুটবলের কোনও আশাপ্রদ উন্নতি তারা দেখতে পাচ্ছে না।
প্রফুল্ল প্যাটেল মে মাসের শেষে তার কমিটিকে বরখাস্ত করার পর ফিফা প্রেসিডেন্টকে একটি চিঠিতে স্পষ্টভাবে লেখেন তার কমিটির অপসারণের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের কথা। কিন্তু নিজের পিঠ বাঁচাতে এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে ফিফা যাতে ভারতকে ব্যান না করে সেই অনুরোধও জানান।
প্রফুল্লের চিঠির পর গত একুশে জুন ফিফা ও এএফসি-র প্রতিনিধিদল এল ভারতে। সিওএ-র সদস্যদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর গঠিত হয় একটি উপদেষ্টা কমিটি যারা নিয়মিত রিপোর্ট পাঠাবে সিওএ-কে। এআইএফএফ-এর এই সমস্যায় সুপ্রিম কোর্টের হস্তুক্ষেপ ছিল জরুরি, কিন্তু একাধারে তা-ই আবার ফিফা সংবিধান-বিরুদ্ধ। ফলে কার্যত জড়ভরত হয়ে যাওয়া ফেডারেশনের দু-নৌকোয় পা দিয়ে চলার নীতি ভেঙে পড়াই ছিল নিয়তি। ফিফা ও এএফসি কর্তাদের সঙ্গে মিটিং-এ স্থির হয় তিনটি কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে ফেডারেশনকে—
- তাঁদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা।
- একটি সর্বসম্মত সংবিধান চালু করা।
- এই সংবিধানকে দেশের প্রতিটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ফুটবল নিয়ামক সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত করা।
এক্ষেত্রে শুরু হল নতুন সমস্যা। রাজ্যের ফুটবল ফেডারেশনগুলির সঙ্গে এআইএফএফ-এর অম্লমধুর সম্পর্ক নতুন নয়। ফলে এই সংবিধানের স্বীকৃতি ও প্রণয়নের জন্য প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি বেছে নিতে রাজ্যের প্রাক্তন খেলোয়াড়দের নাম চাওয়া হল। শুরু হল গোলমাল। কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে পড়ল কেউটে। রাজ্যস্তরেও নেই কোনও প্রাক্তন খেলোয়াড়দের ডেটাবেস, না আছে দেশের হয়ে খেলা খেলোয়াড়দের রাজ্যভিত্তিক তথ্য। এ লেখার গোড়ায় যে বেমবেম দেবির ঘটনার কথা বলা হয়েছে, এই ঘটনায়, জুলাই মাসে, কোর্টের শুনানির সময় তা জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের ডিভিশন বেঞ্চের সওয়াল-জবাবের একটি দৃশ্যপটমাত্র!
এর মাঝে সিওএ ফিফাকে সরাসরি নালিশ জানায় প্রফুল্ল প্যাটেলের অযাচিত হস্তক্ষেপের বিষয়ে। বরখাস্ত কর্তা প্রফুল্ল-র পিছনে সুস্পষ্ট হাত এফএসডিএল-এর। এর ঠিক আগেরদিনই ফিফা এআইএফএফ-কে বরখাস্ত করার হুমকি দিয়ে মেইল করে সুনন্দ ধরকে (প্রফুল্ল প্যাটেলের নির্বাচিত এআইএফএফ সেক্রেটারি জেনারেল)। সুনন্দ এই মেইল মিডিয়ার সামনে ফাঁস করতেই নড়চড়ে বসে জাতীয় মিডিয়া। আচমকা অচলায়তনে হুল্লোড়। সে-ও ক্ষণিকের। দেশ তখন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির নেশায় মশগুল। সিওএ ফিফাকে জানায় যে আগস্টের শেষেই নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ করবে তারা, অন্যদিকে এও পরিষ্কার হয়ে যায় যে এআইএফএফ-এর যা অবস্থা তাতে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ ছাড়া তাদের পক্ষে কমিটি গঠনও সম্ভব না। ফিফার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন তাই কার্যত অসম্ভব। ফলে, পনেরোই আগস্ট মধ্যরাতে নেমে এল সেই অন্ধকার। ভারতকে ব্যান করল ফিফা!
ময়দানে কানপাতলে ইতিউতি শোনা যায়, টাকার পাহাড়ে চাপা পড়ে গেছে ময়দানের কত চিনাঘাস। উয়াড়ি ক্লাবের পাশ দিয়ে, এরিয়ান তাঁবুর তলায়, রাজস্থান ক্লাবের মাঠ ডিঙিয়ে ভেসে বেড়ায় দীর্ঘশ্বাস। হায়দ্রাবাদ সিটি পুলিশ থেকে খেলতে এসে ছোট্ট মেসবাড়িতে ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়ে আছে কুড়ি-একুশের তরুণ। অথচ, দেশের সর্বোচ্চ ফুটবল নিয়ামক সংস্থা, কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রক জওহরলাল নেহেরু জমানার পর ক্ষমতার লিপ্সায় একটু একটু করে ঘুণ ধরাল দেশের ফুটবলে। এআইএফএফ-এর এই স্থবির হয়ে যাওয়ার দায় কার? দেশের ফুটবলে হালফিলে এফএসডিএল, রিলায়ান্স গোষ্ঠী, পুঁজিপতিদের আগমনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলল কারা? বিরাশির এশিয়ান গেমসের আগে জাতীয় ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে গেলেন ফুটবলাররা। ফেডারেশন তাঁদের ন্যূনতম আর্থিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারেনি। সাতের দশকের গোড়ায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলা ময়দানে প্লেয়ার আটকে রাখার দায় কার? বেচু দত্তরায়-পঙ্কজ গুপ্ত-জিয়াউদ্দিন জমানার শেষ প্রফুল্ল প্যাটেলে এসে।
ফিফার ক্ষমতায়ন হয়েছে আন্তর্জাতিক ফুটবলের রাজনীতির মারপ্যাঁচে, আন্তর্জাতিক ফুটবল কার্যত মেনে নিয়েছে তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতার কথা। বিশ্বব্যাপী ফুটবলের যে বহুমাত্রিক রূপ্, যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের কথা ফুটবল বলে, ফিফা তাকে স্বীকৃতি দিলেও কেড়ে নেয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও সোশালিস্ট সত্তাকে। ক্ষমতার নিয়মই যে তাই। এআইএফএফ-এর ক্ষেত্রে যা আরও প্রকট।
তবে একথাও সত্যি, ভারতে ফুটবলের বাজারের কথা মাথায় রেখে হয়ত কিছুদিন পরেই এই ব্যান তুলে নেবে ফিফা। আন্তর্জাতিক ফুটবলে একশোর ওপর র্যাঙ্কিং হলেও, বিলিতি ফুটবলের বড় বাজার এই উপমহাদেশ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচটাইম নির্ধারণে এ দেশের টাইমজোন নিয়ন্ত্রক হয়ে পড়ে। ফিফার কাছে অজানা নয় সে কথা। তাই এই ব্যান ভয়ের চেয়েও বেশি যন্ত্রণার। কারণ, ব্যান উঠে গেলেও পালটাবে না কিছুই। আপস করা স্বাধীনতার মতো ব্যান তুলে নেওয়াও আদতে একটা ক্ষত। বাহান্ন হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে খালি পায়ে চোট পাওয়া শৈলেন মান্না মাঠ ছেড়ে যাননি। ফ্রি কিক নিতে দাঁড়িয়েছিলেন নিজেই। আমরা ক্ষত নিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারি না আর। যেটুকু কুড়িয়ে পাওয়া, তা নিয়েই ভেসে যাই আপন মান্দাসে। সামনে রংচঙে ডার্বি ম্যাচ। টিকিট বিক্রি চলছে পুরোদমে।
“ভালমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে…”— নিলাম!