অয়নেশ দাস
গদ্যকার, প্রাবন্ধিক
এই লেখাটা লিখতে দিয়ে সম্পাদক মহাশয় আমাকে কী ভীষণ লজ্জার মুখোমুখি করেছেন, তা যদি তিনি বুঝতেন! স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে বেশ মজে ছিলাম। অনেকদিন ধরেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের টাকা ও বান্ধবীসংখ্যা গুনতে গুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়তেই আবার মিডিয়ার সঙ্গে গুনতে শুরু করেছি চালকলের মধ্যে গাড়ির সংখ্যা। এর মধ্যে জোর করে শক্তি অর্জন করতে হল ওই ছবিটার সামনাসামনি হওয়ার। তারপর থেকেই আমি রাতে আর ঘুমোতে পারছি না। ছবিটা আমাকে তাড়া করে চলেছে সমানে। বুকের পালকের মতো ছোট্ট সন্তানসম এক শিশু। হাসপাতালের বেডে অচৈতন্য শুয়ে আছে। দুচোখই তার বন্ধ। নাকে স্যালাইনের নল। একটা চোখ আঘাতে এতটা ফুলে আছে, সেদিকে আমি একবারের পর আর কিছুতেই দুবার তাকানোর সাহস করতে পারলাম না। আমি পালাতে চাইলাম। আউটলুক ইন্ডিয়ার খবরের পাতাটায় তাড়াতাড়ি স্ক্রোল ডাউন করে গেলাম আমি। একই পাতাতেই একই খবরের মধ্যেই ইউটিউব বিজ্ঞাপন। আজাদির ‘অমৃত মহোৎসব’-এ স্বপ্নসুন্দরী নায়িকার মুখ থেকে বিশেষভাবে পরিশুদ্ধ জল খাওয়ার দামী মেশিনের ওপর ভারী ডিসকাউন্টের প্রবল ঘোষণা। যত্রতত্র আমাকে ঘিরে আছে প্রবল আনন্দের মহোৎসব। বাড়ির নিচ দিয়ে আওয়াজ করে ছুটে গেল এসইউভি। তার বনেটে উড়ছে তেরঙা। জানলা দিয়ে দেখছি সামনের রেস্তোরাঁয় ডিনারের লাইন পড়েছে। আজাদি কা মেনু-র সুগন্ধ ভেসে আসছে আমার নাকে। কী অধিকার আছে আমার ছবির ওই শিশুটি, সামান্য দু ঢোক জলের কারণে যার বুক সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই, তাকে নিয়ে লেখার? না নেই। আছে শুধু লজ্জা। নিদারুণ লজ্জা, লজ্জা আর এক বুক স্তব্ধতা।
***
আচ্ছা, জলই কি অমৃত? শিশুবেলা থেকে জেনে এসেছি জলের আরেক নাম জীবন। জীবন যে দান করে সেই তো অমৃত। ৭৫ বছর পূর্তিতে ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’ নামকরণটি যিনি করেছেন তিনিও কি এই জানাবোঝার ওপরেই তা করেছিলেন? প্রখর তৃষ্ণায় প্রত্যেক দেশবাসীর জন্য দেশ দু ঢোক অমৃত অর্থাৎ জীবন অর্থাৎ জল নিশ্চিত করবে, এই কি সেই নামকরণের মাহাত্ম্য? জানি না। আমি সত্যিই জানি না। কিন্তু আমার শারীরবৃত্তীয় অভিজ্ঞতা দিয়েই আমি নিশ্চিত জানি যে শিশুবেলা থেকে আমার জলসম্পর্কীয় জানাবোঝায় কোনও ভুল ছিল না। এবং আমি এও নিশ্চিত জানি, আমার মতোই সে জানাবোঝায় কোনওরকম ভুল ছিল না রাজস্থানের জালোর জেলার ছোট্ট সুরানা গ্রামের ওই শিশুটিরও। প্রখর তৃষ্ণাতেই দু ঢোক জলে গলা ভেজাতে চেয়েছিল দেওয়ারাম মেঘওয়ালের কনিষ্ঠ সন্তান, সুরানার সরস্বতী বিদ্যামন্দিরের ছাত্র ছোট্ট ইন্দ্র কুমার মেঘওয়াল। তবে তাকে কেন সেই দু ফোঁটা জলের জন্যই মরতে হল? নামে ইন্দ্র হলেও ওর হাতে ছিল না যে বজ্রের অধিকার। ও যে ছিল দলিত। সে বোঝেনি ৭৫ বছরের স্বাধীন ভারতীয় সমাজ তাকে এখনও অনুমোদন দেয়নি অমৃতের ভাগে। এই তার অপরাধ। সে বজ্রের অধিকার থাকে স্কুলের শিক্ষক ছৈল সিং-এর হাতে। ছৈল সিং যাদের প্রতিনিধিত্ব করে সেই উচ্চবর্ণের হাতে।
***
গত মাসের কুড়ি তারিখের এক উষ্ণ দুপুরে ইন্দ্র মেঘওয়াল তার স্কুলে রাখা একটি মাটির কলসি থেকে জল খেতে গিয়েছিল। সে ইচ্ছা তার পূর্ণ হয়নি। তার আগেই তাকে দেখে ফেলে স্কুলের শিক্ষক ছৈল সিং। এবং উচ্চবর্ণের কলসি ছোঁয়ার ধৃষ্টতা দেখানোর জন্য ছোট্ট শিশুটিকে ছৈল সিং বেদম প্রহার করে। তার পর তৃতীয় শ্রেণির ছোট্ট শিশুটি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার চোখ বীভৎসভাবে ফুলে ওঠে। তার কান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। এমনকি সে তার শরীরের একদিকে পাশ ফিরতেও অক্ষম হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় জালোর, ভিনমল, উদয়পুরের হাসপাতাল ঘুরে হতোদ্যম হয়ে শেষপর্যন্ত বাড়ি থেকে ১৩০০ কিমি দূরের আমেদাবাদ সিভিল হসপিটালে জায়গা হয় তার। কিন্তু ক্ষুদে ইন্দ্র তার লড়াই টিঁকিয়ে রাখতে পারেনি। অমৃত মহোৎসবের ঠিক আগেই ১৩ আগস্ট মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরে যাওয়ার মতোই চিরতরে ঝরে যায় একটি দলিত শিশুর জীবন। দু ফোঁটা জল খেতে চাওয়ার অপরাধে এক ফোঁটা জলের মতোই ঝরে গেল সে।
***
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। উপমহাদেশের সিন্ধ প্রদেশের এক রাজার সঙ্গে বিবাদ চলছিল ব্রাহ্মণদের। ব্রাহ্মণদের দেওয়া শাপে সাত বছরের জন্য বৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল রাজার রাজ্য আর তার সাধারণ প্রজাদের জীবন। রাজা সমস্ত জলাশয়ে পাহারা বসালেন। একদিন হঠাৎ একটি জলাশয়ে স্নান করতে দেখা গেল এক ব্যক্তিকে। এ তো মহা অপচয়। সৈন্যরা লোকটিকে ধরে নিয়ে গেল রাজার কাছে। প্রচণ্ড রেগে রাজা তাঁকে প্রশ্ন করলেন— তুমি কি জানো না যে আমার রাজ্যে সাত বছর কোনও বৃষ্টি হবে না? তবে কেন তুমি এমন করলে? মানুষটি আশ্বস্ত করল রাজাকে। সে বলল আগামী বছরে সেই রাজ্য সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতে ধুয়ে যাবে। সেইজন্যই সে গিরনার পাহাড়ের শিখরে কঠোর প্রার্থনায় বসবে। রাজা তো বটেই, কেউই সেই সময়ে বিশ্বাস করেনি সেই অবাক-মানুষটির কথায়। এ কী ধৃষ্টতা! ব্রাহ্মণদের অভিশাপকে চ্যালেঞ্জ করাও যে অসম্ভব! কিন্তু পরের বছর সত্যিই বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল রাজার রাজ্য। খুশিতে ভরে উঠল মানুষ। অবাক-মানুষটির নাম হল মেঘ ঋষি। আর ব্রাহ্মণদের টক্কর নেওয়া সেই মানুষটির থেকেই এল মেঘওয়ার (ওয়ার = সংস্কৃতে জাতি বা গোষ্ঠী) বা মেঘওয়াল জাতি।
সিন্ধ প্রদেশই মেঘওয়ালদের মূল নিবাস হলেও উচ্চবর্ণের চাপে তারা ছড়িয়ে পড়ে রাজস্থান, কাশ্মির, গুজরাট, হিমাচল, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের নানা জায়গায়। পাকিস্তানেও তাদের সংখ্যা ক্ষয়ে এলেও এখনও বেশ ভালোই, যদিও দেশভাগের পর একটা বড় অংশই আজ এদিকে চলে এসেছে। আর মেঘ ঋষির সময় থেকেই বংশপরম্পরায় অক্ষুণ্ণ রেখেছে রল্লি কুইল্ট এমব্রয়ডারি শিল্পের অনুপম ধারা। মেঘওয়ালদের কোনও লিখিত ইতিহাস নেই। এই শিল্পের মধ্য দিয়েই মুখে মুখে চলা ইতিহাস তারা ছড়িয়ে চলে কাল থেকে কালে, পরম্পরা থেকে পরম্পরায়। সেই শিল্পবোধ উচ্চবর্ণ হাজার বছরেও কেড়ে নিতে পারেনি তাদের রক্তস্রোত থেকে। কিন্তু কেড়ে নিতে পেরেছে বেঁচে থাকার অধিকার। দু ফোঁটা জল খাওয়ার অধিকার।
সেদিন ব্রাহ্মণদের অভিশাপ থেকে মেঘওয়ারদের বাঁচিয়ে ছিলেন মেঘ ঋষি। মেঘ ঋষির দিন আজ আর নেই। স্বাধীন ভারতে আজ যেন ব্রাহ্মণদের অভিশাপই শেষ কথা। মেঘ ঋষির সন্তান হয়েও সে করাল অভিশাপ থেকে বাঁচতে পারেনি ইন্দ্র কুমার মেঘওয়াল।
***
ঘর ঘর তিরঙ্গার উল্লাসে কোনও শোকপালন ছিল না, অন্তত রাষ্ট্রের তরফ থেকে। জালোরের বিজেপি বিধায়ক যোগেশ্বর গর্গ বরং সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টিকে লঘু করার রাস্তায় নেমে পড়েন। ইন্দ্রর বাবা দেওয়ারাম সরাসরি অভিযোগ করেছেন যে সমাজের জাতিভেদ প্রথাই তাঁর সন্তানের মৃত্যুর কারণ, অথচ গর্গ নিয়ে এলেন এক নতুন তত্ত্ব। যেন শিশুটির মৃত্যুর জন্য তার দলিত পরিচয় দায়ী নয়, বরং তার দুষ্টুমির জন্য শিক্ষা দিতেই শিক্ষক এই কাণ্ড করে ফেলেছেন। ন বছরের একটি শিশুর কতটা দুষ্টুমির জন্য তার প্রাণ নিয়ে নিতে পারেন তার শিক্ষক? উচ্চবর্ণের একটি শিশু কি একই সাজা পেত সে ক্ষেত্রে? বা কোনও ক্ষেত্রেই?
আমরা কমবেশি সবাই জানি আরএসএস আর তার তত্ত্বগুলিকে। গর্গের অবস্থান আমাদের আর বিস্মিত করে না। বরং বিস্মিত করে বাকি ভারতবাসীর হিরণ্ময় নীরবতা। বিস্মিত করে প্রগতিশীলদের অবস্থান। মনুসংহিতার তত্ত্বকে সামনে রেখে হিন্দুত্ত্ববাদীরা যেমন জিইয়ে রাখেন সমাজের দলিত-বিরোধী অবস্থান, তেমনই শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বকেও সমানে সামনে রেখে এ দেশের কম্যুনিস্টরা দলিত সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন। বাকিদের জন্য থেকে যায় এনআরআই, হোয়াইট কলার স্বপ্নে গা ভাসানোর খোলা বাজার। সমাজের মনস্তত্ত্বে ঘৃণা চলতে থাকে। ঘৃণার বাজার বাড়তে থাকে। গোপন গুদামঘর থেকে সে চালান হয়ে ক্রমে খোলাখুলি আসে খোলাবাজারে। সে বাজারে আমিও অংশীদারি করি আমার অজান্তেই। ছোটবেলাতেই আমার এক কম্যুনিস্ট কাকা আমায় যেমন শিখিয়ে যান কারা হল সোনার চাঁদ আর কারা হল সোনার টুকরো! আসলে কারা হল অপর। তখন থেকেই আমি দূরত্বের অধিবাসী। হাজার বছর ধরে আষ্টেপৃষ্টের ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি সে দূরত্ব করে তুলেছে অলঙ্ঘনীয়। ছোট্ট ইন্দ্রর খুনের যে পাপ সে পাপ তো আমার নিজেরও! আমার কি অধিকার আছে এ লেখা লেখার? লজ্জা ছাড়া আমার বুকের ধারণ করার কী ক্ষমতা আছে যে সে ধারণ করবে ক্রোধ? যা নিয়ে আসবে সবার জন্য অকৃপণ ধারাপাত? আবির্ভাব সম্ভব করবে অগুন্তি মেঘঋষির? সম্ভব করবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অবিরাম অভিশাপের বিরুদ্ধে মেঘ ঋষিদের সাফল্যের টক্কর? আমি শুধু প্রার্থনা করতে পারি। ঘর ঘর তিরঙ্গার সব তেরঙা যেন ভারি হয়ে অর্ধনমিত হয়ে আসে সেই অবিরাম ধারাপাতের ভারে— দু ফোঁটা জলের আকুতিতে অকালে ঝরে যাওয়া ইন্দ্র কুমার মেঘওয়ালের ছোট্ট নিথর বুকের শোকে।
কী লিখব তোমায় নিয়ে ছোট্ট ইন্দ্র মেঘওয়াল? আমি মেঘ ঋষির মতো মেঘ থেকে বৃষ্টি নামিয়ে আনতে পারি না। আমি কাঁদতে পারি অঝোরে। তাতে পেয়ালা ভরে যেতে পারে। কিন্তু কী লাভ? সেও যে অপেয়, দূষিত। ওই ছৈল সিং-এর কলসির মতোই। জাতিঘৃণায় দূষিত। আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও— এ কথাটা বলারও জোর আমার নেই। আমি ঘরে ঘরে উড়তে থাকা তেরঙা নিশানে তোমার একরত্তি মুখ খুঁজতে থাকি। নাকি তেরঙায় নিজেরই মুখ লুকোনোর চেষ্টা করি!
তার আগে পাঠক, আপনিই বলুন, ঘরে ঘরে উচ্চবর্ণের তেরঙা টাঙিয়ে দলিত কী করে আর কেনই বা বলবে— মেরা ভারত মহান? তারা কেন চিৎকার করে জানতে চাইবে না আজাদির এই অমৃত মহোৎসব আসলে কার আজাদির মহোৎসব? প্রতি দশ মিনিটে ৭৫ বছরের স্বাধীন ভারতে আক্রান্ত হচ্ছে একজন করে দলিত মানুষ— লিখতে হলে নয়া ইতিহাস লিখবে তারাই— যাদের বুকে জমা হতেই হবে সে ক্রোধের ধারাপাত। আমরা নই।
Until the lion tells his side of the story, the tale of the hunt will always glorify the hunter.
–প্রাচীন আফ্রিকান অরণ্য প্রবাদ