চার নম্বর নিউজডেস্ক
দিল্লির কোতোয়ালি লালকেল্লার কাছে সাই মন্দির। পুরনো অসংখ্য কিছু গলিঘুঁজির ভেতর স্বপ্নের প্ল্যাটফর্ম। এক কনস্টেবলের হাত ধরে ছোট ছোট বস্তিবাসী ছেলেমেয়ের বড় হওয়ার গল্প। তাদের স্কুল। নাম ‘থান সিং কি পাঠশালা’।
শুরুতে স্বপ্নের কাণ্ডারি থান সিং-এর কথায় আসি। রাজস্থান থেকে আসা দিল্লির লালকেল্লার কাছে পোস্টেড হেড কনস্টেবল থান সিং একটা সময়ে মীরাবাগের ঝুগগি ঝুপড়ি কলোনির বস্তিতে থাকতেন। প্রত্যক্ষ করতেন বস্তির র্যাগপিকার ছোট ছোট মুখগুলোর কষ্ট। ওদের ভাষা, প্রথাগত শিক্ষা না থাকার পরিণতিতে চলে আসা এক্সপ্লয়েটেশন ইত্যাদি। আর তখন থেকেই অন্যরকম কিছু করার ভাবনা চলে আসে থান সিং-এর মাথায়। ২০১৫। কেল্লার পাশে সাই মন্দিরের ছাদের নিচে এমনই ৪ জন বস্তিবাসী বাচ্চাদের একসঙ্গে নিয়ে বসলেন একদিন। পড়াশুনো এবং অন্যান্য আদবকায়দা রপ্ত করা দিয়ে শুরু করলেন। ক্রমশ সমাজের মুলস্রোতের মধ্যে আনা। শুরুটা এভাবেই।
৪ থেকে ৫০। থান সিং-এর পাঠশালায় ছাত্রছাত্রী বাড়ছে। ইংরিজি, অঙ্ক এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষাদানের পর্ব চলছে প্রতিদিন ভোর থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা অবধি। নার্সারি থেকে ক্লাস ফাইভ অবধি ক্লাস। বছর উনিশের এক গৃহহীন কিশোরী অঙ্কিতা থান সিং-এর সহকারী। এবং সবচেয়ে বড় কথা পুরো শিক্ষাদানের প্ল্যাটফর্ম চলছে থান সিং-এর নিজের পকেট থেকে। অঙ্কিতাকে থান সিং দিচ্ছেন মাসে ৪০০০ টাকা। ওই টাকায় ছেলেমেয়েদের বই, খাতা, পেন এবং ইত্যাদির সহাবস্থান। বা স্কুলের জন্য যা যা লাগে তার ব্যবস্থা। অঙ্কিতা এই স্কুলকেই জীবনধর্ম বানিয়েছে। একটা সময়ে তার ঘর ছিল না, ছাদ ছিল না। আজ থান সিং-এর পাঠশালাই তার ঘর, ছাদ। বাচ্চাগুলো তার ভাই, বোন, বন্ধু।
কীভাবে শুরু? কীভাবে এগোচ্ছেন? ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাই বা কী? থান সিং-এর নিজের কথায় উঠে এল অন্য এক দিক। থান সিং বলছেন, একমাত্র পুলিশের পক্ষেই শহরের যেকোনও জায়গায় ইচ্ছে করলেই ঢুকে পড়া যায়। জানা যায় সমস্যা এবং সমস্যা সমাধানের দিকগুলি। থান সিং এই সুযোগটিকেই বেছে নিলেন। নিজেই একসময়ে বস্তিবাসী ছিলেন বলে এই ছেলেমেয়েগুলির মনের ভেতর, ওদের ভাষা, ওদের রুচি, ওদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় ঢুকে যেতে পারলেন সহজেই। ওরাও ওদের কথা মন খুলে বলে দিল ওদের থান সিংকে। অপরাধজগতের দিকে যাওয়া ওদের স্বাভাবিক জীবন-অভিমুখ বদলে দেওয়াই মুল উদ্দেশ্য ছিল থান সিং-এর। আর সেখানেই মানুষটা চূড়ান্ত সফল। শিক্ষা পেয়ে মাথা উচু করার পাশাপাশি, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের দিকগুলো এত তাড়াতাড়ি ছেলেমেয়েগুলো রপ্ত করে নেবে, এতটা প্রথমেই ভাবেননি থান সিং। তবু কিছুটা তো আশা ছিল। সাফল্যের আগে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন খুব কম মানুষ। ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের থেকেও শুরুর দিকে আশাতীত সাড়া পাওয়া যায়নি। কখনও বলপ্রয়োগ করে, বকাঝকা করে আনিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের। আজ তার সুফল থান সিং-এর হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আজ সমাজ, পড়শি, বস্তির বড়রা, নিজের ডিপার্টমেন্ট থান সিং কি পাঠশালা বললে এক ডাকে দেখিয়ে দেবে লালকেল্লার কোতোয়ালিতে এক গলির ভেতর। ওখানে অঙ্ক করছে, ইংরিজি পড়ছে, নামতা বলছে, আঁকছে, গাইছে, যোগা করছে তাঁর স্বপ্নের কারিগরেরা।
সাহায্য এবং কামারাদারি আসছে খোদ দিল্লি পুলিশ থেকেই। সম্প্রতি দিল্লি পুলিশ রেইসিং ডে-র প্ল্যাটিনাম জুবিলি সেলিব্রেশনের ‘ধারা’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে থান সিং-এর ছাত্রছাত্রীদের অংশদান ছিল অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। দর্শকের হাততালিতে ভেসে গেছিলেন থান সিং, অঙ্কিতা এবং তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা। পুলিশ কমিশনার রাকেশ আস্থানা আলাদা করে বারবার বলছিলেন তাঁর এই অনুজ সহকর্মীর কথা। পদে ছোট হলেও কাজে সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন থান সিং। ডিসিপি সাগর সিং খলসির উদ্যোগে এই পাঠশালার তিরিশের উপর ছেলেমেয়ে ভর্তি হয়েছে বড় কোনও সরকারি স্কুলে। শিকড় হয়ে বেঁচে থাকছে থান সিং কি পাঠশালা।
খুব জরুরি প্রতিবেদন।