পাঁচটি কবিতা
পড়শিকে
হৃদয়পুরের খোঁজ দিয়ে যায় পাশের পাড়া
আজবডাঙায় বাস করি রোজ আমরা কজন
দূর থেকে কাল হাত বাড়িয়ে ডাকল যারা,
তারাই আমার পড়শিদেশের নতুন স্বজন।
শুনেওছিলাম আরশিনগর পাশের দেশে,
সেইখানেতেই কোথাও আছে পড়শিবাড়ি
কিন্তু আমার হিসেব পথের বাইরে এসে,
বেখেয়ালেও সে পথ দিয়ে দিইনি পাড়ি।
উড়ো চিঠির মেঘ নিয়ে যেই পায়রা এল
ওমনি দেখি আমার পাড়ায় হিমেল হাওয়া!
মিঠে রোদের অপেক্ষাতে শীত পোহাল
দুটো মানুষ, আজকে তারা বেপরোয়া…
নীল কুয়াশায় তোমার স্মৃতি রোজই পোড়ে,
যে আগুনে পথ দেখাত নতুন আলো!
কে আর বলো আগুন ঘেঁটে হৃদয় খোঁড়ে?
ভালবাসার অন্ধকারও হয়ত ভাল।
অন্ধকারে হাতড়ে দেখি নরম আঙুল,
আমার মতন কাঙাল কে আর, এ তল্লাটে?
নেশার ঘোরে ছুঁলাম যাকে, সেও কী ভুল?
হয়ত হবে, তবুও তো রোজ সঙ্গে হাঁটে!
ভুলতে চাওয়ার যন্ত্রণাদের লুকোই না আর—
তোমার ঠোঁটে প্রলেপ তো নয়, পশম খুঁজি
বিনিসুতোয় ভর দিয়ে তাই হাঁটছি আবার,
ভালবাসা বলতে আমি জীবন বুঝি…
লক্ষ্মী
বসতবাটির একটি কোণায়
হাতে বোনা আসন পাতি
ওই ধারেতে লক্ষ্মী বসেন,
আল্পনাতেই রাস্তা কাটি।
গাছকৌটোর দুইটি পাশে,
ছড়িয়ে আছে ধানের শীষ
সাজিয়ে দিতাম মনের মত
জায়গা পেলে একটু, ইশ্!
লাল পলা আর নোয়ায় ঢাকা
ছবির ভাঁজে শ্রী মুখখানি,
পঞ্চপ্রদীপ সলতে আঁকা
সাবেক কালের ধূপেরদানি।
লাল শালুতে জড়িয়ে আছে
একই ছবি জন্মকাল,
মায়ার মত আলোর শরীর
বাড়ন্ত আজ হাঁড়ির চাল।
পানপাতাটা মুড়িয়ে রাখা
রেকাবিতে ফলের কুচি,
কাঁসার থালায় আগলে রাখা
আতপচালের গন্ধ খুঁজি…
দুব্বোগুলো পাইনি ভালো,
আগের মত বাগান তো নেই!
যখন-তখন লাফিয়ে নেমে
ফুল কুড়োতে একলা হই…
সেই কবেকার উলের চামর
ন’পিসিরই হাতে বোনা,
তার ওপরে পদ্য লেখা
নরম সুতোয় টানা টানা…
গঙ্গাজলে শুদ্ধ করে,
হাত পেতে নিই হলদে গাঁদা
অভ্যাসেতেই আউরে চলি
অভ্যন্তরং শুচি সদা।
উত্তাপেতে পরশ কোথায়?
তুলোর শিখায় শুধুই আগুন!
ছোঁয়ালে মাথা হাত পোড়ে তাই,
শুকনো পাতা ঝরায় ফাগুন…
পায়ের পাতায় পাপ লাগে; তাই
শান্তিজলে গুটিয়ে যাওয়া,
অলক্ষ্মীর এই বাসভূমিতে
দু দণ্ড আজ তোমায় পাওয়া…
এই শহরেই লক্ষ্মীরা রোজ
শব্দ গোনে মাটির ভাঁড়ে,
জমলে কড়ি একটু বেশি
খুশির খবর আসতে পারে…
কোকিল ডাকে চৈতি বেলায়,
শাঁখের সুরে মিলিয়ে সুর
গেরস্থালি ভালবাসায়,
হাঁটতে পারে বহুদূর…
সে যা জানত না
যে শব্দের মানে নদীর কাছে খোঁজে— তার কাছে যাচ্ছি…
যার কাছে গৃহকোণ, দুদিনের সুখ— তার কাছে যাচ্ছি…
যে বোঝে জোনাকির আলো, হয়ত কোনও মায়া— তার কাছে যাচ্ছি…
যে খোঁজে অন্ধকার
আর নিস্তব্ধতা যার নেশা…
তারই আলো খুঁজছি আমি
দেখা না দেখায় মেশা…
পিছুটান নয়, মুহূর্ত বরং
“ভালবাসা” শুধু নাম!
উড়ে আসা মেঘ, দমকা বাতাস
পিছনে ফেলে এলাম…
ফিরে গেছি শুধু, ফাঁকা মাঠ ধূ ধূ
বদ্ধ তেপান্তর…
ছুঁয়ে গেছে বোধ, ভেতরের ক্রোধ
চোখে লেগে থাকা ঘোর…
দূরত্ব শুধু সেতু দিয়ে গড়া,
ওপারে দীর্ঘশ্বাস….
অছিলায় খোঁজা দিনক্ষণ দেয়
ছুঁয়ে থাকবার আভাস…
লেগে থাকা আলো, কেউ চমকালো
চেনা সড়কের বাঁকে…
কিছু পিছু স্মৃতি, কাজে বা অকাজে
অভ্যাসে বেঁচে থাকে…
পাল্টে গেলে?
তাকে প্রতিবারই কেউ বলে,
“তুমি পাল্টে যাবে একদিন…”
তাকে প্রতিবারই কেউ বলে,
“তুমি তো আর থাকবে না আগের মতন!”
তাকে প্রতিবারই কেউ বলে,
“তুমি তো সেই বদলে যাবেই আবার।”
তবু সে পাল্টায় না,
তারা পাল্টে যায়…
তারপর একটা দিন আসে,
যে দিনটায় শূন্য বারান্দা থেকে একটা ছেঁড়া ওড়না, ভাঙা দোলনার মতো ঝুলতে থাকে…
সে দিনটায় আর আশেপাশে কাউকে দেখা যায় না,
তাকে বলার জন্য, “তুমি সেই পাল্টে গেলেই ঠিক!”
যেসব বৃষ্টির দিন
এসব বৃষ্টির দিন, জন্ম আর মৃত্যুদিনের মাঝে সুরে সুরে গাঁথা থাকে
এসব বৃষ্টির দিন, বুড়ো হওয়ার সাথে সাথে খোঁজে বন্ধুর মুখ
এসব বৃষ্টির দিন, নিভে যাওয়া আলোর মত একঘরে হয়ে যায় কখনও-সখনও
এসব বৃষ্টির দিন, ভেজা কাপড় থেকে শুকনো জল কুড়িয়ে কুড়িয়ে চোখ মুছিয়ে দেয়
এসব বৃষ্টির দিন, সীমাহীন মৃত্যুর মত আজন্ম উৎসবতাড়িত
এসব বৃষ্টির দিন, ঢেকে দিতে চায় ভুল ভেঙে যাওয়া কিছু গ্লানিময়তার
নিষ্পাপ স্মৃতির মত খা খা করা অতীত,
ঘুরে বেড়ায় গেরস্থালির আনাচে-কানাচে
বাইরে থেকে ভিতরে, আর ভিতর থেকে বাইরে;
একটা ভাঙা সংসারকে আগলে রাখবে বলে…