বর্ণালী কোলে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “রক্তকরবী” নাটকে নন্দিনী বিশুকে বলছেন, রাজা তাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, রঞ্জনের জন্য প্রাণ দিয়ে তার লাভ কী, নন্দিনী বলেছেন, জানি নে। প্রেমে লাভ-ক্ষতির হিসেব হয়? ন্যায়-অন্যায়ের? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৃত্যনাট্য “শ্যামা”য় উত্তীয় বলেছেন, “ন্যায়, অন্যায় জানি নে, জানি নে/ শুধু তোমাকেই জানি/ ওগো সুন্দরী।” যুগ যুগ ধরে প্রেম বন্দিত হয়ে আসছে কবিতায়, গানে। চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের ‘নির্বাচিত প্রেমের কবিতা’ প্রেম নামক এক অনিন্দ্য অনুভূতির বর্ণনা। এমনই এক কবিতা, ‘হয়তো বিরহ’—
লিখি না। তোমার ঘোরে বুঁদ হয়ে আছি।
সন্ধে ঘনিয়ে এলে
চোখ ভার করে নেশা নামে।
দিশি বোতলের মতো।
টলমল ভ্রমণের ডানপাশ,
পেছন নেই কোনও, তোমাকে জড়িয়ে
বাঁহাতে, সামনে এগোই।
সব মিছিমিছি।
লিখি না।
মাথা ভোঁতা হয়ে আসে, ফলে..
এমনই জোড়াতালি মারি আজকাল,
আমার ভুবনে!
স্পষ্ট দেখতে পেলে, তুমি নেই,
একথা সহ্য হত, বল
এই কবিতা পড়ার পর কিছু কী বলার থাকে? চেয়ে চেয়ে দেখি। দেখতে দেখতে মন কবিতা ছাড়িয়ে পাড়ি দেয়। মনে পড়ে দেবদাস। তিনিও তো প্রেমিকই ছিলেন। এখানে নেশা অবশ্য বোতলের নয়। মনখারাপ। মনখারাপে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে তো নেশা নামে… নেশা নেমেছে অনেকবার আমার চোখে, আপনার চোখে। চৈতালী চট্টোপাধ্যায়-ই হয়তো লিখতে পারেন, সেই নেশা ঠিক দিশি বোতলের মতো। এই নেশার মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকলে, ভ্রমের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলে হয়তো কিছুক্ষণ নিজের অস্তিত্ব ভুলে থাকা যায়। সত্যিই তো, “স্পষ্ট দেখতে পেলে, তুমি নেই,/ একথা সহ্য হত, বল”।
‘প্রেমিক’ কবিতা নতুন এক দৃশ্যপট আমাদের উপহার দেয়। নিটোল বিশ্বাসের কবিতা। কালস্রোতে হারিয়ে যেত, যদি এই মুখখানি কবি না লিখে রাখতেন। কবিতাটি পড়তে পড়তে ‘প্রেমিক’ নামক পুরুষটি আমাদেরও চেনা হয়ে উঠে। অমিয় চক্রবর্তী লিখেছেন, “আমি যেন বলি, আর তুমি যেন শোনো/ জীবনে জীবনে তার শেষ নেই কোনো”। এই তো প্রেম, দেহ পার হয়েও যা জেগে থাকে। এই শোনা কখনও বা নিভৃত পার্কে, কখনও বা নির্জন ঘরে। কখনও বা রেস্তোরাঁর কেবিন। কখনও বা সেখানে বসে সে তার প্রেমিকাকে শোনায় তার জীবনের নানা ছেড়ে আসা। কবিতা জুড়ে নীরব প্রেমিকাকে দেখি, অনুভব করি তার সংলাপ, “বাষ্প জমছিল আর টের পাচ্ছিলাম, আমারও নির্জন ঘর আজ শুধু মেয়েদের গল্পে ভরে উঠছে।”
‘শান্তিনিকেতন ৫’— একটি অসামান্য কবিতা। পড়লেই মন স্নিগ্ধ হয়ে আসে। কবিতাটি পাঠকদের জন্য থাক।
দেখতে দেখতে ভোর জাগে। ভালবাসার ভোর।
অপমানের ভোরফিরে এসে জানানো হয় না, তোমার প্রায় নিভে আসা দৃষ্টিপথের
আলোয়
তানপুরা বেঁধে আজ আবার আমি গান গেয়ে উঠি
এই কবিতার পাশাপাশি ‘রাধাকৃষ্ণ’ সিরিজের তিনটি কবিতার কথা না উল্লেখ করলেই না। সেখানে আছে অমোঘ এক লাইন, “সময় অতীত/ চুম্বনপীড়নে ঠোঁট শুধু এখনও লবণ হয়ে আছে।”
এই ভাললাগার তুলনা হয় না। কী সুন্দর পঙক্তি। এরপর স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়া ছাড়া উপায় কী! নিজ নিজ ভাললাগার গভীরে ডুব দেওয়া। ‘ভোগ’ নামক কবিতা পড়ে বিস্মিত হতে হয়। হৃদয় প্রস্ফুটিত হয় নতুন এক আলোয়। ঠিক যেন কৃষ্ণকামনায় কাতর রাধার আকুল হৃদয়। নৈবেদ্যের মতো সাজিয়ে নিজেকেই ভোগ বানানো। পুজোর উপকরণ, তার সঙ্গে দেহবোধ মিশে যাওয়া এই কবিতা অনন্য…
ব্যথা হোক, ব্যথা চাঁদের নিয়মে
কমতে থাকুক, বেড়েই চলুক!
আমি তো তোমার কাকপক্ষীটি
নিজেকে নিজেই বুঝতে দেব না—
প্রেমে আছি, নাকি মন্ত্রে মজেছি।
জ্যোৎস্না পড়েছে গুঁড়ো গুঁড়ো,
আমি অপমানগুলো জড়িয়ে নিয়েছি।
চালকলা যেন, প্রহারে ভিজিয়ে
প্রসাদ মেখেছি!
মেঘেরা যখন আলপনা দিল,
বজ্র যখন নিনাদ বাজাল,
ভোগের বাসনে বেড়াল কাঁদল,
আমি তো ছিলাম মধুপর্কের বাটির মতোই
অল্পে কাতর—
যায় আসে না কিছু!
নাটমন্দিরে টাটকা যোনি ও স্তন লাগিয়েছি
পুজো শুরু হোক
কবিতার শেষ দুই পঙক্তি স্তব্ধ করে দেয়। কবিতার ঘোর থেকে বেরোতে সময় লাগে। কবিতা পড়া মানে তো একটি বিশেষ স্বতন্ত্র মনের দোলাচল দেখা। এই কাব্যগ্রন্থে যে মন ফুটে ওঠে, তা দেখলে আমার বর্ষাদিন মনে পড়ে। তার বিচিত্র রং। পেখম মেলা ময়ূর দিন। কী এক আনন্দে ছোটাছুটি। কী এক আনন্দ নৃত্য। জলস্থলে ভাসে সেই সুর, “ভালবাসি, ভালবাসি”।
‘প্রেম, দু-তিন টুকরো’ এক অনবদ্য সিরিজ। তার প্রথম দুটি কবিতা ভোলা যায় না। প্রথমটি—
“তোমাকে জন্মান্তরে পাব”, বললে বটে।
কিন্তু যে শিখে গেছে
এই জন্মই শেষ, তার কাছে,
এ কথা, একটা হাঁ করা গর্ত বই তো কিছু নয়!
সত্যিই তো। খুবই সত্যি। “তোমাকে জন্মান্তরে পাব।”— এই কথা ছলনাই। এখন ভাবি, খুব ভালবাসলে এই কথা বলা যায়! কত শূন্যতা সহ্য করে অনেকেই প্রেমের দোহাই দিয়ে তার পাওয়ার সীমাবদ্ধতা মেনে নেয়। আর যে জেনে গেছে এই জন্মই শেষ, তার কাছে, এ কথা একটা হাঁ করা গর্ত বই তো কিছু নয়।
প্রেম, দু-তিন টুকরোর দ্বিতীয় কবিতা—
দূর থেকে বিরহ পাঠাই
না, না, এসএমএস, ই-মেল নয়!
মনে মনে। খুব তীব্র তরঙ্গ ওঠাই।
দেখ তো ডান চোখ নাচে কিনা!
মনে মনে খুব তীব্র তরঙ্গ ওঠাই। আমরাও কী পাঠাই না? আমরাও কী পাঠাইনি! কে জানে তার ডান চোখ নাচে কিনা।
‘ভণিতা’ কবিতাটিও অনবদ্য। প্রেমের তো শুধুমাত্র সত্য হয়। প্রেমের আবার বৈধ-অবৈধ কী। অনেকেই সত্য অনুভব করেও নিজেকে দমন করেন। সমাজ নামক শান্ত পরিপাটি স্রোতে বয়ে চলে। অনেকে আবার সমাজের থেকে সত্যকে বড় মনে করেন। আমাদের আরাধ্য দেবদেবী রাধা-কৃষ্ণের প্রেম তো সমাজস্বীকৃত প্রেমের কাব্য নয়, সত্য প্রেমের কাব্য। সম্পর্ক মরে গেলেও বাঁচিয়ে রাখাই তো নিয়ম। সেই নিয়মের ফাঁসে জর্জরিত হতে থাকার অনবদ্য আখ্যান অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শোনা— তামাকু সেবনের অপকারিতা।
‘ভণিতা’ কবিতাটি একটি ভণিতা না থাকা কবিতা। ভণিতা না রেখেই এখানে সোজাসাপ্টা কথা বলা হয়েছে:
শিল্পের কথা পরে হবে, আগে বল,
হলুদ আর মস্ত বসন্তকালের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে
আমরা চুমু খেয়েছিলাম কেমন!
তবে বউ বাচ্চার গল্প সঙ্গে আছে তো—
আমাদের ঠোঁটনিঃসৃত আঠালো তন্তুতে
কনফেশনের গন্ধ লেগে যাবে।
রাজনৈতিক কথা পরে থাকবে,
মই ও বড় রাস্তা এড়িয়ে, চল,
কাঁচাপথ ধরে নিই,
বিবেক দংশাতে এলে ডুমুরগাছের টঙে তুলে দেব।
আর, অন্ধ হব।
প্রতারণার কথা পরে আসে, শুরুতে মনমজানোর কথা বল।
তোমার পল্লব থেকে ওই যে মোদক,
মুঠো মুঠো খসিয়ে ফেলব। খাব।
মৃত্যুর কথা পরে বলবে,
আগে সুর ধর, শরীর মেশাও
“বিবেক দংশাতে এলে ডুমুরগাছের টঙে তুলে দেব।”— সত্যি, অভাবনীয়। আনন্দিত হই। নতুন করে অনুভব করি, কবিতা পৃথিবীর অন্যতম এক সত্য। কারণ কবিতাই পারে। অকপট হৃদয়ের ছলনাশূন্য বহিঃপ্রকাশে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে। সত্য প্রকাশের অকৃত্রিম মনোমুগ্ধকর ভাষায় রোমাঞ্চিত হয়ে ধন্য হন, কৃতজ্ঞ থাকেন আমার মতো এক সামান্য পাঠক।
‘নলিন সরকার স্ট্রিট’ আর একটি ভাল কবিতা। সমাজ-অস্বীকৃত প্রেমের কবিতা। তবু তো প্রেম। অপূর্ব সহজসরল ভঙ্গিতে কবিতাটি লেখা হয়েছে। একটি চিরকালীন প্রতীক্ষা ও চিরকালীন আকাঙ্ক্ষার ছবি এই কবিতাটিতে চিত্রিত হয়েছে। চিরকালীন কথোপকথন আর ভালবাসার আপন করা ছবি:
সম্ভাবনার মেঘ বিকেল হলেই উড়ে আসে।
তুমি ঘরে ঢুকে, জুতো-মোজা খোলো। ডাকো,
“কী ব্যাপার, ফোন দাওনি আজ?”
বৃষ্টি আসন্নপ্রায়, তার আগেই
রামলাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে আমি
ক্ষীরের চপ ও কিছু দানাদার
বুদ্ধি করে আনিয়ে রেখেছি।
খুকুদি সাবান কাচছে
সন্ধের শাঁখ বাজছে সবে,
এ-সময়, ঘেন্নাপিত্তিগুলো খেয়াল পড়ে না—
কে কাকে মিসট্রেস ভাবল, তা-ও!
সমস্ত শরীর থমথমে।
আমার কামিনী মেঘ, আমার বকুল মেঘ,
তোমার মিনার খোঁজে, সিঁড়িমুখ,
জল হবে বলে
অপূর্ব। কবিতাটি পড়ার পর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি। এইরকম অজস্র মণিমুক্তোয় সাজানো চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের ‘নির্বাচিত প্রেমের কবিতা’। ‘বিরহ’, ‘বাস্তু’, ‘বিবাহবার্ষিকী’, ‘বিরহের কবিতা’, ‘দেবীপক্ষে লেখা কবিতার উৎসর্গ কবিতা’, ‘সম্পর্ক’, ‘দেওয়াল’ বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়। পরপর দুটি কবিতা পাঠকদের জন্য থাক।
আসুন, আমরা অভাবনীয় কল্পনার ছোঁয়ায় বিস্মিত হই, আসুন ভালবাসার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। প্রেমের অনুভব পাওয়ার জন্য আর একবার নিজেকে বিপন্ন করা যাক। দুটি কবিতা—
আপনকথা
আমাদের মধ্যে ছিল আলোবাতাসের রিচ্যুয়াল।
আমাদের মধ্যে ছিল গরমমশলার গন্ধ, বাসমতি চাল।
আমাদের মধ্যে ছিল কিশোরী আমনকর,
কাশীবাসী কবীর।
আমাদের মধ্যে ছিল জলের মতো তরলতা।
দাগ ধরবে না, তাই নিশ্চিন্ত হতাম।
আমাদের মধ্যে ছিল পথ।
পথে সন্দেহ নামল যেই,
সে, হেঁটে হেঁটে হেঁটে হেঁটে চলে গেল
মোটে ফিরল না
.
রোমান্স ও রেভোলিউশন
তোমাকে ছুঁইনি আমি। কখনও ছোঁব না,
জানি তো…
লতাপাতা ঢেকে-রাখা ল্যান্ডমাইনের গায়ে
আঙুল দিলেই,
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমার,
কোনওটা চাঁদে উড়ে গিয়ে পড়বে,
কোনওটা মঙ্গলে,
কোনওটা বা খোলা ম্যানহোলে।
খুঁজেই পাবে না, বস্তুত