হীরক সেনগুপ্ত
ফুলবন্তী প্রেগন্যান্ট। অতিকষ্টে এসেছিল, কোভিড-স্বামীর ভর্তিতে। পরীক্ষায় বোঝা গেল, নিজেও পজিটিভ।
২.
পেটের মধ্যে পূর্ণিমা শিশু। কাঁচা ঘুঁটের মত, কোনওমতে আঁকড়ে ঝুলছে। যে কোনও মুহূর্তে হইহই করে উঠবে।
একটু আগেও ফুলবন্তী হাঁটছিল। লুপ্তপ্রায়, ছন্দহীন। আপাতত, ওপিডির টানা বেঞ্চে। কাত। অথবা শুয়ে। কখনও বসে…।
হাঁসফাঁস শরীরে কম্পন। অল্প জলে বাঁচিয়ে রাখা মাছ। ওপেন সিক্রেট, বেআব্রু প্রসূতির অসহায়ত্ব।
শেষমেশ লেবার-পেন। ‘অঙ্গীকার’ মাতৃসদনেই। অঙ্গীকার মালটা আবার প্রাইভেট। ফাইভস্টার কেয়ার। বেচারা কর্তৃপক্ষ, দায়বদ্ধতার গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে গেল। সমস্ত টালবাহানা কমপ্লিট ভোগে।
প্রসূতিকে লেবার রুমে নিতেই হল। ড্যাং ড্যাং, চালচুলোহীন ফুলবন্তীও ভর্তি!
৩.
তখন চারদিক ভয়ানক। মাতৃসদনেও কোভিডের তেজস্ক্রিয়তা। একে একে ফুটে যাচ্ছে উপায়হীন নিধিরাম সর্দার-সর্দারনিরা।
স্বভাবত ফুলবন্তীর ভর্তিতে ওয়ার্ডে প্রবল চাঞ্চল্য। যাও বা নর্মাল ডেলিভারি হচ্ছিল, ঝকমারি এল। মাঝপথে পেশেন্টের এক্লাম্পশিয়া, অজ্ঞান।
ডাঃ মধুশ্রী দত্তের অপরিসীম দক্ষতা, ফর্সেপ ডেলিভারিতে গোকুল হল। কিন্তু, ফুলবন্তীর জ্ঞান ফিরল না।
৪.
মেট্রন বলল— মুশকিল, মুশকিল।
নর্মাল টাইমে, ওয়ার্ডেই ল্যাকটেটিং মাদার। চুটকিতে হাজির। বেবির সারভাইভ্যালের প্রশ্ন। নিউবর্ন; কিন্তু দুধ?
মা-মরা বাচ্চা। দুধ কি হাতের মোয়া?
উপায়?
সাবিনা সাফাইকর্মী। হলে কী, ঠিক যেন ভিড়বাসের কন্ডাক্টর। চারদিকে নজর। বলল,
–দিদি, আমি মাই দেব?
মধুশ্রী এমডি, পেডিয়াট্রি। এখানকার আরএমও। সাবিনাকে আসতে যেতে দেখেছে। আলাপ নেই। সে কথাটায় আবার একঝলক দেখল, সাবিনা অল্পবয়সী, স্বাস্থ্য ভাল।
–তোমার বাচ্চার বয়স?
–তিন মাস।
সবাই বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক আছে, ঠিক আছে।
সাবিনা— সাবিনাই।
সাবিনা ক্যাজুয়াল স্টাফ। ছুটিফুটি আবার কী! এছাড়া ওর বাচ্চাও তো আছে, থাকবে কোথায়?
‘অঙ্গীকার’ তো কোভিড ডেজিগনেটেড হেল্থ সেন্টার। বেশ কয়েকজন পেশেন্টও আছে। তার উপরে প্রাইভেট, ফাইভস্টার চক্কর।
গাইনিতে ফুলবন্তী, বিরাট সমস্যা। ওয়ার্ড ভয় পাচ্ছে। একটাই রক্ষে, সাবিনার ইনঅকুলেশন কমপ্লিট। গাইনিতে ফুলবন্তীই একা। উপায় নেই।
সুপার নিমরাজি— ওক্কে, দুদিন…
মেথরানির জন্যেও ছুটি, হুহ!
ক্ষমা-ঘেন্নায়, হ্যালহ্যালে দুদিন গড়িয়ে গেল সপ্তাহে… বেবির জনডিসে।
৫.
কোভিড-ওয়ার্ডের ব্যস্ততার মধ্যেও মধুশ্রীর মাথায় ফুলবন্তী-গোকুল-সাবিনা ঘুরপাক খায়। ফুলবন্তীর হাজব্যান্ড মারা গেলে কেউ খোঁজও নেয়নি।
হাসপাতাল চেষ্টা করেছিল, ঠিকানা ভুল। কাউকে পাওয়া যায়নি।
মধুশ্রী যাতায়াতের পথে সাবিনাকে দেখে। কখনও ডানহাতের কনুই উঁচু, মুঠোয় ধরা কম্বল।
গোকুল আর মেয়ে জারাকে ঘিরে আছে। কাঁচা গোকুল, ফুটফুটে কপাল, বন্ধ চোখ। কোঁকড়ানো লেবু-লজেন্স।
সাবিনার জামা খোলা, ধবল অন্নপূর্ণার নিপুণ কমলা শৃঙ্গ। মধুশ্রীর বুকে সবুজ রোঁয়া ধানের ক্ষীণ ছায়া। বিভ্রান্ত ভ্রূণের হলুদ আকর্ষ, দিকশূন্য হাওয়ায় একাকী পাক খায়…।
সুপার বললেন,
–ডক্টর দত্ত, লকডাউন উঠে যাচ্ছে। ওয়ার্ডে পেশেন্ট বাড়বে। সাবিনার এই যে আন-অথরাইজড স্টে, মুশকিল…
মধুশ্রীর কপালে ভাঁজ, বেবির ওয়ান উইক।
তবুও সুপারকে জানাল,
–সাবিনাও বলছিল, এভাবে আর কতদিন…
–আপনি কী বললেন?
–কী বলব স্যার, সিচুয়েশনটা তো ক্রিটিক্যাল। তবে ও বলেছে, বেবিকে নিয়ে যাবে…
–সেকী! কম্পিটেন্ট অথরিটিকে না জানিয়ে ওসব হয় নাকি? ওরাই তো অরফানেজের…
–অরফানেজ!… মানে?
–অ্যাকচুয়ালি এমন শিশুদের আইনানুগ ব্যবস্থা…
–সেকী! আমি অ্যাডাপ্ট করলে?
–নট সো ইজি… সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটির পারমিশন…
ডক্টর হোড়কে থামিয়েই বলল মধুশ্রী,
–ওসব জানি। নিয়ম তো অনেকই আছে স্যার। পরিত্যক্ত, অনাথ শিশুদের জন্য জে-জে অ্যাক্ট সমাজকল্যাণ… আরও কত কী! কিন্তু বেনিফিট? উপরন্তু শিশুদের গায়ে লাগছে কুসংস্কারের তকমা— ‘কোভিড অনাথ’!
–ডক্টর দত্ত, আপনি ভুল ভাবছেন। সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু বেশ কাজের…
–নো স্যার… নো সার্টেনটি। ওখানে যে করুণ অ্যাপিলগুলো ঘুরপাক উড়ে বেড়ায়, এতে অনেক শিশুর হিতে বিপরীত হয়। এ দেশে পোস্ট অ্যাডপশন কোনও মনিটরিং নেই। কে কার খোঁজ রাখে?
সুপার ডাঃ হোড় উত্তেজিত,
–আপনার ভাবনা সিনিক্যাল। আমার পরিচিত কাপলই..
ডাঃ দত্ত মাঝপথে থামিয়ে বলে ওঠে,
–ওগুলো রেয়ার এক্সেসেপশন। অল্পবিস্তর উপকার হলেও… শিশুশ্রম, শিশুপাচার, এসব প্রিভেনশনের কোনও উপায় নেই। যদি না অভিযোগ আসে। আর তাতেও কাজটা সহজ না। সাক্ষী, প্রমাণ… বিস্তর ঝামেলা। এগুলো আটকানো রিয়েলি টাফ।
–সরকারি সাহায্য. চাইল্ড-হেল্পলাইন এসব আপনি উড়িয়ে দিচ্ছেন?
–আমি উড়িয়ে দেওয়ার কে? আছে তো অনেক কিছুই। সমস্যা হল, মা-বাবা যে সত্যিই কোভিড-ভিক্টিম, এ প্রমাণ বাচ্চাদের পক্ষে জোগাড় কি আদৌ সহজ? হলেও করবে কে?
সুপার বললেন,
–বুঝতে পারছি। আপনি বিষয়টা যতই মানবিকভাবে দেখুন… নারী-শিশুকল্যাণ দপ্তরের পরামর্শ ছাড়া…
মধুশ্রী ক্রমশ মরিয়া—
–আইন মানতে গেলে তো স্যার গোকুলের জন্মই হত না… সবই কি আইনমাফিক? বলুন স্যার?
সুপার ঈষৎ নরম,
–হয়ত আপনিই ঠিক… আমি যেটুকু করতে পারি, সাবিনাকে ন্যাচারাল গার্জেন দেখিয়ে… রিলিজ… কিন্তু কেসটা জানাজানি হলে… বেশ কমপ্লিকেটেড…
মধুশ্রীর ভেতরে ভেতরে রাগ। টগবগ টগবগ। তবে চিন্তা করল। কথা বাড়ালে কাজ ভণ্ডুলের এভরি পসিবিলিটি। দরকার ডিপ্লোম্যাটিক্যালি ট্যাকল।
সুপারকে আশ্বস্ত করতে ডেসপারেটলি বলল,
–আন্ডারটেকিং দেব। যাবতীয় রেপন্সিবিলিটি, আমার…
৬.
ব্রিজমোহন, হাসপাতালের সিকিউরিটি।
কোয়াটার্সের হাতায় থাকে। বউ লক্ষ্মী, মধুশ্রীর রান্না করে।
মধুশ্রী লক্ষ্মীকে বলেছে গোকুলের কথা। লক্ষ্মী খুশি।
–দিদি, আপনার দয়ায় বাচ্চাটা বেঁচে যাবে!… এ অসুখে কত বাচ্চা ভেসে গেল। কতদিন হল?
মধুশ্রী বিনুনির পাক ছাড়াচ্ছিল।
–উনিশ।
–কবে আসবে?
–দেখি…
গোকুলের জিনিসপত্র দরকার। বাজারেও যেতে হবে। আলমারিতে দুটো তোয়ালে ছিল। আপাতত ওগুলোই দিয়েছে।
লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করে,
–দিদি, সাবিনা থাকবে?
–দেখি…
লক্ষ্মী চুপ। ঘরের আলো মরে এসেছে।
প্যাসেজে নীলবাতি, গাঢ়।
–সাবিনা হলে তো চিন্তা নেই…
বাঁহাতে আংটি ঘোরাচ্ছিল মধুশ্রী। অন্যমনস্ক।
নিজের মনেই কথা বলে—
–ইফ নট, দেন ইটস রিয়েলি টাফ। নাও সাবিনা ইজ ইনডেসপেনসিবল… অ্যাটলিস্ট ফর সিক্স-মান্থস…
–দিদি…, একটা কথা বলব?
–বলো…
–আমার ছোটমেয়ের বাচ্চা দশমাস। ওকে বলব?
–কী বলবে?
–এখানে এসে… গোকুলকে…
–কোথায় থাকে?
–ধানবাদ।
–সে তো অনেকটা রাস্তা…
–বেশি না। পাঁচ ঘন্টা…
–ছেলেমেয়ে?
–এক নাতি, আট বছর। নাতনির দশমাস…
–ওর সংসার?
–সে তো আছেই। তবে গোকুলের জম্মেদারি ভি গম্ভীর…
–তা ঠিক। কাল আমার সঙ্গে বাজার যাবে?
লক্ষ্মী আহ্লাদিত।
–কব?
–দুপুরে।
বিকেলে মধুশ্রীরা ‘লাড্ডুগোপালে’ এল। কী সুন্দর নামটা। উফ, কত বাচ্চাদের জিনিস!
তোয়ালে, ন্যাপি, মশারি, টয়লেট্রি, ক্রেডেল, টুপি…
একজোড়া নীলজুতো…। কিনতে গিয়েও বাধো বাধো ঠেকে। ঠিক সেইরকম। একদম এক!
জিনিসপত্রে হাত ভরে উঠেছে। থলিতেও জায়গা নেই। মধুশ্রীর হাত ভারি, তবু টের পায়— শরীর ভারহীন।
চারপাশে জনসন বেবি-পাউডার… হাওয়ায় উড়ছে… প্রথম আনন্দ। মধুশ্রীর বুকটা চঞ্চল, তৃষ্ণার্ত অন্নপূর্ণা। দেবাংশুর হামাগুড়ি… তাজমহল হাসি…
মধুশ্রীর শরীরময় কাডলিং।
৭.
আজ সাবিনার রিলিজ। পিপিই কিট ছেড়ে স্যানিটাইজড হয়ে বেরোতে দেরি হল মধুশ্রীর। চিফ মেট্রন করিডর পর্যন্ত এলেন।
সাবিনাকে অনেক কিছু বোঝাচ্ছিল মধুশ্রী।
বারবার।
সাবিনার বোন আলিমা, আর বড় মেয়ে এসেছে। দেখলে বোঝা যায়, সাবিনার মেয়ে। তেমনই ঢলঢলে, ফর্সা। বড়বড় চোখ। ভুরুটা সরু, পাতলা ঠোঁট। চোখে মোচার ফুলের মত এককাঁদি কৌতূহল, ছটফট করছে।
সাবিনা হাসপাতালের কম্পাউন্ডেই থাকে। গোকুলকে হলুদ তোয়ালে জড়িয়ে মাথার দিকে হুডি করে দেয় মধুশ্রী। শেষে একটু আদর। গোকুলকে আবার শুইয়ে দিল সাবিনার বুকের জাজিমে। আলিমারা আস্তে আস্তে হেঁটে সিঁড়ির বাঁকে অদৃশ্য।
মধুশ্রীর বুকের ভেতরটা খেলাশেষের ইডেন গার্ডেন।
ভাঙা পিচ, দুরন্ত ডিউসে ছড়ে যাওয়া লাল নুনছাল। উইলো কাঠের অহঙ্কারী গর্তে মৃত শিশির।
দর্শকাসনে কফি কাপের লেপ্টে থাকা বিবর্ণ ফেনা, খড় খড় খড় খড়… কাউকে কি আওয়াজ দিচ্ছে?
মেট্রন গভীর চোখে দেখছিলেন অনেক কিছুই। ইচ্ছে ছিল মধুশ্রীর মাথায় হাত রাখার, হল না।
৮.
মধুশ্রী আরেকবার ঠিকানাটা দেখল। ঘড়িতে ছটা দশ। অন্ধকার হয়ে আসছে।
হাসপাতালের ডক্টরস’ ওয়াশরুমটা চমৎকার।
পরিষ্কার, প্রশস্ত। ফিমেল ডক্টরদের ইনডিভিজুয়াল লকার। আপাতত স্পেয়ার সালোয়ার কামিজই ছদ্মবেশ।
রংটা ম্যাড়ম্যাড়ে, হোক গে। ওড়নাটা চওড়া, মুখ ঢাকা যাবে। মাথায় শাওয়ার ক্যাপ। এন-নাইনটি ফাইভ মাস্ক, মুখের অনেকটা ঢাকা পড়েছে।
আয়নায় একঝলক দেখে। ঝট করে চেনা যাচ্ছে না।
তবুও ইতস্তত ভাবনায় হাঁটছিল।
হাসপাতালের ডাক্তারদিদি, অনেকেই চেনে। যদি চেনা কেউ মুখোমুখি কেউ হয়, কী বলবে?
সাবিনা বলেছিল,
–গাছের নিচে ইস্তিরির দোকান, জলের ট্যাঙ্ক। ওর ঠিক পাশেই। আমার বরের নাম মইনুদ্দিন। বললেই হবে। যে কেউ দেখিয়ে দেবে।
মধুশ্রী বলেছিল,
–সাবিনা, সময় করে যাব। ফোন-নম্বর তো রইলই। অসুবিধা হলে ফোন কোরো।
হাতের বিগ-শপারে গতকালের জিনিস।
আন্দাজ হল, এসে গেছে। বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকে,
–সাবিনা…
মেয়ে বেরিয়ে এল।
মিষ্টি গলা,
–ভেতরে এসো। মা জলের লাইনে। এক্ষুনি আসবে।
সঙ্কীর্ণ দরজা পেরিয়ে ভেতরে আসে। খাটে জারা, গোকুল পাশাপাশি। ঘুমোচ্ছে। একটাই ঘর, বড়। টিউব জ্বলছে। মাথার কাছে জানালা, পাল্লা ভাঙা। অ্যাসবেসটাসের চাল। পুরনো ডিসি পাখার ঘটরঘটর।
মেঝেতে জল-ভর্তি বালতি। থালা-বাটি, হাতা-খুন্তি।
কৌটোয় হলুদ, মুখ-খোলা। ফাটা ঠোঙায় শুকনো লঙ্কা, রসুন। ফুটো বেতের ঝুড়িতে আলু, পুঁইশাক।
গ্যাসের ওভেন। প্লাস্টিকের আলমারিতে অল্প জিনিস। গুড়ের খোলা বাটি, মাছি ভিনভিন।
ফাটা মেঝেয় মরা আরশোলা। পাশে ছেঁড়া পুতুল, জট পাকানো সোনালী চুল। সেসব ঘুরে ঘুরে পিঁপড়েদের লম্বা ব্যস্ততা।
দেওয়ালের হুকে ঘুড়ি। গোকুলের মত ফিনফিনে, ধবধব সাদা। পাখার হাওয়ায় ভয়ানক দুলছে।
কালো সরু সুতো, যেকোনও মুহূর্তে ছিঁড়ে গোত্তা খাবে মাটিতে। আর একটা টিকটিকি। একভাবে তাকিয়ে আছে। ভাবছে ঘুড়িটাও শিকার।
একটু পরেই এল সাবিনা। পেছনে বোন।
আগের দিনের মলিন সালোয়ার কামিজটাই পরা। চাপা রং, রোগা। মুখটা মিষ্টি।
–দিদি, আপনি!
মধুশ্রীকে দেখে সাবিনা দিশেহারা। একটু ইতস্তত করে। এদিকওদিক তাকায়। আলিমা চেয়ার আনে।
–দেখে বসবেন। পিঠের দিকে ভাঙা।
বয়স্ক মহিলাকে দেখিয়ে আলিমা বলে,
–আমাদের আম্মা।
মহিলার মুখে চামড়ার কুইলিং। গাল বসে গেছে। পিঠ নুয়েছে, চোখে উচ্ছ্বাস। মাথার উপরের পাখায় হাওয়া কম। গোকুল আর জারাকে হাতপাখার বাতাস দিচ্ছিল, ঢিমে তে-তালায়।
মধুশ্রী হাতজোড়। নমস্কার জানায়।
সাবিনার বর ঘরে নেই। মেয়ে চেয়ার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।
চোখে কৌতূহলের হাসি। মধুশ্রীর ব্যাগে চার-পাঁচটা চকোলেট। খচমচ খচমচ। মুঠো করে সাবিনার মেয়েকে দেয়। মুহূর্তে চকোলেটের মোড়কের গাঢ় বেগুনি আলো। ঝকমক করে ওঠে মেয়েটির দু-চোখ।
মধুশ্রী গাল টিপে বলল,
–তোমার নাম কী?
চকোলেট মুঠোয় রেখে বলল,
–ফরজানা।
সাবিনাকে ব্যাগটা দিয়ে বলল,
–এতে তোমার বাচ্চাদের জিনিসপত্র, খেলনা আছে।
আলিমা ব্যাগটা নেয়।
–বাব্বা খুব ভারী। অনেক কিছু তো দিলেন দিদি…
মধুশ্রী কুন্ঠিত।
–না। না। অনেক আর কোথায়…
কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে। সাতটা পঞ্চাশ।
অন্ধকার হয়ে এসেছে। আলিমা আলো জ্বালিয়েছে।
সাবিনা ইতস্তত করে,
–দিদি, একটু চা করব?
সত্যি বলতে কী ঘরে এসে মধুশ্রীর গা ঘিনঘিন করছিল। একটু চুপই ছিল, প্রথমটায়। পরে মনে মনে ভাবল। আমার গোকুল তো এই বিছানাতেই শুয়ে। এই ঘরের আলো-হাওয়াতে, ওই অপরিচ্ছন্ন থালাবাটিতেই তো সাবিনার দুধের পুষ্টি। আমি ভয় পাচ্ছি? গোকুল তো জীবন ফিরে পেয়েছে। আমার কিসের সংশয়?
মধুশ্রী বলল,
–হ্যাঁ দাও। মুড়ি আছে? মুড়িও মাখতে পারো। খুব ভালবাসি…
আলিমা, সাবিনার চোখে উজ্জ্বল বিস্ফোরণ।
–আপনি মুড়িমাখা খাবেন?
–হুঁ, কেন খাব না?
মুড়িমাখাটা আশাতীত সুস্বাদু। নারকেল, আচারের আম, তেল, লঙ্কা, পেঁয়াজ। মধুশ্রী খাওয়া শেষে স্টিলের গ্লাসে চায়ে চুমুক দিল।
সাবিনা চোখের জল মোছে,
–দিদি, সবাই যদি আপনার মত…
মধুশ্রীর সমান্তরাল ভাবনার বেড়া ভেঙে যায়। উষ্ণ অভিজ্ঞতা, কম্ফর্ট-জোন ফুঁড়ে যায় সাফাইকর্মীর সজিনা মধু।
সাবিনার হাতে একগোছা মাস্ক দিল।
–জানি সাবিনা, ভারি কাজে মাস্ক পড়লে কষ্ট। তবুও যদি সম্ভব হয়… সবাইকে বোলো, ইউজ করতে।
গায়ে মাথায় ভাল করে ওড়না জড়িয়ে নেয়। হাসপাতালের পেছনদিকে গেট আছে। সাবিনারা গেট অবধি এল।
–দিদি আবার কবে আসবেন?
–দেখি, ছুটি পাওয়া তো মুশকিল।
৯.
লক্ষ্মীর রান্না শেষ। মধুশ্রীকে সিঁড়িতে দেখে হাসল।
–দিদি, তুলসী এসে গেছে…
–বাহ বেশ…
–কাল সন্ধেবেলা আনব।
–আচ্ছা।
লক্ষ্মীর পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল।
১০.
বারান্দাটা বেশ বড়। জায়গাটা… জমিদার দুর্লভ রায়চৌধুরীর সম্পত্তি। দুর্লভ ‘অঙ্গীকার’ ট্রাস্ট। এখানে অনেক গাছগাছালি, পাখি।
ব্রিজমোহন গাছপালা ভালবাসে। দূরে ওদের ঘর।
মধুশ্রীর কোয়াটার্সে সারাদিন নিংড়ানো স্তব্ধতা।
বারান্দায় বেতের সোফাসেট। মৃদু নীল আলোর শ্যান্ডলিয়ার। জরুরি নম্বরগুলো দ্বিতীয় ফোনে। ফোন দেখল, মিসড কল নেই।
ফ্রেশ হয়ে টি-পটে চা নিয়ে বসে। টি-টিপ ঘিরে চমৎকার সোনালী ফুলেল নকশা। পরাগের পছন্দ, সিমলায় কেনা।
জ্যোৎস্নার গাছপালা। রাতপাখির আবছা অবয়ব। শাবকের ডাক।
ফুলবন্তী-গোকুল পর্ব… সুপারের কথোপকথন… মিছিল চলছে।… মধুশ্রীর আরও কত কী বলার ছিল।
চা ঢালতে ঢালতে ভাবে…
এই ভয়ানক ঢেউ ক্রমশ স্বাভাবিক, পৃথিবী আবৃত্ত হবে। এক সময়। এই আবৃত্তের তলায় তলায় কি কোনও চোরাটান থাকবে না? ইতিহাস কী লেখা হবে না… এই ভয়ঙ্কর মহামারি, চুরমার শিশুজগতের!
মা-বাবার হাত ধরে দীর্ঘপথ হেঁটেও শেষ পর্যন্ত যারা গন্তব্যহীন… সামাজিক সংযোগের ধসে।
লিপিবদ্ধ হবে? অসংখ্য শিশুমনের হতচকিত বিভ্রান্তি… অব্যক্ত, অকথ্য অত্যাচার! আমরা কি বিস্মৃত হব, এই বিহ্বল প্রজন্ম!
দারিদ্র্যের যন্ত্রণায় অগুনতি বজ্রপাত…
অতিমারির ফাটলে মূল্যবোধের চুড়ান্ত অবক্ষয়। সভ্যতার অহঙ্কার ভেঙে চুরমার। সম্ভব-অসম্ভব, কুসংস্কার, সত্যি-মিথ্যের বিচিত্র স্থানাঙ্কে প্রাগৈতিহাসিক বর্তমান।
শিশুমন, জীবনে অবাস্তবকে আপন করে… অত্যাচার ভুলে থাকার হাতছানির লোভে… নেশাচ্ছন্ন… আত্মহত্যায় ইউফোরিক। স্নেহ-মমতা-সুবিধাবঞ্চিত শৈশব! কেন আজ মুহূর্তে এত অপ্রাসঙ্গিক?
ডক্টর হোড়, সর্বগ্রাসী নৈরাজ্যে পালিয়ে বাঁচবেন?
মোটামুটি গতবছরের সরকারি হিসেবে চারলক্ষ অনাথ… অরফানেজ আছে, মেরেকেটে হাজার দশেক।
খোঁজ নিয়েছেন? অরফানেজের শিশুরা কেমন থাকে, প্রতারক, অসুন্দর পরিবেশে? নিজেদের মত ক্ষমাহীন লড়াইয়ে বড় হয়..!
কে এদের নিরাপদ জীবনস্রোতে মিলিয়ে দেবে, আপনি?
প্যানডেমিকে… শিশুমানসের বিপুল উথালপাথাল… সিংহভাগই অব্যক্ত। অথচ অসহ্য পীড়ন!
অভিমান, হাসিগান হুল্লোড়… খেলাধুলোয় বিস্তৃত কল্পনার গুরুত্ব… পরিবারহীনতার কষ্ট কোন প্রতিষ্ঠানে প্রশমিত?
সঙ্কট কাটিয়ে নিউ-নর্মালে যৌথ-অভ্যেস গড়তে চাইছি। অথচ ভালবাসা, মমতায় যে হৃদয় গোকুলের জন্য ব্যাকুল হল, তার আবেদন খারিজ হয়… তামাদি নিয়ম-জাল!
মধুশ্রী চিৎকার করে।
–ডক্টর হোড়, এ অসহায় এলোমেলো জীবনে অস্তিত্বের সংশয়। দুস্তর বাধাবিপত্তি ঠেলে… আমাদের বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে… কালবেলায় ভেসে থাকতেই হবে। সুখের স্মৃতিগুলিতে সভ্যতাকে পুনরায় বুনতে হবেই। জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাফল্যের বীজ, যতদিন না, প্রাংশু বিশ্বাসের মহীরুহ জন্মায়…. আপনি, সে প্রচেষ্টায় কুঠারাঘাত! হ্যাঁ, হ্যাঁ, কুঠারাঘাত…. জানবেন… একজন মধুশ্রী… একজন পরাগ হেরে গেলেও… যুদ্ধ, বিরতিহীন…
১১.
ফোনটা কী কেঁপে উঠল?
–পরাগ, এত দেরি! জানিস, ব্রেস্ট-ফিডিংয়ের বিষয়টা বোধহয় মিটল। কেয়ারটেকারের মেয়ে, তুলসি… ওর দশমাসের বেবি… কাল আসবে। … জুতো বাদে সব কিনেছি।… তোর পছন্দের সেই নীল জুতো… মনে আছে, দেখিয়ে বললি, এটা আমাদের বেবির জন্য…। জানিস, একটু ভয় ভয় করছে…
–কেন?
–মানে, ভাবছি… পারব তো সামলাতে?… ভারি আফশোস হয়! এইমসে কোভিড সামলাতে সামলাতে, তুই নিজেও ভেন্টিলেশনের হিমশয্যায় নিঃসঙ্গ। আমি কী পারতাম, তোকে ছাড়া বাঁচতে! গড়িয়ে গেলাম কোভিড-খাদে…
–তবু এ আমাদের মৃতের গল্প নয়। তবুও নীলজুতোর… মন্দ্রিত স্বপ্ন, কৃষ্ণ-পারিজাতে… যে কী মায়া…
১২.
দরজায় ঠকঠক। সাবিনা, এত রাতে! বারান্দায় অন্ধকার হাতড়ে এগোয়। হাওয়ার চুপকথার ঝরাপাতা, উড়ন্ত স্বপ্নপালক… খস খস…
সাবিনার আর্তনাদ:
–দিদি গো… দিদি,.. গোকুল বিক্রি হয়ে গেছে…..
অন্ধকারে চৌচির অতীত উষ্ণতা, সোনালী টি-পট। শিল্পিত সূক্ষ্ম কাহিনির রাতপাখি— উড়ে যায়।