রণিতা চট্টোপাধ্যায়
সাংবাদিক, গোয়েন্দা-সাহিত্যের গবেষক
–কোন অস্ত্র ছুঁড়লে শত্রুরা মাথা গুলিয়ে সেমসাইড করে বসে?
–ত্বাষ্ট্র।
মহাভারত থেকে এক আশ্চর্য অস্ত্রের দৃষ্টান্ত তুলে এনে শুরু হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাকাহিনি ‘গোলকধাম রহস্য’, যে গল্পের শেষও হবে আর-এক আশ্চর্য মারণাস্ত্রের উল্লেখে। না, মহাভারতের বিপুল বিস্তারকে কেবল গোয়েন্দাকাহিনির অভিধায় বাঁধা যায় না বটে, তবে তারও পাতায় পাতায় রহস্যের জাল বোনা আর জট ছাড়ানো তো চলেই। আর তার সূত্র ধরে আসে আশ্চর্য সব অস্ত্রের তত্ত্বতালাশ। শত্রুকে হাই তুলতে বাধ্য করে জৃম্ভণাস্ত্র, যুক্তিবুদ্ধি গুলিয়ে দেয় ত্বাষ্ট্র, এ ছাড়া একাঘ্নী বাণ, পাশুপত অস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র থেকে ব্রহ্মশির— এমন কত না অস্ত্রশস্ত্রের খবর জানায় মহাভারত। আর সেখান থেকেই এক আশ্চর্য অস্ত্রের উদাহরণ তুলে এনে এই কাহিনির নান্দীমুখ করছেন সত্যজিৎ রায়, কিশোরদের উপযোগী করে গোয়েন্দা গল্প লিখতে গিয়ে ‘ভায়োলেন্স’-কে প্রায় হিসেবের বাইরে রাখতেই যিনি বাধ্য হয়েছিলেন। ‘আমাদের কথা’-য় সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাকাহিনি লেখার প্রসঙ্গে বিজয়া রায় জানাচ্ছেন, এই কারণেই ফেলুদাকাহিনিতে গোয়েন্দা গল্পকে জমিয়ে তোলার দুই মূল উপাদান— সেক্স এবং ভায়োলেন্সের ঠাঁই হয়নি। আসলে তিনি একা নন, গোয়েন্দাকাহিনির প্লটে এই দুটি উপাদানের উপরেই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন গোয়েন্দাসাহিত্যের তাত্ত্বিকেরাও। এমনকি গোয়েন্দাকাহিনিতে হিংসাত্মক ঘটনার প্রকৃতি ঠিক কেমন হলে ভালো হয়, তা নিয়েও বিস্তর ভাবনাচিন্তা করেছেন দুই বিদেশি লেখক তথা প্রাবন্ধিক এস এস ভ্যান ডাইন এবং রোনাল্ড নক্স। কোন কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে ক্রাইম কাহিনি গোয়েন্দা কাহিনি হয়ে ওঠার যোগ্যতা লাভ করে, তার রীতিমতো নিয়ম-নির্দেশিকা বানিয়ে ফেলেছিলেন এই দুজন। ‘আমেরিকান ম্যাগাজিন’ পত্রিকার সেপ্টেম্বর, ১৯২৮ সংখ্যায় উইলার্ড হান্টিংটন রাইট ওরফে ভ্যান ডাইন ‘টুয়েন্টি রুলস ফর রাইটিং ডিটেকটিভ স্টোরিজ’ নামে যে প্রবন্ধটি লেখেন, তার সাত নম্বর নিয়মটি ছিল, খুন এবং মৃতদেহ থাকতেই হবে ডিটেকটিভ গল্পে। খুনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ অপরাধকে গোয়েন্দার পাতে দেওয়ার যোগ্য বলেই মনে করতেন না ভ্যান ডাইন এবং তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র ফিলো ভান্স। আবার, ঠিক পরের বছর ১৯২৯ সালে ‘দ্য বেস্ট (ইংলিশ) ডিটেকটিভ স্টোরিজ অফ ১৯২৮’ বলে একটি বইয়ের ভূমিকা লিখলেন রোনাল্ড নক্স। আর সেখানেই গোয়েন্দা কাহিনি রচনার দশটি নিয়ম ঘোষণা করলেন তিনি, পরবর্তীকালে গবেষকরা যে নিয়মগুলিকে আখ্যা দেবেন ‘টেন কম্যান্ডমেন্টস অফ ডিটেকশন’। দেখা গেল, রোনাল্ড নক্সের একাধিক নিয়ম ভ্যান ডাইনের মতামতের সঙ্গে মিলছে তো বটেই, আর গোয়েন্দা গল্পে খুনের প্রসঙ্গে দুজনেই একেবারে একমত। উভয়েরই মতে দাঁড়াল, খুন না থাকলে গোয়েন্দা গল্পের ষোলো আনাই মাটি।
পরবর্তীকালে এই বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। খুনের তদন্ত ছাড়াও যে গোয়েন্দাকাহিনি সার্থকতার শিখরে পৌঁছোতে পারে, ডরোথি এল সেয়ার্স থেকে শার্লক হোমস, কিংবা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সত্যজিৎ রায় তা অনায়াসেই দেখিয়ে দিয়েছেন। তবুও এ-কথা স্বীকার করে নিতেই হবে, হত্যা গোয়েন্দা গল্পের লেখকদের একটি অতি প্রিয় উপাদান। আর যদি সেই খুন হয় অস্বাভাবিক উপায়ে, তবে গোয়েন্দা তাঁর মগজাস্ত্র খাটানোর সম্পূর্ণ সুযোগ পান। সেই কারণেই, দেশি বিদেশি গোয়েন্দা গল্পে দেখা পাওয়া যায় অভিনব সব মারণাস্ত্রের।
অদ্ভুতরকম মার্ডার ওয়েপনের প্রসঙ্গ উঠলে ক্রাইম কাহিনির পাঠকদের হয়তো প্রথমেই মনে আসবে রোয়াল্ড ডালের বিখ্যাত গল্প ‘ল্যাম্ব টু দ্য স্লটার’-এর কথা। ফ্রিজে থাকা জমাট হয়ে যাওয়া ভেড়ার ঠ্যাং যে মানুষ খুন করে ফেলতে পারে, সে কথা কে ভেবেছিল! হোমসিয়ানা ক্লাবের সদস্যরা আবার মনে করে নেবেন আর্থার কোনান ডয়েল-এর ‘দ্য স্পেকলড ব্যান্ড’ গল্পে ডোরাকাটা ফিতের মতো দেখতে সাপটিকে। কিন্তু আপাতত বিদেশি গোয়েন্দা সাহিত্য থেকে নজর সরিয়ে আনা যাক বাংলার গোয়েন্দাকাহিনির দিকে। গোয়েন্দাকাহিনি বিষয়টি মূল ধারার সাহিত্যে ব্রাত্য ছিল দীর্ঘদিন, পরে পরিস্থিতি বদলালেও গোয়েন্দাসাহিত্যের আলোচনা বিদেশি সাহিত্যের আনাচেকানাচে যতখানি ঘোরাফেরা করে, বাংলা গোয়েন্দাকাহিনি নিয়ে তত ভাবিত হয় না। কিন্তু অভিনব এবং বিচিত্র মারণাস্ত্রের ব্যবহারে বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্য তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে কতটা তাল মেলাতে পারে, এই প্রবন্ধে সেই তল্লাশি করা যাক।
বাংলা ভাষায় গোয়েন্দাসাহিত্য বলে জঁরটির সূত্রপাত হয় উনিশ শতকের প্রৌঢ়ত্বে এসে, পুলিশি তদন্তের বাস্তব বিবরণ লিপিবদ্ধ করে। লেখকদের কেউ কেউ ছিলেন পুলিশিব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম নিঃসন্দেহে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর ‘দারোগার দপ্তর’-এর যে কাহিনিগুলি মৌলিক, তাতে খুন আছে অজস্র, তবে খুনের ব্যাপারে অপরাধীরা সাধারণত চিরাচরিত প্রথাই অবলম্বন করেছে। বরং সমকালে যেসব বটতলার লেখকেরা গোয়েন্দাকাহিনি লেখায় হাত মকশো করছিলেন, তাঁদের মধ্যে থেকে রমানাথ দাসের লেখা ‘চুম্বনে খুন’ উপন্যাসটির উল্লেখ করা যেতে পারে। এই উপন্যাসের বিজ্ঞাপনে ঘোষণা করা হয়েছিল— ‘পুস্তকে উল্লিখিত ঘটনার সহিত ইহার নামের বেশ সামঞ্জস্য আছে।’ বাস্তবিক, এখানে খুন হত তীব্র বিষের দ্বারাই, তবে চুম্বনের মধ্যে মৃত্যুবাণ লুকিয়ে রাখার পদ্ধতিটি বেশ অভিনব।
খুন না হলেও, চুম্বনের মধ্যে দিয়েই মৃত্যু এসেছিল এর বছর চল্লিশ-পঞ্চাশ পরে লেখা একটি গোয়েন্দা উপন্যাসে। প্রকৃতপক্ষে সেই উপন্যাসের স্রষ্টার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দাকাহিনি প্রথম জাতে ওঠে। তিনি ব্যোমকেশের জনক, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ‘চিড়িয়াখানা’ উপন্যাসের শেষে অপরাধী দম্পতি ভুজঙ্গধর-বনলক্ষ্মী পালাবার পথ না দেখে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছিল। আর সেই মৃত্যু নেমে এসেছিল শেষ চুম্বনে বাহিত পটাশিয়াম সায়ানাইডের অ্যাম্পুল ভেঙে। বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যকে পুলিশি কেস ফাইল বা বটতলাজাতীয় চটুল রগরগে লেখার ছক ভেঙে বের করে আনতে চেয়েছিলেন বলেই হয়তো, নিজের লেখায় অপরাধকে অনেক বেশি বুদ্ধিদীপ্ত করে তুলেছিলেন শরদিন্দু। আর সেইজন্যই, তাঁর লেখা হত্যারহস্যে খুনের প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায়। ‘চিড়িয়াখানা’ উপন্যাসটিতেই যেমন, দুটি খুন হয় নিকোটিন বিষ দিয়ে। আর একটি খুনে হাইপারটেনশনের রোগী নিশানাথের পায়ে মোজা পরিয়ে তার ওপর দিয়ে দড়ি বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। মাথায় রক্ত উঠে মৃত্যু হলেও তাকে স্বাভাবিক স্ট্রোক বলে চালিয়ে দিতে প্রাথমিকভাবে অসুবিধে হয়নি।
ব্যোমকেশের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের প্রথম পরিচয় ১৩৩৯ সালে, ‘পথের কাঁটা’ গল্পে। আর এই গল্পেই এমন এক অদ্ভুত উপায়ে হত্যারহস্য ফেঁদেছিলেন লেখক, যে, গোয়েন্দা ও পাঠক উভয়েরই ধাঁধা লেগে গিয়েছিল প্রথমে। একদিকে খবরের কাগজে ‘পথের কাঁটা’ সরিয়ে দেওয়ার বিজ্ঞাপন, অন্যদিকে পথের উপরে কাঁটার মতো একটা জিনিস দিয়েই খুন করা হচ্ছিল একের পর এক ধনী লোককে। এ গল্পে সাইকেলের বেল থেকে গ্রামোফোন পিন ছোড়ার কলকবজা বানিয়েছিল অপরাধী, বন্দুকের গুলির মতো যা নিখুঁত নিশানায় গিয়ে বিদ্ধ করত উদ্দিষ্ট মানুষের হৃৎপিণ্ডকে। ‘অর্থমনর্থম’-এ করালীবাবুকে খুন করা হয়েছিল অ্যানাটমির জ্ঞান মেনে। ঘাড়ে, মেডালা আর ফার্স্ট ভার্টিব্রার মাঝখানে সুচ ফোটানোর ফলে মৃত্যু ছিল অবধারিত। ‘চোরাবালি’ গল্পে আবার কালীগতি এমন অদ্ভুত উপায়ে হরিনাথকে খুন করেছিলেন যে খুনের প্রমাণ অর্থাৎ মৃতদেহই চিরদিনের মতো লোপাট হয়ে গিয়েছিল চোরাবালির অতলে। ‘অগ্নিবাণ’ গল্পে দেশলাই জ্বালালে কাঠিতে মাখানো বিষের ধোঁয়া নিমেষে মৃত্যু ঘটাত, কিন্তু দেহে কোনও চিহ্ন থাকত না। ‘দুর্গরহস্য’ উপন্যাসে খুনগুলো হয়েছিল সাপের বিষে, কিন্তু বিষ প্রয়োগের পদ্ধতিটি নজরকাড়া। ফাউন্টেন পেনে কালির বদলে বিষ ভরে নিব ফুটিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। যদিও শেষমেশ কেল্লাটি অপরাধী মণিলালের বদলে রমাপতির হস্তগত হয়েছিল। ‘অমৃতের মৃত্যু’-তে সদানন্দ সুরের মৃত্যু হয় বুবি ট্র্যাপে পড়ে। ‘অচিন পাখি’ গল্পে দুটি খুন হয় মিলিটারি প্রশিক্ষণে শেখানো নিরস্ত্র লড়াইয়ের পদ্ধতিতে, যে পদ্ধতিতে প্রতিপক্ষের গলায় সজোরে আঘাত করে থাইরয়েড কার্টিলেজ ভেঙে দেওয়া যায়। তবে মারণাস্ত্রের বিচারে ব্যোমকেশ কাহিনিতে সেরার শিরোপা পেতে পারে দুটি কাঁটা কাহিনিই। ‘পথের কাঁটা’-র মতো ‘শজারুর কাঁটা’ উপন্যাসেও একাধিক খুন করেছিল হত্যাকারী, হত্যার উপকরণ ছিল শজারুর কাঁটা।
‘কাঁটা সিরিজ’ লিখে যিনি বিখ্যাত, সেই নারায়ণ সান্যালও খুনের পদ্ধতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন। ‘রিস্তেদারের কাঁটা’ উপন্যাসে খুন করা হয় মোটেলের ঘরে গ্যাস লিক করিয়ে। ‘সারমেয় গেণ্ডুকের কাঁটা’ উপন্যাসে বৃদ্ধা পামেলা জনসনকে খুন করার জন্য সিঁড়ির রেলিং আর দেওয়ালের মধ্যে সুতো বেঁধে দিয়েছিল আততায়ী। তাতে হোঁচট খেয়ে সিঁড়ি থেকে নিচে পড়ে যান বৃদ্ধা, আর সেই আঘাতই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়। একই পদ্ধতির দেখা মেলে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখা কর্নেল সিরিজের ‘কালো সুতো’ গল্পে। তাঁর ‘বা রহস্য’ আর ‘ভূতুড়ে বাঘ’-এ খুনির অস্ত্র ছিল বাঘনখ। ‘তুষারে রক্তের দাগ’ উপন্যাসে দুটি খুনেরই অস্ত্র ছিল স্কি খেলার লাঠি। আর ‘কা-কা-কা রহস্য’-তে ভীমগড় এস্টেটের বড়কুমার নিজের ছোটভাইকে খুন করেছিল নিজেরই কাঠের পা দিয়ে আঘাত করে।
হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জোড়া গোয়েন্দা জয়ন্ত এবং হেমন্ত। একটি জয়ন্ত কাহিনি ‘শনি মঙ্গলের রহস্য’-তে খুনের অস্ত্র ছিল ব্লো-পাইপ থেকে নিক্ষিপ্ত তির। বিমল করের ‘হলুদ পালক বাঁধা তীর’ উপন্যাসেও যেমন বিষক্রিয়া ঘটানো হয়েছিল বিষমাখানো তির ছুড়ে। আবার হেমন্তের রহস্যভেদের একটি কাহিনি ‘অন্ধকারের বন্ধু’-তে ভিক্টিমকে তরলে পরিণত বাতাস গিলিয়ে দিয়ে খুন করে অপরাধী, ফলে মৃতদেহে অস্ত্রের কোনও চিহ্নই ছিল না। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর গোয়েন্দা ভাদুড়ি মশাই, থুড়ি চারুচন্দ্র ভাদুড়ি ‘শ্যামনিবাস রহস্য’-এর সমাধান করে জানিয়েছিলেন, খুনের অস্ত্র আসলে জমাট বরফের চাঁই। এ গল্পে ভিক্টিম ছিল মাছের পাইকারি ব্যবসায়ী, আর মাছ সংরক্ষণ করার জন্য ওই ধরনের বরফের চাঁই তার কাছে থাকাই স্বাভাবিক। গরমে বরফ গলে যাওয়ার ফলে খুনের অস্ত্র খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয়েছিল পুলিশকে। এদিকে সিদ্ধার্থ ঘোষের ‘দরজার ওপারে মৃত্যু’ গল্পে কোনও অস্ত্রই ব্যবহার করা হয়নি। একটি অসম্পূর্ণ বাড়ির তিনতলায় ঝুলবারান্দা বানানো হয়নি বলে সেদিকের দরজা আটকানো থাকত। খুনি স্রেফ নিহত ব্যক্তির খাটের অবস্থান বদলে দিয়েছিল, যার ফলে ঘুমের ঘোরে উলটো দিকের বাথরুমের দরজা ভেবে এই ঘাতক দরজাটি খুলে ফেলেন তিনি। ফল, পতন ও মৃত্যু। এমনই নিরস্ত্র খুনের উদাহরণ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শবর-কাহিনির একটি উপন্যাস ‘সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে’। এই ষড়যন্ত্রে আটতলা ফ্ল্যাটের লিফট অচল করে দেওয়া হয়েছিল কেবল। হার্টে সামান্য গোলযোগ থাকলেও প্রাক্তন খেলোয়াড় বাসুদেব সেনগুপ্ত লিফটের তোয়াক্কা না করে সিঁড়ি ভেঙে আটতলায় উঠতে শুরু করেন। তাতেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, এবং মৃত্যু।
আগাথা ক্রিস্টি থেকে মনোজ সেন, অনেকেই বলেছেন মহিলাদের পছন্দের অস্ত্র ছোরাছুরি নয়, বিষ। সেই কথা মেনেই হয়তো হাল আমলের অপরাধিনীকে দিয়ে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন গোয়েন্দা অধিরাজ ব্যানার্জি-র মাস্টারমাইন্ড সায়ন্তনী পূততুণ্ড। তাঁর ‘সর্বনাশিনী’ উপন্যাসে প্রিয়া বাজাজ হ্যাকিংয়ে যেমন পটু, বিষের বিষয়েও ততটাই জ্ঞানের অধিকারী। তাই তাঁর সিরিয়াল কিলিং-এর অস্ত্র হয়ে ওঠে অ্যামাটক্সিন এক্স। যা তিলে তিলে মৃত্যু আনে, কিন্তু দেহে কোনও চিহ্ন রাখে না। ফলে একের পর এক মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে খুনের অস্ত্র ও মোটিভ খুঁজতে গিয়ে নাকাল হয় পুলিশ।
কিন্তু বাংলা সাহিত্যে যত মেয়ে গোয়েন্দার দেখা মেলে, সেখানে বিষ ছাড়া অন্যরকম অস্ত্রও নেহাত অপ্রতুল নয়। মনোজ সেনের গোয়েন্দা, আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ দময়ন্তীর কথাই ধরা যাক। ‘সরল অঙ্কের ব্যাপার’ গল্পে চিনিতে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল বটে, যাতে সেই চিনি মেশানো শরবত খেয়েই ভিক্টিমের মৃত্যু হয়। উপরন্তু এ গল্পে খুনের অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল ঘরের চৌকাঠ। লম্বা এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে মৃত ব্যক্তির মাথায় মারা হয়েছে বলে ধারণা করেছিল পুলিশ, কিন্তু দময়ন্তী ঘরে বসেই এই কাহিনি শুনে ঘোষণা করে, “একটা জিনিস ধরেই নিচ্ছেন কেন যে অস্ত্র দিয়ে মাথায় মারলেই তবে মাথা ফাটে? মাথা দিয়ে অস্ত্রে মারলেও তো মাথা ফাটতে পারে?” তার ‘পর্বতো বহ্নিমান’ শীর্ষক কেসে আবার খুনি এবং ভিক্টিম দুজনেই মেয়ে। খুনের অস্ত্র প্রুসিক বা পিকরিক অ্যাসিড, যা মুখের ওপর ছিটিয়ে দিলে মৃত্যু ঘটে কিন্তু তার চিহ্ন থাকে না। ‘সূর্যগ্রহণ’-এ অপরাধীর সহকারী মেয়ে হলেও সে খুনি নয়। এ উপন্যাসে খুন হয়েছিল ড্র হিচ ফাঁসের সাহায্যে ভিক্টিমকে রোলারের সঙ্গে বেঁধে চলন্ত গাড়ির সামনে গড়িয়ে দিয়ে। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের গোয়েন্দা প্রজ্ঞাপারমিতা ওরফে মিতিন, ‘মারণ বাতাস’ রহস্যের শেষে বুঝতে পারে অসুস্থ ছেলের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সিরিঞ্জে বাতাস ভরে ইঞ্জেকশন দিয়ে তাকে মেরে ফেলেছিলেন মা, ডাক্তারি পরিভাষায় যে পদ্ধতিকে বলা হয় এয়ার এমবলিজম। ‘বিষ’ উপন্যাসে আপাতদৃষ্টিতে খুনের কারণ আর্সেনিক মনে হলেও শেষমেশ দেখা যায় মাকে ডিপ্রেশনের দুই বিপরীত প্রতিক্রিয়ার ওষুধ একসঙ্গে খাইয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল মেয়ে। আবার কিশোরপাঠ্য ‘আরাকিয়েলের হিরে’ উপন্যাসে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল প্যারাফিনের সঙ্গে পারদ মিশিয়ে তৈরি মোমবাতি দিয়ে। ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে শরীরে ঢুকে স্লো পয়জনিং ঘটাচ্ছিল পারদের বিষ।
যেখান থেকে এই প্রবন্ধের সূত্রপাত হয়েছিল, আবার সেখানেই ফিরে আসা যাক। অর্থাৎ বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের কাল্ট চরিত্র ফেলুদার কেস ফাইলে। ছোটদের জন্য লেখার দরুন বিষয়ের বাধ্যবাধকতা থাকলেও ফেলুদার পঁয়ত্রিশটি গল্পের মধ্যে কুড়িটির সঙ্গেই জুড়ে আছে কোনও খুনের ঘটনা। কিন্তু সাদামাটা খুন হলে আর ফেলুদার মগজাস্ত্রকে কাজে লাগানো যায় কী করে! তাই ফেলুর অধিকাংশ খুনের মামলাতেই খুনের পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে হত্যার অস্ত্র সম্পর্কেও মাথা ঘামাতে হয়েছিল সত্যজিৎ রায়কে। আর বাংলা ক্রাইম কাহিনির লেখকদের মধ্যে তিনিই প্রথম খুনের অস্ত্রশস্ত্র বিষয়ে একটা সাধারণ ধারণা পেশ করেছিলেন। ‘হত্যাপুরী’ উপন্যাস জানায়, অস্ত্র দিয়ে খুন সাধারণত তিন ধরনের হয়। এক, আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে; দুই, শার্প ইন্সট্রুমেন্ট, আর তিন, ব্লান্ট ইন্সট্রুমেন্ট বা ভোঁতা হাতিয়ার দিয়ে। যদিও এই তিনরকম অস্ত্রের কোনওটিই ব্যবহার না করে বিভিন্ন বিচিত্র পদ্ধতিতে যে হত্যা ঘটানো যায়, ফেলুর তা অজানা ছিল না।
ফেলুদা সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘বাদশাহী আংটি’-র কথাই ধরা যাক। লখনউয়ের ধনী ব্যবসায়ী পিয়ারিলাল শেঠের মৃত্যুর কারণ ছিল হার্ট অ্যাটাক, এমনটাই সবাই জানত। কিন্তু সেই হার্ট অ্যাটাকের আসল কারণ ছিল বনবিহারীবাবুর পোষা আফ্রিকার বিষাক্ত মাকড়সা, ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার। ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ উপন্যাসে হেলিকপ্টার পাইলট হিমাদ্রি চক্রবর্তী মারা যান জাল ইঞ্জেকশনের প্রভাবে। তাঁকে দেওয়া অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশনের মধ্যে আদতে ছিল স্ট্রিকনিন নামের তীব্র বিষ। আরেকটি মৃত্যু অবশ্য প্রথমে খুন বলে মনে হলেও পরে ঘটনার অভিমুখ পালটে যায়। ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ উপন্যাসে শেষমেশ তড়িৎ সেনগুপ্তের মৃত্যুর কারণ হিসেবে সাব্যস্ত হয় বজ্রপাত।
অস্ত্র ছাড়া শ্বাসরোধ করে খুনের ঘটনাও ঘটেছে ফেলুদা কাহিনিতে। তার মধ্যে নজর কাড়ে ‘ডাক্তার মুনসীর ডায়রি’-তে উল্লিখিত একটি হত্যাকাণ্ড। খুনি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, জর্জ হিগিনস। টেলিভিশনের জন্য বিদেশে জানোয়ার চালান দেওয়ার ব্যবসা ছিল এঁর। ঘটনাচক্রে এক সুইডিশ চলচ্চিত্র পরিচালককে টুঁটি টিপে খুন করে ফেলেন ইনি। তারপর পরিচালকের দেহ ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে নিজের সংগ্রহের একটা হিংস্র বনবিড়ালকে গুলি করে মারেন, যার ফলে পরিচালক হত্যার দায় গিয়ে বর্তায় পশুটির ওপর।
শার্প ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে খুন করা হয়েছিল অন্তত দশটি ফেলুদা কাহিনিতে। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ পটুয়া শশীবাবু, ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’-এ সুকিয়াস, ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’-এ বেয়ারা অবিনাশ, ‘নয়ন রহস্য’-এ হিঙ্গোয়ানি, এমন অনেকগুলো কেসেই খুনের অস্ত্র ছিল ছুরি। ‘যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে’ হিমাদ্রি চক্রবর্তীর বন্ধু অনীকেন্দ্র সোম এবং ‘দার্জিলিং জমজমাট’-এর বিরূপাক্ষ মজুমদার দুজনেই খুন হন ভোজালির আঘাতে। বিরূপাক্ষবাবুর বেয়ারা লোকনাথকে খুন করা হয়েছিল পেপার কাটার দিয়ে। তবে আগ্নেয়াস্ত্র বা শার্প ইন্সট্রুমেন্টের চেয়ে বেশি অভিনবত্ব দেখা গেছে ব্লান্ট ইন্সট্রুমেন্টগুলির ক্ষেত্রেই।
‘নেপোলিয়নের চিঠি’-তে খুন হয়েছিলেন কিউরিও সংগ্রাহক পার্বতীচরণ হালদার। তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল তাঁরই সংগ্রহে থাকা ভিক্টোরিয়ার আমলের একটি পেপারওয়েট। ‘টিনটোরেটোর যীশু’-তে নিয়োগীবাড়ির সেক্রেটারি বঙ্কিমবাবুকে খুন করা হয় ব্রোঞ্জের ঘোড়সওয়ার মূর্তির আঘাতে। পিতলের বুদ্ধমূর্তি দিয়ে খুনের একটি ঘটনা অবশ্য এরও আগে ফেলুদার গোচরে এসেছিল। ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ মহেশ চৌধুরীর বিগতযৌবনের এই অপরাধের কথা জানাজানি হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরে। ‘হত্যাপুরী’ উপন্যাসের অস্ত্রটি অবশ্য অন্যান্য সব ফেলুদা কাহিনিকেই টেক্কা দিয়ে গেছে। এ উপন্যাসে দুর্গাগতি সেনের সেক্রেটারি নিশীথ বোসকে হত্যার অস্ত্র ছিল দ্বাদশ শতাব্দীর সংস্কৃত পুথি অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, থুড়ি, পুথির কাঠের পাটা।
লন্ডনে যে ছেলেটির খোঁজ করতে গিয়েছিল ফেলুদা, সেই পিটার ডেক্সটর মারা গিয়েছিল মাথায় বইঠার আঘাত পাওয়ার পর অজ্ঞান অবস্থায় জলে ডুবে। আঘাত করেছিলেন ফেলুদার মক্কেল, রঞ্জন মজুমদার। ডাক্তার মুনসী খুন হয়েছিলেন হামানদিস্তার ডান্ডার বাড়িতে, একইভাবে খুন হন ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’-তে ইন্দ্রনারায়ণ আচার্য। এই একই অস্ত্র সঙ্গে নিয়ে গেছিলেন জটায়ু, ‘নেপোলিয়নের চিঠি’-র রহস্য উদ্ধারের জন্য যখন এক রাতে আততায়ীর মোকাবিলা করার প্রয়োজন পড়েছিল। অবশ্য নেপালের ভোজালি, অস্ট্রেলিয়ার ব্যুমেরাং থেকে মিলিটারি স্মোক বম্ব, এমনকি মন্দার বোসের নকল পিস্তল, কী ছিল না তাঁর অস্ত্রের সংগ্রহে! কিন্তু বলাই বাহুল্য, তার মধ্যে কোনওটিরই ‘মারণাস্ত্র’ হয়ে ওঠবার সৌভাগ্য হয়নি।
‘গোলকধাম রহস্য’-এ অন্ধ বিজ্ঞানী নীহার দত্ত খুন করেছিলেন বাড়ির ভাড়াটে দস্তুর ওরফে সুপ্রকাশ চৌধুরীকে। খুনের পদ্ধতি রাজা দশরথের শব্দভেদী বাণের কথা মনে করালেও এখানে বাণের জায়গা নিয়েছিল তাঁর হাতের রুপো বাঁধানো লাঠি। এককালের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, যার চক্রান্ত নীহারবাবুর দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যবনিকা টেনে দিয়েছিল তাঁর গবেষণাতেও, তার অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়াই ছিল নীহারবাবুর অসমাপ্ত কাজ। দস্তুরের হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গে হত্যার অস্ত্র চিনতেও ভুল হয়নি গোয়েন্দা প্রদোষচন্দ্র মিত্রের। নীহারবাবুর পিতামহের সূত্রে পাওয়া লাঠির আঘাত যত জোরালোই হোক, জিঘাংসার চেয়ে শক্তিশালী কোনও মারণাস্ত্র আছে কি?