মহাশ্বেতা আচার্য
সঙ্গীত, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রপ্রেমী; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জীববিজ্ঞানে গবেষণারত
There were some sheep who were afraid of the imaginary. And there were two gods’ shepherds, Cousin Alain and Uncle Jo, who longed for reality. Only a dog was needed for them to make circles around everybody, paying attention to each and every one; so, goes the law of democracy.
কান চলচ্চিত্র উৎসবের পাতায় জঁ-লুক গোদারের প্যাশন (১৯৮২) ছবিটার বিষয়ে এক স্তবকে লেখা এই আশ্চর্য কথাগুলো। ‘হু লংড ফর রিয়ালিটি’ কথাটা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে আমাদের খুব চেনা একটা ধারণা যে, মানুষ বাস্তব বা রিয়ালিটিতে ক্লান্ত হয়ে কল্পনায় আশ্রয় খোঁজে। অথচ গোদারের সিনেমায় প্রবেশ করতে গিয়ে বারবার মনে হয়, এই যে ‘কন্সট্রাক্টেড রিয়ালিটি’র খোঁজ, যা ১৯৮২-র এই ছবিতে উঠে আসছে ঘোষিতভাবে, সেই খোঁজ এর আগে ও পরে গোদার করে গেছেন তাঁর সিনেমায় নিরন্তর।
আমরা জানি, এক্কেবারে শেষের দিকে এসে, গোদার তাঁর একটি ছবির টাইটেল কার্ডেই বলবেন, “those lacking imagination take refuge into reality.” একথাটা ডিস্টোপিয়ান সিনেমার সেটআপে খুব অজানা নয়। কিন্তু গোদার ভীষণ বাস্তব মানুষদের টানাপোড়েনকে, শুধুমাত্র একটা পাসিং কমেন্টের বদলে, প্রায় জীবনের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন তাঁর কাজের বয়ানে। আমার মনে হয়েছে, আমাদের নাগরিক এবং আন্তর্জাতিক একাকিত্বকে ভীষণ ছুঁয়ে যাচ্ছেন পরের পর্যায়ের গোদার। হয়তো ছুঁয়ে যাচ্ছেন শুরু থেকেই, যখন তাঁর ছবিতে চরিত্র বা আখ্যানের প্রয়োজন এতটা ফুরিয়ে যায়নি। সেই থেকেই চলচ্চিত্রের যান্ত্রিক নিয়মগুলো ভাঙতে ভাঙতে নিরন্তর প্রশ্ন করছেন স্থাপিত সত্যকে অথবা যাদের সত্য বলে মনে হচ্ছে সেই ধারণাগুলোকে। আসলে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের ছোট্ট ছোট্ট জীবনে যতটুকু নিয়ম ভাঙি, তাঁর প্রতিটাই হয়তো আমাদের এই মাইক্রো-রিয়ালিটিকে একটু ধাক্কা দেওয়ার জন্য।
ঠিক এইখান থেকেই আমার মনে পড়ছে একেবারে অন্য একটা প্রসঙ্গ— রিয়ালিজম ও নমিনালিজমের মাঝখানে সেতুর মতন হয়ে থাকা ‘ট্রোপ’ বলে একটা মতবাদ বা ধারণা। ভাবা যেতে পারে, নীল জামা আর নীল কালির মধ্যে ট্রোপ হল ওই নীলচে-ভাব। এমনিতে ‘নীলচে’ বলে কোনও জড়বস্তু নেই, কাজেই নীলচে বলে কোনও কিছু আমরা আলাদা করে ছুঁতে পারি না, অথচ নীলার নীলকে বুঝতে পারি, জামার নীলকে বুঝতে পারি। এক্ষেত্রে অস্তিত্ব আর অনস্ত্বিত্বের মাঝে দাঁড়িয়ে এই নীলচে রঙের ট্রোপ। দার্শনিক তর্কের বাইরে, ট্রোপ হয়ে যায় জ্যঁর (genre)-ভিত্তিক, সিনেমা বা সাহিত্যের আখ্যানে যার ব্যবহার খুব স্বতঃস্ফূর্ত। ট্রোপকে ‘প্রায়’ প্রাসঙ্গিক-আর্কিটাইপ বলা যায়, যেমন ‘ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস’ অর্থাৎ বিপদোন্মুখ সহায়হীন কন্যা এবং তাকে বাঁচাতে ছুটে আসা “ঘোড়ার পিঠে রাজপুত্তুর”। এভাবে ভাবলে দেখব, আমাদের চিত্রাঙ্গদা–র ‘কুরূপা ও সুরূপা’ ঠিক দুটি বিপরীতমুখী ট্রোপ। এগুলোকে বলা যায় চরিত্রভিত্তিক ট্রোপ আর এধরনের ট্রোপ বহুল ব্যবহারে বা যথেচ্ছ ব্যবহারে সহজেই ক্লিশে হয়ে উঠতে পারে।
অন্যদিকে, বস্তুভিত্তিক ভাবনায় নব্যসভ্যতায় বিখ্যাত হয়ে আছে ‘ট্রেন ট্রোপ’। আমরা জানি, সিনেমার সেই প্রথম যুগের ট্রেনটি স্টেশনে এসে থামা থেকেই অর্থাৎ সিনেমার আদিতম পর্ব থেকেই ট্রেনের চলমানতা, সেই ‘মুভি’ হয়ে ওঠা, আমাদের প্রযুক্তিগত যুগবিভাগের অন্যতম প্রধান চিহ্ন। গোদারের ২০১৮র ছবি ‘দ্য ইমেজ বুক’ ছবিতে আমরা দেখি ক্রমানুসারে আসে চারটি দৃশ্যাংশ— আধুনিক একটি ছোট্ট মেয়ে যে অবাক হয়ে জানাচ্ছে ট্রেন আসছে “আ ট্রেএ—ন”, যে ট্রেন তখনও পর্দায় নেই; পরমুহূর্তে এসে পড়ছে এক ধূসর ডিস্টর্টেড ট্রেন বা ট্রেনের ছবি; তারপরে আসছে পর্দা-জোড়া ভীষণ ছেঁড়াখোঁড়া অথচ রঙিন ‘ইমেজ বা ‘IMAGE’ শব্দটা, যা এই ছবির শিরোনাম থেকেই, এবং তারপর সেই আদ্যিকালের স্টেশনে কিছু মানুষ প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে আসার দৃশ্য, যেখানে ট্রেন আসবে, আসবে, আসবে।
কাজেই জঁ-লুক গোদার যখন তাঁর সিনেমায় ট্রেনের ব্যবহার করছেন, আমরা জানি তা ডেকে আনবে কিছু চলতি এবং কিছু অপ্রচলিত ভাবনার অনুষঙ্গ, ডেকে আনবে স্বভাবসুলভ ইতিহাস চেতনা। আমাদের মন জানে ট্রেন সাধারণত একধরনের অগ্রগতি এবং লোকোমোশনের চিহ্ন। আবার আমাদের স্মৃতি জানে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা নেতিবাচক সরণ বা ডিসপ্লেসমেন্টের দ্যোতনাও বহন করতে পারে। ছুটির ট্রেন হয়, ভাবনার ট্রেন হয়, স্বপ্নের ট্রেন হয়, বাড়ি ফেরার ট্রেন হয় আর আমাদের মতন দেশগুলির সঙ্ঘবদ্ধ স্মৃতিতে তা লক্ষ লক্ষ মানুষের চিরন্তন ডিসপ্লেসমেন্টের ট্রেনও হয়।
তাই তারঁ ‘দ্য ইমেজ বুক’ ছবিতে যখন ট্রেন আসা বা সরে যাওয়া দেখানো হয়, সময়ের এবং রঙের প্রয়োগের বিপজ্জনক সীমান্তে দাঁড়িয়ে, তখন তা বিশ্বসিনেমার প্রথম ট্রেনকে মনে করাতে পারে, একটি আধুনিক পশ্চিমি মেয়ের ট্রেন আসতে দেখাকে মনে করাতে পারে। আবার মনে করাতে পারে আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত এই স্মৃতি, ‘পথের পাঁচালী’র একটি কাল্পনিক মেয়ের এই কাল্পনিক ট্রেন দেখার স্মৃতি, তাঁর ভাইয়ের অতীত প্রায় চিরতরে সরে যাওয়ার স্মৃতি এবং পাশাপাশি আমাদের ভাষার সিনেমার এই প্রথম ‘হয়ে ওঠার’ যূথবদ্ধ স্মৃতি। আমার ধারণা, বিভিন্ন চেনা ট্রোপকে ন্যারেটিভের স্ট্রাকচারের (আখ্যানধর্মী কাঠামো) বাইরে এনে ফেলে, গোদার এভাবেই ধরতে চাইছেন আমাদের ব্যক্তিগত লুকানো স্মৃতির চিহ্নগুলোকে, যারা নিজেরাই এক-একটা ন্যারেটিভ।
যে মুহূর্তে তাঁর সিনেমা সব অর্থেই আক্ষরিক প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠেছে, সেই মুহূর্ত থেকেই তাঁর সিনেমায় ছবি-ভাষা-শব্দের যে আপাত অসম সঙ্গম দেখি, তাকে আসলে একপ্রকার স্বাধীনতা বলেই আমার ভাবতে ইচ্ছা করে। গুডবাই টু ল্যাঙ্গোয়েজ ছবিতে গোদার যুগান্তকারী এক থ্রি-ডি শটে দর্শকদের দিতে চেয়েছিলেন “ইন-আই এডিটিংয়ের” স্বাদ, যেখানে আলাদা চোখে আলাদা সাবজেক্টকে দেখা যাবে একই দৃশ্য ভাগ হয়ে গিয়ে (রেফ: দ্য ডিসল্ভ ম্যাগাজিন)। আমার মনে হয় আসলে এই স্বাধীনতাটাই বৌদ্ধিক স্তরে তিনি দিতে চেয়েছেন তাঁর শেষ পর্যায়ের সমস্ত ছবিতে।
একেবারে আধুনিক ‘পপ কালচারে’ ইনফিনিটি ট্রেন নামের অ্যানিমেশন সিরিজের স্রষ্টা ওয়েন ডেনিস ট্রেনের ট্রোপকে ভাবতে চাইছিলেন নিজের মতন করে। অনন্তকাল চলতে থাকা এক ট্রেন, ধূ-ধূ মাঠের মধ্যে দিয়ে যার শুরু ও শেষ দেখা যায় না— এই ভাবনা তাঁর মনে এসেছিল একটি আন্তর্জাতিক বিমানে হঠাৎ জেগে উঠে চারদিকে যাত্রীদের আর তাদের সবার সামনে ধরা ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনের সারি দেখে। সেই থেকে ইনফিনিটি ট্রেন হয়ে ওঠে তাঁর দ্যোতক, হঠাৎ অজানা বা অস্বস্তিকর কোথাও এসে পড়াকে বোঝাতে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গোদার বারবার সচেতনভাবে চেষ্টা করেছেন আমাদের কিছু অস্বস্তির মধ্যে এনে ফেলতে— মিডিয়ামের মধ্যে দিয়ে, শব্দ ও ধারাভাষ্যের মধ্যে দিয়ে এবং আবহের হঠাৎ অনুপস্থিতির মধ্যে দিয়ে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মূলচ্যুত হওয়ার মানুষদের পরের-পরের প্রজন্ম বহু দেশে বড় হচ্ছে এখন। বেশ কিছু দেশে চলছে ইমিগ্র্যান্টদের তৃতীয়-চতুর্থ প্রজন্ম। এই মুহূর্তে, এই বছর পূর্ব ইউরোপে এবং অবশ্যই ইউরোপ-এশিয়া সীমান্তের দেশগুলিতে চলছে এক নতুন সরণ, নতুন উচ্ছেদ, নতুন শরণ। ভাবলে দেখা যাবে আমাদের প্রত্যেকের রিয়ালিটি আলাদা এবং একটু পিছিয়ে হাঁটলে কোথাও গিয়ে এক সুতোয় বাঁধা। আমরা দেখছি বিলক্ষণ ঘেঁটে যাওয়া একটা স্পেস— যেখানে ফাঁকা আশাবাদ আছে, অসংখ্য অস্বস্তি আছে, আত্মহত্যা আছে আর আছে অপ্রেম। এই পর্যায় থেকে একের পর এক আফগানিস্তান, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, ইরান, প্যালেস্টাইনের মতন ঘটনাগুলো পেরিয়ে এসেছি আমরা।
অথচ সেই কবে থেকেই গোদার তাঁর মহাকাব্যিক কাজ হিস্টরি অফ সিনেমা-য় (১৯৮৮-৯৮) বারবার যে অস্বস্তিকর শৈল্পিক ইতিহাস-মুখীনতা তৈরি করতে চেয়েছেন, পরবর্তী বিভিন্ন ছবিতে সভ্যতার আধুনিকতম সমস্যার ও মানব-হিংস্রতার যে কথা বারবার শোনাতে চেয়েছেন, সেকথা আজ মনে পড়লে কি আমাদের আফসোস হবে না?
আমরা দেখি, একেবারে শেষের দিকের সিনেমায় যে-ধরনের চিত্র ও চিত্রকল্পের ব্যবহার গোদার করছেন, সেখানে ইতিহাস এবং বর্তমান একেবারে গা-ঘেঁষে আছে (আক্ষরিক অর্থেই পর্দায়) সম্পৃক্ত হয়ে আছে। ছোট্ট ছোট্ট ছবি, আবহ, ধারাভাষ্যের আপাত অসংলগ্নতা— এসবই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গোদারের সিগনেচার হয়ে থেকেছে বা থাকবে, আগেও পরেও। এই যে সুপারইম্পোজিশন অফ ইমেজ— এইটুকুই আমাদের কঠিন বাস্তবকে সামান্য ধাক্কা দিতে দিতে যেতে পারে। বরং ভাবা যেতে পারে যে, তাঁর আগের পর্বের ছবিতে প্লট বা আখ্যান রাখার কিছু প্রয়োজন ছিল, ধাক্কা দেওয়ার কন্টেক্সট প্রয়োজন ছিল। আর পরের পর্বের ছবি হয়ে উঠল প্রকৃত স্বাধীন, যেখানে বিশ্ব-ইতিহাস ও রাজনীতিই হয়ে উঠল ইউনিভার্সাল কন্টেক্সট।
আমরা ভীষণ ভালবেসে (হ্যাঁ, ভালবেসেই) মনে রাখব, আমাদের স্মৃতির ও মস্তিষ্কের স্বাধীনতাকে গোদারের সিনেমা কোথাও কখনও একবারের জন্য অসম্মান করেনি। মনে পড়বে ভাষার ও ভাষার দৈন্য খোঁজার কথা বলতে গিয়েও এই সরণ বা ডিসপ্লেসমেন্টকে তিনি আবহে স্বীকার করেছেন বা প্রতিষ্ঠা করেছেন এই অপসৃয়মান আলোর মধ্যে দিয়ে। এই আলোর নিচে দাঁড়িয়ে, আমাদের নিজের নিজের বাস্তবের আর অবাস্তবের মধ্যে দাঁড়িয়ে, তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর পাশে দাঁড়িয়ে আমরা আজ তাঁর কথা মনে করব, আগামীকাল তাঁর কথা মনে করব, আর মনে করব যতদিন সিনেমা নামের এই মাধ্যম ও যতদিন “Histoire(s) du cinéma” বেঁচে থাকবে।