ব্র্যান্ড ‘বিশ্ববাংলা’র রাজ্য ছেড়ে কেন যাস তোরা দক্ষিণে?

ব্র্যান্ড ‘বিশ্ববাংলা’র রাজ্য ছেড়ে কেন যাস তোরা দক্ষিণে? | সরিতা আহমেদ

সরিতা আহমেদ

 

ছোটবেলা থেকেই একটা বড় শিক্ষা গুরুজনেরা দিয়ে এসেছেন। বাংলায়— স্বাস্থ্যই সম্পদ। আর ইংরেজিতে— Prevention is better than cure.

স্বাধীনতার পর থেকেই পশ্চিমবাংলা শাসক বদলের পাশাপাশি আপ্রাণ চেষ্টা করেছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নত পরিষেবা দিতে।

আজ ২০২২-এ পঁচাত্তুরে স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’ মোচ্ছবের দোরগোড়ায় এসে আমরা দেখছি মুড়িমুড়কির মতো নার্সিংহোম আর মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালে ছেয়ে গেছে এই রাজ্য। ঝাঁ চকচকে সেইসব ইমারত একাকী দাঁড়িয়ে, কোনও ডাক্তার বা রোগী ছাড়াই।

কারণ শাসকের একটাই লক্ষ্য— গুণমান যাই হোক না কেন ‘বিশ্ববাংলা’র ব্র্যান্ডিং বাড়ানো।

প্রতিবছর রাজ্য জয়েন্টে প্রচুর ছেলেমেয়ে দারুণ র‍্যাঙ্ক করে মেডিক্যালে ভর্তি হয়। সরকারি বা বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়তে যায়। জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকাও এদের গড়ে তোলার পেছনে অনেকটাই থাকে, নিঃসন্দেহে। উদ্দেশ্য একটাই টাকার চেয়েও মেধা ও সামগ্রিকভাবে উন্নত পরিষেবা দেওয়া।

আমাদের রাজ্যে মাধ্যমিকের ‘বাধ্য ছেলেপুলেরা’ মেধা তালিকায় এসে, বোর্ডের পরীক্ষায় সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে শুধু নানা বইবিপণীর বিজ্ঞাপনই দেয় না, প্রায় সবাই বলে “বড় হয়ে তারা ডাক্তার হতে চায়”। সুতরাং মেধাবী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাবিশিষ্ট ছাত্রছাত্রী বাঙালির ঘরে কম নেই। নইলে মেডিক্যাল কলেজের পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সংখ্যায় সারা ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম তিনে থাকত না।

তাহলে এত এত কলেজ, এত এত মেধা, এবং অলিগলিতে মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল গড়ে ওঠা সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত বাঙালি রোগীর একটা বড় অংশ, যারা শিক্ষিত, দেশদুনিয়ার খবর নিয়ে মোটামুটি ওয়াকিবহাল, তারা দক্ষিণভারতে চিকিৎসার জন্য দৌড়ায় কেন?

প্রশ্নটা সাধারণ আড্ডার ঠেক থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সভা সবেতেই ওঠে— গত কয়েক বছরে বাঙালিদের দক্ষিণভারতপ্রেম এত উথলে উঠছে কেন? কী এমন মধু ওখানকার হাসপাতালে আছে যা আমাদের নেই! এদিকে ভারতের মধ্যে একমাত্র আমাদের রাজ্যই নাকি বিশ্বমানের হয়ে ওঠার দৌড়ে সামিল, সেই লক্ষ্যের গালভরা নামও যেমন আছে, তেমনি আছে নতুন কলকাতায় বিশাল মাপের ফটকও— ‘বিশ্ববাংলা’।

তাহলে জেলাশহর ছাড়াও কলকাতার মানুষেরাই কেন কলকাতার ডাক্তারে ভরসা না রেখে ইডলি-দোসা-সাম্বারের দেশে ছুটছে?

এই ব্যাপারে একেবারে খেটে খাওয়া মানুষের অভিজ্ঞতা, বন্ধু-স্বজনদের অভিজ্ঞতা ও হালফিলে নিজের অভিজ্ঞতা বলব বলেই এই লেখার অবতারণা।

তবে এটা সস্তা সাধারণীকরণ নয়। হ্যাশট্যাগে লিখলে বলা যায় #নটঅলডক্টরস্‌! শিক্ষকতার মতো ডাক্তারিও একটা সেবামূলক কাজ তা বলাবাহুল্য। সুতরাং সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করানোটা চুড়ান্ত অপরিণামদর্শিতার কাজ। কিন্তু কথায় বলে— একটা পচা আম গোটা বস্তার আম নষ্ট করতে পারে। ঠিক সেরকমই কিছু পচা অথচ ভয়ঙ্কর সত্য অভিজ্ঞতার তালিকাটি মোটেও ছোট নয় আজকের কলকাতায়।

ঘটনা এক: আমাদের পারিবারিক বন্ধু ও একজন বিমাকর্মী গত চার মাস ধরে নিজের স্ত্রী এবং জামাইবাবুকে নিয়ে জেরবার হয়ে পড়েছিলেন। জামাইবাবুর হার্নিয়া অপারেশন হবে। প্রথমে রোগটা ধরাই পড়েনি, জেলাস্তরে নানা জায়গায় ঘুরে শেষে যখন অবস্থা খুব সঙ্গীন তখন খোঁজ পেলেন কলকাতার এক ‘খুব ভাল ডাক্তারে’র।

বাড়ির লোক তাঁর কাছে ছুটল। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সেই ‘খুব ভাল ডাক্তার’ জানালেন মেডিক্লেম যাই থাক— তাঁর অ্যাকাউন্টে আগাম পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে অ্যাডমিশনের দিনেই। অর্থাৎ অপারেশন সাকসেসফুল কিনা সেসব ভাবার অবকাশ নেই, আগে টাকা দিন। কিন্তু মেডিক্লেম থাকা সত্ত্বেও কেন ক্যাশলেস সুবিধা পাবেন না তিনি?

উত্তরে ডাক্তার বলেন— বিমা থেকে তাদের ফিজ পেতে দেরি হয় তাই এই ব্যবস্থা। বাড়ির লোক ফাঁপড়ে, সব শুনে রোগীর শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি মানসিক অবস্থাও শোচনীয় হয়ে উঠল। শেষে মাছের বাজারের মতো দরাদরি করে পঁচিশ হাজারে রফা করে সেই ‘খুব ভাল ডাক্তারবাবু’ রাজি হলেন অপারেশন করতে। ক্যাশলেস মেডিক্লেম খুব একটা কাজে এল না।

স্ত্রীর গাইনি ডাক্তার (অ্যাপোলো) অপারেশনের জন্য যা খরচ বলেছিলেন তাতে জমি বন্ধক রাখার উপক্রম হয়েছিল। পরে তাঁরা চেন্নাইয়ে অন্য এক হাসপাতালে প্রায় অর্ধেক খরচে সাফল্যের সঙ্গে অপারেশন করিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। না, কিছুই বন্ধক দিতে হয়নি।

ঘটনা দুই: আমার প্রিয় বন্ধুর দিদিকে পিজি, ফোর্টিস সহ কলকাতার বেশ কিছু হাসপাতালের ‘খুব বড় ডাক্তার’রা বলে দিয়েছিলেন তার সারভাইকাল ক্যান্সার হয়েছে। এমনকি হাতে যে মাত্র ছমাস সময় সেটার নিদানও দিয়ে ফেলেছিলেন। উপসর্গ বলতে ছিল অনিয়মিত ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং এবং তলপেটে মাঝেমধ্যে ব্যথা। কপাল ভাল যে তাঁদের আর্থিক সঙ্গতি ছিল, তাই প্রবল উৎকণ্ঠায় ও আত্মীয়পরিজনের পরামর্শে তাঁরা মুম্বাই টাটা ক্যান্সার হাসপাতালে দেখাতে যান।

সেখানে ডাক্তার সব টেস্ট রিপোর্ট দেখে অবাক স্বরে বলেন— “ক্যান্সার! কিস নে বোলা আপকো?” সবটুকু জেনে তিনি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলেন— কলকাতার ওইসব ডাক্তারের নামে কেস করে দিন— আমি এখান থেকে গিয়ে সাক্ষী দেব।

দিদির নেহাতই মেনোপজের আগের কিছু হরমোনাল কারণে অমন অসুবিধা হচ্ছিল। মুম্বাই থেকে মাত্র ২১ টাকার ওষুধ নিয়ে তাঁরা কিছুটা অবিশ্বাস নিয়েই (মাত্র ২১ টাকার ওষুধে সেরে যাবে!!) চলে যান হায়দ্রাবাদ সেকেন্ড ওপিনিয়নের জন্য। সেখানে আমার বন্ধুরা সপরিবার থাকে। সেখানে আরও দুজন ডাক্তার তাঁকে পরীক্ষা করে একই কথা জানান— ক্যান্সারের ‘ক’টুকুও নেই ওঁর শরীরে।

অথচ হাজারো টেস্ট ও ‘বড় ডাক্তারে’র ‘বড় ভিজিট’-এর ফাঁদে প্রায় লাখখানেকের বেশি খরচ হয়ে গেছে এই কলকাতায় বড়-মেজ-সেজ নানা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ঘুরে।

ঘটনা তিন: আমার মায়ের গলব্লাডার স্টোন ওপেন সার্জারি হয়েছিল ২০০০ সালে। তারপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস্ট্রিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় বহুবার ইউএসজি করা হয়েছে, রিপোর্টে বলেছে ‘সব নর্ম্যাল’। এখানকার ‘ভাল ডাক্তারেরা’ ডায়েট চার্ট আর গ্যাসের বড়ি ছাড়া কিছু দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি। তবে গত এক বছরে গ্যাস্ট্রিক সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় আমরা হায়দ্রাবাদে দেখাই। সেখানে আলট্রাসোনোগ্রাফি-তে পাওয়া যায় পিত্তনালী বা বাইলডাক্ট-এর একটা অংশ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গেছে এবং পিত্তনালীতে বেশ কিছুটা অংশে স্ট্রিকচার দেখা দিয়েছে— যা প্রথমে জন্ডিস ডেকে আনবে এবং পরে ক্যান্সারে টার্ন নিতে পারে। এমআরসিপি টেস্ট রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানালেন হয়ত বা ওই ফোলা অংশে সিস্ট বা টিউমার আছে, যা সেরে যাওয়ার কোনও ওষুধ নেই। আরও কিছু টেস্ট করে অপারেশন করাতে হবে, তবে খুব তাড়াহুড়ো না করে সময় নিয়ে আসবেন। কারণ এটি গত ২২ বছর ধরে বেড়েছে, নাকি রাতারাতি তা বোঝা যাচ্ছে না। এই একাত্তর বছর বয়সে মায়ের ব্যাপারে কেউই দেরি করার রিস্ক নিতে চাইছিলেন না।

এরই মধ্যে আমারও ওভারিতে ডারময়েড সিস্ট ধরা পড়ে, যা দ্রুত অপারেট করাতে হত। সুতরাং হায়দ্রাবাদ থেকে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। যেহেতু দুজনের ক্ষেত্রেই সেকেন্ড ওপিনিয়নের দরকার, এবং আমার চেয়ে মায়ের ব্যাপারটা বেশি জটিল— তাই আগে আমার সার্জারিটা হোক বলেই স্থির হল। সেকেন্ড ওপিনিয়নে গাইনি ডাক্তার আমাকে একই কথা জানালেন— এই সিস্টের কোনও ওষুধ নেই। সার্জারি করিয়ে নেওয়াই ভাল।

আমাদের মা-বেটির মাইক্রো ফ্যামিলিতে যেহেতু লোকবল নেই একেবারেই, দূরে গিয়ে অপারেশনের অনেক ঝক্কি ইত্যাদি— তাই পরিকল্পনা করি আমার সার্জারির পরে যেহেতু মাস খানেকের বিশ্রামের ব্যাপার, তাই আগে সেটাই হয়ে যাক। তারপর মায়ের অপারেশনটা কলকাতাতেই করাব।

নিজের অপারেশনের ডেট পেলাম খুব তাড়াতাড়িই। ইতিমধ্যে এক পরিচিত ডাক্তার-লেখকের পরামর্শে যোধপুর পার্কের এক চেম্বারে ‘এক নাম্বার গ্যাস্ট্রো সার্জেন’-এর কাছে গেলাম। তাঁর গুগল রেটিং হাই-ফাই, চেহারা হাই-ফাই, রকমসকম হাই-ফাই, প্রচুর জটিল কেস সারিয়ে প্রাপ্ত পুরস্কারের তালিকাও হাই-ফাই। সার্চ ইঞ্জিনে ‘বেস্ট গ্রাস্ট্রো সার্জেন ইন কলকাতা’ লিখলে প্রথমেই তাঁর নাম উঠে আসে অজস্র ডিগ্রি ও পুরস্কারের তালিকা সহ।

এহেন ‘বড় ডাক্তার’ আমার আসন্ন সার্জারি, শূন্য লোকবল ইত্যাদিতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে নিদান দিলেন দ্রুত মায়ের সার্জারিটা করিয়ে নিতে হবে। যাঁর রেফারেন্সে গিয়েছিলাম তাঁর নাম বলামাত্র উনি বলে দিলেন “হ্যাঁ আমি ওঁকে বলেছি সার্জারিটা আমিই করব।” হাবেভাবে বোঝা গেল যেন উনি ছুরিতে ধার দিয়ে বসেই আছেন।

এবার এল পরের ধাপের কথা। ডাক্তারবাবু নিজের নার্সিংহোমে অস্ত্রোপচার করতে চাইলেন। আমরা যখন ঢাকুরিয়ার আরেকটি হাসপাতালে হতে পারে কিনা (কারণ মায়ের হেলথ কার্ডে কিছু নির্দিষ্ট হাসপাতালের ইন্ডোর ট্রিটমেন্টের রিইম্বার্সমেন্ট পাওয়ার নিয়ম আছে) জানতে চাইলাম হেলথ কার্ডের কথা বলে, তখন ডাক্তারবাবুর হাসিমুখ গম্ভীর হয়ে গেল।

তিনি স্পষ্ট জানালেন, কোনওরকম মেডিক্যাল কার্ডের ব্যাপারে উনি এন্টারটেইন করবেন না। কারণ স্বাস্থ্যসাথী মার্কা হেলথ কার্ডে ডাক্তারদের নিজেদের ‘ফিজ’ পেতে অনেকটা দেরি হয়। তাই পেশেন্ট-পার্টির কাছ থেকে তাঁরা আগেই নিজের পেমেন্ট ‘বুঝে নেন’। পোষালে কাজ করেন, নইলে নয়। এরপর জানালেন—

ভর্তির দিনেই তাঁর নিজের চার্জটুকু আগে তাঁর অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দিতে হবে। তবেই অপারেশনে নামবেন তিনি। আমরা দৃশ্যতই চমকে গেছি। তবু কিছুটা ধাতস্থ হয়ে “কত টাকা তাঁকে দিতে হবে?” জানতে চাইলাম। উনি পার্সোনাল অ্যাসিট্যান্টকে ডেকে বললেন তাঁর অ্যাকাউন্ট ডিটেল পাঠিয়ে দিতে, নামধাম সব লিখে নিতে।

শেষে বললেন তাঁর নিজস্ব ওটি চার্জ— সাড়ে চার লাখ টাকা (মাত্র)! যা আগাম দিতে হবে তাঁর নিজের অ্যাকাউন্টে।

এছাড়া তাঁর টিমের জন্য আলাদা খরচা আছে এবং আছে হাসপাতালে ভর্তি থাকার খরচ— সেসব পরে দেওয়াথোয়ার ব্যাপার।

একরাশ শূন্যতা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মনে মনে হিসেব করে দেখলাম ডাক্তারের চার্জ, ওটি সহকারীদের চার্জ এবং প্রায় সাতদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার খরচ মিলিয়ে প্রায় এগারো লাখের ধাক্কা। অত টাকা একসঙ্গে দেখিইনি জীবনে। দেব কোত্থেকে!

অগত্যা নিজের অপারেশন শেষে কিছুটা সেরে উঠেই তাই মাকে নিয়ে আবার চলে গেলাম হায়দ্রাবাদ। দুজন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে বিস্তর গবেষণা শেষে, বন্ধুদের পরামর্শ নিয়ে শেষমেশ গ্লোবাল হাসপাতালে যে ঋষিতুল্য ডাক্তারবাবুর দেখা পেলাম, তিনি জানালেন মায়ের এক্ষুনি কোনও সার্জারির দরকার নেই। বদলে ইআরসিপি করে একটা স্টেন্ট বসিয়ে ব্লকেজ ও স্ট্রিকচার ছাড়িয়ে ফেলতে পারবেন তাঁর টিম। এতেই ৯৯.৯ শতাংশ কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবে কোনও রক্তপাত ছাড়াই।

দিন সাতেক ভর্তি সহ গোটা প্রসিডিওরে হাসপাতাল থেকে (সিঙ্গল কেবিন ভাড়া সমেত) শেষ দিনে মোট বিল এল— এক লাখ সত্তর হাজার।

হায়দ্রাবাদ থেকে ফিরে কিছু মেডিকেল সেক্টরে কাজ করা বন্ধুদের কাছে খবর পেলাম চিকিৎসাব্যবস্থাতেও এ রাজ্যে সিন্ডিকেট চলছে রমরমিয়ে। চলছে সহ-ডাক্তারদের মধ্যে কমিশনের খেলাও। একজন ডাক্তার আরেকজন সহকর্মীকে পেশেন্ট ‘ধরে দিয়ে’ আখের গোছাচ্ছেন ভালমতোই।

স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে প্রান্তিক মানুষেরা সুবিধা পাচ্ছেন, প্রচুর জটিল কেস সাফল্য পাচ্ছে, বহু মানুষ উপকৃত হচ্ছেন, ‘দুয়ারে সরকারে’ ভিড় আরও বাড়ছে, ভোটবাক্সেও তাঁর প্রতিফলন পাচ্ছি— এগুলো সবই ঠিক। এর পেছনের কারণ মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা— যাতে স্পষ্ট ভাষায় তিনি বলেছেন স্বাস্থসাথী কার্ডের কোনও রোগীকে ফিরিয়ে দিলে হাসপাতালের/ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল হবে। সেই ধমকি এবং জনরোষের ভাংচুরের ভয়ে কেউ ফিরিয়ে দিতে পারছে না দুঃস্থদের। কিন্তু একথাও উঠে আসছে যে, সরকারি কার্ডে ডাক্তাররা খুব বেশি টাকা পান না, ফলে জটিল অপারেশনে একরকম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন তাঁরা। কিন্তু রাজ্য সরকারের কড়া হুমকির মুখে তাঁরা নিরুপায়।

এইজন্যই আইনের ফাঁক গলে পাশাপাশি উচ্চমধ্যবিত্তদের হাবভাব বুঝে শুরু হয়েছে অন্য পথে ক্ষতিপূরণ। কলকাতার বেশ কিছু নামী-দামী বড় ডাক্তারেরা মধ্যবিত্ত রোগীদের ঘাড় ভেঙে হেলথ কার্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থের লোকসান পূরণের ব্যবস্থা করে ফেলছেন— সরাসরি তাঁর অ্যাকাউন্টে টাকা নিয়ে। যা ধারে ও ভারে বিরাট অঙ্কের— কিন্তু সেটার কোনও রসিদ মিলবে না। এ কি একরকমের কালো টাকা নয়? বাঁচার স্বার্থে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার আশায় এইরকমের ডাক্তারদের ‘খাঁই’ মেটাতে গিয়ে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন জমিবাড়ি বন্ধক রাখতে।

কিন্তু মুখে প্রতিবাদ তো দূর অস্ত কাউকে কিছু বলতেও পারছেন না ব্যক্তিগত স্বার্থে। এদিকে দ্রুত নিঃশেষিত হচ্ছে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স। এতে মধ্যবিত্তরা কতটা ক্ষতির মুখে পড়ছে— সেটার হিসেব কি কেউ করছে?

এছাড়া আছে কলকাতার ‘ভাল ডাক্তারদের’ লাইন পেতে ধরনা দেওয়া। রেলের বুকিং-এর মতো তিন-চার মাস আগে থেকে ডাক্তারের ‘ডেট পেতে’ লাইন দিতে বাধ্য হচ্ছেন রোগী। অথচ অন্য রাজ্যে এসবের বালাই নেইই। আমার মায়ের ক্ষেত্রে গাস্ট্রো-হেপাটিক সার্জারি বিভাগীয় প্রধান ও হাসপাতালের অন্যতম ফাউন্ডার মেম্বার তিনজনের টিম সহ যেভাবে যত্ন নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা করলেন তা এখানে ভাবাই যায় না।

এবার কি বোঝা গেল কেন কলকাতা ছেড়ে আমরা দক্ষিণে যাই?

ক্যাম্পের ভিড়ের ‘স্বাস্থ্য সাথী’ নাকি নীতিশিক্ষা ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’— বিশ্বাস রাখব কিসের উপর? শুনেছিলাম খোদার উপর খোদকারি করার লাইসেন্স যাঁর থাকে তাকেই এই ধরাধামে ডাক্তার বলা হয়— কিন্তু এমন অসাধু ডাক্তাররা যাঁরা একরকমের স্বঘোষিত ঈশ্বর হয়ে আখের গোছাচ্ছেন— তবে ভরসাটুকু কাকে ও কীভাবে করব আমরা?

প্রায়দিন মেডিক্যাল জার্নালে পড়ব উন্নত থেকে উন্নততম হচ্ছে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, অথচ সাধ্যের বাইরে থাকা সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের মরণবাঁচন তবে কি ভাগ্যের হাতেই থাকবে চিরকাল?

অন্যদিকে মুষ্টিমেয় কিছু পচামাছের জন্য পুরো দিঘির জল নষ্ট হবে? বদনাম হবে গোটা রাজ্যের চিকিৎসকদের? ‘বাংলাপক্ষ’-র মতো সংস্থা ‘বাঙালি অস্মিতা’কে হাতিয়ার করে বাংলা ও বাঙালির জন্য সোশাল মিডিয়ায় গলা ফাটাতে অথবা অবাঙালি হোর্ডিংয়ে কালি লেপনে ব্যস্ত থাকবে আর এদিকে কর্মসংস্থানহীন মেধাবী-বাংলা থেকে শুধু ব্রেন-ড্রেনই নয়, আমরা বাঙালিরা বিভুঁয়ে যেতে বাধ্য হব ধনপ্রাণ বাঁচাতে আর সুষ্ঠু স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে!

আর ‘কেন দক্ষিণে যাস তোরা?’— প্রশ্নটা যতবার শুনব ততবার কেউ মুচকি হাসব আর কেউ আত্মগ্লানিতে ভুগব! কারণ সবাই জানে বাংলার বুকে আজ যা কিছু ঘটমান বর্তমান তা যতই প্রতিকূল হোক না কেন আমজনতার কোনও সুরাহা হবে না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...