অশোক মুখোপাধ্যায়
পূর্ব-প্রসঙ্গ: দ্বিতীয় সঙ্কেততন্ত্র
চিন্তার শারীরতত্ত্ব
এবার প্রশ্ন হল, কথা বলার প্রক্রিয়া বোঝার সঙ্গে চিন্তন প্রক্রিয়ার সম্পর্ক কোথায়? কথা বলার শারীরতত্ত্ব না হয় বোঝা গেল। কিন্তু চিন্তার শারীরতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াটি কেমন?
প্রথমে দেখা যাক আমরা শুনি কী কী ভাবে। প্রশ্নটা অনেকের কাছে বাহুল্য মনে হতে পারে। কেন না, আমরা যে কান দিয়ে শুনি একথা শিশুরাও জানে। চারপাশের বিভিন্ন শব্দের পাশাপাশি অন্যের কথাও আমরা যেমন কান দিয়ে শুনতে পাই, আবার আমরা নিজেরা যে যা কিছু বলি, তার শব্দও পুরোটাই কান দিয়ে শুনে থাকি। এই অর্থেই ভাষাকে বলা হয়ে থাকে জ্ঞাপন মাধ্যম (means of communication)।
কিন্তু অনেকেরই জানা নেই, আমরা আরও একভাবে আমাদের নিজেদের কথা শুনতে পাই। তবে সেই প্রক্রিয়ায় অপরের কথা শোনা যায় না। শুধু নিজের কথাই শোনার অনুভূতি লাভ হয়।
সেটা হল, কথা বলার সময় আমাদের বাক্যন্ত্রের বিভিন্ন পেশির যে আন্দোলন হতে থাকে তার প্রতিবেদন প্রক্রিয়া। এসম্পর্কে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার ফলে আমরা যখন কথা বলি তখন স্বরযন্ত্র, কণ্ঠনালী থেকে শুরু করে তালু, মূর্ধা, দাঁত, ঠোঁট, জিহ্বা, নাক, ইত্যাদি অঙ্গগুলির যে সমস্ত পেশির স্পন্দন বা নড়াচড়া হতে থাকে তার প্রত্যেকটার একটা অভ্যন্তরীণ জবাবি দেহানুভূতি সংবেদন মস্তিষ্কের বাক্-সংবেদন কেন্দ্র বা হ্বার্নিক অঞ্চলে যেতে থাকে। এই সূক্ষ্ম সংবেদন প্রবাহের জন্যও আমাদের একরকম শ্রবণ অনুভূতি হতে থাকে (চিত্র নং-১৭)।
বিষয়টা বুঝবার জন্য যে কোনও পাঠক সহজেই একটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আপনি কোনওরকম শব্দ উৎপাদন না করে, মুখ বন্ধ রেখে, আপন মনে অনুচ্চারিতভাবে কিছু কথা বলুন। দেখবেন, আপনি কী বলেছেন শুনতে পেয়েছেন, বুঝতেও পেরেছেন। কোথাও কোনওরকম অস্পষ্টতা নেই। এই শোনাটা কীভাবে সম্ভব হল? এই কথাগুলি তো শ্রবণেন্দ্রিয় (কান) এবং শ্রবণ অন্তর্বাহী স্নায়ুকোষের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কে যাচ্ছে না।
কী ঘটছে তাহলে?
আপনি যেভাবেই কথা বলে থাকুন, এমনকি মনে মনেও, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মুখের এবং স্বরযন্ত্রের অসংখ্য পেশির সঞ্চালনের একটা সূক্ষ্ম সংবেদন শৃঙ্খল মুখ ও মাথার ভেতরকার অন্য স্নায়ুপথে মস্তিষ্কে চলে যাচ্ছে। তার ফলেই এই শোনার অনুভূতি হচ্ছে। সাধারণভাবে স্নায়ুর ভেতর দিয়ে যে কোনও সংবেদন বাহিত হওয়ার গতিবেগ গড়ে ৭০ ফুট/সেকেন্ড। তাই এই দেহানুভূতির প্রক্রিয়ায় আমরা বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পাই।
সুতরাং বিপরীতভাবে বলা যায়, আমরা যখন মনে মনে কথা বলি, তখনও বাক্যন্ত্রের মধ্যে আন্দোলন হয়, পেশিসঞ্চালন হয় এবং বায়ুস্তরের কম্পন হতে থাকে। এস ফ্লেচার, কে সি ফাবর্গ-অ্যান্ডারসেন, প্রমুখ স্নায়ুবিজ্ঞানীরা স্বরযন্ত্রের মধ্যে তড়িদ্দ্বার ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন, জোরে জোরে কথা বললে এইসব জায়গার পেশিগুলির সংশ্লিষ্ট স্নায়ুতন্তুতে যতটা তড়িৎ-স্পন্দন হয়, মনে মনে কথা বললেও একইরকম স্পন্দন হয়। কিন্তু তার তীব্রতা কম থাকে। অর্থাৎ, জোরে কথা বলার তুলনায় মনে মনে কথা বলার সময় বাক্যন্ত্রের বায়ুস্তম্ভের যে কম্পন হয়, তাতে তরঙ্গগুলির কম্পাঙ্ক (frequency) এক থাকলেও বিস্তার (amplitude) অনেকটা কমে যায়। স্পন্দনের তীব্রতা কমে যায় বলেই বাইরে থেকে তা শোনা যায় না। মানে, কর্ণগোচর হয় না।
এই মনে মনে কথা বলার প্রক্রিয়াই আসলে এক সূক্ষ্মতম স্তরে বিকশিত হয়ে চিন্তা করার সামর্থ্য হিসাবে ব্যক্ত হয়। অর্থাৎ, উচ্চারিত শব্দের ন্যূনতম তীব্রতায় মনে মনে অনুচ্চারিত স্বরে কথা বলার নামই চিন্তা। এইজন্য চিন্তন প্রক্রিয়াকে অনেক সময় অন্তর্মুখী ভাষা (internal speech) বা অস্ফুট ভাষা (inarticulate speech) বলা হয়। আর জোরে জোরে শোনার মতো করে কথা বললে তাকে বলা হয় বহির্মুখী ভাষা (external speech) বা সোচ্চার চিন্তা (articulated thinking)। দুটো ক্রিয়ারই শারীরতাত্ত্বিক বা স্নায়বিক প্রক্রিয়াগত ব্যাপারটা একইরকম। অর্থাৎ, কথনের সঙ্গে চিন্তনের পার্থক্য শুধু বাক্যন্ত্রের কম্পনের বিস্তারে এবং পেশিসঞ্চালন সংক্রান্ত স্নায়ুগুলির তড়িৎ-স্পন্দনের মাত্রায়।
ব্রোকার অঞ্চল থেকে বাক্যন্ত্রের পেশিগুলিতে সঞ্চালনের নির্দেশ যাওয়ার পরে পরেই এই পেশিসঞ্চালনের দেহানুভূতি হ্বার্নিকের অঞ্চলেও যেতে থাকে। আবার একই সঙ্গে শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে শোনা কথাগুলির সংবেদনও হ্বার্নিকের অঞ্চলে আসতে থাকে। এই প্রক্রিয়া বারংবার পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে এই দুই অঞ্চলের মধ্যে প্রথমে অস্থায়ী সংযোগ গড়ে ওঠে। তারপর একইরকম ধ্বনি বারবার উচ্চারণ ও শ্রবণের ফলে এগুলো স্থায়ী সংযোগে পরিণত হয়। এইভাবে শ্রুতিকথন পরাবর্তগুলি (audiophonetic reflex) ধীরে ধীরে সংশ্লিষ্ট অঙ্গগুলির পেশি ও অস্থিসঞ্চালনের এক স্বতঃপ্রণোদিত পরাবর্ত (proprioceptive reflex) হিসাবে ক্রিয়া করার ক্ষমতা অর্জন করে। তার ফলে যে কোনও উদ্দীপনা থেকেই বাক্-অঞ্চল উত্তেজিত হয়ে বাক্-শ্রবণ কেন্দ্রে শ্রবণ অনুভূতি পাঠাতে শুরু করে (চিত্র নং–১৮ দ্রষ্টব্য)।
আবার, মানুষের মস্তিষ্কের গঠন এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে স্নায়ুসংযোগের ব্যবস্থাটা এমন যে মস্তিষ্কের অন্য যে কোনও কেন্দ্র উত্তেজিত হলেই তার থেকে তরঙ্গের একটা অভিঘাত বাক্সঞ্চালন কেন্দ্রেও পৌঁছায়। তার প্রতিক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তরফে কিছু কথা জোরে বা আস্তে উচ্চারিত হয়। যেমন, ব্যথা লাগলে, অবাক হয়ে গেলে, আনন্দিত হলে, আমাদের মুখ দিয়ে অনেক সময়, আমাদের সচেতন ইচ্ছানিরপেক্ষভাবেই, কিছু না কিছু আওয়াজ, এমনকি কথাও বেরিয়ে আসে। শোনার কোনও লোক না থাকলেও। এর থেকে বলা যায়, যে কোনও ঘটনার প্রতিক্রিয়াতেই মানুষ চিন্তা করে। বরং বলা ভালো— চিন্তা করতে বাধ্য হয়। জাগ্রত ও সচেতন অবস্থায় সমস্ত সুস্থ মানুষই হয় কথা বলে, নতুবা, চিন্তা করে। এ না করে তার বাঁচার কোনও উপায়ই নেই।
ভাষা ও চিন্তার এই জটিল শারীরতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে একজন ফরাসি মনোবিজ্ঞানী, পোল চৌশার্দ (১৯১২-২০০৩), বলেছেন:
বাক্ ও বাক্-শ্রবণ কেন্দ্রগুলির অবস্থান পর্যালোচনা করলে গুরুমস্তিষ্কের কোথায় কী হচ্ছে বোঝা যায়। কোনও একটা জায়গা থেকে চিন্তনপ্রক্রিয়া ঘটছে, এরকম ব্যাপারটা নয়; চিন্তনপ্রক্রিয়া কথনপ্রক্রিয়ার বাইরে ঘটছে, এমনও নয়। বিশেষ বিশেষ সংবেদন গ্রহণ বা নির্দেশ প্রেরণের জায়গাগুলি বিশেষভাবে নির্দিষ্ট এবং সেইসব জায়গার ক্ষতি হলে কাজগুলিরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এই অর্থে নির্দিষ্ট বাক্ কেন্দ্র থাকলেও কথা বলা সুনিশ্চিত হয় কিন্তু কর্টেক্সের ব্যাপকতর জায়গা জুড়ে ক্রিয়ারত বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অসংখ্য সংযোগ সৃষ্টি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে। গুরুমস্তিষ্কের কর্টেক্সের নানা জায়গায় সঞ্চালন ক্রিয়া, স্বতঃপ্রণোদিত পরাবর্ত, দৃশ্য ও শ্রাব্য সংবেদন, ইত্যাদি সব কিছু মিলিয়ে যে বিমূর্ত ছবি ফুটে ওঠে তার ফলেই ভাষা চিন্তার বাহন হিসাবে কাজ করতে সক্ষম হয়।[1]
কথা বলা শেখা এবং মস্তিষ্কের বাক্-অঞ্চল ও বাক্-শ্রবণ অঞ্চলের মধ্যে স্থায়ী সংযোগ গড়ে ওঠার জন্য মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলির বৃদ্ধি এবং বহির্জগতের সঙ্গে সংযোগ ও অভিযোজনের দরকার। কেননা, মুখ বা স্বরযন্ত্রের আসল কাজ খাদ্য গ্রহণ, শ্বসন এবং আওয়াজ উৎপাদন। নিম্নমস্তিষ্কের সঙ্গে স্নায়ু সংযোগের সেই অংশগুলি মানবশিশুর ক্ষেত্রে জন্মসূত্রেই গড়ে ওঠে। আর ভাষার অর্থে, কথা বলার মতো করে অর্থবহ শব্দ উৎপাদন করা ও তা বোঝার কাজগুলি মস্তিষ্কের পক্ষে নতুন বাড়তি ও অভিযোজনমূলক দায়িত্ব। এর জন্য শিশুর জন্মের পর এই দেহাঙ্গগুলির সঙ্গে উচ্চতর মস্তিষ্কের, বিশেষ করে কর্টেক্সের, স্নায়ু সংযোগ গড়ে তুলতে হয়। তাতে অনেকটা সময় লাগে। এইজন্যই মানবশিশু জন্ম থেকেই কথা বলতে বা চিন্তা করতে পারে না। এই ক্রিয়া তাকে আস্তে আস্তে অর্জন ও আয়ত্ত করতে হয়।
কীভাবে— এবার সেই প্রসঙ্গ।
(আবার আগামী সংখ্যায়)
[1] Chauchard 1964, 67-68.
অত্যন্ত উপকারী লেখা ।অজানা তথ্য জানতে পারলাম ।ধন্যবাদ আপনাকে ।ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন ।