কণিষ্ক চৌধুরী
শিক্ষক, প্রাবন্ধিক
পূর্ব প্রকাশিতের পর
বর্ণ-জাতভেদ— রামমোহন রায় যেভাবে দেখেছিলেন
গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও উদার ও যুক্তবাদী মতকে সাদরে বরণ করতে দ্বিধা করেননি রামমোহন রায়। সময়টা তখন দুঃসময়।
ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। ইতিমধ্যে মুঘল যুগের প্রগতিশীল বিকাশের সমস্ত ছাপগুলি মুছে গেছে সমাজ থেকে। সমাজ পরিণত হয়েছে এক বদ্ধ জলাশয়ে। ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে সামাজিক-অর্থনৈতিক অসাম্য এক চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। এমন এক সময়ে রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩) এগিয়ে এলেন যুক্তি, মানবতা ও জ্ঞানের মশাল নিয়ে— প্রমিথিউসের মতো। বিরোধিতা করলেন শাস্ত্র ও আপ্তবাক্যের, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের, আর কুসংস্কার ও অন্ধত্বের। ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখক ও চিন্তাবিদরা রামমোহন নিয়ে বহু কথাই বলেন— কিন্তু যে বিষয়টি প্রায়শই অনুচ্চারিত থাকে তাঁদের লেখায়-কথায়, তা হল বর্ণ-জাতভেদ ব্যবস্থা। তাই বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করতে হবে।
বৃহত্তর সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখেই রামমোহন বর্ণ-জাত-এর সমস্যাটিকে তুলে ধরেছিলেন। ‘ব্রাহ্মণ’ সেবধি’ পত্রিকায় (১ নং, ১৮২১) তিনি লেখেন, পরাধীনতার কারণ হল “আমাদের অতিশয় শিষ্টতা ও হিংসা ত্যাগকে ধর্ম জানা ও আমাদের জাতিভেদ যাহা সর্ব্বপ্রকারে অনৈক্যের মূল হয়।”[1] শুধু তাই নয়, স্বদেশের প্রতি অনুভব-অনুভূতি থেকেও এই বর্ণ-জাতভেদ ভারতবর্ষের মানুষকে বঞ্চিত করে। ১৮ জানুয়ারি, ১৮২৮-এ একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন:
The distinction of castes introducing innumerable divisions and sub-divisions among them [Indian] has entirely deprived them of patriotic feeling […] have totally disqualified them from undertaking any difficult (economic) enterprise…[2]
রামমোহন উপলব্ধি করেছিলেন যে, বর্ণ-জাতভেদ কেবল মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থকেই বাধা দেয় না, সামাজিক-রাজনৈতিক ঐক্যের ক্ষেত্রেও বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ১৮৩২-এ ‘India, its boundary and history’ প্রবন্ধে সামাজিক সংহতি, বিন্যাস-নাশক ও রাজনৈতিক অনৈক্য সৃষ্টিকারী হিসেবে তিনি বর্ণ-জাতকে দায়ী করেছেন:
…a vast number of castes and sects, destroying every texture of social and political unity.[3]
একজন নিম্নবর্ণের মানুষের বর্ণ-জাতভেদমূলক ব্যবস্থার পীড়ন সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা হয়, রামমোহন ব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে সে অভিজ্ঞতা তাঁর হয়নি। যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের ভিত্তিতেই তিনি বর্ণ-জাত ব্যবস্থাকে বিচার করেছেন। তাঁর সমকালে শিক্ষিত, উচ্চবর্ণের প্রায় একশো শতাংশই হয় বর্ণ-জাত ব্যবস্থার সমর্থক, অথবা বিষয়টি সম্পর্কে উদাসীন। এরকম একটি রক্ষণশীল অসাম্যমূলক সমাজের দমবন্ধ করা সামাজিক কাঠামোর মধ্যে প্রায় একক প্রচেষ্টায় বর্ণ-জাতভেদের বিরুদ্ধে কলম ধরেন, বই লেখেন, তর্ক করেন, মানুষের মতামত পরিবর্তনের প্রবল চেষ্টা চালান। বর্ণ-জাত বিরোধী সংগঠিত সংগ্রামের কথা তখনও ভবিষ্যতের অপেক্ষায় ছিল। হরিচাঁদ, জ্যোতিবা ফুলে-দের আবির্ভাব হতে তখনও অনেক দেরি।
দুই.
রামমোহন কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ১৮১৫-তে। ওই বছরেই স্থাপন করেন আত্মীয় সভা। ইতিমধ্যে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ জেমস মিল, জেরিমি বেন্থাম সহ আরও অনেকের ভাবনা-চিন্তার। তাঁদের হিতবাদী মতবাদ দ্বারা খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী, তাই ইহজগৎই ছিল তাঁর কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। ইহজাগতিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই তিনি হিতবাদী চিন্তাধারার কাছাকাছি আসেন এবং সমর্থন জানান মুক্ত অর্থনীতির। এখন এই মুক্ত অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বাধা হল বর্ণ-জাত ব্যবস্থা। রামমোহন প্রতিষ্ঠিত আত্মীয় সভার অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল বর্ণ-জাতগত অসাম্য ও ভেদমূলক প্রথা। ১৮ মে ১৮১৯-এ India Gazette-এ এই সভা সম্পর্কে একটি খবর পাওয়া যায়। আত্মীয় সভার অধিবেশনে “জাতিভেদ পরিহার করিয়া বিভিন্ন জাতিভুক্ত পরিবারের মধ্যে সামাজিক আদানপ্রদান সমর্থন, খাদ্যে স্পর্শদোষ সম্পর্কে প্রচলিত বিধিনিষেধের অযৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা হত।”[4] বলাই বাহুল্য যে, আত্মীয় সভার প্রতিষ্ঠাই কেবল রামমোহনের হাতে হয়নি, এর নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনিই। ফলে, আত্মীয় সভার আলোচ্য বিষয়ের দিকে লক্ষ রেখে বলা যায় যে, রামমোহন বর্ণ-জাতভেদগত বৈষম্য ও তার ক্ষতিকর দিকগুলির বিষয়ে সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটি সামাজিক আলোচ্য বিষয়ে পরিণত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম তিনটি দশকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে একচেটিয়া বাণিজ্য চলছিল, রামমোহন তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মুক্ত বাণিজ্য নীতির কথা বলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল শিল্পায়ন ও শিল্পপুঁজির বিকাশ। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তার সহযোগী দেশীয় জমিদারবর্গ রামমোহনকে মোটেই সুনজরে দেখত না। রামমোহনের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, কোম্পানির এই একচেটিয়া বাণিজ্য ও চিরস্থায়ী ব্যবস্থা-সম্ভূত শাসনব্যবস্থা আসলে বর্ণ-জাত ব্যবস্থাকেই টিঁকিয়ে রাখতে চায়। এ-কথাই তিনি চার্লস গ্রান্ট (১৭৪৬-১৮২৩)-কে চিঠিতে লিখে জানান। তাঁকে রামমোহন বলেন যে, বর্ণ-জাত ব্যবস্থা শাসকগোষ্ঠীর কাছে একটি সেফটি ভালভ বিশেষ। তাঁর ভাষায়:
The institution of castes constitutes a source of security to the permanence of our East India government hitherto unparalleled in the history of the world.[5]
বর্ণ-জাত ব্যবস্থা একটি অসম, অনায্য ও শোষণমূলক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার প্রয়োজনে একটি ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যস্ত, অসম, অন্যায্য ও পীড়নমূলক ব্যবস্থা। ইউরোপীয় আমলা ও বুদ্ধিজীবীরা ভারতীয় সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির ইতিহাস চর্চা করে এটা উপলব্ধি করে যে, শাসন ও শোষণকে চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই বর্ণ-জাত ব্যবস্থা একটি চমৎকার কার্যকর মাধ্যম। এই ব্যবস্থা শাসন-শোষণ ব্যবস্থাকে সরল ও সহজ করে তোলে। তাছাড়া জনগণের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি একটি আধা-স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া। একই সঙ্গে এটি একটি অবস্থা (state)-ও বটে। তবে, শুধু আধিপত্য নয়, হিংস্রতা ও বলপ্রয়োগের কাজটিও বর্ণ-জাতের মধ্যে দিয়ে সংগঠিত হয়। হয়তো এতটা স্পষ্ট করে ইংরেজ আমলা ও বুদ্ধিজীবীরা না বুঝতে পারলেও, এটা তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বর্ণ-জাত প্রথার একটি বিভাজনমূলক বা ঐক্যধ্বংসকারী ক্ষমতা রয়েছে। অন্য ভাষায়, সমাজের অনৈক্যের মূল কারণই হল, এই বর্ণ-জাত প্রথা। এই কারণেই এই প্রথাটি পরিবর্তনের জন্য তারা কোনও উদ্যোগ নেয়নি। বরং নীরবতা/উদাসীনতাকেই তারা শ্রেয় মনে করেছিল। একই সঙ্গে তারা এটাও লক্ষ করেছিল যে, এই অসম ও অন্যায় ব্যবস্থাটি নানা ধরনের ধর্মীয় শাস্ত্র ও সাহিত্য দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। ফলে তারা ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বা ধর্মনিরপেক্ষতার (সেকুলারিজম নয়) নীতি গ্রহণ করে। লক্ষ্য একটাই— সমস্ত ধরনের রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাৎপদতাকে রক্ষা করা। রামমোহন সম্ভবত তা বুঝেছিলেন, আর সেই কারণেই মুক্তকণ্ঠে উদার চিন্তা ও বিজ্ঞানভাবনার প্রসার চেয়েছিলেন।
তিন.
বর্ণ-জাতভেদ কীভাবে অর্থনৈতিক সচলতাকে বাধা দেয় এবং সামাজিক স্থবিরতা সৃষ্টি করে তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ঘটনাটি ঘটে বেন্টিঙ্কের (১৭৭৪-১৮৩৯) গভর্নর জেনারেল (১৮২৮-৩৫) থাকাকালীন সময়ে। জনৈক ইংরেজ জনস্টন গঙ্গানদীতে বাষ্পীয় জাহাজ চালাবার এক পরিকল্পনা করেন। এই জাহাজে বিদেশি কর্মচারী ও কারিগরের বদলে দেশি মানুষদের নিয়োগ করতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হন। জনস্টন তাঁর ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে বলেছেন যে, এটা খুবই দুঃখের যে, এই দেশীয় যন্ত্রকুশলী কারিগররা কঠোরভাবে ধর্ম ও বর্ণ-জাতের বিধিনিষেধ মান্য করে। যা তাদের জাহাজে একসঙ্গে কাজ করতে বাধা দিত।[6]
রামমোহন ছিলেন গভীর দৃষ্টি ও বোধশক্তির অধিকারী মানুষ। বর্ণ-জাত প্রথার ভয়ঙ্কর কুপ্রভাবটিকে বুঝতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি। অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতা এই পশ্চাদগামী শক্তি সম্পর্কে তাঁকে সচেতন করেছিল। তিনি বর্ণ-জাতভেদ সম্পর্কে কেবল কতগুলি বিচ্ছিন্ন উক্তিই করেননি, এটিকে একটি সামাজিক ইস্যুতে পরিণত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই লক্ষ্যে বিষয়টি সম্পর্কে নানা প্রবন্ধ/পুস্তিকা লিখতেন, আবার প্রকাশ্য বিতর্কসভায় অংশগ্রহণ করে বিরোধী পক্ষকে পর্যুদস্ত করতেন। এইরকমই একটি বিতর্ক হয়েছিল ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বিহারীলাল চৌবের বাড়িতে। সেখানে তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী। সেকালে রক্ষণশীল সমাজের প্রধান পান্ডা রাধাকান্ত দেব এই সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন রামমোহনের সঙ্গে বিতর্ক করতে। বিতর্কে সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী নিদারুণভাবে পরাজিত হন। শাস্ত্রীমশাই শাস্ত্রচর্চায় শূদ্রকে কোনও অধিকার দিতে রাজি হননি। তিনি মনুর মতোই মনে করতেন শূদ্র থাকবে শিক্ষাহীন, শাস্ত্রহীন ও অধিকারহীন, ব্রাহ্মণকে অনুসরণ করাই তার একমাত্র কাজ। এই মতের বিপরীতে রামমোহন বিভিন্ন শাস্ত্র থেকে উদাহরণ দিয়ে দেখান— রৈক্ক, মৈত্রেয়ী, সুলভা, বিদুর, ধর্মব্যাদ প্রমুখের পুরাণ ও ইতিহাসপাঠের ফলে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। সুতরাং শূদ্রের ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করায় কোনও বাধা নেই। অন্যভাবে বললে, রামমোহন শিক্ষার দরজা সকল বর্ণ-জাতের মানুষের জন্য খুলে দিতে চেয়েছিলেন। আর এই শিক্ষাটা অবশ্যই হবে বিজ্ঞান ও পাশ্চাত্য শিক্ষা। কারণ এই শিক্ষা ছাড়া সামাজিক সচলতা বৃদ্ধি সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বর্ণ-জাত ব্যবস্থার অবসান। ১৮১৬-তেই কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার’ নামক পুস্তিকাটি। এই পুস্তিকায় তিনি শূদ্রশিক্ষার পক্ষে জোরালো মত প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়, এই বাংলা পুস্তিকাটি ইংরেজি, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় ছাপিয়ে বিনামূল্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন।
বিংশ শতাব্দীতে আম্বেদকর বর্ণ-জাত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে শিক্ষাকে যেমন হাতিয়ার করেছিলেন, তেমনই অসবর্ণ বিবাহ প্রচলনের ওপরও গুরুত্ব দেন। কারণ অসবর্ণ বিবাহ বর্ণ-জাত-প্রসূত সামাজিক দূরত্ব, পবিত্রতা-অপবিত্রতা ইত্যাদি ভাবনাকে দুর্বল করে এবং অবশেষে অবসান ঘটায়। আম্বেদকরের ১০০ বছরেরও পূর্বে রামমোহন বিষয়টির গুরুত্ব বুঝেছিলেন। সেই কারণে তিনি অসবর্ণ বিবাহের প্রস্তাব দেন। ওই একই লক্ষ্যে তিনি বিবাহ সংস্কারের কথা বলেন। তিনি মহানির্বাণতন্ত্রের ভাষ্য অনুসারে বিভিন্ন জাত ও সম্প্রদায়ের মধ্যে শৈব বিবাহের প্রস্তাব করেন। তিনি মনে করতেন যে, যদি অসবর্ণ বিবাহ স্বীকৃত হয়, তাহলে সমাজ অনেক সমস্যা ও সঙ্কটের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
নিজের যুক্তিকে শক্তিশালী করতে রামমোহন অশ্বঘোষ রচিত ‘বজ্রসূচী’র প্রথম অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ করেন (১৮২৭)। এই বইতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের জন্মভিত্তিক বর্ণবিন্যাসকে আক্রমণ করা হয়েছে। বইটির সিদ্ধান্তটি এইরকম: যাঁর ব্রহ্মজ্ঞান আছে, তিনি ব্রাহ্মণ। যাঁর ব্রহ্মজ্ঞান অল্পবিস্তর আছে, তিনি ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য। আর যাঁর মধ্যে ব্রহ্মজ্ঞান একেবারে নেই, তিনি শূদ্র। এর মধ্যে দিয়ে যা স্পষ্ট হয়ে গেল:
প্রথমত, বর্ণ সৃষ্টির ঐশ্বরিক উৎপত্তিবাদকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হল। অর্থাৎ ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে উল্লেখিত পুরুষ সূক্তের তত্ত্বটি ভ্রান্ত হিসেবে দেখানো হল। পুরুষ সূক্তে (১০/৯০/১১-১২) এক পুরুষের কথা বলা হয়েছে। “এর মুখ ব্রাহ্মণ হল, দু-বাহু রাজন্য হল, যা ঊরু ছিল তা বৈশ্য হল, দু চরণ হতে শূদ্র হল।”[7] আবার গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ১৩ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে— “চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্মাবিভাগশঃ” (৪/১৩)। অর্থাৎ গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে চারটি বর্ণ আমি [ঈশ্বর] সৃষ্টি করেছি। এখানে গুণ বলতে তিনটি গুণের কথা বলা হয়েছে। সেগুলি: সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। সত্ত্বগুণ বলতে জ্ঞান, ধৈর্য্য, ক্ষমা, উদারতা, সংযম ইত্যাদি বোঝায়। ব্রাহ্মণ হল এই সত্ত্বগুণসম্পন্ন। রজঃগুণ বলতে বোঝানো হয় বীরত্ব, শক্তি, সাহস, বীর্য ইত্যাদিকে। ক্ষত্রিয় রজঃগুণসম্পন্ন হলেও তার মধ্যে সত্ত্বগুণও থাকে, যদিও তা অপ্রধান। তমোগুণ হল নিকৃষ্টতম— মোন, মাৎসর্য, লোভ, হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা, অসংযম, অজ্ঞানতা ইত্যাদি। বৈশ্যদের মধ্যে রজঃগুণ প্রধান হলেও তাদের মধ্যে অল্প হলেও তমোগুণ থাকে। আর শূদ্রের পুরোটাই তমোগুণ। তাই তাদের প্রধান কাজ প্রথম তিন বর্ণের সেবা করা।[8]
রামমোহন এইসব ঐশ্বরিক তত্ত্বকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যেই ‘বজ্রসূচী’র ওই অধ্যায়টির বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন।
দ্বিতীয়ত, এর মধ্যে দিয়ে রামমোহন আরও একটি কাজ করে ফেললেন। গুণের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক ব্যাখ্যাটি, যার ভিত্তি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ, তাকেও বাতিল করা হল।
তৃতীয়ত, তাঁর অনুবাদের আরও একটা লক্ষ্য হয়তো ছিল। জ্ঞানের ভিত্তিতে চতুর্বর্ণ বিভাজনের ফলে বর্ণ ব্যবস্থাটি নমনীয় ও সচল হয়ে পড়বে— এটাই তাঁর আকাঙ্ক্ষা। কারণ ব্রহ্মজ্ঞান যদি ব্রাহ্মণ হওয়ার মাপকাঠি হয়, তাহলে, যে কোনও ব্যক্তি ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে পারে। ‘সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার’-এ তো তিনি প্রমাণ করেই দিয়েছেন যে, শূদ্রেরও ব্রহ্মজ্ঞান লাভের অধিকার আছে। সুতরাং শূদ্র, বৈশ্য বা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে ব্রাহ্মণ হওয়া কিছুই অসম্ভব নয়। আবার একই সঙ্গে ব্রাহ্মণঘরে জন্মগ্রহণ করেও যদি কারও ব্রহ্মজ্ঞান না থাকে, তাহলে সে শূদ্রে পরিণত হবে। ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
চার.
বর্ণ-জাতভেদের তীব্র বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও, ব্যক্তিগত জীবনে রামমোহনকে নানারকমের আপস করতে হয়। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের নানা কাজ তাঁর সামাজিক কর্মকাণ্ডকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন করে। যেমন, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতীক পৈতে তিনি চিরকালই ধারণ করে এসেছেন। ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় (১৯৩০) তিনি সঙ্গে ব্রাহ্মণ পাচক নিয়ে যান। আরও আছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনীর পরিশিষ্টে (১৯) পাওয়া যায় যে, রামমোহন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম সমাজে [আসলে ব্রহ্ম সভা] ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণের বিভাজিত অবস্থান। দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন:
যখন প্রথম ইহা [ব্রাহ্ম সমাজ] সংস্থাপিত হইল, তখন সেখানে কী হইত? তখন সূর্য্য অস্ত হইবার কিছু পূর্ব্বে একজন হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণ সমাজের পার্শ্ব-গৃহে উপনিষদ পাঠ করিতেন; সেখানে কেবল রামমোহন রায়, বিদ্যাবাগীশ, প্রভৃতি ব্রাহ্মণেরা উপবেশন করিয়া তাহা শ্রবণ করিতে পাইতেন; শূদ্রদিগের সেখানে যাইবার অধিকার ছিল না। সূর্য অস্ত হইলে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ ও উৎসবানন্দ গোস্বামী সমাজের ঘরে আসিয়া বেদিতে বসিতেন। উৎসবানন্দ উপনিষদ ব্যাখ্যা করিতেন, বিদ্যাবাগীশ রামমোহন রায়ের রচিত ব্যাখ্যান পাঠ করিতেন, এবং কখন কখন বেদান্ত দর্শনেরও ব্যাখ্যা করিতেন। সঙ্গীত হইয়া সেই সমাজ ভঙ্গ হইত। সেই সমাজের মধ্যে ব্রাহ্মণ, শূদ্র, খ্রীস্টান, মুসলমান সকলেরই সমান অধিকার ছিল।[9]
এখন প্রশ্ন হল, এগুলি কি তাঁর স্ববিরোধিতা, না কি সুবিধাবাদের লক্ষণ, না কি নিছক কৌশল? নির্মাল্য বাগচী তাঁর মতো করে একটি যুক্তি দিয়েছেন:
বৃহৎ মৌলিক নীতিগত প্রশ্নে রামমোহন কোনও আপস করেননি, তার জন্য সমাজের বিরুদ্ধে অনেক লড়াই করতে হয়েছিল, কিন্তু ছোটখাট প্রশ্নে তিনি আপস করেছিলেন, তার কারণ তিনি প্রধানত যে সমাজে বাস করতেন, সে সমাজের কাছেই তাঁর আবেদন। তিনি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাননি, তিনি সমাজের ভিতরে থেকে সমাজকে সংস্কার করতে চেয়েছিলেন।[10]
এই যুক্তিতে কেউ সন্তুষ্ট নাও হতে পারেন। কেউ মনে করতেই পারেন যে, এটা তাঁর চারিত্রিক দুর্বলতা এবং একই সঙ্গে আত্মপ্রবঞ্চনা। তাই ইতিহাসের মধ্যে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করাই ভাল। সেই সময়টি একটি আত্মবিরোধপূর্ণ সময়। পুরনো সমাজের সামনে আবির্ভূত হয়েছে অপরিচিত ঔপনিবেশিক শক্তি। মুঘল যুগের প্রগতিশীল বিকাশের স্রোত অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা সহ আরও কয়েকটি কারণে প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেল, আর ঔপনিবেশিক রাজশক্তির আবির্ভাব তাকে ধ্বংস করে দিল একেবারে। ফলে একদিকে রয়েছে পচাগলা দুর্গন্ধযুক্ত ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক সমাজ আর অন্যদিকে ইউরোপীয় স্বাধীনতা ও বিজ্ঞানের ধারণা। রামমোহনের কাছে এই বিকল্পের মধ্যে পাশ্চাত্য ভাষা, জ্ঞানবিজ্ঞান কুসংস্কারগ্রস্ত গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজের দাওয়াই বিশেষ। তাই তিনি যুক্তিসম্মতভাবে তাকেই গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর শিকড় ঐতিহ্যবাহী সমাজের মধ্যে। তাই নিষিদ্ধ বিদেশযাত্রায় পরাঙ্মুখ না হলেও সঙ্গে নিলেন ব্রাহ্মণ পাচক। দেবেন্দ্রনাথের সাক্ষ্যের মধ্যেও রয়েছে এই দ্বৈততা। সময় ও সমাজকে অতিক্রম করা সহজ কাজ নয়। ইতিহাসগতভাবে সকলেই সীমাবদ্ধ। রামমোহনের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁকে আপস করতে হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, পৈতা-ধারণ, শ্রাদ্ধ-শান্তি ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান রামমোহন করতেন, আর তা করতেন অনেকটা সামাজিক আচার বিবেচনা করেই। কারণ সে-সময় সামাজিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে প্রায় কোনও পার্থক্যরেখাই ছিল না। ফলে এগুলি পালন খুব একটা অস্বস্তির জন্ম দিত না। বিদ্যাসাগর ঈশ্বরচন্দ্রের ক্ষেত্রেও এ-কথা প্রযোজ্য। বর্তমানকালের সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের বিচারে এগুলি অপ্রগতিশীলতার লক্ষণ বলে মনে করা হলেও সে-সময়ের ক্ষেত্রে একেবারেই তা প্রযোজ্য হতে পারে না। বর্তমানেও প্রগতিশীল তকমাপ্রাপ্তরা এই কীর্তি করেন— আর রামমোহন-বিদ্যাসাগররা তো দুশো বছর আগের গল্প।
(আবার আগামী সংখ্যায়)
[1] উদ্ধৃত বাগচী, নির্মাল্য। ১৯৯৫ : ৭২।
[2] পূর্বোক্ত।
[3] Roy, Rammohan.
[4] বাগচী, নির্মাল্য। ১৯৯৫ : ৭২।
[5] উদ্ধৃত বাগচী, নির্মাল্য। ১৯৯৫ : ৭২।
[6] পূর্বোক্ত: ৭৪।
[7] ঋ. স.। ১৯৭৫ : ২ : ৫৭১।
[8] ঘোষ। ১৩৬৫ বাংলা : ১৬১-৬২।
[9] ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ। ১৯২৭ : ৩৫৪।
[10] বাগচী, নির্মাল্য। ১৯৯৫ : ৭৬।