নয়নদাদু গপ্পো

নয়নদাদু গপ্পো | যুগান্তর মিত্র

যুগান্তর মিত্র

 

দাদুর ভুলভাল গল্প শুনে তুই যে কী মজা পাস কে জানে! কোনও মাথামুণ্ডু বুঝতে পারি না। সেই তো রাজারানি আর রাজপুত্তুরের কথা। আজ আবার কোথাকার কোন প্রধানমন্ত্রীর গল্প! সব বানানো। অল ভোগাস!— বাইক চালাতে চালাতে বলেছিল শুভ্র। ওর গলায় বিরক্তির চিহ্ন। শুভ্রর সব কথাই হাওয়া আঁকড়ে আমার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমার জবাবের শব্দগুলো উল্টো হাওয়ার গতিতে ওর কান ছুঁয়ে যাচ্ছিল কিনা জানি না। তবু গলা উঁচুতে তুলে বলেছিলাম—প নয়নদাদুর গল্পটা কিন্তু ব্যাপক। দাদু ভীষণ মজার লোক। বানিয়ে বানিয়ে এমন মজার গল্প বলেন! শুভ্রর দিক থেকে আর কোনও পালটা কথা ভেসে আসেনি।

আমাদের যাত্রাপথের বিপরীত দিকে একে একে বাড়িঘর, গাছপালা, দোকানপাট, লোকজন সব বয়ে যাচ্ছিল। সেসব দেখছিলাম আর নয়নদাদুর গল্পটা মাথার মধ্যে বিনবিন করছিল। শুভ্রও নিশ্চিত সারা রাস্তা প্রধানমন্ত্রীকে চেনার চেষ্টা করে গেছে। একবার তো বলেই ফেলেছে— বড্ড চেনা চেনা লাগছে, বুঝলি। কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। আদৌ কি এইরকম কোনও দেশ আছে? নাকি পুরোটাই দাদুর কল্পনা? শুভ্র কী বুঝছিল অথবা বুঝছিল না জানি না, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম দাদুর গল্পের প্রধানমন্ত্রী ওর মাথা থেকে কয়েক গজ ওপর দিয়ে সাদা বকের মতো উড়ে গেছে, যার ডানার নিচে নিকষ কালো আন্ধকার। আমিও যে বুঝতে পারিনি, সেকথা ওকে আর বলিনি।

দীপককাকার চা-দোকানের আড্ডায় সেসময় যারা উপস্থিত ছিল, সবাই দাদুর গল্প শুনে ফিকফিক করে হাসছিল। তার মানে ওরাও চিনতে পেরেছে প্রধানমন্ত্রীকে। অন্তত ওদের কথাবার্তা শুনে বা ইঙ্গিত দেখে তেমনই মনে হয়েছিল। সবাই যখন নানা কথা বলাবলি করছিল, ও-ওকে ঠেলছিল বা চোখের ইঙ্গিত করছিল, দাদু তখন মিটিমিটি হাসছিলেন। বুঝতে পারছিলাম দাদু বেশ মজা পেয়েছেন। নয়নদাদু অবশ্য গল্প বলার সময় মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখেন। প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবার মুখে দৃষ্টি বুলিয়ে নেন। আজকের গল্পটা বলার সময় বিষ্ণু নামের এক কিশোর ভ্রূ তুলে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল— এই প্রধানমন্ত্রী কি আসলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নাকি মুখ্যমন্ত্রী, দাদু?

নয়নদাদু ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। এর আগে দাদুকে এইরকম রাগতে দেখিনি। প্রথমে চোখ সরু করে দেখলেন ছেলেটিকে। তারপর চোখেমুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলে উঠেছিলেন— এই পোলাটা বড্ড ইঁচড়ে পাকা। ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ করে। যা কই চুপ মারি শোন হারামজাদা! কোথার থিকা এইসব আসে কে জানে! বাইন…। খিস্তিটা দাদু গিলে নিয়ে বলেছিলেন— মাস্টার আছে বইল্যা গালিটা দিলাম না। নাইলে…

স্কুলের টিচার জানে বলে দাদু বরাবরই আমাকে মাস্টার ডাকেন। খানিকটা গুরুত্বও দেন। ফলে খিস্তি দিতে চান না আমার সামনে। তবে অভ্যাসবশত বেরিয়ে যায় মাঝেমাঝে। আর যদি কথার স্রোতে খিস্তি বেরিয়ে যায় কখনও, তখন লম্বা করে জিভ কেটে বলেন— কিছু মনে নিও না মাস্টার। ছুটোকালের অইভ্যাস তো। বাইরইয়া যায়। যদিও কিছু মনে করেছি কিনা তার জবাবের অপেক্ষা করেন না। নিজেই জবাব বুঝে নেন— জানি তুমি ভালা মানুষ। দাদুর কথায় কিছু মনে করো নাই।

বিষ্ণুর মতো আমিও দুবার প্রশ্ন করেছিলাম। দুবারই নয়নদাদু এমন ব্যাট চালিয়েছিলেন যে বলটা মাথার অনেক ওপর দিয়ে সোজা মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিল। সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। একবার বলটাকে অসহায়ভাবে গ্যালারিতে আছড়ে পড়তে দেখেছিলাম, আর-একবার গ্যালারির বাইরে।

নয়নদাদু মানুষটা ভালো। মাঝেমাঝে কথার মধ্যে খিস্তি মিশে যায়, এটুকুই যা দোষের। তবে অনেক শিক্ষিত ও বহিরঙ্গে মার্জিত মানুষকেও অবলীলায় খিস্তি উচ্চারণ করতে শুনেছি। তাই দাদুর মুখে খিস্তি শুনে খুব-একটা বিস্মিত হই না। শুভ্রর মুখে শুনেছি আমি না-থাকলে নাকি আরও বেশি মুখখারাপ করেন। আর মিটিমিটি হাসেন।

কী এক অসম্ভব টানে নয়নদাদুর কাছে ছুটে যাই কোনও কোনও শনিবার। সেটা দাদুর ভালবাসার আকর্ষণে হতে পারে, কিংবা আমাকে মাস্টার বলে আলাদা সমীহ করেন বলেও হতে পারে। নাকি নয়নদাদুর অদ্ভুত সব গল্পের জন্যই এমন টান অনুভব করি, জানি না। দিনকয়েক না-যেতে পারলে মন আনচান করে।

আমার বন্ধু শুভ্রর মাধ্যমে নয়নদাদুর সঙ্গে আলাপ। শুভ্র আর আমি ক্লাস ফাইভ থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত একই স্কুলে পড়েছি। উচ্চমাধ্যমিকে কমার্স নিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছিল বলে শুভ্রর সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় ছিলই না। কোনওরকমে বিকম পাশ করে কলেজ স্ট্রিটের এক পাবলিশারের অফিসে ক্যানভাসার হিসাবে যোগ দিয়েছে ও। সেই সুবাদে আমাদের স্কুলে আসা-যাওয়া শুরু করল। আবার বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। একদিন বই দিতে এসে নয়নদাদুর প্রসঙ্গ তুলেছিল শুভ্র। কী প্রসঙ্গে দাদুর কথা উঠে এসেছিল, এখন আর মনে নেই। তবে এমনভাবে কথাগুলো বলেছিল যে, আমিও রাজি হয়ে গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে দাদুর কাছে যেতে। খুব তো দূরে নয়! শুভ্র নিজেই যদিও উৎসাহ নিয়ে দাদুর কথা বলেছিল, কিন্তু আজকাল ওর আর তেমন ভাল লাগে না নয়নদাদুর গল্প। একঘেয়ে লাগে নাকি। নেহাত আমার উৎসাহ বেশি। তাছাড়া ওদের কোম্পানির কয়েকটা বই আমাদের স্কুলে পাঠ্য করার ব্যাপারে আমার ‘হাত’ আছে, তাই আমাকে নিয়ে যেতে আপত্তি করে না, অন্তত প্রকাশ্যে তো নয়ই।

শুভ্রর বাইকের পেছনে বসে কোনও শনিবার স্কুল থেকে চলে যাই দাদুর আড্ডাখানায়, দীপককাকার চায়ের দোকানে। আর অবধারিতভাবে নয়নদাদুর গল্প শুনে চমৎকৃত হই। দুপুর গড়িয়ে দিন যখন বিকেলের গায়ে হেলান দেয়, সেইসময় দাদু গুটিগুটি পায়ে চায়ের দোকানটায় আসেন। দাদুর গল্পের টানে অন্যরাও তখনই দোকানে আসে। দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে বলে আজকাল বিকেল ফুরোনোর আগেই ঘরে ফিরে যান নয়নদাদু। নিজেই বলেছেন একথা। ওপার বাংলার গল্প বলার সময় দাদুকে মনে হয় একজন প্রাক্তন স্বাধীনতা যোদ্ধা। রাজাকার আর পাক-সেনাদের অত্যাচারের কথা যখন বলেন, তখন তাঁর চোখ চকচক করে ওঠে। সারা শরীর থেকে রাগের আগুন বেরিয়ে আসে যেন। কিন্তু আজকের গল্পটা ওপার বাংলার নয়। আমার ধারণা এপার বাংলারও নয়। এইরকম কোনও দেশ আছে বলেও বিশ্বাস হয় না।

 

দুই.

গল্প শুরু করার আগে দাদুর কিছু প্রস্তুতি থাকে। গলা ঝেড়ে প্রথমেই একটা বিড়ি ধরাবেন তিনি। তারপর একে একে সবার মুখ দেখবেন আর ফুকফুক করে বিড়ি টানবেন। সেইসঙ্গে বিড়বিড় করবেন— আইজ কী নিয়া কই তোমাগো ভাবতাছি। গপ্পো তো ম্যালা মাথার মইধ্যে গিজগিজ করে। সেইসময় কেউ একজন নিশ্চিত বলবে— তোমার যেটা ইচ্ছে সেটা বলো দাদু। নয়নদাদু তখন মাথা নেড়ে বলবেন— আইচ্ছা, আইজ তাইলে এট্টা মজার গপ্পো শুনো। এবার বেঞ্চ থেকে ঋজু শরীরটা ঝুঁকিয়ে বিড়ির শেষাংশ মাটিতে গুঁজে শুরু করবেন তাঁর গল্প— শুনো তাইলে…। আজও সেভাবেই গল্প শুরু করেছেন। আমি আর শুভ্র যখন পৌঁছেছি, ততক্ষণে দাদুর প্রস্তুতিপর্ব সারা, শুরু করবেন গল্প বলা। ইশারায় আমাদের বসতে বলে তিনি চালিয়ে গেছেন গল্প।

–আইজ এক দ্যাশের গপ্পো কই তোমাগো। এই পিত্থিবীরই এক মজার দ্যাশ। দ্যাশটার নাম হইল গিয়া আমোদপুর। সেই দ্যাশের প্রধানমন্ত্রীর গপ্পো কইতে মন চাইতাছে।

আমোদপুর? এমন দেশের নাম তো শুনিনি! আমি কেন, আর কেউ শুনেছে বলে মনে হয় না। আমি ভূগোলের টিচার বলে আমার পক্ষে প্রশ্নটা সঙ্গতই ছিল— আমোদপুর নামে কোনও দেশ আছে নাকি দাদু? কোন মহাদেশের?

দাদু সপাটে ব্যাট চালিয়ে দিয়েছিলেন— নাই বইল্যা কিছু হয় না মাস্টার। আবার আছে বইল্যাও কিছু নাই। আছে মনে করলে আছে, নাই মনে করলে নাই। এই নিয়া আর প্রশ্ন কইরো না!

আমি দমে গিয়ে চুপ করে গিয়েছিলাম। তাছাড়া এই নিয়ে আর কিছু বললে গল্পটাই মাঠে মারা যাবে। তাই চেপে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। দাদু আবার একটা বিড়ি বের করে কানের কাছে নিয়ে দু-আঙুলে পাকাচ্ছিলেন। আমরা জানতাম, দাদু এবার বিড়ির আগুন জ্বালানোর দিকটাতে দু-বার ফুঁ দেবেন। তারপর দেশলাই দিয়ে বিড়িটা জ্বালিয়ে আয়েশ করে টানবেন। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে শুরু করবেন তাঁর গল্প। তাই সকলেই অপেক্ষা করছিলাম।

–আমোদপুরের এখনকার প্রধানমন্ত্রীর নাম সুমন বাক্যবাগীশ।
–সুমন বাক্যবাগীশ? তার মানে বাঙালি? একে দেশের নাম শুনিনি। এখন দেখছি প্রধানমন্ত্রীর নামও বাঙালির নামে। কোন দেশের কথা বলছেন দাদু?
–ওহ্‌ মাস্টার! আজ তোমার হইছেটা কী কও দিনি? এমন সব প্রশ্ন করো ক্যান? এই বুদ্দি নিয়া মাস্টারি করো ক্যামনে?

আমার দ্বিতীয়বারের প্রশ্নের জবাবটা শুধু মাথার ওপর দিয়েই নয়, একেবারে গ্যালারি পার করে স্টেডিয়ামের বাইরে বল চলে যেতে দেখলাম যেন। মুখ কালো করে, মাথা নিচু করে নিয়েছিলাম। দাদুর অবশ্য কোনও হেলদোল ছিল না। গল্প চালিয়েই গেলেন।

–ব্যাটায় ছুটোকাল থিকাই এট্টু আলাদা, বুঝলা কিনা! পড়াল্যাখায় ভালা ছিল না। অষ্টরম্ভা আর কি! এক্কেরে মাথা মোটা। সারাদিন শুধু ফক্কিকারি করি বেড়ায়। আর খুব মাথা গরম। যারে যা-না তাই কইয়া বেড়ায়। এইজন্যই কেউ ব্যাটার লগে মিলামিশি করতে চাইত না। সবসময় মেজাজ তিরিক্ষি থাকলে কেউ কি মিশতি চায়? তোমরাই কও দিনি! নাকমুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দাদু প্রশ্ন করেন। অবশ্য জবাবের তোয়াক্কা না-করে বলেই যেতে থাকেন— একদিন হইছে কী, সকালে ঘুম থিকা উইঠ্যাই ব্যাটায় টের পাইছে হ্যার মাথায় বড্ড যন্তনা। সে এক মহা ঝকমারি! কিছুতেই কমে না। মাথা য্যান ছিঁড়া পড়তাছে।

দাদুর গল্প এগোতে এগোতেই একবার লিকার চা আসে। যে-কেউ ইশারায় দীপককাকাকে চা দিতে বলে। সেও ট্রেতে করে এনে সবার হাতে হাতে কাগজের কাপ ধরিয়ে দেয়। অবশ্যই দাদুর হাতে সবার আগে দিতে হয়। গল্প শেষে আবার এক রাউন্ড চা না-হলে চলে না। আজ বিকেলেও তার অন্যথা হয়নি।

দেশটা বা প্রধানমন্ত্রীর নাম অজানা হলে কী হবে, গল্পের প্রধানমন্ত্রীকে খানিকটা চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না। মাথার মধ্যে গোটা গল্পটাই ঘুরঘুর করছিল। এসব ক্ষেত্রে অনেকের মতোই আমিও বউকে খুব ভরসা করি। তাই বাড়ি ফিরে ওকেই গল্পটা যতটা সম্ভব দাদুর মতো করে বললাম। আশ্চর্য হয়ে গেলাম, আমার বউ দ্রুত প্রধানমন্ত্রীকে চিনে ফেলল আর ব্যাপারটা খোলসা করল আমাকে আর শুভ্রকে। সেই থেকে আমার সমস্ত শিরা-উপশিরা দিয়ে পর্যন্ত কুলকুল করে হাসি বয়ে যাচ্ছে। দাদুর গল্পটা এইরকম:

প্রায় বিশ-বাইশ বছর আগে, এক সকালে সুমন বাক্যবাগীশ ঘুম থেকে উঠেই টের পেলেন ভয়ঙ্কর মাথার যন্ত্রণা। এমনই অবস্থা যে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল তাঁর। তিনি কোনও ওষুধ-বিষুধ খেতে পছন্দ করেন না। তবে আয়ুর্বেদিক ওষুধ হলে তাঁর কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু আয়ুর্বেদাচার্য সেইসময় অসুস্থ হয়ে নিজেই হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দীর্ঘদিন। তাই তাঁর থেকে ওষুধ খাওয়ার সুযোগ ছিল না। সুমনবাবু নাকি এতবছর পরেও আয়ুর্বেদিক ওষুধের ওপরই ভরসা করেন। আজব কাণ্ড, সেইদিনই ঘণ্টাখানেক পরে তাঁর বেডসাইডে থাকা ল্যান্ডলাইনে এক টেলিকলারের ফোন এল। রিনরিনে গলা শুনে সুমন নিশ্চিত হলেন মেয়েটির বয়স বেশি নয়। একে তীব্র মাথার যন্ত্রণা, তার ওপর একান্ত গোপনীয় ল্যান্ডলাইনে ফোন আসায় তাঁর বিরক্ত হওয়ার কথা ছিল। তার বদলে একটু উৎসাহিতই হলেন।

–তা তুমি আমার এই নম্বর পেলে কোথা থেকে? জিজ্ঞাসা করলেন সুমন।
–এসব আমাদের জোগাড় করতে হয় স্যার। এমনও হতে পারে আপনার কোনও কাছের লোক আমাদের নম্বরটা দিয়েছেন। আপনার ভাল চাই বলেই আমরা নম্বরটা খুঁজে নিয়েছি।

তাঁর মাথাব্যথার উপশমের কথা জেনে কাছের কেউ নম্বর দিয়েছে ভেবে সুমন আর প্রশ্ন করলেন না। বরং মেয়েটির কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন। মধুকণ্ঠে সে জানিয়েছিল, হেড অ্যান্ড ব্রেন রিপেয়ারিং সেন্টার থেকে ফোন করেছে। সুমন জানতে চেয়েছিলেন, সে যে কোম্পানির হয়ে কথা বলছে, তারা অসহ্য মাথার যন্ত্রণা সারাতে পারে কিনা। এসব ক্ষেত্রে যেমন হয় আর কি। মেয়েটিও কথাটাকে লুফে নিয়ে জানিয়েছিল, অবশ্যই পারে। একেবারে সেরে যাবে সব। উলটে আরও নানা সুযোগসুবিধার কথাও জানিয়েছিল সে। মহা উৎসাহে সুমন বাক্যবাগীশ সেই কোম্পানির প্রতিনিধিদের আসতে বললেন তাঁর বাড়িতে।

ঘণ্টাখানেকও পেরোয়নি, দুজন ষণ্ডামার্কা লোক হাজির হয়েছিল। তদের মধ্যে একজন ভারিক্কি চেয়ারার, চোখেমুখে বুদ্ধির প্রলেপ। কথা বলছিল খুব মৃদু অথচ আত্মবিশ্বাসী ঢঙে। সে সুমনের শরীরের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করল। মাথা দুলিয়ে জানাল— নাহ্‌, এভাবে হবে না। আমরা বরং আপনার ব্রেনটা খুলে নিয়ে যাই। রিপেয়ার করা দরকার। ব্রেন নিয়ে সুমনের কোনও আগ্রহ ছিল না। ও জিনিস থাকা আর না-থাকায় তাঁর কিছুই যায়-আসে না।

আশ্চর্যজনক ঘটনা হল, যেই মুহূর্তে ব্রেন খোলা হল, তখন থেকেই তাঁর মাথার যন্ত্রণা বন্ধ হয়ে গেল। এবং সেদিন থেকেই সুমন বাক্যবাগীশ হয়ে গেলেন অন্য মানুষ। সবসময় মুখে ঝুলত হাসির আলখাল্লা। কণ্ঠস্বর মোলায়েম। জনে-জনে গিয়ে হাতজড়ো করে কথা বলতেন। সবাই অবাক হত। একসময় সকলেই বুঝতে পেরেছিল এই সুমন একেবারেই আলাদা এক মানুষ। ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত ও জ্ঞানের কথা বলেন। খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে গেলেন তিনি। এতটাই সেই জনপ্রিয়তা যে, নানা সভাসমিতিতে তাঁকে ডাকা হত। কোনও ক্লাবের অনুষ্ঠানে তিনি বিশেষ অতিথির আসন অলঙ্কৃত করতেন। অনেকেই নানা ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ নিতেও শুরু করে দিল। তিনিও খুশি মনে মতামত দিতেন।

এইরকম জনপ্রিয় মানুষের দিকে সবসময়ই রাজনৈতিক দলের নজর থাকে। স্বভাবতই তাঁর দিকেও চোখ পড়ল প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের। তারা নানা অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকত। একসময় সুমন একটি রাজনৈতিক দলের দিকে ঢলে পড়লেন। এই দলটার প্রতি তাঁর অবশ্য ছোটবেলা থেকেই দুর্বলতা ছিল। সেই দলের লোকেরা তাঁকে ভোটে দাঁড় করাল। তিনি জিতেও গেলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা, অদ্ভুত বুদ্ধিমত্তা, প্রতিশ্রুতি প্রদানের ক্ষমতা, ঠান্ডা মাথা প্রভৃতি কারণে সম্মিলিতভাবে তাঁকেই দেশের প্রধানমন্ত্রী করা হল। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশবিদেশে তিনি ঘুরে বেড়ালেন। মাঝে মাঝেই দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন। ক্রমশ তিনি সারা দেশেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন। তাঁর প্রিয়জনে দেশ ভরে উঠল। এভাবেই বেশ চলছিল। কালক্রমে সুমন বাক্যবাগীশের মোলায়েম ব্যবহার রইল বটে, কিন্তু নয়নদাদুর ভাষায় ‘ফক্কিকারি’ করার প্রবণতা ফিরে এল। ফলে অনেকেই বিরক্ত হতে শুরু করেছেন।

বেশ কয়েক বছর পরে ‘হেড অ্যান্ড ব্রেন সেন্টার’-এর মালিক খেয়াল করলেন ল্যাবরেটরির কাচের জারে একটা ব্রেন পড়ে আছে। তার দাবিদার কেউ নেই। লগবুক ঘেঁটে ঠিকানা উদ্ধার করে তাঁর ঠিকানায় প্রতিনিধি পাঠালেন তিনি। জানা গেল এই ব্রেনটা যাঁর, তিনিই এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। নানা প্রোটোকল টপকে মালিক স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে হাজির হলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ব্রেন আর তাঁর দরকার নেই। ওটার জন্যই তাঁর কোনও উন্নতি হচ্ছিল না। উল্টে তিনি অসুস্থ হতেন। তার বদলে মালিক আবেদন জানালে প্রধানমন্ত্রীর কোষাগার থেকে ‘হেড অ্যান্ড ব্রেন সেন্টার’-এর উন্নয়নখাতে মোটা অর্থ অনুমোদন করা যেতে পারে।

প্রায় নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে মালিক প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আবেদন লেখার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। এবং কাজে গাফিলতির জন্য যে সমস্ত কর্মীকে বরখাস্ত করেছিলেন, তাদের সব্বাইকে পুনরায় কাজে বহাল করলেন।

প্রধানমন্ত্রীর নিজের দেশ আমোদপুরের জনগণ এখন অসহ্য মাথার যন্ত্রণার অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন। সবাই প্রতীক্ষা করছেন তাদেরও যেন মাথার যন্ত্রণা অনুভূত হয়। তাহলে তারাও নিশ্চিত উন্নয়নের দিশা পাবেন।

শোনা যাচ্ছে, দেশের আমজনতা যতই সুসময়ের জন্য অপেক্ষা করুক-না-কেন, আজকাল পরিযায়ী পাখিরা দেশান্তরে যাওয়ার সময় এড়িয়ে যায় সেই দেশের পরিসীমা।

শুভ্র আমাকে বাড়িতে নামিয়ে দেওয়ার সময় আমার বউ ওকে চায়ের কথা বলায় বসে পড়ল। তখনই বউকে গল্পটা বলেছিলাম আর বুঝে নিয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রীর বৃত্তান্ত। চা-বিস্কুট খেয়ে শুভ্র যখন বাইক চালিয়ে নিজের বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল, তখন আমার মাথার ওপর দিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ বক উড়ে যেতে দেখলাম। তাদের অন্ধকার-ছোঁয়া ডানার নিচ থেকে দিনাবসানের মরা-আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...