সম্বিত বসু
কবিতা লিখতে আসা যেন গ্রীষ্মকালে লেপের তলায় ঢুকে যাওয়া। তারপর আবহাওয়ার নিয়ন্ত্রণ ছাড়ানো ঘাম। লেপ অল্প ওপরে তুলে দেখা লাল-সাদাটে চৌকোর চারপাশে ক্যারামবোর্ডের ঘুঁটি ফেলার মতো আলোর পকেট। সেই পকেট দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের ছাদ। ঘরের ছাদ ফুটো করে উঠে গেলেই মহামেঘ, মহাআকাশ। কবিতা লিখতে আসা এক তরুণ সেই আকাশের তলায় বেছে নিয়েছে এক অন্যরকম আবহাওয়া।
‘দুনিয়ার ছটফটানিগুলো’ নামের একটি আজব কবিতার বই হাতে এসেছিল। কবি অনিন্দ্য সুন্দর রায়। ২০১৪ সালের লিটল ম্যাগাজিন মেলায়, এই বইয়ের একটা চাপা বিক্রি দেখেছিলাম। কিন্তু অনিন্দ্য সুন্দর রায়ের কবিতা এখন দেখতে পাওয়া যায় আর? লিটল ম্যাগাজিন বা যে কোনও বাণিজ্যিক কাগজে তাঁর প্রকাশিত শেষ কবিতা কেউ মনে করে বলতে পারবেন আজ? অথচ—
কোল্ডড্রিঙ্কস
নিজের দুঃখগুলো বাবা বুঝতে দেয় না কিছুতেই
মাঝেমাঝে এটা ওটা চেয়ে বসি, খাওয়াতে বলি
বাবা হাত ধরে দোকানে নিয়ে যায়
তারপর ফিরে আসি একসাথে
বাবা নিজেও জানে ধারের কোল্ডড্রিঙ্কস কখনোই ঠাণ্ডা থাকে না
বাবা এমনটাই। অনেকটা বইয়ের বিজ্ঞাপনে প্রচ্ছদশিল্পীর মতো, নাম থাকে না। তবু যায় আসে না। তাঁর কাজ আঁকা। প্রচ্ছদ করা। ভাবা। তিনি ভেবে যান। নিজের দুঃখ তাঁর আছে। দুঃখকে শিল্পে নিয়ে চলে যান। ওটাই ট্রান্সফরমেশন। দুঃখের পরশপাথর যেখানে ছোঁয়ান, যে দাগ দেন, শিল্প হয়ে ওঠে। ক্ষমতার বাইরে কেনা কোল্ডড্রিঙ্কস, যার নামেই নাকি কোল্ড আছে, ঠাণ্ডা আছে, তা কোল্ড থাকে না। একে ধারে নেবেন, তার ওপর ঠাণ্ডা চাই? এরকম একটা গলার খনখনে স্বর ভেসে আছে দোকানির থেকে। বাবার তখন অবস্থা কী? ছেলেটির? ঠাণ্ডা পানীয় বুকের মধ্যে ঢুকে যে আরাম, সেই আরাম, আরামের ঢেঁকুর পাওয়া যায় না। আরাম ও ঢেঁকুর পাওয়া যাবে না ধার চোকাবার দিনেও। বাবার সঙ্গে হাত ধরে এইরকম একটা সত্যি বুঝতে পারা যায়, কাঁচের শিশিভরা কালো গরম পানীয় গলায় ঢেলে।
দুনিয়ার ছটফটানিগুলো,অনিন্দ্য সুন্দর রায়, খোয়াবনামা, ৩০ টাকা
এই বাবা ধারের কোল্ডড্রিঙ্ক সম্পর্কে জানলেও, জানে না কলকাতা শহরে এত খাবারের নাম। ইটালিয়ান, স্প্যানিশ হাজাররকম ডিশের নামের ভেতর তিনি দেখতে পান লোডশেডিং। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে গেছে। কালো হয়ে আছে গ্রাম। সেইখানেই সাদা পেটমোটা মুড়ি। হাজার হাজার টিউবলাইটের মতো জ্বলছে। পাশাপাশি। হাত ঢুকিয়ে তুলে নেওয়া যায়। উচ্চারণ খুব সোজা। বাবাকে চিন্তায় পড়তে হয় না। লজ্জা পেতে হয় না—
খাবার
খাবারের এত অদ্ভুত অদ্ভুত নাম হতে পারে
শহরে আসার আগে বাবা বলেনি,
জানতো না।
জিভ ঠেকানোর আগে
উচ্চারণে আটকে থাকে মহাপৃথিবী
বেলা বারোটা বাজলে আমার মুড়ি খেতে ইচ্ছে হয়…
বোঝা যায় শহরে এসে পড়েছে এক কিশোর। কিশোর না হলেও তাকে যুবক বলা যায় না। অন্তত তাঁর বাবাকে দেখা তাঁকে কিশোর প্রতিপন্ন করছে। খাবারের এত নাম, এত আজব নামে সে চমকে চমকে যাচ্ছে। বাবা তো বলেনি। তারপর দেখল, বাবাও জানত না। কিশোর বয়সে মনে হয়, আমার বাবা সব জানে। এই বিশ্বাস এখানে অল্প অল্প করে ভাঙছে। শহরে এসে পড়া, এক গ্রামের কিশোর বিলিতি খাবারের বদলে মুড়ি খেতে চাইছে। এই তাঁর জিভের প্রার্থনা। মুড়ি খেলে হয়তো আবার বাবাকে সর্বজ্ঞানী মনে হবে। সব জানে এরকম একটা উচ্চাশা আর আনন্দ হবে ভেতর ভেতর।
এই বইয়ের কোনও কবিতাই বড় নয়। দু-ফর্মার ঝকঝকে এই বই, এখন কোথাও পাওয়া যায় না। কেন পাওয়া যায় না, সে নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেককিছু বলতে হয়। অনেক অনেক কবিতাই মনে রাখার মতো। মুখে মুখে বিলি করার মতো। খিদে থেকে অনিন্দ্যর কবিতা কোনদিকে চলে যাচ্ছে এই শহরে?
খিদেরা খুব আপন হয়
খিদে পেলে আমি রাস্তাদের চিবিয়ে খাই
হাওয়া হাওয়া সমস্ত গলিঘাট
চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া হয়ে গেলে
ঢেকুরের মতো রক্ত উঠে আসে
তারপর পেট চেপে থরথর করে বসে পড়ি কোথাও একটা
যন্ত্রণাদের কোনো একাকীত্ব নেই
দেখি সব মানুষ কোন জুতোর মতো হেঁটে বেড়াচ্ছে,
সবাই
কয়েকজন কে কি সবাই বলা যায়?
যায় হয়তো, যখন আর কেউ নতুন করে আসার থাকে না…
শহরে এসে একলা হয়ে গেল। সফলভাবে সে যুবক হয়েছে, সফল যুবক হয়নি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এখন চোখই দাঁত। শহর কামড়াচ্ছে। পাতে প্রথমে একটা উঁচু ফ্ল্যাট। পাতের ডানদিকে পাঁচিল। বাটিতে করে সরু একটা গলি। আর লঙ্কার মতো অন্ধকার জিভে লেগে গেলে অনেকক্ষণ শান্তি। কারণ এই অন্ধকারে কেউ আসার নেই। যারা আছে আছে। তারাই সবাই এখন। আমার কাছে সবাই। আর কেউ না হলেও চলে যাবে এখন।
কবিতার আরও উদাহরণ দেওয়া, আর কথা চলতে পারে। চলতেই পারে। আমরা কথা চালাতেই পারি যেখানে-সেখানে। মেসেজে। ইনবক্সে। চায়ের দোকানে। পার্টি অফিসে। যাদবপুরের মাঠে। আমাদের নিশ্চয়ই কথা হবে। এই বই দরকারে চালাচালি হবে।
কেউ একজন চিৎকার করছে, আর অন্য কেউ তাকে মিউট করে দেখছে। অনিন্দ্যর কবিতা বলতে আমি এইটুকু বুঝি।
এক-একটা কবিতা যেন লাল- নীল- হলুদ বাল্ব। নিজস্ব আলোয় উজ্জ্বল! সব আলো গায়ে মেখে নিলাম!