তিস্তা চক্রবর্তী
স্মাইলি
দেওয়ালটাই আজকাল ক্যানভাস ওর। সারা দুপুর মোমরঙের আঁচড়ে কত কী যে এঁকে চলে মেয়েটা! আয়ামাসি অকাতরে ঘুমোয়। টিভিতে কার্টুন নেটওয়ার্কও একের পর এক চরিত্রদের রঙ্গ-তামাশা দেখিয়ে ক্লান্ত। শুধু টুপুরের চোখে ঘুম নেই একফোঁটাও।
এই একটা সার্কল, এবার চোখমুখ করে দিলেই হয়ে যাবে স্মাইলি। এবার আরেকটা সার্কল এঁকে ঠোঁটের শেপটা উল্টে দিলেই স্যাডফেস হয়ে যাবে। টুপুর গতকাল কাউন্টিং-এ স্যাডফেস পেয়েছে। মা খাতাটা দেখে মুখটা গম্ভীর করে বলেছিল— যাও, স্পুনস্ট্যান্ডে কটা স্পুন আছে, কটা নাইফ আছে আর কটা ফর্ক আছে গুনে এসে এক্ষুনি বলো আমায়।
সবকটা ঠিক হয়েছিল বলে মা অ্যাত্ত হামি দিয়েছিল। মায়ের স্কুলটা এত দেরিতে ছুটি হয় কেন কে জানে…
টুপুর ব্যালকনিতে রাখা তার ফেভারিট বিনব্যাগে চড়ে বসে। চোখ সজাগ সামনের রাস্তায়। আর একটু পরেই মা ফিরবে…
স্কুল থেকে ফিরে মণীষা রোজ দেওয়ালটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। আদরে আঙুল ছোঁয়ায় ওই লালনীলসবুজবেগুনি আঁকিবুকিতে। দুটো হ্যাপিফেস হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে একটা দুধসাদা পেন্টহাউসের দরজায়। দূর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে একটা আবছা হয়ে আসা স্যাডফেস।
একলা দাঁড়িয়ে থাকা গুলমোহরগাছটা থেকে ফুল ঝরে যায় অবিরাম।
উল্টোদিকের দেওয়ালে টাঙানো ফ্যামিলি ফটো থেকে একটা মানুষ কখন যেন একটু দূরত্বে সরে দাঁড়ায়। একা, ম্লান।
মণীষা আঁচল দিয়ে তার মুখ মুছে দেয়। সময়ের ধুলো ঝরে যায়। একজোড়া উজ্জ্বল চোখ হাসিমুখে চেয়ে থাকে টুপুরের আঁকা ছবিটার দিকে।
চোরাবালি
পুরনো অ্যাকোয়েরিয়ামটা বদলে নতুনটা এসেছে সপ্তাখানেক হল। আগেরটার তুলনায় এটা আকার আয়তনে বেশ খানিকটা বড়। সাতশো স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাটের ছিমছাম সাজানো ড্রয়িংরুমের পক্ষে কিছুটা বেমানান তো বটেই। বাড়িতে আনা ইস্তক তাই কেয়া গজগজ করেই চলেছে— নিজেদেরই হাত-পা মেলার জায়গা পাওয়া যায় না ঠিকমতো, উনি মেতেছেন মৎস্যবিলাসে! নিজে তো এসব উৎপাত কিনে এনেই খালাস… এদের খেদমত খাটার জন্য তো এই একজন মুফতের দাসিবাঁদি রয়েছে কিনা…
আমি জানি কেয়ার এই রাগ যতটা না অ্যাকোয়েরিয়ামের ওপর, তার চেয়ে অনেক বেশি আমার ওপর। তাই কেয়া যখন অশান্তি করে, যা মুখে আসে তাই বলে, আমি সেসব তেমন গায়ে মাখি না। আসলে ওর এই রাগীমুখটা বাইরের খোলস ছাড়া কিছুই নয়, ভেতরে-ভেতরে বড্ড মায়া মেয়েটার। এই তো গত মাসের শেষের দিকেই, যখন গাপ্পিজোড়ার একটা হঠাৎই মরে গেল, খুব কান্নাকাটি করেছিল কেয়া। মরা মাছটাকে অ্যাকোয়েরিয়াম থেকে বের করে জল পাল্টে দিচ্ছিল যখন, পচা আঁশটে গন্ধে আমার গা গুলিয়ে উঠেছিল। অদ্ভুত ব্যাপার হল, কেয়া কিন্তু একটুও ঘেন্না পাচ্ছিল না কাজটা করতে। একবারের জন্য নাকে আঁচল চাপাও দেয়নি দুর্গন্ধ আড়াল করতে। মরা মাছটার স্থির পলকহীন চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল খানিকক্ষণ। তারপর ঠান্ডা গলায় বলেছিল— যাক, বেঁচে গেলি তবে… একজনের অন্তত বন্দিদশা ঘুচল চিরতরে…
কথাটা যে আমাকে শুনিয়েই বলেছিল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। কোনও প্রতিবাদ করিনি সেদিন। শুধু আঙুলের সামান্য ভুলে সুদৃশ্য চায়ের কাপটা টেবিল থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে গেছিল। আরেকটা সুন্দর জোড়াও একলা হয়ে গেল এই ঘটনার সঙ্গে-সঙ্গেই। কেয়ার খুব পছন্দের ছিল কাপদুটো। নষ্ট হয়ে গেল, আমারই জন্য।
অন্য সময় হলে কেয়া হইচই করত, রাগের মাথায় হয়তো আরও দুটো কাচের জিনিস ভাঙত। কিন্তু সেদিন একদম থমথমে গলায় বলে উঠেছিল— এত হিংসে! এখনও! এবার শান্তি পেয়েছ তো!
আমি মাথা নিচু করে ভাঙা কাপের টুকরোগুলো কুড়োতে লাগলাম। বলা যায় না, বেখেয়ালে হয়ত কেয়ারই পায়ে বিঁধে একটা রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে গেল…!
কেয়াকে ভালবাসার কথা বললে মুখ বেঁকিয়ে বলে— আদিখ্যেতা…।
তবু আমি রোজই কেয়াকে কানে-কানে বলি, ভালবাসি। ওর ঘুমন্ত মুখটা তখন অদ্ভুত নরম দেখায়। সামান্য খোলা ঠোঁটদুটোতে চুমু দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু একতরফা চুমু আমার একটুও ভাল লাগে না। কেমন যেন বাসি মাংসের গন্ধ এসে লাগে নাকে।
সরে আসি ওর ঘুমের পাশ থেকে। আমি জানি ও এখন স্বপ্নে জয়ন্তর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে রেখেছে আরামে।
ড্রয়িংরুমে এসে রকিং চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিই। ডিমলাইটের নীলচে আলোয় অ্যাকোয়েরিয়ামটাকে সমুদ্রের মতো দেখাচ্ছে এখন। ছটফটে মলিটা তার সঙ্গীর সঙ্গে খুনসুটিতে মত্ত। জয়ন্ত বাড়িতে এলে কেয়াও ঠিক এরকমই কিশোরীর মতো উচ্ছল হয়ে উঠত। বিরক্ত লাগত আমার ওদের হাহাহিহি দেখে। আড়ালে কেয়ার মতোই মুখ বেঁকিয়ে বলতাম— আদিখ্যেতা…
–বড্ড বাড়াবাড়ি করছ কিন্তু, এখনও ঘুমোওনি কেন শুনি?
কেয়ার গলা। আমাকে পাশে দেখতে না পেয়ে উঠে এসেছে বিছানা ছেড়ে…
–ঘুম আসছে না আমার।
–আসবে ঠিক। মাথায় হাত বুলিয়ে দেব, চলো…
–আর জয়ন্ত?
–আহ, আবার! জয়ন্ত আর আসবে না, জানো না তুমি?
কেয়া পেছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে। জুঁইফুলের গন্ধ ভেসে আসছে ওর গা থেকে এখন। নরম বুকের ভাপ। বুঝতে পারছি ক্রমশ ডুবছি ভাললাগায়। চোখ বন্ধ করে ফেলি। অ্যাকোয়েরিয়ামের নীল জলে বুদবুদ ওঠে। ঢেউয়ের শব্দ। দেখি সেই একলা গাপ্পিটা! ঠোঁট হাঁ করে এগিয়ে আসছে আমারই দিকে। চিৎকার করে ডাকতে যাই— জয়ন্ত…!
পারি না। কেয়ার ঠোঁট ততক্ষণে গিলে নিয়েছে আমায়। দমবন্ধ লাগছে খুব।
গাপ্পিটা আমার দিকেই তাকিয়ে। ওর চোখে চোখ রাখতেই আমাকে চোখ মেরে বলে উঠল—
–ডুবে মর শালা…
টোপ
প্রতিদিন মানুষটাকে ঠিক একইভাবে জোড়াদিঘির পাড়ে বসে থাকতে দেখে শোভন। ছিপ ফেলে একদৃষ্টে তাকিয়ে জলের দিকে। অবিচল। অল্প দূরে বসে থাকা অন্যান্য অত্যুৎসাহী শখের মৎসসন্ধানীদের গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা কিছুই যেন স্পর্শ করে না তার একাগ্রতাকে। শোভন মুগ্ধ হয়। ভাবে, জীবনের আসল সময়ে যদি সে এই লোকটার মতো আরেকটু কনসেন্ট্রেট করতে পারত তাহলে হয়তো এমন বেচুবাবু হয়ে সেলস ডিপার্টমেন্টে পচে মরতে হত না, আর রুমেলাও তাকে ছেড়ে… হয়তো!
মোড়ের মাথায় বিনুদার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটা গোটা সিগারেট পুড়িয়ে খরচ করা অব্দি তার এই আত্মদর্শনের বিলাসিতা চলে। তারপর আবার যে কে সেই ঘোড়দৌড়। ট্রেন ধরার তাড়া… ক্লায়েন্ট মিট… ক্লান্ত লাগলেও দম ফেলার উপায় নেই।
টার্গেট আর টার্গেট। এই একটা শব্দ বিষাক্ত তিরের মতো সারাক্ষণ বিঁধে থাকে মাথার ভেতরে, যতই সেই তিরের পেছনে ‘ইনসেনটিভ’ নামক রঙিন পালকটি গোঁজা থাকুক না কেন…
সিগারেটের শেষটুকু ঝকঝকে পালিশ করা বুটের পেছনে ফেলে পিষতে পিষতে শোভন জিজ্ঞেস করে—
–এই বিনুদা, মালটা কে গো, চেনো? রোজ এরকম গেঁড়ে বসে থাকে একই জায়গায়, আদৌ মাছটাছ কিছু পায়? নাকি সবটাই দেখনদারি?
বিনুদা খুচরো পয়সার বদলে একটা হাজমোলা ক্যান্ডি ধরিয়ে দেয় হাতে। তারপর মাথা নেড়ে বলে— মাছের খবর জানি না, তবে মাছের চার কিনতে ভোলে না কখনও।
শোভন আর কথা বাড়ায় না। হাঁটতে হাঁটতে লোকটার ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। কোনও হেলদোল নেই ভদ্রলোকের! যেন পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেলেও তিনি ওই ফাতনাতেই আটকে থেকে যাবেন শেষ পর্যন্ত!
জেদ চেপে যায় শোভনের। চুলোয় যাক ট্রেন, আজ সে দেখবেই শেষ পর্যন্ত কী হয়। জুতো ছেড়ে সে বসে পড়ে লোকটার পাশেই।
লোকটা যদিও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে না একবারও।
শোভন ছিপের দিকে তাকিয়ে থাকে। নড়ে উঠল কি একটু! না না, মনের ভুল… নাকি চোখের?
দু-একটা বোলতা এদিকে থেকে-থেকেই কানের কাছে এসে বোঁ বোঁ করে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। ঘাটের গা বেয়ে সরসর করে জলের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে হিলহিলে ঢোঁড়া সাপ।
কতক্ষণ সময় পেরিয়েছে খেয়াল নেই শোভনের। বোধহয় ঝিমুনি আসছিল অল্প। এমন সময় জলের মধ্যে একটা যেন হালকা আলোড়ন টের পেল সে…
এই তো, টোপ গিলেছে মনে হয় একটা…!
অদ্ভুত ব্যাপার! লোকটা তবু চুপচাপ বসেই রইল! বিন্দুমাত্র নড়নচড়ন নেই। শুধু অপেক্ষা করার জন্যই যেন তার এই নিয়মিত আয়োজন…
শোভন অধৈর্য হয়ে ওঠে। বিরক্তি ছুড়ে দিয়ে বলে,
–আরে ও মশাই, এটা কী হল! মাছটা তো পালাল… আপনার টোপ কোন কম্মে লাগল শুনি?
শোভনের প্রশ্নে এই প্রথম মানুষটা সাড়া দিল। শান্ত গলায় বলল,
–প্র্যাকটিস করছি তো…
–কী…!
ছিপ গোটাতে গোটাতে মুচকি হেসে লোকটা উত্তর দিল,
–ছেড়ে যেতে দেখা…