পাঁচটি কবিতা
দহনবেলা
একরাশ অভিমান নিয়ে
ঘটাং ঘটাং শব্দে ট্রাম এসে থামল
কেউ কেউ উঠল। নামলও কয়েকজন
তুমি উঠলে না
দ্বিধাগ্রস্ত পা সিঁড়িতে রেখেও
পিছিয়ে এলাম আমি…
মুখভার শহরের মেঘলা বিকেল
তোমার বুকে জমা রেখে,
ট্রাম চলে যায় গন্তব্যের দিকে…
টুপটাপ ফোঁটা থেকে অঝোর বৃষ্টি
ডানাভাঙা জল চুইয়ে নামছে রাস্তায়
একটু একটু করে সরে যাচ্ছে মেঘ
একটু একটু করে আসছি আমি,
তোমার ঘনঘোর ছাতার আশ্রয়ে—
আবার ভিজব বলে।
অনুকম্পা হও
পাহাড়ের উৎরাই বেয়ে
নেমে আসে নদীর প্রত্যয়
চিরায়ত ক্ষয়…
দুখজাগানিয়া ঢেউ ছুঁয়ে যায়
ব্যর্থ উপকূল
প্রায়ান্ধ এই পরবাসে,
যে চরণ পড়েছিল অস্ফুট ঘাসে—
প্রতি মুদ্রায় তার বিদায়-নিয়তি
কারুণ্যমতি,
আর কিছু নেই ওই স্রোতের গভীরে?
সমূহের জলভার। ধ্বস্ত ভাঙনতট ছাড়া?
অপরাহ্ণধারা—
ভাসিয়ে নিয়েছে সব অর্পণ, শস্যের স্তব
রুদ্ধ কলরব,
বুকের আগুন ছুঁয়ে বলে ওঠে—
অনুকম্পা হও…
নদীর প্রত্যয় এসে ধুয়ে দিক
পলিবাঁধ। ধুলোসঞ্চয়।
নিরাময় রেখেছি দু-হাতে
কে ভাসালে আজ বুকের ভেতর
কাঁপতে থাকা রাত্রিজাগা মাঠ!
কে ভাসালে আজ বেদনার মতো
দীঘল মেঘের পানসি যেমন…!
বুকের ভেতর তরুবীথিময় শীত
ব্যথার ভেতর সারাদিনমান জলজ পাথর
পাথর পাথর ভেঙে ভেঙে কারা
চন্দ্রাহত স্বপ্নপথ ধরে
আমাকে ফিরিয়ে নিতে আসে,
অনর্থ জীবনের থেকে বহুদূর…
কোথায় রেখেছ ঘুম?
নিভৃত সৃজন ফেলে অলীক নির্মাণে
আমার ভিতরে আমি ক্রমাগত দূরে চলে যাই
আয়ুহীন নভঃছায়াপথে!
এই যে খরস্রোত, নিরাময় নিয়ে—
ভাসালে মেঘের ভেলা আজ
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিগান ছুঁয়ে
তোমার চারণমাঠ, ভীরু করতল
যতটা বিপন্ন ভাবে
ততখানি বাড়াব দু-হাত।
ফিরে এসো, ব্যথাজন্ম
যে সৃজন রেখেছিলে নিজের গোপনে
জানো কি পথের ধারে ভীরু শালবন
চুপিচুপি তারই কথা বলে?
জানো কি সে-মৃদুপথ, খুলে যায়
তোমারই নির্মাণ?
থরোথরো বুকের গভীরে
মেঘপ্রাসাদের চুড়ো অলীক রোদের মাখামাখি!
আর এই নিভৃত-প্রহরে,
গোত্রপরিচয়হীন মরমি ব্যথারা ছুঁয়ে যায়
ঘুমিয়ে পড়ার আগে শেষবার
জেগে ওঠে গান
ঘুমিয়ে পড়ার আগে লুপ্ত পথিক এক
মাথা রাখে নির্ভার কোলে
নিবিড় পাথর ভেঙে যায়
বৃষ্টি নামে শাল্মলীর বনে
ভাসিয়ে নিয়েছ যত আত্মপরাভব
ভাসিয়ে নিয়েছ যত নির্জন গৌরবক্ষত
না-ফোটা ভোরের চৌকাঠে
কাঁপাকাঁপা আলোর আখরে
তুমি কি নতুন কোনও জন্ম লিখে দেবে?
যমুনাকিশোরী
খেয়ালি সে সুরের দেহলি
নিচু তারে বয়ে চলে কুলুকুলু
যমুনাকিশোরী। রাধাভাব লেগেছে মরমে
হায় কী শরমে, দ্রিমিদ্রিমি
বুকে তার উন্মনা মাদলতিয়াসা
থরোথরো আঙুলের বেহাগপরশে
উপ্ত বরষধারা কোন্ সে কলসপটে
ভরে দেয় শ্যামকল্যাণ!
কোন্ সে আতরঘ্রাণ, রাই জাগে ব্যর্থ প্রহরে!
আর এই উন্মুখ ভোরে—
দুরুদুরু পায়ে তার দ্বিধা-অভিসার!
মৃদু জলভার, আমিও কি রেখেছি দু-হাতে?
এই আঁখিপাতে, কে আমায় নিয়ে যাবে
হিয়া-ছলোছলো ওই নদীটির কাছে?