১৯৮৪-র ৩১শে অক্টোবর : দুই শহরে ভয় নামল যেদিন

সুচেতনা দত্ত

 

সজলার কথা

জন্মসূত্রে আমার মা ছিলেন হিন্দু পরিবারের মেয়ে এবং আমার বাবা ছিলেন শিখ পরিবারে ছেলে। আর আমি নিজে পড়াশোনা করেছি একটা খুবই কড়া ক্যাথলিক স্কুলে। ফলে আমার ধর্ম কী এবং আমার ধর্মাচরণ ঠিক কেমন হওয়া উচিৎ এই ব্যাপারে আমার ধারণা খুবই অস্পষ্ট ছিল। ছোটবেলায় কখনও ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আমার চারপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁদের কারুকেও কখনও ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখিনি।

কিন্তু একটা কনভেন্ট স্কুলে পনেরো বছর পড়েছিলাম তো, ফলে যখনই চোখ বন্ধ করি, একটা ক্রস দেখতে পাই। সেই ক্রসটা– যে ক্রসটা আমার স্কুলের প্রতিটা ক্লাসরুমের দেওয়ালে স্পিকারের উপরে লাগানো ছিল। সেই স্পিকারটা যেটার থেকে দিনে দু’বার জিম রিভসের গান আর স্তবগান ভেসে আসত।

আমার ধর্মাচরণ বলতে ছোটবেলায় কখনও কখনও ঠাকুমার সঙ্গে গুরুদ্বারায় যাওয়া। আর গুরুদ্বারার কথা বলতে গেলেই গুরুদ্বারার লঙ্গরের প্রসাদের স্বাদ মনে পড়ে, যে অপূর্ব স্বাদ আজও যেন মুখে লেগে আছে।

ওদিকে আবার আমার মামারবাড়িতে আমার দিদিমাকে দেখতাম শিবমূর্তির সামনে আরতি করতে, ভজন গাইতে।

আমার বাবা-মা দুজনেই নিজেদের কাজ নিয়ে এবং আমাকে আর দাদাকে বড় করে তোলা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে ওঁদের কখনও মাথাতেই আসেনি আমাদের মন্দিরে বা গুরুদ্বারার মতো জায়গাতেও নিয়ে যাওয়ার কথা। হয়তো ওঁরা ধর্মের উপর খুব একটা নির্ভরশীল ছিলেন না।

আমার মা কখনও সখনও, (যদিও সেটা খুবই দুর্লভ ব্যাপার ছিল) বিপদে পড়লে বা জীবনের বড় পরীক্ষাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে গুরু গ্রন্থসাহিবের একটা প্রার্থনা আবৃত্তি করতেন জোরে জোরে। আমার ধারণা, মা সেটা করতেন শান্ত হতে, শান্তি পেতে।

আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল একটা মসজিদ আর সেই মসজিদটার থেকে সারা দিনে বেশ কয়েকবার আজানের সুর ভেসে আসত, আর সেই সুর শুনতে শুনতে আমি কী জানি কেন, আরবি ভাষার সেই কাঁপা কাঁপা সুরেলা ধ্বনিকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। যা ততদিন অবধি আমার শোনা যে কোনও সুরেলা গানের থেকে একদম আলাদা ছিল।

আজানের সুর শুনতে আমার যতটা ভালো লাগত, ততটাই ভালো লাগত মীরার ভজন শুনতে, অথবা গুরু নানকের কীর্তন শুনতে, অথবা আমার ক্যাথলিক স্কুলের হীমস বা স্তবগানগুলো শুনতে। “আভে মারিয়া” ছিল আমার সবথেকে প্রিয়।

আর এসব ছাড়াও তো, আমার জন্য ছিলই সাইমন অ্যাণ্ড গারফাঙ্কেল। ফিল কলিন্স ছিল, ব্রায়ান অ্যাডামস, হুইটনি হিউস্টনরাও সবাই ছিল।

আমাদের স্কুলে সিভিকসে যা পড়ানো হত তখন, সেই সময়ে আমি সেটাই বিশ্বাস করতাম। বিশ্বাস করতাম যে আমাদের দেশের বুনিয়াদ হল– সাম্য, ন্যায়বিচার আর ধর্মনিরপেক্ষতা। আরও বিশ্বাস করতাম যে একদিন আমার দেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ হবে। আমাদের আগের বেশ কয়েক প্রজন্মের প্রচুর রক্তঝরানো লড়াই করে পাওয়া স্বাধীনতার মূল্য তখনও আমাদের সবার কাছে বড় দামি, বড় মহার্ঘ ছিল।…

আমার কথা

বড় হয়েছিলাম আশির দশকের উত্তর কোলকাতায়। মধ্যবিত্ত পাড়া, মধ্যবিত্ত ইস্কুল। বড্ড আপন, বড্ড নিরাপদ। অবশ্য তখন নিরাপদ কী, নিরাপত্তা কাকে বলে, তাইই বুঝতাম না। সব কিছুই বড় স্বাভাবিক, বড় সহজাত ছিল। পাশের বাড়ির কাকিমা হাঁসের ডিমের কষা রাঁধলে দুখানা ডিম আমার আর মায়ের জন্য বাটি করে দিয়ে যাবেই, সরস্বতীপুজোর আগে কুল খেলে হাফ ইয়ার্লিতে ফেল করতেই হবে, সিকান্দারমামা কাচা কাপড় ফেরত দিতে এলে দেখা যাবে, মায়ের ডুরে শাড়ির বদলে কাদের জংলা ছাপা শাড়ি নিয়ে চলে এসেছে, এইসব কিছু নিয়েই তখন সবার জীবন বেশ ঘটনাবহুল হয়ে থাকত। ধর্ম কী, কাকে বলে সেসব জানা যেত স্কুলের পাঠ্য কবিতা মুখস্থ করতে গিয়ে, ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’ আর ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ সব।

কিন্তু তাই বলে কি আর নীলষষ্ঠীর সাবুমাখা খেতে ভালো লাগত না, নাকি সরস্বতীপুজোর পরদিন কারুর বাড়ির গোটাসেদ্ধ খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেলে ভালো লাগত না!

উত্তর কোলকাতার বিডন স্ট্রিটে একটা অতি কড়া ক্যাথলিক স্কুলে পড়তাম বটে, কিন্তু মজার ব্যাপার হল, সেই স্কুলটায় একদিনের জন্যও বাইবেল পড়তে হয়নি। চ্যাপেল একটা ছিল বটে, সেখানে উইকলি টেস্টের দিন সকালবেলায় যিশুর মূর্তির সামনে দিব্যি নীল অপরাজিতা ফুল বা লাল জবা রেখে কপালে হাত ঠুকে “পাশ করিয়ে দিও গো ঠাকুর” বলে বাইরে এসে জর্ডন নদীর জল কপালে মেখে পরীক্ষা দিতে যাওয়া যেত। ক্রিসমাসের দিন স্কুলবাড়িটা ঝলমল করে সেজে উঠত, মিউজিক সিস্টেমে ক্রিসমাস ক্যারল বাজত, বনিএম গাইত, “মেরি’জ বয় চাইল্ড”, শুনতে শুনতে মনটা আর কোলকাতায় থাকত না, অন্য কোথাও চলে যেত। মজার ব্যাপার হল, দুর্গাপুজোর সময় বিডন স্ট্রিটে ঠাকুর দেখতে গেলে দেখা যেত, সেই ক্যাথলিক স্কুলটাই আবার লম্বা লম্বা আলোর মালা দিয়ে নিজেকে দিব্যি সাজিয়ে রেখেছে।…

সজলার কথা

…কিন্তু একদিন এই সমস্ত ধারণা, যাবতীয় বিশ্বাস, সব চুরমার হয়ে ভেঙে গেল। ১৯৮৪ সালে। টের পেলাম, এতদিন একটা নিটোল বুদবুদের ঘেরাটোপে বাস করছিলাম, আর সেই বুদবুদটা ফেটে গেল।…

আমার কথা

…এই নিরুপদ্রব জীবনে প্রথম আলোড়ন তুলল, একটা দিন। ৩১শে অক্টোবর, ১৯৮৪। ক্লাস ফোরে পড়ি তখন।…

সজলার কথা

…সেদিন আমরা স্কুলে ছিলাম, যখন ঘোষণা হল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নিজেরই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। আমরা, স্কুলের প্রত্যেকটি মেয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লাম ঘটনার আকস্মিকতায়। সেই সময় আমাদের স্কুলের প্রতিটি মেয়েদের কাছে তখন তিনি ছিলেন শক্তির, সাহসের প্রতীক।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা স্কুলে বসেই খবর পেলাম, পুরো দিল্লি শহর জুড়েই শিখদের নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে। শিখ দেখলেই তাদের গলায় পেট্রোল ভর্তি টায়ার ঝুলিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। শিখ মেয়েরা, মায়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, আর তখন সেই মুহূর্তেই তাদেরই চোখের সামনে তাদের বাবাদের, ভাইদের, অথবা নিতান্তই শিশুসন্তানদের মেরে ফেলা হচ্ছে।

আমার বাবা ছিলেন সরকারি সাংবাদিক আর সেদিন প্রধানমন্ত্রী আবাসেই ছিলেন কর্মসূত্রে। ফলে সেই আতঙ্কের মুহূর্তগুলোয় আমরা বুঝতেই পারছিলাম না, এবং জানাও সম্ভব ছিল না যে সেদিন বাবা আদৌ বাড়ি ফিরতে পারবেন কিনা।

আমার দাদাও সেদিন বাড়ির বাইরেই ছিল। বাবা এবং দাদা দুজনেই সেদিন রাস্তায় রাস্তায় অবলীলায় অসংখ্য হত্যায় এবং লুঠতরাজে ব্যস্ত, রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে কোনওরকমে নিজেদের বাঁচিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরতে পেরেছিল।

সেদিন দুপুরবেলাতেই স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিকেলবেলায় যখন আমাদের বাড়ির ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম, দেখলাম আমার চারপাশে শুধু কালো ধোঁয়া আর ধোঁয়া। দিল্লী পুড়ছে। শুধুই কি দিল্লী পুড়ছিল সেদিন?…

আমার কথা

…টিফিন শুরু হত বেলা বারোটা চল্লিশে। তার ঘন্টাখানেক আগেই সিস্টারদের আর দিদিদের চিন্তিত মুখে দ্রুত হেঁটে যাওয়া আর চাপা গলায় আলোচনা শুনে আঁচ পাওয়া গেল কিছু একটা ঘটেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ থমথমে মুখে দিদিরা এবং সিস্টাররা ক্লাসে ক্লাসে এসে বুঝিয়ে বললেন, হঠাৎ করে ছুটি দিতে হচ্ছে, কিন্তু অভিভাবক ছাড়া একজনকেও একা বাড়ি যেতে দেওয়া হবে না। যাদের অভিভাবকরা এসে পৌঁছতে পারবেন না, তাদের অপেক্ষা করতে হবে, পরে তার বাড়ির দিকে কতজন থাকে, সেই দিকে কোন শিক্ষিকা থাকেন, বা অন্য কোনও অভিভাবক থাকেন, যিনি নিজের সন্তানকে নিতে এসেছেন, সেরকম কারও সঙ্গে তাদেরকে বাড়ি পাঠানো হবে। নচেৎ তার অভিভাবক না আসা পর্যন্ত স্কুলেই বসে থাকতে হবে।  তখনও আমরা জানি না, কী হয়েছে। স্কুলের মেন গেট অ্যাসেম্বলির সময় যে মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেত, তখন থেকেই স্কুলটা পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্করহিত একটা অন্য গ্রহ হয়ে যেত।

স্কুলের সম্বল একটা মাত্র ল্যান্ডলাইন ফোন। সেদিন সেই ফোনটা ক্রমাগত বেজেই যাচ্ছিল। আর একজন-দুজন করে সিস্টার দৌড়াদৌড়ি করে বিভিন্ন ক্লাসে এসে বলে যাচ্ছিলেন, “রঞ্জনা, তোমার মা ফোন করেছিলেন, তোমাকে সোনালীর মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে বলেছেন।” অথবা, “পারমিতা, তোমার বাবা অফিস থেকে ফোন করেছিলেন, তোমাকে নিতে আসছেন পায়ে হেঁটে, তোমাকে ততক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেছেন।”

১৯৮৪ সালে সবার ঘরে ঘরে ফোনও ছিল না, যাদের ছিল, সেদিন তাদের বাড়িতে উৎকণ্ঠিত মুখের লাইন পড়েছিল। আমরা যারা হঠাৎ পড়ে পাওয়া ছুটির আনন্দে বিহ্বল ছিলাম, তারা সিস্টারদের এই দৌড়াদৌড়ি করে এসে বারে বারে খবর দিয়ে যাওয়া থেকে আঁচ করলাম, আজকের ছুটিটা ঠিক রেনি ডের মতো ছুটি নয়, অন্য কিছু। টিচারদের হাজারবার “কী হয়েছে?” জিজ্ঞাসা করেও “চুপ করে বোসো।” ছাড়া আর কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।

সেদিন আমার বাড়ি থেকে কোনও ফোন আসেনি। স্কুলের উল্টোদিকে স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রফেসর ছিলেন অর্পিতার বাবা। অর্পিতার বাবা এসে সিস্টারদের সঙ্গে কথা বলে অর্পিতাকে, পিউকে আর আমাকে নিয়ে রওনা দিলেন বাড়ির পথে। স্কুলবাড়িটার বাইরে এসে জানতে পারলাম, আজ হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে, বাস, রিকশা কিচ্ছু চলছে না। ডবল মজা। আহা সব কিছু তারিয়ে তারিয়ে দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরতে পারব! কেউ বাস ধরার জন্য তাড়া দেবে না!

কিন্তু মানিকতলা বাজারের কাছাকাছি পৌঁছনোর আগেই টের পেলাম, বাতাসটা আজ বেশ ভারি ভারি, কোথাও কিছু পুড়ছে, সেই পোড়া গন্ধ আসছে। রাস্তার দুধারের সব দোকানপাট বন্ধ। ফুটপাথে বসে থাকা হকাররাও নেই। ভাতের হোটেলও বন্ধ। এমনকি উল্টোদিকের ফুটপাথের ছোট্ট মন্দিরটাও বন্ধ! রাস্তার এদিকওদিক বেশ কিছু লোকের জটলা। কেউ চেঁচাচ্ছে না। সব্বাই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গলা নামিয়ে কী সব যেন আলোচনা করছে। মানিকতলা মোড়ের ট্রামলাইনে পৌঁছনো মাত্রই অন্য দৃশ্য। ট্রামলাইনের মাঝখানে একটা গাছের ডাল পুঁতে তার উপর বেশ কিছু টায়ার চাপিয়ে কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! গলগল করে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তাহলে এই পোড়া গন্ধই পাচ্ছিলাম এতক্ষণ!

রাস্তার ধারেই কংগ্রেসের একটা পার্টি অফিস ছিল, সেখানে খুব জোরে চালিয়ে রাখা রেডিও থেকে জানতে পারলাম, ইন্দিরা গান্ধীকে তারই নিরাপত্তারক্ষী গুলি করেছে।

যত এগোই, রাস্তাঘাট থমথমে, আমাদেরই মতো আরও অনেকে, অন্যান্য স্কুলের ছেলেমেয়েরা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে, আর জায়গায় জায়গায় টায়ারের স্তূপে আগুন জ্বলছে দেখতে পাচ্ছি। না, সেদিন রাস্তায় কোনও মারামারি, বা খুনোখুনি দেখতে পাইনি, অন্তত সেই মুহূর্তে। শুধুই মানুষের জটলা একটা রেডিও ঘিরে, অথবা ঘরফেরতা মানুষের সারি। শুধু বাগমারি ব্রিজে ওঠার মুখে দেখলাম, এক পাগড়ি বাঁধা সর্দার একটা স্কুটার তীরবেগে চালিয়ে মানিকতলা থানার দিকে চলে গেল। তার সেই চোখের দৃষ্টিটা আজও মনে আছে। রাস্তাতেই কে যেন বলল, “প্রাণ বাঁচাতে থানায় গেল শেল্টার নিতে। শালা খলিস্তানি!” তখনও আমরা জানি না, ভবানীপুরে কী হচ্ছে। অথবা পুরো উত্তর ভারতেই শিখদের সঙ্গে কী ঘটছে! বাগমারি বাজার ছাড়িয়ে রেলব্রিজের দিকে এগোতে না এগোতেই দেখি, আমার মা, আমার তিনমাসের ভাইকে কোলে নিয়ে হনহন করে হেঁটে আসছে। আমাদের বাড়ি থেকে আড়াই কিলোমিটার তো হবেই ওই দূরত্বটুকু। আমাদের দেখে মা কেঁদেই ফেলল।

কাকুকে মানে অর্পিতার বাবাকে বলল, “দাদা, ভাগ্যিস আপনি ছিলেন! আমি খবর পেয়েই বেরিয়ে পড়েছি। আমাদের বাড়িতে তো ফোন নেই। আশপাশের কোনও বাড়িতেই নেই। কী করব বলুন? ওষুধের দোকান থেকে স্কুলে ফোন করব ভাবলাম, গিয়ে দেখি জয়শ্রী মেডিকাল স্টোরসও বন্ধ।”

কাকু আশ্বস্ত করলেন, “আপনি কী করে ভাবলেন, আমি নিজের মেয়েকে আনতে যাব, আর আপনার মেয়েকে আনব না। ওরা সবাইই তো আমার মেয়ে।”

সজলার কথা

…পরের দিনই বাস ভর্তি রক্তপিপাসু দাঙ্গাবাজরা হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে ঢুকল আমাদের পাড়ায়। তাদের লক্ষ্য শিখরা। লক্ষ্য না বলে শিকার বলাই ভালো। শুধু আমাদের পাড়াতেই নয়, পুরো দিল্লিতেই সেই মুহূর্তে শিখরা ছিল দাঙ্গাবাজ খুনিদের লক্ষ্য। লক্ষ্য না বলে বরং বলা ভালো শিকারের লক্ষ্য ছিল সেই সময়। সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের এক প্রতিবেশীর কাছে একটি বন্দুক ছিল এবং তিনি সেটি নিয়ে ফাঁকা গুলি করায় দাঙ্গাবাজরা সেদিনের মতো রণে ভঙ্গ দিয়ে আবার বাসে উঠে পড়ে এবং ফিরে যায়।

এই সব যা কিছু ঘটছিল সেই অদ্ভুত দিনটায়, আমরা আমাদের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। দেখতে দেখতে মা হঠাৎ জলভরা চোখে অস্ফুটে বলে উঠলেন, “দেশটা বুঝি আবার ভাগ হতে চলল!” আজ বুঝতে পারি, ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসের শেষের সেই দিনটা ছিল আমার মায়ের জন্য ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির দিন।

আজ যে জায়গাটার নাম পাকিস্তান, সেখান থেকে যেদিন অসংখ্য পৈশাচিক হত্যালীলা, ধর্ষণ ইত্যাদি নারকীয়তার মধ্যে আমার মায়ের পরিবারকে নিজেদের সবটুকু সম্বল ছেড়ে চলে আসতে হয়, সেদিন আমার মা ছিল হিন্দু পরিবারে জন্মানো ছোট্ট দুই বছরের শিশু। আর সেদিনের সেই শিশুই আজ ১৯৮৪ সালের অক্টোবর মাসে দিল্লির বারান্দায় দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলা দুই সন্তানের জননী, প্রাপ্তবয়স্কা এবং বিবাহসূত্রে শিখ।

যারা বলে, ধর্ম দাঙ্গা লাগায়, তারা ভুল বলে। দাঙ্গার সঙ্গে কিন্তু ধর্মের কোনও সম্পর্কই নেই। দাঙ্গার সঙ্গে যদি আদৌ কারও সম্পর্ক থেকে থাকে, তবে তা ঘৃণার। দাঙ্গা আর ঘৃণা বরং আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে একে অপরকে, ধর্ম নয়।

১৯৮৪-র দাঙ্গার দিনগুলোয় আমাদের পাড়ার পুরুষরা একত্রিত হন এবং রাতের বেলায় একত্রে জড়ো হয়ে পাড়ায় টহলদারি শুরু করেন। না করে উপায়ও ছিল না। আমাদের নিরাপত্তার রক্ষক পুলিশদের দেখা যে কোথাও মিলছিল না!

এই সময়ে আমার মাবাবা ঠিক করেন যে আমাকে আমার মামাবাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। নিরাপদ আশ্রয় কারণ, আমার মামা একজন হিন্দু। সেই হিন্দু মামাবাড়িতেই সেদিন শিখপিতার কন্যা আমি সবথেকে বেশি নিরাপদ থাকব বলে আমার মাবাবা ভেবেছিলেন। সেই বয়সে ধর্ষণ শব্দটার সঠিক অর্থ বা অভিঘাত কোনওটাই বোঝার মতো যথেষ্ট বড় ছিলাম না, কিন্তু বড়দের কথার থেকে এটুকু বুঝেছিলাম যে ধর্ষণ নামের কোনও একটা ব্যাপার থেকে আমাকে বাঁচাতে মামারবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাকে।

ছোট্ট আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে এসব কেন হচ্ছে! আর এতসব কিছু যখন হচ্ছে, তখন পুলিশই বা কোথায়! তারা আসছে না কেন?

সেই আতঙ্কের দিনগুলোয় অগুনতি ফোন করা হত পুলিশকে বিপদের সময়। তারা কয়েকটিমাত্র ফোনকলের উত্তর দিত, কিন্তু কখনওই ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছত না।

ফিরে আসি মামাবাড়ি রওনা দেওয়ার সময়টায়। যে মুহূর্তটায় আমি মা-বাবা-দাদাকে বিদায় জানালাম, সেই মুহূর্তটাতেও কিন্তু আমি জানতাম না যে এদের আর কখনও দেখতে পাব কিনা। মা এসে আমাকে মায়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ডিটেলস আর সোনাদানা কী কোথায় রাখা আছে, চুপিচুপি বলে গেল। আরও বলল ওরা যদি সবাই খুন হয়ে যায় দাঙ্গাবাজদের হাতে, তখন আমার কী কী করা উচিৎ। আমার বাবা কীভাবে জানি না একটা মিলিটারি গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই গাড়িতে করেই ছোট্ট আমি জীবনে প্রথমবার একা রওনা হলাম।

যেতে যেতে রাস্তায় দেখলাম রক্তের স্রোত। দেখলাম মানুষ একে অপরকে খুন করছে। সহ্য করতে না পেরে গাড়িতেই বমি করে ফেললাম। সেদিনের সেই গা গোলানো বমি বমি ভাব আমাকে তারপরেও দিনের পর দিন ধরে তাড়া করেছে।

কিছুদূর যাওয়ার পরেই কিছু দাঙ্গাবাজ আমাদের গাড়ি থামিয়ে আমার থেকে জানতে চায় যে আমি শিখ কিনা।

আমি উত্তরে বলি, “না, আমি শিখ নই।” আর মজার ব্যাপার হল যে সেই মুহূর্তটাতেই প্রথম আমি টের পাই যে আমি জন্মসূত্রে শিখ। আমার নিজের কাছে না হলেও, অন্তত বাইরের পৃথিবীর চোখে।

যেন হঠাৎ করে আমার কপালে কেউ বড় বড় অক্ষরে লিখে দিয়েছে যে আমি একজন শিখ। যখন সেদিনের সেই ছোট্ট আমির সঙ্গে শিখ হওয়ার সম্পর্ক ছিল ততটুকুই, যতটুকু হিন্দু হওয়ার বা ক্যাথলিক হওয়ার। বা পৃথিবীর আর যে কোনও ধর্মাবলম্বী হওয়ার।

কিন্তু সেদিনের সেই ভয়টা ভুলি কী করে? যে ভয়টা একটা ছোট্ট মেয়ে পেয়েছিল একলা গাড়িতে বসে কিছু উন্মাদ, রক্তপিপাসু খুনির প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে, যাদের হাতে ধরা ছিল রক্তমাখা তলোয়ার। সেই খুনিদের চোখে সেদিন ছিল উন্মত্ত আনন্দ আর খুনের জন্য তৃষ্ণা।

সেদিনের পর থেকে আমি আর জীবনে কখনও ভয় পাইনি। ভয় নামের অনুভূতিটা একবারেই ফুরিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে।

আমি যখন আমার মামার বাড়িতে পৌঁছলাম, আমাকে বলা হল বাগানে না বেরোতে। মামাবাড়ির ফোনের লাইনগুলোয় সেদিন কোনও সাড় ছিল না। ফলে আমি জানতেও পারলাম না, আমার মাবাবা তখনও বেঁচে আছে কিনা।

মামাবাড়ি পৌঁছনোর তৃতীয় দিনের মাথায় কিছু দাঙ্গাবাজ এসে হাজির হল আমার মামাবাড়িতে। তারা আমার মামাকে জিজ্ঞেস করল যে মামা কোনও শিখ মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছেন কিনা। আমার মামাবাড়িতে এসে আশ্রয় নেওয়ার কথা নিশ্চয়ই মামাবাড়ির কাজের মেয়ের মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছিল। ওরা আসামাত্রই আমার মামীমা আমাকে একটা উঁচু লফটে তুলে লুকিয়ে দেয়। সেই ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার লফটটার কথা আজও মনে আছে। ওখানে লুকিয়ে থাকতে থাকতে আমি ভেবেছিলাম যে আমি বোধহয় মরেই যাব দমবন্ধ হয়ে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল যে সেই সময় আমার কেন জানি না, একটুও ভয় হয়নি।

লোকগুলো যখন আমার মামাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল, এমন সময় আমার মামার এক বন্ধু তাঁর গুরুগম্ভীর গলায় গর্জন করে ওঠেন, “এদের বাড়িতে যে মেয়েটি আছে, সে আমার মেয়ে। তোমাদের কেউ যদি তার গায়ে হাত দেয়, আমি তোমাদের সব্বাইকে খুন করব।”

দাঙ্গাবাজরা এবার ধীরে ধীরে পিছু হটতে আরম্ভ করে।

তিনদিন ধরে অবাধ গণহত্যার পরে সরকার সেনাবাহিনীর উপর দায়িত্ব দেয় পরিস্থিতি সামলানোর এবং কার্ফিউ রুজু হয়। কিন্তু ততদিনে যতটা ক্ষতি, যতটা তাণ্ডব হওয়া সম্ভব, হয়ে গেছে।

পঁচিশ দিন বাদে আমি আমার নিজের বাড়িতে ফিরে আসি যেদিন, আমার মা আমাকে সারাদিন নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখে শুধুই কেঁদেছিলেন।

তখন যেহেতু ছোট ছিলাম, আমি ভেবেছিলাম যে যারা বা যাদের পরিবার বিনা দোষে এই ভয়ঙ্কর দাঙ্গার শিকার হয়েছে, তারা ন্যায়বিচার একদিন না একদিন পাবেই ঠিক।

বুঝিনি সেদিন যে দাঙ্গায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তরা, নির্যাতিতরা ন্যায়বিচার তো পাবেই না। উলটে যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই দাঙ্গা সংগঠিত করেছিল, তারা দিব্যি ছাড় পেয়ে যাবে এবং আবারও জনপ্রতিনিধিত্ব করার জন্য নতুন করে নির্বাচিত হবে।

স্কুলের বইয়ের পাতায় পড়া সিভিকসের চ্যাপ্টারগুলোর উপর সব বিশ্বাস হারালাম।

একটা সমগ্র দেশের জাতিসত্ত্বার উপর বিশ্বাস হারালাম।

২০০২ সালে টিভিতে দেখলাম, গুজরাটে মুসলিমদের সঙ্গে সেই একই ঘটনা ঘটছে।

আমি নিশ্চিত করে জানি যে গুজরাটের ঐ মুসলিমদের মধ্যে নিশ্চয়ই আমার মতো অনেক মুসলিমই ছিল, যারা জানত না যে তারা মুসলিম; যেমন আমি জানতাম না যে আমি শিখ।

প্রথমে এই দুনিয়া আমাদের কপালে লেবেল লাগিয়ে দেয় ধর্মপরিচয়ের নামে, আর তারপরে তাদেরই লাগানো সেই লেবেলকে কারণ হিসাবে দেখিয়ে তারা আমাদের মেরে ফেলতে চায়।

যারা কখনও দাঙ্গার সম্মুখীন হয়নি, মৃত্যুভয়ের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ায়নি, তাদের পক্ষে হয়তো বোঝাও সম্ভব নয় বিনা দোষে, শুধু কপালে অন্য কারুর লাগিয়ে দেওয়া লেবেলটার জন্য অসহায়ভাবে মরে যেতে কেমন লাগে। সমাজ শুধু লেবেলই লাগাতে পারে– ধর্মের লেবেল, জাতের লেবেল, লিঙ্গের লেবেল বা আরও উনকোটি অসংখ্য লেবেল। আর কপালে লাগিয়ে দেওয়া এই লেবেলগুলোর জন্যই মরে যেতে হয় কিছু মানুষকে।

আর ঠিক এই কারণেই আমি অর্থনৈতিক উন্নয়নের এবং তার নীতিনির্ধারণের মিথ্যে প্রতারণায় ভুলি না কিছুতেই, যতদিন অন্তত এই দেশে ধর্মের নামে মানুষকে মারা হচ্ছে।

একটা সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন তখনই হয় যখন সেই সমাজ মানুষের জীবনকে সঠিক মূল্য দিতে জানে, সম্মান করতে জানে। বাকি আর যেকোনও উন্নয়নের জায়গা তার অনেক পরে।

আমার কথা

এতদিন ধারণা ছিল, ১৯৮৪-র অক্টোবর মাসের শেষ দিনটায় প্রথম জেনেছিলাম নিরাপত্তারক্ষী, নিরাপত্তা, নিরাপদ, আতঙ্ক ইত্যাদি শব্দের আসল অর্থ। ভুলটা ভাঙল ফেসবুকে সজলা চাওলার এই লেখাটা পড়ে।

১৯৮৪-র সেই দিনটায় যদিও আমার আর অচেনা সজলা চাওলার মধ্যে দূরত্ব ছিল দেড় হাজার কিলোমিটার, অথচ কাকতালীয়ভাবে মিলও কিছু কম ছিল না। সেদিন দুজনেরই বয়স ছিল এক, পরিবারের চিন্তাধারাও মোটামুটি এক, ধর্মপরিচয়-পুজোআচ্চা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না দুজনের পরিবারের কারও, সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল দুজনের স্কুলও এক। একজনের দিল্লির হোলি চাইল্ড স্কুল আর একজনের কোলকাতার হোলি চাইল্ড স্কুল। দেশভাগের পর সজলার মায়ের পরিবারকে এদেশে চলে আসতে হয় পাকিস্তান থেকে, আর আমার বাবার পরিবারকে চলে আসতে হয় পূর্ব পাকিস্তান বা এখনকার বাংলাদেশ থেকে।

তবুও কী ভীষণ আলাদা ছিল ১৯৮৪-র সেই দিনটা সজলার আর আমার জীবনে! আতঙ্ক, প্রাণভয় এইসব শব্দগুলোর মানে আমি ১৯৮৪-তে শিখিনি, বুঝতে পারিনি, যেভাবে সজলা পেরেছিল।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

5 Comments

  1. সে দিনটা মনে আছে …কলকাতায় আমি রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের ক্যাম্পাসে ছিলাম | আর তারপরে ১৯৮৭ -র ২০ শে অক্টোবরে, দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে রাত ৯ টায় সেই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চলেছিল যেদিন ..আমি সেদিনও একেবারে অকুস্থলেই | এ লেখা সে সব দু:স্বপ্নের স্মৃতি উস্কে দিল নতুন করে |

  2. Ki sabolil sundor kore likhechhis re… sediner katha aaj o mone achhe…. kintu satti amader to sedin pran bhoye dourote hoy ni… jebhabe palate hoyechhilo sedin Sajla ke… ba aro age amar Maa, Masi der ke, sei samayer Purbo Bongo theke….. Dhormer naam e hanahani je kobe bondho hobe!!

আপনার মতামত...