প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
স্যাম। স্যামুয়েল।
এতদিনে রডরিগেজের শাগরেদের নাম জানতে পারল শাহিদ।
রডরিগেজ সকালে আসে না। আসে এই নরকের কীটটা। আর এসেই শুরু করে শাহিদের ওপর নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা। শাহিদের মতো জেদি, গোঁয়াড় লোককে কতরকমভাবে ভাঙা যায়। নখ উপড়োনো, মারধর, ছ্যাঁকা দেওয়া, খেতে না দেওয়া অবধি হয়ে গিয়েছিল। এবার যেটা করল, সেটা শাহিদের পক্ষে বিপজ্জনক। চোখ শাহিদের কাজের অন্যতম অবলম্বন। চোখটা নষ্ট হলে তো সব গেল। সেই চোখে সরাসরি লেজার ফেলছে শুয়ারটা! শাহিদ দাঁতে দাঁত চেপে আছে। আর্তনাদ করলেই ওরা বুঝবে, দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ও। কিন্তু ওর চোখের মণি তো জ্বলছে! আর পাঁচ মিনিট রাখলেই চোখটা বোধহয়…
–স্যামুয়েল!
জাঁদরেল গলায় একটা আওয়াজ শুনে পিছিয়ে গেল গুন্ডাটা।
–তোমাকে না কতবার বলেছি স্যাম, চোখ একেবারে শেষবেলার জন্য বাঁচিয়ে রাখবে!
শাহিদ আপাতত চোখ বুজে আছে। কিন্তু রডরিগেজের গলার স্বর ও স্পষ্ট চিনতে পারছে।
রডরিগেজ বোধহয় ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। ওর গরম নিঃশ্বাস টের পাচ্ছে শাহিদ।
–তোমাকে বোধহয় আর দরকার হবে না, ন্যাস্টি ইন্ডিয়ান! তোমার বন্ধুই আমাদের কার্যসিদ্ধি করবে।
বন্ধু? সরিতের কথা বলছে নাকি রডরিগেজ?
এই অবস্থাতেও হাসি চাপতে পারল না শাহিদ।
রডরিগেজ একটু থেমে, কেটে কেটে বলল— হাসছ যে?
শাহিদ গম্ভীর হয়ে গলা খাঁকরে বলল— শোনো মূর্খ, সরিৎ প্রথমত আমার বন্ধু নয়। দ্বিতীয়ত, ওর বাপের সাধ্যি নেই এব্যাপারে তোমাদের কোনও সাহায্য করে।
এবার একটু বিরতি। তারপর হাসল রডরিগেজ। সে একেবারে অট্টহাসি!
–তুমি বড্ড পিছিয়ে ভাবছ নিগার! আমি বলছি তোমার আরেক বন্ধুর কথা।
–কী আজেবাজে বকছ!
এই দুর্বল শরীরেও বাঘের মতো গর্জন করে উঠল শাহিদ।
রডরিগেজ আর স্যামুয়েল এবার একসঙ্গে হেসে উঠল হো হো করে।
চুক চুক করে একটা শব্দ করল রডরিগেজ, তারপর বলল— সো স্যাড শাহিড! সো স্যাড! ইউ নো হোয়াট? আই ফিল ইউ। আই ডিটেস্ট ট্রেটরস টু। স্পেশালি হোয়েন দে আর মাই ফ্রেন্ডস। বাট দোজ ফ্রেন্ডস হু বিট্রেড মি, আর নো লঙ্গার মাই ফ্রেন্ডস। ইভেন, দে আর নো লঙ্গার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।
আবার দুজনের সম্মিলিত অট্টহাসি।
মৌলিনাথ! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে শাহিদের! এত বড় বিশ্বাসঘাতকতাটা মৌলিনাথ করবে?
কিন্তু সে কি আসল জিনিসটার সন্ধান পেয়ে গেল?
এর ঠিক আগের সন্ধেবেলা শাহিদ-মৌলিনাথের ইনস্টিটিউটে মৌলিনাথ আর অ্যাঞ্জেলার মধ্যে কথোপকথন চলছিল।
–ছোট জলে থাকলে ছোট মাছই হতে হবে, তার কোনও মানে নেই। চাইলে হিরেও হওয়া যায়।— এই লাইনটা শাহিদ এমনি এমনি লেখেনি। এটা বোঝা উচিত ছিল আমার। ইশশ! কী করে আমি এটা আন্দাজ না করে বসে রইলাম!
অ্যাঞ্জেলা তার আদরের ‘মল্লি’-র অস্থির পায়চারি দেখছিল।
–কিন্তু হিরে মানে কি শাহিদের কাছের ওই আকাশি হিরেটা? তার মানে ওটার মধ্যেই কিছু একটা ঘটছিল, যার সিগনাল আমরা পাচ্ছিলাম। কিন্তু কী হতে পারে বিষয়টা? এরকম আশ্চর্য জিনিস আমি কোনওদিন দেখিনি। এটা কি সত্যিই অন্য গ্রহের কিছু?
পায়চারি করতে করতে এবার টেবিল থেকে একটা কাচের জার তুলে নিল মৌলিনাথ।
অ্যাঞ্জেলা এবার তুমুল বিরক্ত হল!
–কী দেখছ বারবার ওটার মধ্যে? ওটা তো ফাঁকা!
মৌলিনাথ শূন্য দৃষ্টিতে একবার তাকাল অ্যাঞ্জেলার দিকে। তারপর ওর কাছে এসে জারটা তুলে দেখাল। বলল— লুক কেয়ারফুলি অ্যাঞ্জেলা! একটা ছোট্ট মাইকা-র মতো জিনিস চোখে পড়ছে?
অ্যাঞ্জেলা একবার ভাল করে দেখার চেষ্টা করল।
–হ্যাঁ। নীল রঙের জেলির মতো যেন!
–নীল নয়। স্কাই ব্লু। আকাশি। আশ্চর্য রং! জিনিসটা কী, আমি এখনও আন্দাজ করিনি, কিন্তু এখান থেকেই যে আমরা সিগনালটা পাচ্ছিলাম, সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত! কিন্তু জিনিসটা সম্পর্কে তুমি বোধহয় একটা ধারণা দিতে পারো, তুমি তো জিওলজির ছাত্রী ছিলে।
–আমিও কখনও এরকম কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ছে না, বেশ তবু আমি একবার দেখব। কিন্তু এখন মাথা খারাপ না করে চলো তো! দিন নেই রাত নেই, ল্যাবে পড়ে আছ! একটু ডিনার করে আসি চলো।
একটা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল মৌলিনাথ। তারপর কী মনে হতে অ্যাঞ্জেলার দিকে চেয়ে একবার হাসল। মুখ নামিয়ে ওর ঠোঁটে একটা আলতো চুমু খেয়ে বলল— কোটটা নিয়ে আসি ওয়েট।
অ্যাঞ্জেলা হেসে বলল— যাও।
কোট আনতে পাশের ঘরটায় ঢুকেই মাথাটা বাঁই করে ঘুরে গেল মৌলিনাথের।
শাহিদ এই সঙ্কেতটা দিয়ে যুদ্ধে গেছে? কক্ষনও তা হতে পারে না। কোথায় যেতে পারে ও? আর কোনও সঙ্কেত কি দিয়ে গেছে? ওর ড্রয়ারটা একবার দেখা যেতে পারে। একটা ডুপ্লিকেট চাবি ও রাখে ঘরের কোণে একটা সেফে। ও জানে সেটার ঠিকানা।
শাহিদের ঘরে ঢোকে মৌলিনাথ। ঢুকেই ওর শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়।
শাহিদের ঘর লন্ডভন্ড। ওর ড্রয়ারটা ভাঙা। ভেতর থেকে সব জিনিসপত্র বের করে তোলপাড় করে যেন কী যেন খুঁজেছে কে!
কিছু একটা বিপদ নিশ্চিতভাবে হয়েছে শাহিদের! ওর এই হিরে লুকিয়ে রাখার বিষয়টা কি জানতে পেরে গেছে কেউ?
সরিৎ, সরিৎ কোথায়? সরিৎ জানে, শেষ কবে দেখেছে শাহিদকে। এই বাঙালি অ্যাসিস্ট্যান্টটিকে যারপরনাই স্নেহ করত শাহিদ।
সরিতের বাড়ি এক্ষুনি যেতে হবে। নতুন আবিষ্কারের উত্তেজনায় শাহিদের কথাই ভুলে যাচ্ছিল মৌলিনাথ! লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে ওর!
কোটটা নিয়ে বেরতে গিয়ে থমকাল শাহিদ। কোণের সেফটা ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু ভাঙা যায়নি। ওটা খোলার পদ্ধতি কেবল মৌলিনাথ জানত।
হ্যান্ডেলটা বিশেষভাবে ঘোরাতে একটা খোপের মতো জায়গা বেরিয়ে এল সেফের দরজায়। সেখানে একটা গোপন কম্বিনেশন। সেখানে নম্বর দিতেই খুলে গেল সেফটা। সেফের ভেতর একটা পিস্তল আছে শাহিদের। সেটা নিয়ে নিল মৌলিনাথ।
সেফটা খোলা সহজ নয় জেনেও ঝুঁকি নেয়নি শাহিদ। ও জানত অ্যাকোয়ারিয়াম মূল ল্যাবে। সেখানে ভাঙচুর করলে ব্যাপারটা জানাজানি হবে। তাছাড়া অ্যাকোয়ারিয়ামের নুড়িপাথরের তলায় কেউ খুঁজে দেখবে না কিছু।
এখনই শাহিদের খোঁজ করতেই হবে।
পিস্তল কোমরে গুঁজে কোটটা কোনও ক্রমে গায়ে গলিয়ে অ্যাঞ্জেলাকে গিয়ে মৌলিনাথ বলল— কুইক! একজনের বাড়ি যেতে হবে।
অ্যাঞ্জেলা বিরসবদনে বলল— আর ডিনার?
–পরে হবে। এসো।
কী মনে করে কাচের জারটা সঙ্গে নিয়ে নিল মৌলিনাথ। ল্যাব মোটেই নিরাপদ নয়।
অ্যাঞ্জেলার হাত ধরে ল্যাব থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরোল মৌলিনাথ।
সরিৎ দত্ত তার ছোট্ট কন্ডো-তে ঘর অন্ধকার করে বসেছিল। চিন্তা ক্রমে বাড়ছিল ওর। রডরিগেজ একটা মূর্তিমান শয়তান! শাহিদ রাজি না হলে এই কাজে ও সরিৎকে ভেড়াতে চাইবে। কিন্তু সরিৎকে শাহিদ ভেঙে বলেনি, ওই আশ্চর্য সঙ্কেত কোথা থেকে, কীভাবে পাচ্ছিল সে। শাহিদ যদি সাহায্য না করে, তবে কপালে দুঃখ আছে সরিতের।
হঠাৎ জোরে কলিংবেল বেজে উঠল কন্ডো-র।
সাতটা বাজতে যায় এখানকার সময় অনুযায়ী। রাত না নামলেও, ওয়াশিংটনের শহরতলির এই পাড়া এখনই বেশ নিঝুম। সরিতের তো কোনও অতিথি আসার কথা নয়!
দরজার পিপিং হোল দিয়ে বাইরে নজর রাখল সরিৎ। ওকে এখন প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে।
ওর বুকটা ধড়াস করে উঠল।
মৌলিনাথ। সঙ্গে ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট মহিলা, কী যেন নাম, অ্যাঞ্জেলা।
এরা কী চায়? সব বুঝে গেল না তো!
সরিৎ দরজাটা ভয়ে ভয়ে খুলতেই ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকে পড়ল মৌলিনাথ।
–শাহিদ এখন কোথায়?
প্রশ্নটা বজ্রপাতের মতোই এল সরিতের কাছে।
ও কী উত্তর দেবে বোঝার আগেই মৌলিনাথ আবার বলল— তোমাকে বলে গেছে সরিৎ, যাওয়ার আগে? বলো বলো, খুব দরকার।
সরিৎ বুঝল, অন্য কিছু একটা ঘটেছে। শাহিদের কী হয়েছে, এখনও পর্যন্ত জানে না এরা।
–স্যর তো যুদ্ধে…
আমতা আমতা করে কথাটা বলতে গেল সরিৎ।
–বাজে কথা, সরিৎ! বাজে কথা।
অস্থিরভাবে ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত যাতায়াত করতে করতে বলল মৌলিনাথ। অ্যাঞ্জেলা ওর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে।
সরিৎ চুপ। কথা সরছে না ওর মুখে।
একটা চুরুট ধরাল মৌলিনাথ। তারপর বলল— আই নো সামথিং ইজ রং! ও আমার জন্য একটা সঙ্কেত রেখে গেছে। তাছাড়া ওর ড্রয়ারটা লন্ডভন্ড…
–সঙ্কেত!
সরিৎ প্রায় আঁতকে উঠল।
এক সেকেন্ডের জন্য থামল মৌলিনাথ। তারপর বলল— তোমাকে সবটা বিশ্বাস করে বলছি সরিৎ! তোমাকে বোধহয় বিশ্বাস করা যায়!
মৌলিনাথ বুঝলও না, কত বড় ভুল ও করতে চলেছে।
[আবার আগামী সংখ্যায়]