মুরিদ বারঘৌতি: প্যালেস্তাইনের নির্বাসিত কবি

সোহেল ইসলাম

 

অধিকৃত প্যালেস্তাইনের পশ্চিম অঞ্চল ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের রামাল্লাহ্ শহরের কাছের একটা গ্রামে ১৯৪৪-এ মুরিদ বারঘৌতি জন্মগ্রহণ করেন। মুরিদ বারঘৌতিকে প্যালেস্তাইনের নির্বাসিত কবি হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৬৩-তে ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রি অধ্যয়নের জন্য কায়রোতে যান, সেই থেকে তাঁর নির্বাসন শুরু। আর দেশে ফেরার অনুমতি পাননি। ইজরায়েলি সরকারের নির্বাসন ঘোষণার ফলে তাঁর ৩০ বছরের জন্য ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৬-এ তাঁকে মিশর থেকে এবং পরবর্তীতে লেবানন ও জর্ডন থেকেও নির্বাসিত করা হয়। মুরিদ বারঘৌতিকে এতটা সময় নির্বাসনে রাখার একটাই কারণ, তাঁর লেখালেখি। প্যালেস্তিনীয় জনগণের উপর ইজরায়েলি সরকারের করা অত্যাচার আর অন্যায়ের ছবি বারঘৌতির কবিতা। প্যালেস্তিনীয়দের বাস্তুচ্যুত করা বা উদ্বাস্তুর জীবন বেছে নিতে বাধ্য করাকে বারঘৌতি কোনওদিন মেনে নিতে পারেননি। বারবার নিজের লেখালেখিতে প্যালেস্তিনীয়দের বেদনাদায়ক জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে এনেছেন।

২০২১-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি মুরিদ বারঘৌতির মৃত্যুর খবর সকলের মনখারাপ করে দেয়। তাঁর মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে প্যালেস্তাইনের সংস্কৃতিমন্ত্রী আতেফ আবু সইফ বলেছেন যে “প্যালেস্তিনীয় আরব বিশ্ব জাতীয় সংগ্রাম ও সৃজনশীলতার প্রতীক হারাল।”

তাঁর প্রকাশিত বইসমূহ: আমার রামাল্লাহ্ (২০০৩); ছোট সূর্য (২০০৩); মুনতাসাফ আল-লায়ল (২০০৫); মধ্যরাত এবং অন্যান্য কবিতা (২০০৮) প্রভৃতি।

 

মুরিদ বারঘৌতির কবিতা

সৈনিক

যুদ্ধে
একটা সৈনিক থাকেই
যে একরাশ বিভ্রান্তি নিয়ে
তাঁবুর বাইরে একা
নিজেই নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে

রক্ত আর ধ্বংস থেকে
নিজেকে আলাদা করতে
মাউথ অর্গানে সুর খোঁজে
গান ধরে
পরক্ষণেই ভাবে
নরকে মাউথ অর্গানের কী কাজ?

ভাবতে ভাবতেই
একটা ছায়া এগিয়ে আসে
তারপর আরও অনেক ছায়া
সহযোদ্ধারা ঘিরে ধরে

শুরু হয় গান
শুরু হয় পরবর্তী হত্যা পরিকল্পনা

 

এও ঠিক আছে

পরিষ্কার বালিশে মাথা রেখে
বন্ধুদের সঙ্গে মরে যাওয়া ভাল
বুকের উপর আড়াআড়িভাবে থাকবে হাত
মুখ ফ্যাকাশে হবে না
কোনও স্লোগান না
কোনও ব্যানার না
কোনও পোস্টার না
কোনও আঁচড় না
শেকলও না
শার্টে থাকবে না কোনও ফুটো
পাঁজরেও কোনও চিহ্ন থাকবে না
একটা মৃত্যু
নির্ভেজাল মৃত্যু
গালের নিচে সাদা বালিশ নিয়ে
প্রিয়জনের হাতে হাত রেখে
ডাক্তার-নার্সের ঘিরে থাকা উৎকণ্ঠায়
মরে যাওয়া ছাড়া
আমাদের কিছুই করার নেই

পৃথিবী যেমন আছে— থাক
এতকিছু না ভেবে, চলে যাওয়াই ভাল

ঠিক কেউ না কেউ এসবের পরিবর্তন ঘটাবে একদিন

 

আমার কোন সমস্যা হয় না

যখন নিজের দিকে তাকাই
কোনও সমস্যা হয় না
সাদাচুলওয়ালা মানুষটাকে মেয়েরা আজও পছন্দ করে

আমার চশমা
ইস্ত্রি করা শার্ট
চকচকে জুতো
এমনকী আমার শব্দ— স্তব্ধ হয়ে যায়নি
এখনও ওদের হাতকড়ায় বেঁধে ফেলা হয়নি
নির্বাসিত করা হয়নি দেশ থেকে

বন্ধুদের জানাজায় শামিল হতে দেওয়া হয়
এও কি কম পাওয়া?

এখন কোনও কিছুতেই অবাক হই না
বন্ধুর মাথায় শিং গজানো দেখেও না
লেজ লুকানোর কৌশলেও না
জামাকাপড়ের আড়ালে মুখ লুকোতে দেখেও না
কিছুই আর অবাক করে না

জানি, যে কোনওদিন
খুন হয়ে যেতে পারি
ক্ষমা করে দেব— সে তো বন্ধু

টিভি অ্যাঙ্করের হাসি
আগের মতো আহত করে না
আতঙ্কিত করে না খাকি রঙের পোশাক
সুইমিং পুলের জলে ডুবসাঁতার দেওয়ার সময়ও
পরিচয়পত্র কাছেই রাখি

নিজের দিকে তাকাই
ভাবি—
জন্মের দিন থেকে এখন অবধি
সবাই বুঝিয়ে গেল: মৃত্যুর পরও জীবন আছে

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে
হে ঈশ্বর, মৃত্যুর আগে কি
কোনও জীবন নেই

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...