জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
I waited till the shadows grew
Like giants, grim and grey;
I waited till night’s coming chased
The shadows far away.
ফেরার অপেক্ষা করছিলাম। গাড়ি সময় মত আসবে, ডাক আসবে। অথবা অন্যরা গিয়ে যেখানে প্রতিদিন হাতঘড়ির দিকে বারবার তাকাতে তাকাতে, অথবা ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলতে বলতে গাড়ি আসার অপেক্ষা করে… সেখানে চলে যাব, কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর। প্রতিটা অপেক্ষার একটা নিজস্ব আলো-অন্ধকার থাকে। আবহসঙ্গীতও থাকে, সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ধরা দেয় না। সারাদিন যেখানে রিসেপশনিস্ট বসে থাকে, সেখানে রাত হলে এসে বসে নিরাপত্তারক্ষী। অফিসের ল্যান্ডলাইন থেকে ফোনে কথা বলে— যখন কেউ দেখার থাকে না। কথা বলতেই থাকে, কথা আর শেষ হয় না। ক্রমে একটা সাহস এসে যায়, কেউ দেখে ফেললেও বিশেষ ভাবে না। বেলা শেষ হওয়ার সঙ্গেই রিসেপশনের টেবিলে সাজিয়ে রাখা ফুলদানিগুলোর ফুলও শুকিয়ে যায়। একদিন এই অফিস-ফেরতদের মধ্যেই একজন একটা ফুলের বোকে দেখিয়ে হঠাৎ নিরাপত্তারক্ষীকে বলেছিল— নিয়ে যাব? কেনই বা না বলবে সেই নিরাপত্তারক্ষী? সবাই জানে— ওটা ফেলেই দেওয়া হবে পরেরদিন সকালে। যে নিয়ে যাচ্ছে সাধ করে এখন… তার বাড়িতেও— ফেলেই দেওয়া হবে পরদিন সকালে।
সমস্ত রিসেপশনই এক অপেক্ষার জায়গা। সাক্ষাতের উদ্দেশ্য, কাজ উদ্ধার করা, অভিযোগ, সমস্যা এইসব কিছুর দীর্ঘ ছায়াকে অতিক্রম করে রিসেপশনিস্টের হাসি আর সাজিয়ে রাখা ফুলগুলো খুব একটা নজরেই আসে না। কাজ বা প্রয়োজনটা মিটলে, ফেরার সময়ে হয়ত কখনও কখনও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখন একটু সেই নিয়ে ভাবার অথবা মনে মনে প্রশংসা করার অবকাশ পাওয়া যায়।
একটা ভারের গুরুত্ব আলাদা করেই বেড়ে যায়, অপেক্ষা করতে হলে। ওজন যাই হোক, ব্যাগ পিঠে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না বেশিক্ষণ। সেই কারণেই দ্রুত নিচে না নেমে গিয়ে, ওই রিসেপশনেই বসে থাকা। রিসেপশনের এক কোণে একটা ছোটখাটো টেবিলে আর একটা ফুলদানি, তাতেও ফুলের তোড়া। একটা অনুজ্জ্বল একাকী কোণ, আর ছড়িয়ে পড়া কিছুটা আলোর নিচে একটা নকশা করা কাচের ফুলদানি। এক-এক দিন এক-একরকম ফুলের তোড়া থাকে তাতে। সার্বিক ভাবে, সেই নিভৃত কোণ, তার বিষণ্ণতা— কোনও ফুলের রং বদলে দিতে পারে না। উজ্জ্বল হলুদ হলেও না। লাল-হলুদ অথবা নীল-হলুদ কম্বিনেশনেও না। বরং মনে হত জোর করে মেক-আপ করিয়ে দেওয়ায় অস্বস্তি নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে গলির এক কোণে। অনেক বেশি সুন্দর লাগে যখন সাদা ফুল থাকে, অথবা অন্য একটি রঙের সঙ্গে সাদাকে রাখা হয়।
অপেক্ষার জন্য এই কোণটিই আমারও পছন্দ। তাই ক্রমে সেই কাচের ফুলদানির সঙ্গে সখ্য হয়ে যায়। এমন অপেক্ষার মাঝেই কিছু সিদ্ধান্ত বা তাকে প্রভাবিত করার মত চিন্তাগুলো বদলে যায়। হঠাৎই মনে হয়, প্রতিদিনের মত ঘরে নয়… আজ অন্য কোথাও ফেরা যাক। আজ রাতেই।
যদিও, আমাদের অপেক্ষার মুহূর্তদের কোনও ছবি নেই। একটা কোণ-আলো-করা স্মৃতি আছে।
আমাকে দেখিয়ে দাও পাহাড়ের গা ঘেঁষে সেই পাথুরে পথ—
আমি যাব
এই দেখো তোমাদের মত আমারও ক্ষত— এই দেখো উলটে পালটে…
অরণ্যপথের শেষ চেকপোস্ট পার করে যে প্রথম গ্রামাঞ্চল… সেখানে এক পাহাড়ি জলস্রোতে মোষ আর হাতিদের স্নান করাতে নিয়ে আসে গ্রামবাসীরা। অরণ্যের মধ্যে যেতে যেতে যাদের জংলি হাতি অথবা গৌর চোখে পড়ে না। তারা এইসব দৃশ্য দেখেই চোদ্দ আনা কুড়িয়ে নেয়। যারা পথ আর অঞ্চল চেনে, নিশ্চিত থাকে— এইদিকে একটু চোখ খোলা রাখলে কিছু না কিছুর দেখা মিলবেই। আসলে, মানুষের সবসময়েই বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছুকে ট্রফি হিসেবে পাওয়ার ইচ্ছে থাকে। তাই কাঠবিড়ালি, পাখি, প্রজাপতি, জংলা ফুলের গাছ— এসব বিশেষ চোখে পড়ে না। আর একবার ঘর-বাড়ি জনবসতির টুকরো অংশ ছত্রাকের মত দেখা দিতে শুরু করলে তো হতাশাই নেমে আসে। ‘আর কোনও আশা নেই’।
ঠিক সেই চোকপোস্টের পরেই, একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে পাহাড়ের দিকে। আর একটা পথ চলে গেছে পাহাড়তলির জনবসতি পেরিয়ে টাউনের দিকে, সেখান থেকে একটু ঘুরপথে লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে একটু বেশি সময় নিয়ে পাহাড়ে ওঠার পথ ধরতে হয়। সেই পথে বাঁক কম, বিপদের ঝুঁকি কম, হেয়ারপিন বেন্ডের সংখ্যা কম। একের পর এক পাহাড়ি বসতি, চা-বাগান পার করে উঠতে হয়ে ওপরে। আর সেই অন্য সোজা পথে পাহাড়ে উঠতে সময় লাগে কম, অনেকটা পথই জনবসতিহীন, বিপদের ঝুঁকি আর হেয়ারপিন বেন্ড বেশি। ঠিক রূপকথার গল্পের মত, গভীর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে পথ চলে গেছে দুদিকে— দুই পৃথক পথের যাত্রা-ভাগ্য দুরকম। যে পথে বিপদের ঝুঁকি, সেই পথেও যায় অনেকে— অভিযান আর রোমাঞ্চ কুড়োতে। সেই পথের ধারে ফরেস্ট বাংলো আছে। আছে বেসরকারি উদ্যোগে গজিয়ে ওঠা ক্যাফে। পাহাড়ে ওঠার আগে, অথবা পাহাড় থেকে নেমে এসে ফরেস্ট বাংলোর মতই দেখতে এই ক্যাফের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কিছুক্ষণ পা-কোমর ছাড়িয়ে নেয় পর্যটকরা। জার্মান শেফার্ড অথবা গোল্ডেন রিট্রিভারের সঙ্গে চেহারার মিল নিয়ে স্থানীয় কুকুরগুলো বিশ্রাম করে। তাকিয়ে দেখে অচেনা মুখগুলোকে ঢুলুঢুলু দৃষ্টি নিয়ে। ওরা ছুড়ে দেওয়া বিস্কুট খায় না। ছুড়ে দেওয়া কিছুই খায় না। আর হাতে করে কেউ ওদের কিছু খাইয়ে দিয়েছে— এমনও দেখিনি। ক্যাফের সিঁড়ি অথবা বারান্দায় শুয়ে শুয়ে ওরা ঠিক কিসের অপেক্ষা করে… আসলে, একথা তো ঠিকই ক্যাফেরা চিরকালই এক অপেক্ষার পীঠস্থান। কোথাও থেকে কোথাও পালিয়ে যাওয়ার মাঝে এমনই ক্যাফেতে নকশা-করা কাঠের কেদারায় বসে অপেক্ষা করি, কিছুক্ষণ… দেরি হয়ে যায়, এলোমেলো হয়ে যায় নির্ধারিত সময়ে পৌঁছনোর পরিকল্পনা। হঠাৎই ভেসে যাওয়া মেঘে দু পশলা বৃষ্টি পড়ে, সন্ধের আগে আচমকা অন্ধকার হয়ে আসে পাহাড়-জঙ্গল। ঝুলিয়ে রাখা হারিকেন-চোঙের ভেতর হলুদ বিজলি বাতি জ্বলে ওঠে ক্যাফের বারান্দায়। অপেক্ষার মেয়াদ বাড়ে। একটা রাঙতামোড়া বোতলে একটি মাত্র গোলাপ— নিজের সরু শাখা আর কাঁটা সহ কাচের দেওয়ালে মাথা দিয়ে বসে আছে নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে একা। আমরা শব্দহীন ছিলাম। আমাদের প্রতিবিম্বদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথা হল।
How dreary— to be— Somebody!
How public— like a Frog—
To tell one’s name— the livelong June—
To an admiring Bog!
অনেকেই আছে, যারা বেড়াতে বা পর্যটনে যায় না, পালাতে যায়। আমি নিশ্চিত— পালাতেই যায়।
এমনিতেও, ছবি তোলাটা একটা অবসেশন হয়ে গেছে। একরকম ডোপামিন-এফেক্টের মতই সর্বত্র মানুষ অবিরাম ছবি তুলছে, মূলত নিজের বা নিজেদেরই। হাঁটতে-চলতে সচেতন থাকতে হয়, হয়ত কারো ছবির ফ্রেমে অনধিকার প্রবেশ করে ফেলছি। অপ্রস্তুত হয়ে দুঃখপ্রকাশ করতে হয়। কেজো কথা বলতে বলতে বলতে একসময়ে যখন আর কিছু বলার থাকে না, তখন মানুষ হয় চুপ করে বসে থাকে… নাহলে উঠে চলে যায়। একসঙ্গে চুপ করে বসে থাকারও একটা গুরুত্ব আর প্রয়োজনীয়তা থাকে। দুজনে মানুষ, একে অপরের সান্নিধ্যে চুপ করে বসে থাকতে চায়। সেই নৈঃশব্দ্য, সেই নিভৃত যাপন— তাদের নিজস্ব। ব্যক্তিগতও। ভিড়ের মধ্যে থেকেও হঠাৎ আলাদা হয়ে যাওয়া যায়। তেমনই, ছবি তুলতে তুলতে একসময়ে নিশ্চয়ই নতুন করে ছবি তোলার সেই ট্রিগারটা আর থাকে না। তখন প্রকৃতির মাঝে নিভৃতে বসতে ইচ্ছে করে। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে গেলে আর ছবি তোলার কোনও আগ্রহ জন্মায় না। বরং ইচ্ছে করে সেই জায়গাটাকে কিছুটা ব্যক্তিগত সময় দিতে। আমার জন্য আলাদা করেই তার কোনও অপেক্ষা কখনও থেকেছে কি না… এসব ভেবে নতুন করে প্রত্যাশাহত হই না। এমনিই বসে থাকতে ইচ্ছে হয় কিছুক্ষণ। তার না থাক, আমারই মনে ছিল না হয়। আমি প্রতীক্ষা করেছিলাম… আর একবার দেখা করব বলে। এতজনে্র মাঝে আলাদা করে আমাকে নিয়ে সচেতন হওয়া জরুরি নয়। কত লোক আসে, চলে যায়… একজন কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেলেই বা কী!
একাধিকবার যাওয়া হলে অঞ্চল সম্বন্ধে একটা ধারণার সৃষ্টি হয়, যেমন দীর্ঘদিন পরিচিতির পর কোনও বিশেষ ব্যক্তি সম্পর্কে। বুঝতে পারি, কোনদিকে পর্যটকদের ভিড় বেশি। কোনদিকে পালিয়ে আসা মানুষরা এসে বসে, কোনদিকে মানুষ নির্জনতা খোঁজে। আসা-যাওয়ার এই উপত্যকা আর মালভূমিতে কেউ এমনই এক নির্জন অঞ্চলে কিছু একটা নির্মাণ করতে শুরু করে পরিত্যক্ত ফেলে রেখে চলে গেছে— এমন দৃশ্য হতাশ করে। বুঝতে পারি, এই অঞ্চল আর এমন থাকবে না। এর পরেরবার এলে, এখানে অন্য কিছু দেখব। ছবি তোলার অদম্য ইচ্ছে আর যাবতীয় বাতুলতা ঘিরে ফেলবে জমির এই অংশকেও। অসমাপ্ত কাঠামোর জ্যামিতি ভেদ করে আকাশ আর পাহাড় দেখি— যত দূর দৃষ্টি যায়। যেহেতু এই বসার জায়গাটুকু আর আগের মত ফিরে আসবে না। এখানে আমাদের সম্ভবত এই শেষ সাক্ষাৎ এবং কিছু কথা ব্যক্তিগত। কিছু সলিলকি পেরিয়ে একটা সেলফি তুলতে যাই। ছবিতে আমরা ধরা পড়ি না— শুধু এই জ্যামিতিক সমস্যা আর ভেসে যাওয়া মেঘ… নির্দিষ্ট দূরত্বে এবং উচ্চতায়।
এত কালো মেখেছি দু হাতে
এত কাল ধরে।
কখনও তোমার করে, তোমাকে ভাবিনি।
একটা বিপজ্জনক চড়াইয়ে একটানা ঘুরে একধাপ ওপরের রাস্তা উঠে যাওয়া… ঠিক ইংরেজি বর্ণমালার ‘U’ কে উলটে দিলে যেমন হয়, কিংবা অশ্বক্ষুর চুম্বক— এইরকম চিহ্ন থাকে, বিশেষ একরকমের রোড-সাইন… বুঝে নিতে হয়, হেয়ারপিন বেন্ড। প্রথমদিকে সমতলকে ক্রমে নিচে নেমে যেতে দেখার একটা কৌতূহল ছিল। আগ্রহ ছিল, পাথর বেয়ে গড়িয়ে পড়া পাহাড়ি নদীর ধারা দেখার। আসলে বোধহয়, তখন সাবধান হওয়া কাকে বলে— তার দৃষ্টিকোণটা অন্যরকম ছিল। উলটোদিক থেকেও কাউকে সেই এক সচেতনতা নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দেখছি একই সাবধানী বাঁকের তাৎক্ষণিকতায়।
ভিড় থেকে সরে যেতে যেতেই অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া যায়। পাহাড়ি শহর, শহরতলি, জনবসতি, চা-বাগান— সব কিছু থেকে দূরে একেবারেই অন্য কোনও দিকে। নির্জনতম কোণে… দূরের পাহাড় আর জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না, এমন কোনও খাদের কিনারে। খাদ, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গভীর জঙ্গল… উলটানো চুম্বক, আর তার আকর্ষণ অতিক্রম করে বিরাজমান এক অনন্ত শূন্যতা। ইচ্ছে, আর সাহস… এর মধ্যে কোনটা যে বেশি ফাঁকি দেয়… যাত্রাপথকে নিজের ভাবার সান্ত্বনাও নৈঃশব্দ্যে বিলীন হতে দেখি ‘সব ঝুট হ্যায়’ সাবধানবাণীর পর। আসলে এইসব কিছুই আমার নয়… হয়ত কোনওকিছুই আমার নয়। তাই পাহাড়ের কাছে বার বার আসা… আর ফিরে যাওয়া সমতলে… কাঁধ-ঘষা ভিড়ে। একটা হেয়ারপিন বাঁক থেকে আর একটা হেয়ারপিন বাঁক গুণে গুণে। তবুও যে কেন ‘হয়ত’-টা সরিয়ে ফেলতে এত মায়া!
গভীর রাতেও পাহাড় জেগে থাকে… জেগে থাকে খাদ, উপত্যকা… আর হেয়ারপিনগুলো। আর খাদের খুব কাছে কেউ একা। সেও পাহাড়ি অন্ধকারের ক্যানভাসে কালচে নীল, শুধু ঠোঁটের কাছাকাছি লালচে আগুনটা জোনাকিদের থেকে আলাদা… কৃত্রিম। নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ ভারী হয়ে উঠলে, বোধহয় নিজের ইচ্ছেমত রাতের অন্ধকারে পাথুরে দেওয়ালের ধারে গাড়িটাকে এইভাবেই থমকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়। মাঝে মাঝে আঁধারও সাহসকে এমন একটা ধাক্কা দেয়, যা আলোয় থেকে মানুষ ভাবতেই পারবে না। জ্বলতে জ্বলতে আগুন, প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে একটু একটু করে ঠোঁটের কাছাকাছি আসে… ছাইগুঁড়ো ভেসে যাওয়া হাওয়ায়। গাঢ় নীল আকাশের ক্যানভাসে কাস্তের মত চাঁদ… আর জনপদের নিভু নিভু লণ্ঠনের মত ছড়িয়ে থাকা একমুঠো তাড়া। সেদিকে তাকিয়ে ফ্ল্যাশব্যাকের পর ফ্ল্যাশব্যাক। আগুনের অন্তিম স্পর্শ মেখে সিগারেটের অবশেষটুকু ঝাঁপিয়ে পড়ে… খাদের অন্ধকারে। অন্ধকারে হাত দুটোর দিকে তাকালেও মনে… কত কালি মাখা, স্তরের পর স্তর কালির প্রলেপ।
ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভাল
এত কালো মেখেছি দু হাতে
এত কাল ধরে…
এতক্ষণ ওপরের দিকে তাকিয়ে আঁধারে আলো খোঁজা চোখ… কিছুক্ষণ নিচের দিকেও তাকিয়ে থাকে একইভাবে। ছাইয়ের গতিপথ… প্রত্যাখ্যাত সিগারেটের গতিপথ, আগুনের গতিপথ… আঁধারে মিশেছে সেই নিচে; আরও গভীরে। যতটা গভীরে তাকালে, আঁধার ছাড়াও কোনও কিছুর অস্তিত্ব অনুভূত হয়। এভাবেই স্তূপাকার ব্যবধান… ভস্মাবশেষ, অস্থি ভাসানোর স্মৃতি। তারপর, পাহাড়ি বাতাসের শব্দ… পাতা ঝরার শব্দ… পায়ের শব্দ। পদক্ষেপ এগোয় না কি পিছোয় আঁধারে বোঝা যায় না। সামনে প্রশান্ত শূন্যতা… দীর্ঘশ্বাস মিশে যায় পাহাড়ি বাতাসের প্রতিধ্বনিতে। তারপর নীরবতা, তবে বেশিক্ষণ নয়… অন্ধকার চিড়ে এক জোড়া হেডলাইট ধীরে ধীরে হেয়ারপিন পার করে চলে যায় দীর্ধশ্বাসের প্রতিধ্বনিকে পেছনে রেখে।
আর আমি? কোথায় আমি… এত সবের মাঝে কোথায় আমি? আমার কথা থাক… গাড়িটা চলে গেছে বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেল। রাস্তায় চাকার দাগও বোঝার উপায় নেই। কোথাও কোনও পাহাড়ি ঝরনা, বর্ষার ধারা নিয়ে তিরতির করে নেমে ধুয়ে দিয়ে যায় চাকার দাগগুলো। ভেজা পিচ রাস্তা… তার নিচে শাবল আর গাঁইতির দাগ… আর ডায়নামাইট ফাটানো ঘা-গুলো। হয়ত পাহাড়ও কোনওদিন প্রশ্ন করে বসবে— “কী রে? ওই গাঁইতি আর ডায়নামাইটের দাগগুলোকে ছুঁতে পেরেছিলি?
Not that it was beautiful,
but that, in the end, there was
a certain sense of order there;
something worth learning
in that narrow diary of my mind,
in the commonplaces of the asylum.
ডায়েরি লেখার অভ্যেস নেই। আর ছবিরাও সব ভোলাটাইল। হারাতেই থাকে। শুধু হারাতেই থাকে। কিন্তু এভাবে এক এক জায়গায় মনের কাছাকাছি চলে আসা কেউ বা কিছুর সঙ্গে এক-একটা মুহূর্তকথা— গুহাচিত্র অথবা বৃক্ষের শরীরে আঁচর কেটে লেখা স্মৃতিচিহ্নের মত মনে হয়। যেহেতু কণিকামাত্র, নগণ্যই— তাই সেসবের অর্থ-তাৎপর্য সকলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়াও জরুরি নয়। মানুষ একে অপরকে চিনতে পারলেও ডাকার আগে একবার ভাবে, নির্দ্বিধায় ডাকতেও পারে না সবসময়ে। প্রতিটা ডাকেরও নিজস্ব অর্থ আর উদ্দেশ্য পালটে যায় সময়ে সময়ে। যেহেতু অন্য প্রাণীর মত ডাক বলতে ‘কল’ নয়, ভাষা-বাক্য আছে, তার অহমিকা আছে— তাই বুঝতে পারে না সব সময়ে। আসলে মানুষও ডাকে, অন্য সব প্রাণীর মতই— মানুষের বিশেষ বিশেষ ডাক আছে, তারা নিজস্ব শব্দতরঙ্গে চলাফেরা করে। সবাই সব ডাক শুনতে পায় না। সবার কাছে সব শব্দের অর্থও হয় না। সবটা সচেতন, পূর্বনির্ধারিত কিংবা নির্দিষ্ট বলতে পারি না… তবে ডেকে ফেললে, বা সাড়া দিয়ে ফেললে— বুঝতে পারি। গুছিয়ে বোঝাতে পারব না যদিও, যে কী বুঝলাম। সে সব বুঝতেও একটু সময় দরকার, একটু অপেক্ষা করতে হবে। এখানে আস্থাও একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ।
একটা অপেক্ষা থেকে আর একটা অপেক্ষা অবধিও একটা পূর্ণ বৃত্ত আঁকা হয়ে যায়। কৃত্রিম জলাশয়ে ওয়াটার লিলির ছোট ছোট পাতায় সকালের রোদ এসে পড়লে আগেরদিন রাতের অনেক কথাই বহু বছর আগের স্মৃতি মনে হয়। ছোট ছোট একটা দুটো মাছ চোখে পড়লে, খুঁজে দেখতে ইচ্ছে হয়— আরও কিছু মাছ। সেই জলতরঙ্গকে আলো করা রোদের প্রতিফলন এসে পড়ে মুখে। অজ্ঞাতেই ঠোঁটের কোণে হাসি জন্ম নেয়। সেই সব ক্ষণস্থায়ী অভিব্যক্তি কোনও ছবিতে ধরা থাকে না। সচেতনের থেকে অবচেতনে থাকা অভিব্যক্তি অনেক সৎ, অথচ…
সাজানো রিসেপশন আর রিসেশনিস্টের থেকে অনেক দূরে, এখানে কোনও শৌখিন ফ্লাওয়ার ভেস নেই। একটা ছোট মাটির টবে একটা ছোট্ট ক্যাকটাস, শিশুর মত উজ্জ্বল। তাতে ছোট ছোট গোলাপি ফুল ফুটে আছে। পরিচিত কারও কপালে দেখা ছোট্ট গোলাপি টিপের মত।
*প্রতিটি আলোকচিত্রই লেখকের নিজস্ব