সীমা মুখোপাধ্যায়
নাট্যকর্মী, রংরূপ নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত
ঘটনাটি আমরা এখন প্রায় সকলেই জেনে গেছি। গত তেইশে ডিসেম্বর বেলেঘাটা রাসমেলার মাঠে এই ঘটনাটি ঘটে। ২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর ওই মাঠে নাট্যমেলার আয়োজন করেছিল ‘বিদূষক নাট্যমণ্ডলী’। ২৩ তারিখ সকালে মেলার আয়োজন চলাকালীন স্থানীয় তৃণমূল নেতা সে মাঠে হাজির হন। এই মাঠ নাকি কেক উৎসবের জন্য দরকার, তাই এখানে নাট্যমেলা করা যাবে না— এই মর্মে বিদূষক নাট্যমণ্ডলী-র নাট্যকর্মী অমিত সাহা ও অরূপ খাঁড়াকে ‘আদেশ’ দেওয়া হয়, অর্থাৎ শাসানো হয়। বাকবিতণ্ডা চলাকালীন অমিতকে মারধোর করে মাঠের বাইরে বের করে দেওয়া হয়। এরপর নাট্যমেলার ফ্লেক্স ও পোস্টার ছিঁড়ে তাণ্ডব চালায় স্থানীয় তৃণমূল বাহিনি।
এর অর্থ আজ শুধুমাত্র নাটক করার ‘অপরাধে’ সংস্কৃতির পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গে এক নাট্যকর্মীর গায়ে হাত তোলা হল। স্বাধীন মতপ্রকাশের যে কটি আধুনিক জায়গা রয়েছে, থিয়েটার তার মধ্যে একটি। আমাদের চারপাশে আজ যা ঘটছে, সেই সমসময়ের কথা নিজের মতো করে তুলে ধরে থিয়েটার। কিন্তু রাষ্ট্র বা আমাদের সমাজ আজকে এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে তাদের বিরুদ্ধে একটি কথাও শুনতে তারা রাজি নন। আজ সাংবাদিক থেকে শুরু করে ইতিহাসবিদ, যারাই একটু অন্য সুরে কথা বলছেন, যা ঘটে চলেছে তার বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তাদের ওপরেই শাসকের আঘাত নেমে আসছে ঘাতকের অস্ত্রের মতো। আমাদের দেশে থিয়েটারের ওপর তো আজ অবধি কম আক্রমণ হয়নি। আমরা সফদর হাশমির কথা জানি, আমরা প্রবীরবাবুর কথা জানি। শাসকের আক্রমণে তাঁদের প্রাণ হারাতে হয়েছিল। কিন্তু আজ এই একবিংশ শতাব্দীদের দাঁড়িয়ে আমাদের রাজ্যের শাসকদল নাটক-চলচ্চিত্রের উৎসব করছে, তাঁরা নাকি শিল্পীকে খুব সম্মান করে ও গুরুত্ব দেয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয়, কদিন আগে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মঞ্চে আমরা এই নিয়ে কত বড় বড় কথা শুনলাম। কিন্তু যখন কার্যক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে, তখন বোঝা যায় শাসকের আসল রূপটা কী। এই ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানাই। আবারও বলছি, তীব্র ধিক্কার জানাই।
সেদিন আমার শো ছিল বলে প্রতিবাদসভায় যেতে পারিনি। এই ন্যক্কারজনক ঘটনা হয়তো বলে দিচ্ছে আমাদের সমাজের শেষের শুরুয়াত হয়ে গেছে। মঞ্চকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। কোনও জায়গার থিয়েটার বলে দিতে পারে সেই জায়গাটা ঠিক কেমন। তাই যখন থিয়েটারের শিল্পীদের গায়ে হাত পড়ে, থিয়েটার নিজেই আক্রান্ত হয়, তখন তার থেকে নিন্দাজনক আর কী হতে পারে! ব্যাপারটা এরকম নয় যে থিয়েটার আগে কোনওদিন আক্রান্ত হয়নি, কিন্তু নিঃসন্দেহে সাম্প্রতিককালে আমাদের রাজ্যে অসহিষ্ণুতার পরিবেশ অনেকগুণ বেড়ে গেছে৷ কারণ অমিত সাহা ও অরূপ খাঁড়ার ওপর আক্রমণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বর্তমান শাসক বিরুদ্ধ মত, অপছন্দের কাজকে সহ্য করতে পারে না, যেকোনও অপছন্দের কাজকে চোখ রাঙানোই তাদের আসল সংস্কৃতি। আর আজ যখন চারপাশে দুর্নীতিতে মুড়ে দেওয়া হয়েছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানুষের ঘরবাড়ি, বাচ্চাদের মিড ডে মিল, সবেতেই দুর্নীতির গন্ধ, আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না কী ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে আমরা রয়েছি৷ অতএব বেলেঘাটায় আমরা সেদিন যেটা দেখলাম সেটা এই পচে যাওয়া সমাজেরই আরেকটা প্রকাশ। এগুলো কমা তো দূরের কথা, এই পচন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে বলেই আমার মনে হয়।
আশার কথা, বাংলার থিয়েটারের কর্মীরা একজোট হয়ে এই ঘটনার প্রতিবাদ করছেন৷ এখনও কিন্তু একটা ডাকে থিয়েটারের মানুষজন একজোট হয়। সবাই সমস্ত ঘটনায় একভাবে প্রতিবাদ না-ই করতে পারেন, কারণ মূলত থিয়েটার করাটাই তাদের কাজ, মিটিং-মিছিল করাটা নয়। কিন্তু এখনও বাংলার নাট্যমঞ্চে কোনও ক্রাইসিস দেখা দিলে, বাংলার আপামর নাট্যকর্মীরা একজোটে পাশে এসে দাঁড়ান। কোভিডের সময়েও আমরা দেখেছি। আমাদের থিয়েটারের লোকেরা একজোট হয়ে সেসময় কলাকুশলী বা ব্যাকস্টেজের কর্মীদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আজও আমরা একই ঘটনা ঘটতে দেখলাম। এটাই আমাদের থিয়েটার করার প্রেরণা। অনির্বাণ যে চিঠিটি ফেসবুকে পোস্ট করেছে, তা আমি অন্য একজনের কাছ থেকে দেখলাম, কারণ আমি ফেসবুকে নেই। চিঠিটা পড়ে আমার গর্বিত লেগেছে যে আমাদের থিয়েটারের একজন কর্মী এইভাবে সরাসরি প্রতিবাদ জানিয়েছে৷ অনির্বাণ একা নয়, এরকম অনেকেই প্রতিবাদ জানিয়েছেন, অবশ্যই যে বেশি পরিচিত মুখ, তার প্রতিবাদ যতটা প্রভাব ফেলে, অন্যদের প্রতিবাদ অতখানি প্রভাব ফেলে না। কিন্তু বাংলার নাট্যমহল একই মাটিতে দাঁড়িয়ে একজোট হয়ে এর নিন্দা করেছে। বাংলা জুড়ে নানা নাটকের শো-য়ের আগে এই ঘটনার বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব নেওয়া হচ্ছে৷ এইটাই আমাদের জোরের জায়গা। শাসকের অত্যাচার আমরা প্রতিহত করতে পারব কিনা জানি না, আমরা তো থিয়েটার করি, হাতে অস্ত্র ধরতে জানি না, থিয়েটারই আমাদের অস্ত্র, তাই হাজার ভয় দেখিয়েও আমাদের প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করা যাবে না।
*ফোনে কথোপকথনের ভিত্তিতে অনুলিখিত
শুধু নাট্যকর্মী নয় , একটু শুদ্ধ বুদ্ধি আছে, এমন সবার জোরালো প্রতিবাদ চাই।
হীরক সেনগুপ্ত