দেবাশিস সেনগুপ্ত
ক্রীড়াপ্রেমী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী
যদি আকাশের গায়ে কান না পাতি…
তোমার কথা শুনতে পাব না।(বুধাদিত্য মুখোপাধ্যায়)
তখন আমার নয় বছর, সেটা ১৯৬৭। কলকাতার ফুটবল তখনই যাবতীয় জাগতিক অনুভূতির ভাইরাসকে হারিয়ে দিয়ে ভ্যাকসিন হয়ে ঢুকে গেছে শিরায় শিরায়। আর একটু বড় হয়ে উঠে তিন বছর পরে একদিন সেই ভ্যাকসিনই আকাশের গায়ে কান পাততে শিখিয়েছিল। তখনই শুনতে পেয়েছিলাম তার কথা।
১৯৭০-এ বাড়িতে আসা যুগান্তর কাগজে, একজন হলুদ রঙের জার্সি পরা লোকের কোলে উঠে আর একটা হলুদ রঙের জার্সি পরা লোকের হাত মুঠো করে ছুড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে উল্লাস করার একটা ছবি দেখেছিলাম। হাত মুঠো করে ছুড়ে দেওয়া লোকটার নাম ক্যাপশনে লেখা ছিল পেলে আর তিনি যাঁর কোলে উঠেছিলেন তার নাম ছিল জেয়ারজিনহো। ছবি অনুযায়ী ১৯৭০-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে ইতালির বিরুদ্ধে দলের প্রথম গোলটি করার পরে আনন্দ করছিলেন পেলে, ফাইনালে তাঁর টিম ইতালির বিরুদ্ধে জিতেছিল ৪-১ গোলে। ব্যস… ওই একটা ছবি থেকেই আমার আন্তর্জাতিক ফুটবলের ধ্যানধারণাহীন কিশোরসত্তাতেও ঢুকে পড়লেন “পেলে”। একটু খোঁজ নিতেই ভাল নামটা জেনে গেলাম, এডসন অ্যারান্টেস ডু নাসিমেন্টো। এবং ক্রমশ আমার আর আমাদের প্রজন্মের আন্তর্জাতিক ফুটবল চেনার প্রথম আয়না হয়ে গিয়েছিলেন এডসন অ্যারান্টেস ডু নাসিমেন্টো ওরফে পেলে। কলকাতা ফুটবলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফুটবলও পেলের ছবির ছদ্মবেশে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে দিল আমার অঙ্ক খাতার ভাঁজে আর মনের গোপন কোণায়। সেদিনের বারো বছরের ছেলেটার আজ হারিয়ে যাওয়া সেদিনের অঙ্ক খাতায় একটা ছয় লাইনের ছড়া হয়ত ছটি ঋতুর মতন আলো ছড়ায় আজও—
পেলে, পেলে, পেলে,
এমন ভাল খেলা বলো
কোথায় খুঁজে পেলে?
পেলে, পেলে, পেলে,
তুমি খেললে ভুলি সবই,
কালো রঙের ছেলে।
আমার সেই মুগ্ধতা আরও বেড়েছিল সাত বছর পরে, তার কলকাতায় খেলে যাওয়ার পরে। সে বছর কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গলের কাছে হতমান মোহনবাগান পেলের কসমসের বিরুদ্ধে ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭-এর ম্যাচ থেকেই রসদ পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারতজোড়া অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে ত্রিমুকুট জিতেছিল। কসমসের বিরুদ্ধে ম্যাচে শিবাজী-সুধীর-সুব্রত-গৌতম-প্রসূন-হাবিব-আকবর-শ্যামদের প্রতিরোধ সেদিন যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল, সেটাই নিরঙ্কুশ দায়ী ছিল সেবারের ত্রিমুকুট জেতার জন্য। কলকাতার ফুটবল খাজানায় কোহিনূর ছিল দিনটা। তার চার দিন পরেই আইএফএ শিল্ড ফাইনালে শ্যাম থাপার গোলে ইস্টবেঙ্গলকে হারায় মোহনবাগান। তার মাসতিনেকের মধ্যেই তাদের তাঁবুতে ঢুকে পড়েছিল ডুরান্ড কাপ আর রোভার্স কাপ। তখন উনিশ বছরের আমার ভাবতে ভাল লাগত যে পেলেই ছিলেন মোহনবাগানের ১৯৭৭-এর সাফল্যের উপহার নিয়ে আসা সান্তাক্লজ।
এই মুগ্ধতা পুরোটা টাল না খেলেও কিছুটা তো টলে গিয়েছিলই এরও নয় বছর পরে, যখন মেক্সিকোর মাটিতে এক হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা ফুটবলের ইতিহাস-ভূগোল-জ্যামিতি বদলে দিয়ে বিশ্বকাপ তুলে দেন আর্জেন্টিনার ঘরে। বাঙালির ব্রাজিল আর পেলেমুখিনতা আড়াআড়ি ভাগ করে অন্য অর্ধটার উপর থাবা বসিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার মারাদোনা, সেই ১৯৮৬-তেই। সে ভাগবাঁটোয়ারায় আজও মুগ্ধ ক্যাপটিভ, অনেকের সঙ্গে আমিও, পরে যা দৃঢ়তর করেছিলেন আর এক আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি।
পেলের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর। খুব ছোট থেকেই ফুটবলের সঙ্গে সখ্য। ১৩ বছরেই বাউরো ক্লাবের যুব দলে খেলা ৪ বছরের জন্য। ১৯৫৭ থেকে সান্টোসে খেলা। যখন বয়স সতেরো পেরোচ্ছে তখনই প্রথম বিশ্বকাপ খেলা, ফাইনালে ২টি ও মোট ৬ট গোল করা, সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিকসহ। ৫-২ গোলে হোম টিম সুইডেনকে হারিয়ে প্রথমবারের জন্য বিশ্বকাপ জেতা, সেই ১৯৫৮-এ। ১৯৬২-র বিশ্বকাপে ২টি ম্যাচ খেলে চোটের জন্য আর খেলতে না পারা, ১টি গোল করতে পারা, কিন্তু দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ জেতা টিমের সদস্য থাকা। ১৯৬৬-তে তৃতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ খেলা, ১টি গোল করা ও ব্রাজিলের গ্রুপ লিগ থেকেই বিদায়। ১৯৭০-এ ইতালিতে চতুর্থবার খেলে তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জেতা, ফাইনালের ১টি গোল সহ ৪টি গোল করা। মোট ১৪টি বিশ্বকাপ ম্যাচে ১২টি গোল করা।
দেশের হয়ে ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল (১৪টি বিশ্বকাপ ম্যাচে ১২টি গোল সহ), বিশ্বকাপে মোট ১০টি অ্যাসিস্ট এবং ৩ বার বিশ্বকাপ জেতা মিলে দেশের হয়ে তাঁর খেলা যেন উজ্জ্বল এল.ই.ডি বাল্বের আলো ছড়ানো। তাঁর ক্লাবের হয়ে খেলাতেও প্রায় একইরকম আলো ছড়িয়ে যেত, সান্টোসের হয়ে ২১টি ট্রফি আর অনেক পরে কসমস-এর হয়ে ২টি ট্রফি জেতায় আর ৭২০ ম্যাচে ৬৮০ গোল করায়। সব ধরনের ম্যাচ মিলিয়ে ১৩৬৩ ম্যাচে ১২৮৩ গোল করে গিনেস বুকে থেকে যাওয়া তাঁকে “জাতীয় সম্পত্তি” ঘোষণা করে ব্রাজিল সরকার তাঁকে প্রাইম টাইমে দেশের বাইরের কোনও ক্লাবে যেতে দেয়নি। প্রাইম টাইম শেষ হয়ে যাওয়ার পরে নিউইয়র্কের কসমস ক্লাবের হয়ে খেলার অনুমতি পেয়েছিলেন তিনি। তিনি সান্টোসের হয়ে ৬৫৬ ম্যাচে করেছেন ৬৪৩ গোল আর কসমস ক্লাবের হয়ে ৬৪ ম্যাচে ৩৭ গোল। ১৭ বছর ২৪৪ দিনে বিশ্বকাপ (১৯৫৮) জিতেছেন, ১৭ বছর ২৩৯ দিনে প্রথম বিশ্বকাপ হ্যাটট্রিক করেছেন। তাঁর খেলা দেখার জন্য নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ সাময়িক থামানো হয়েছিল।
২০২১ সাল থেকে অন্ত্রের ক্যানসারে আক্রান্ত হন পেলে। কাতার বিশ্বকাপের সময় শারীরিক অবস্থার প্রচণ্ড অবনতি হওয়ায় গত ২৯ নভেম্বর তাঁকে সাও পাওলোর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতালে থেকেই ১৮ ডিসেম্বর কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালে জয়ী মেসির নেতৃত্বাধীন আর্জেন্টিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন পেলে, দেখেছিলেন কুড়ি বছর পরে বিশ্বকাপের লাতিন আমেরিকায় ফিরে আসা। গত ২২ ডিসেম্বর ক্যানসারের প্রকোপ আচমকাই বেড়ে যায়, যা আর কমাতে পারেননি চিকিৎসকরা। তাঁরা সুস্থ করে তুলতে পারলেন না ফুটবল সম্রাট পেলেকে। অতঃপর ২৯ ডিসেম্বরের শেষতম প্রহরে ৩টি বিশ্বকাপ জেতা পেলে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে, কাতার বিশ্বকাপকে বিঘ্নিত না করে। এই শেষ লাইনটাও আসলে ভুল। তিনি কোথাও যাননি। তিনি কোথাও যেতে পারেন না। তিনি ছিলেন। তিনি আছেন। তিনি থাকবেন। যতদিন বিশ্বে ফুটবল খেলা থাকবে। যতদিন বিশ্বে একজনও ফুটবলপ্রেমী থাকবে।
সেদিনের ১২ বছরের ছেলেটা এখন আরও বাহান্ন বছর পেরিয়ে এসে মারাদোনা ও মেসিতে মাখামাখি হয়েও বেশ বুঝতে পারছে যে ২৯ ডিসেম্বর থেকে পেলে মরণোত্তর রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন তার হৃদয়পুরে। বাংলার মাটিতে দুটি সম-উচ্চারিত সমার্থক শব্দ আজও পেলে আর মারাদোনা। সে অর্থের নাম ফুটবল। কিন্তু, এসব কিছু না। পেলের আসল কৃতিত্ব অন্তত দুটো প্রজন্মকে ফুটবলে টেনে আনা। ফুটবলে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া অন্তত দুটো প্রজন্মের জন্য তিনিই দায়ী থেকে যাবেন। আর মারাদোনার কৃতিত্ব এখানেই যে পেলের সেই নিরঙ্কুশ আধিপত্যকে তিনি সমান দুটো ভাগে ভাগ করে ফেলেছিলেন। মারাদোনার ১৯৮৬-র ঐশ্বরিক উত্থানের আগে পর্যন্ত সিংহভাগ বাঙালি আচ্ছন্ন ছিলেন পেলে নামের জাদুতেই।
“ফিফা ম্যাগাজিন”-এর পাঠক এবং জুরি বোর্ডের বিচারে পেলেই বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফুটবলার। তবে ইন্টারনেটে সাধারণ ফুটবলপ্রেমীদের ভোট গিয়েছিল দিয়েগো মারাদোনার পক্ষে। ফিফা শেষ পর্যন্ত যুগ্মভাবে শতাব্দীসেরা ঘোষণা করে দুজনকেই। ২০২০-র ২৫ নভেম্বর আচমকাই ৬০ বছর বয়সে প্রয়াত হন মারাদোনা। আর ২০২২-এর ২৯ ডিসেম্বর পেলেও চলে গেলে চিরনিদ্রার দেশে।
পৃথিবীর যে কোনও দেশের যে কোনও সাইজের যে কোনও মাঠে ফুটবল খেলা শুরু হলেই সেখানে থেকে যাবেন পেলে আর মারাদোনা, জ্বলতে থাকবেন ফুটবলের স্মারকপ্রদীপের শিখা হয়ে। আজ এবং আগামীতেও। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা অথবা লাতিন আমেরিকার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বজোড়া প্রতিটি ফুটবলপ্রেমীর যাপনেই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থেকে গেছেন তাঁরা, ফুটবলের ব্র্যান্ডদূত হয়ে। লাতিন আমেরিকার ফুটবলকে বিশ্বে পরিচিতি দেওয়া পেলে আর মারাদোনা ফুটবল থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না কোনওদিন।
ভাল থাকুন পেলে, যেখানে গেলেন। সেখানে লাতিন আমেরিকা বনাম ইউরোপ একটা ফুটবল ম্যাচের প্রস্তুতি হয়ত শুরু হয়ে গেছে এখনই। হয়ত সেই ফুটবল ম্যাচের রূপরেখা ও পরিকল্পনা ঠিক করতে এতক্ষণে আলোচনার টেবিলে বসে গেছেন পেলে, পাশে মারাদোনা, গ্যারিঞ্চা, ডি স্টেফানো, সক্রেটিসদের নিয়ে।
পেলে ইজ ডেড।
লং লিভ পেলে…
খেলাকেন্দ্রিক, আরো স্পষ্ট করে বললে ফুটবল নিয়ে এত সুখপাঠ্য লেখা বহুদিন পর পড়লাম। কুর্নিশ আপনাকে।
খুব সত্যি কথা, বাঙালি মনে ‘দুটি সম-উচ্চারিত সমার্থক শব্দ আজও পেলে আর মারাদোনা’। ফুটবলের দুই জাদুকরকে সেলাম!