বেকারত্ব: আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে?

দেবব্রত শ্যামরায়

 



রাজনৈতিক ভাষ্যকার

 

 

 

কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ।

এ তো জানা কথা-ই। বিশেষত, ভারতবর্ষের মতো এমন এক অসাম্যপীড়িত দেশে, একই সঙ্গে, কারও সর্বনাশ ও কারও পৌষ মাস ঘটতেই পারে। কিন্ত লেখাটির শুরুতে অতি সরল, অতি সাধারণ, এবং বহুব্যবহারে ক্লিশে এহেন একটি আপ্তবাক্যের উল্লেখ কেন? নিচের দুটি তথ্যে বিষয়টা স্পষ্ট করে দেওয়া যাক।

তথ্য এক। বর্তমান অর্থবর্ষের (২০২২-২৩) প্রথমার্ধের শেষে প্রাপ্ত অর্থনৈতিক ঝোঁক (Trend) অনুযায়ী ২০২২ সালে ভারতীয়দের উৎসব উদযাপন হেতু সামগ্রিক খরচ আনুমানিক ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ডলারকে টাকার রূপান্তর মূল্য দিয়ে গুণ করলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম শ্রেণির মানুষেরা সারা বছর ধরে নানা উৎসবে উদযাপনে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২৬,৪৮,৩২,০০,০০,০০০ টাকা খরচ করলেন, অর্থাৎ এই পরিমাণ মূল্যের বস্তু বা সেবা (Goods and Services) ক্রয় করলেন। (তথ্যসূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২)। তার আগের দুবছর অর্থাৎ ২০২০ ও ২০২১-এর থেকে এইবার খরচের পরিমাণ অনেক বেশি, স্বাভাবিকভাবেই। কারণ অতিমারি আগের বছরদুটির তুলনায় ২০২২-কে ততটা প্রভাবিত করতে পারেনি।

তথ্য দুই। গত মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০২২-এ এসে আমাদের দেশের বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়াল ৮.৩০ শতাংশ (নভেম্বরে এই হার ছিল ৮.০০ শতাংশ), যা বিগত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। হরিয়ানা (৩৭.৪ শতাংশ), রাজস্থান (২৮.৫ শতাংশ) ও দিল্লিতে (২০.৮ শতাংশ) বেকারত্বের হার সর্বাধিক। বেকারত্বের হার যেখানে সবচেয়ে কম, সেই রাজ্যগুলি হল ওডিশা (০.৯ শতাংশ), গুজরাট (২.৫ শতাংশ) এবং কর্নাটক (২.৫ শতাংশ)।

তথ্য এক এবং তথ্য দুইয়ের চূড়ান্ত বৈপরীত্য বলে দিচ্ছে, ভারতবর্ষের পেটের ভিতর একাধিক ভারতবর্ষ আছে, যাদের একের সঙ্গে অপরের দেখা হয় না। একটি ভারতবর্ষ দু-বছর ব্যাপী অতিমারির ক্ষত ভুলে, তেড়েফুঁড়ে উঠে উৎসবে-ব্যসনে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে বটে, কিন্তু বাজারে সেইসব ধনাত্মক কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক যোগফল অর্থনৈতিকভাবে দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশটিকে টেনে তুলতে পারছে না। বরং সারা দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েছে ও বাড়ছে।

এখানেই শেষ নয়। আরও কিছু ডেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করা যাক। বস্তুত, যারা ধৈর্য ধরে লেখাটি পড়ছেন, তাদের কাছে লেখাটি কিঞ্চিৎ তথ্য-ভারাক্রান্ত মনে হতে পারে, কিন্তু দেশে কর্মসংস্থানের হাল-হকিকত বুঝতে সংখ্যাই একমাত্র ও উপযুক্ত সাধন, ভাষার আড়ম্বর এখানে অপ্রয়োজনীয়। অতএব…

গত বছর অর্থাৎ জানুয়ারি ২০২২-এ ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে ও আতসবাজি পুড়িয়ে আমরা যখন যাত্রা শুরু করেছিলাম, তখন দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৬.৫৬ শতাংশ যা ডিসেম্বর ২০২২-এ এসে দাঁড়াল ৮.৩০ শতাংশে। এই অবনমন চোখের পড়ার মতো।

আসুন, এই ৮.৩০ শতাংশ বেকারত্বের হারটিকে আরও দু-ভাগে ভেঙে দেখা যাক। শহর ও গ্রামাঞ্চল এই দুই অংশের বেকারত্বের হার বছরের শেষে অর্থাৎ ডিসেম্বর ২০২২-এ যথাক্রমে ১০.০৯ শতাংশ ও ৭.৪৪ শতাংশ৷ বোঝাই যাচ্ছে, শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার দেশের গড় বেকারত্বের হারের (৮.৩০) চেয়ে অনেকটাই খারাপ এবং যথেষ্ট আশঙ্কাজনক। প্রসঙ্গত, নভেম্বর ২০২২-এ শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার ছিল ৮.৯৬ শতাংশ, আর গ্রামাঞ্চলে তা ছিল ৭.৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ একমাত্র ও অতি ক্ষুদ্র উন্নতি ভারতের গ্রামে, যেখানে বেকারত্ব নভেম্বর ২০২২ (৭.৫৫ শতাংশ) থেকে ডিসেম্বরে ২০২২-এ (৭.৪৪ শতাংশ) অতি সামান্য হলেও কমেছে। যদিও এই উন্নতি আদৌ কোনও সদর্থক ইঙ্গিত কিনা তা পরিসংখ্যানকে সময়ের আরেকটু লম্বা পাল্লায় না ফেলে দেখলে বোঝা যাবে না। তার জন্য আমাদের আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে।

কিন্তু দেশীয় অর্থনীতির অবস্থা যে মোটের ওপর সঙ্কটজনক সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷ গত এক বছরে বেকারত্ব পরিস্থিতির কতখানি অবনতি ঘটেছে তা বোঝা যাচ্ছে এ থেকে— বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি ২০২২-এ শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার ছিল ৮.১৪ শতাংশ ও গ্রামাঞ্চলে ছিল ৫.৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ শহর ও গ্রাম দুই ক্ষেত্রেই অবনমনের রেখাচিত্রটি বেশ চড়াই।

অতিমারির আগে, অতিমারিকালে ও তারপরে দেশে বেকারত্বের হার কীভাবে বদলেছে তা নিচের টেবিল থেকে দেখে নেওয়া যেতে পারে।

সময় দেশে বেকারত্বের হার
ডিসেম্বর, ২০১৯ ৭.৭০%
ডিসেম্বর, ২০২০ ৯.১০%
ডিসেম্বর, ২০২১ ৭.৯০%
ডিসেম্বর, ২০২২ ৮.৩০%

 

ছক থেকে স্পষ্ট যে বেকারত্বের হারের এই ঊর্ধ্বগামিতা শুধুমাত্র অতিমারির দান নয়, কারণ ২০২০-তে অবিমৃষ্যকারী লকডাউনের ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে ২০২১-এ বেকারত্বের হারে উন্নতি ঘটেছিল, কিন্তু অন্য কোনও কারণে ২০২২-এর শেষে পৌঁছে আমরা আরও গভীরে তলিয়ে গেলাম! কী এর কারণ আর পরিত্রাণের পথই বা কী, তা অর্থশাস্ত্রীদের বিচার্য।

উপরের সমস্ত তথ্য একটি স্বশাসিত সংস্থা Centre for Monitoring Indian Economy Pvt Ltd (CMIE)-এর সূত্রে প্রাপ্ত। সংস্থার অধ্যক্ষ মহেশ ব্যাস সংবাদসংস্থা রয়টার্সকে জানালেন, এর মধ্যেও আশাব্যঞ্জক কিছু যে নেই, এমন নয়। উপমহাদেশের বেকারত্বের হার ডিসেম্বর ২০২২-এ ৩৭.১ শতাংশ। আমাদের দেশের পরিসংখ্যান (৮.৩০%) সেই তুলনায় বেশ ভাল (যদিও তা কোনওভাবেই আত্মতুষ্টির কারণ হতে পারে না)। আর শ্রম সংযুক্তি হার-ও (Labour Participation rate) ডিসেম্বর ২০২২-এ ৪০.৪৮ শতাংশ— সাম্প্রতিককালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অন্ধকারের মধ্যে রুপোলি রেখার আভাস এই মুহূর্তে এটুকুই।

যাঁদের হাতে আমাদের দেশের শাসনভার, উপরের তথ্যগুলো তাঁদের কতটা সচেতন করে ও তাঁরা কী পদক্ষেপ নেন, আপাতত সেটাই দেখার। তবে দেশের মানুষের হাতে উপযুক্ত কাজের অভাব-ই যে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা, অন্য কিছু নয়, সবার আগে এটা স্বীকার করে নেওয়া দরকার। অবশ্য যাঁরা ভাবেন যে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির হাতে দেশের বাজারকে তুলে দেওয়াই অর্থনৈতিক মোক্ষলাভের একমাত্র উপায়, তাঁদের হৃদয় বা দৃষ্টিপরিবর্তনের আশা করা বাতুলতা। অতএব বেকারত্ব হ্রাসে বড়সড় কার্যকরী পদক্ষেপ বা আর্থিক দিশায় বাঁক বদলের কোনও সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. খুবই প্রাসঙ্গিক একটি লেখা।সবার জানা দরকার। হীরক সেনগুপ্ত

আপনার মতামত...