আশীষ লাহিড়ী
বিজ্ঞানের দর্শন ও ইতিহাসের গবেষক, প্রবন্ধকার, অনুবাদক
পুরো-ঔপনিবেশিক ভারতের তুলনায় আধা (নাকি সিকি?)-ঔপনিবেশিক চিনে বিজ্ঞান-আত্মীকরণ ঘটেছিল অনেক ধীরগতিতে। মধ্য-উনিশ শতকে চিনে আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে অল্পবিস্তর শৌখিন আলোচনা হলেও কার্যত ১৯১০-এর আগে নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে চিনের শিক্ষিত সমাজের সম্যক পরিচয় হয়নি। পুরনো আলকেমির জোরালো প্রভাবে আধুনিক রসায়নেরও কোনও ছাপ প্রথমদিকে চিনের ওপর পড়েনি। একই কথা আধুনিক গণিতচর্চা প্রসঙ্গেও। ১৯০৫ সালের আগে সেখানে স্থান করে নিতে পারেনি আধুনিক গণিত। ১৯১৫-র আগে প্রাণ-রসায়ন চর্চা শুরু হয়নি। অথচ ভারতে রাধানাথ শিকদার ১৮৩০-এর দশকেই নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষা করেছিলেন, গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিকাল সার্ভের কাজে যোগ দিয়েছিলেন, এমনকি জার্মানি থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছিলেন ১৮৬৪ সালে। ১৮৩০-এর দশকেই মধুসূদন গুপ্ত আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাবিজ্ঞান রপ্ত করেছিলেন। ১৮৭৬-এ স্থাপিত হয়েছিল ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের কাল্টিভেশন অব সায়েন্স। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ১৮৮০-র দশকে আধুনিক গণিতচর্চায় কৃতী হয়েছিলেন। জগদীশচন্দ্র-প্রফুল্লচন্দ্রর কথা বলাই বাহুল্য। চিন যখন সবে নিউটনীয় বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, বাঙ্গালোরে তখন তোড়জোড় চলছে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠার। ফারাকটা অনেকখানি।
আরও একটা পার্থক্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনেকগুলি ইউরোপীয় শক্তির ভাগের পুতুল হয়ে উঠলেও, আধা-ঔপনিবেশিক চিনের বিজ্ঞানচর্চা কখনওই কোনও ইউরোপীয় ভাষার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল না। প্রায় সমস্তটাই হয়েছিল মাতৃভাষায়, ইংরেজি থেকে, জাপানি থেকে অনুবাদের মাধ্যমে। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতীয়রা যেমন চটপট ইংরেজি-পটু হয়ে অনুবাদের বিশেষ তোয়াক্কা না করে সরাসরি ইংরেজিতেই জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, বহু-ভর্তৃক চিনে সেটা একেবারেই ঘটেনি। আত্মীকরণে দেরির একটা কারণ হয়তো সেটাই। তবে মাতৃভাষায় চর্চার ফলেই হয়তো বিজ্ঞানচেতনা চৈনিক শিক্ষিত সমাজের কিছুটা গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিল, ক্রমে নব্য চৈনিক শিক্ষিত সমাজের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছিল, যেটা ভারতে ঘটেনি। ১৯২০-র দশকে চিনে গড়ে উঠেছিল ‘আইনস্টাইন ফ্যান ক্লাব’। সত্যেন্দ্রনাথ-মেঘনাদ-প্রশান্তচন্দ্র আইনস্টাইনের পেপার জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দুনিয়াকে চমৎকৃত করেছিলেন, কিন্তু ভারতে আইনস্টাইন ফ্যান ক্লাব গড়ে ওঠেনি। ঔপনিবেশিক দেশগুলির মধ্যে ভারতই সবচেয়ে দ্রুত আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় এগিয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু প্রধানত ধর্মীয় কারণে তা ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠতে পারেনি। ভারতে বিজ্ঞান ছিল সাহেবি সুটের মতো— বহুমূল্য, কিন্তু আটপৌরে ব্যবহারের জন্য নয়। বাড়িতে আমরা ফতুয়া-লুঙ্গিই পরে রইলাম। চিনের শিক্ষিত সমাজে ঠিক উলটোটা ঘটেছিল। লু স্যুন তার সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ।
বিপ্লবের পর
১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির অধীনে ছিল পনেরোটি গবেষণা সংস্থা আর তিনটি প্রস্তুতি-কার্যালয়। ১৯৫৫-র শেষে গবেষণা সংস্থার সংখ্যাটা বেড়ে হয় ৪৭; ১৯৬০-এ ২৪১। দশ বছরে প্রায় ষোলো গুণ! এই বিপুল প্রসারণকে সামাল দেওয়ার মতো বিজ্ঞানশিক্ষিত জনসম্পদ চিনের ছিল না। সোভিয়েতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণ এই সমস্যার মোকাবিলায় খুবই সহায়ক হয়েছিল। ১৯৫০-এর দশকে চিনের বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির সঙ্গে সোভিয়েত বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। চিন থেকে বহু বিজ্ঞানী সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রশিক্ষণ এবং উচ্চশিক্ষার জন্য যান; সোভিয়েত থেকে বহু বিজ্ঞানী চিনে এসে বিভিন্নভাবে গবেষণায় ও পরিকল্পনায় সাহায্য করেন।[1] ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত রাষ্ট্র দরাজভাবে চিনের বিজ্ঞানচর্চার পাশে দাঁড়িয়েছিল। পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর জন্য সোভিয়েত রাশিয়া থেকে সাইক্লোট্রন, রিঅ্যাক্টর প্রভৃতি এল। পরমাণু পদার্থবিদ্যা, সলিড স্টেট পদার্থবিদ্যা, ফ্লুইড ডাইনামিক্স, চুম্বকক্রিয়া, আলোকবিদ্যা, ধ্বনিবিদ্যা, ইলেকট্রনিকস প্রভৃতি ক্ষেত্রে জোরকদমে কাজ শুরু হল। মূলত সোভিয়েত ধাঁচেই এগোতে থাকে চিনের সংগঠিত বিজ্ঞান।
একই সঙ্গে সোভিয়েতের ভ্রান্তিগুলিরও শিকার হল চিন। যেমন জিনতত্ত্বর বদলে লাইসেঙ্কোর ভ্রান্ত তত্ত্বকে গুরুত্বদান। সুখের কথা, খুব অল্পকালের মধ্যেই চিন ওই ভ্রান্ত পথ ছেড়ে জিনতত্ত্বর মূলস্রোতে ফেরে। ওই সময় থেকেই চিন-সোভিয়েত মতাদর্শগত ফারাক প্রচণ্ড বাড়তে থাকে। ১৯৬১ সালের পর প্রায় রাতারাতি সোভিয়েত রাশিয়া তার সমস্ত সহায়তা তুলে নিল। বাধ্য হয়েই চিনকে ‘আত্মনির্ভরতার নীতি’ অনুসরণ করতে হল। তাতে ফল ভালই হল। পরমাণু বিজ্ঞান, পারমাণবিক বোমা বানানোর মশলানির্মাণ, হাইড্রোডিনামিক্স, জেট প্রোপালশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে চিনের কাজ এগিয়ে চলল। কিন্তু তারপরই মধ্য-ষাট থেকে শুরু হল অতি-বিতর্কিত মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব। চিনের ইতিহাস অপ্রত্যাশিত এক বাঁক নিল।
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দরকার হয়েছিল কেন
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দরকার হয়েছিল কেন তা বুঝতে গেলে একটু পিছনে যেতে হবে। ঢের বেশি অস্ত্রশস্ত্র হাতে থাকা সত্ত্বেও উদারপন্থী জাতীয়তাবাদী সান ইয়াৎ সেন–এর অযোগ্য উত্তরাধিকারী চিয়াং কাই-শেক কমিউনিস্টদের কাছে হেরে গিয়েছিলেন দুটো প্রধান কারণে। এক, আগ্রাসী জাপানের প্রতি নরম মনোভাব নেওয়া। তিনি ভেবেছিলেন আমেরিকানরা নিজের গরজেই জাপানকে হারাবে, আর তিনি নিজে আমেরিকারই সাহায্য নিয়ে দেশের মধ্যে কমিউনিস্ট নিধন-যজ্ঞ চালাবেন। বাস্তবে এ অঙ্ক মেলেনি। দ্বিতীয় কারণটা ছিল দুর্নীতি— নির্লজ্জ, অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় দুর্নীতি, যার বোঝা বইত চিনের হতদরিদ্র মানুষ। কুয়োমিন্টাঙের এই দুর্নীতি চিনের কমিউনিস্ট পার্টির বিজয়ের পথ অনেকটা সুগম করে দিয়েছিল। জনগণের যন্ত্রণার প্রতি উদাসীন কুয়োমিন্টাং পার্টির সর্বময় দুর্নীতির বিপরীতে কমিউনিস্টদের অচঞ্চল মরণপণ আদর্শবাদ চিনের মানুষের কাছে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারই ওপর ভর করে তারা মাওয়ের নেতৃত্বে ক্ষমতায় এল।
একটা বিপ্লবী সংগঠন এবার পরিণত হল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে। বিপ্লবী আদর্শবাদীরা যেমন পার্টিতে রইল, তেমনই এল আখের-গোছানো সুযোগসন্ধানীরা। নতুন সমাজ তাদের সামনে অনেক সুযোগসুবিধার দুয়ার খুলে দিল। ১৯৫১ সালের নভেম্বরেই মাও পার্টিকে চেতাবনি দিলেন:
দুর্নীতি আর অপচয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একটা প্রধান বিষয়, যার সঙ্গে গোটা পার্টিই সংশ্লিষ্ট। এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবার জন্য আমরা আপনাদের আগেই বলেছি। গোটা পার্টিটাকেই ভালভাবে ঝাড়াই-বাছাই করতে হবে, যার ফলে দুর্নীতির বড়, মাঝারি, ছোট যাবতীয় ঘটনাই উদ্ঘাটিত হবে। লক্ষ্য হবে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্তদের ওপর প্রধান আঘাত হানা, আর মাঝারি ও ছোটখাট তছরুপকারীদের ক্ষেত্রে শিক্ষাদান ও নবরূপদানের নীতি অনুসরণ করা, যাতে করে তারা আর যেন সে-কাজ না করে।[2]
কিন্তু ফল বিশেষ হল কি? ১৯৫৭ সালেই মাওকে বলতে হল, “কিছু ক্যাডার এখন নাম আর সম্পদের পিছনে হামলে পড়েছে, একমাত্র ব্যক্তিগত লাভ ছাড়া আর কোনও কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই।”[3] তাঁর এই অভিযোগ ক্রমে তীব্রতর হতে থাকে। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি তাঁর অনুমোদনে চালিত মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল পার্টি আর সরকারের মধ্যে থেকে এই ক্ষমতা ও অর্থ-লোলুপতা দূর করা, পার্টিকে পুরনো জনমুখী আদর্শবাদে ফেরানো। অমর হয়ে আছে তাঁর স্লোগান: সদর দপ্তরে কামান দাগো!
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলেন মাও। এখনও বিতর্ক চলে, ওই পদ্ধতিতে ওই লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব ছিল কিনা। কেননা এর ফলে শুধু সমাজে নয়, চিন্তাজগতে দেখা দিল অবাঞ্ছিত বিশৃঙ্খলা। সম্পূর্ণ অকারণে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের, লাইনাস পলিঙের কেমিক্যাল রেজোন্যান্স তত্ত্বের[4] বিরোধিতা করলেন চেন বো-দা প্রমুখ সাংস্কৃতিক বিপ্লবী, যাঁরা জানতেন-ই না তত্ত্বগুলো কী। বেশ কিছু নামকরা রসায়নবিদকে হেনস্থা করা হল। এ যেন সোভিয়েত বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই উগ্র রুশ বিপ্লবীদের খাঁটি “সর্বহারা” সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার হঠকারী প্রয়াসেরই পুনরাবৃত্তি, যার বিরোধিতা করেছিলেন লেনিন। চিনেও ১৯৭০ সালেই এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তবু সব মিলিয়ে এক ধরনের বহির্বিচ্ছিন্নতা পেয়ে বসল চিনকে, যা বিজ্ঞানের পক্ষে সর্বনাশা।
কিন্তু তাই বলে সবকিছুই একেবারে থেমে গেল, তা কিন্তু নয়। ওই পর্বেই নানা ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সাফল্যও অর্জন করেছিলেন চিনের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা। তার মধ্যে সবচেয়ে আদৃত হল, ইনসুলিনের কেলাস-কাঠামো নির্ণয়। এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন পদ্ধতিতে পৃথিবীতে প্রথম শূকর-ইনসুলিনের কৃত্রিম সংশ্লেষণ করেন শাংহাইয়ের প্রাণরসায়নবিদরা। দুনিয়া-কাঁপানো এই কাজটি ১৯৬৫ সালেই সম্পন্ন হলেও, মূল পেপারটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি। ঘোষণা করা হয়: এই আবিষ্কার ‘প্রাণের রহস্য উদ্ঘাটনের কাজে মানুষের বিপুল প্রয়াসের’ নিদর্শন। ‘প্রাণের উদ্ভব বিষয়ক বস্তুবাদী-দ্বান্দ্বিক তত্ত্বের সপক্ষে জোরালো নতুন সাক্ষ্য’ হাজির করেছে এই আবিষ্কার। এই কৃত্রিম ইনসুলিনকে যথার্থভাবেই পৃথিবীর “প্রথম কেলাসীভূত প্রোটিন” বলে চিহ্ণিত করে বলা হয় যে এটিই হল ‘এ যাবত সংশ্লেষিত বৃহত্তম প্রাকৃতিক জৈব যৌগ যা জীববৈজ্ঞানিক অর্থে ক্রিয়াশীল’। ইনসুলিন-কাঠামো বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডরোথি হজকিন স্বয়ং একাজের পূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন।[5] এছাড়া প্রাণ-রসায়নের ক্ষেত্রে ‘এনএডিপি’ সহ-উৎসেচক সংশ্লেষণের জন্য ওয়াং দেবাও (১৯১৮-২০০২) এবং গণিত ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে ‘চিনের রামানুজন’ নামে খ্যাত হুয়া লুওগেং (১৯১০-১৯৮৫)-এর কাজ সারা বিশ্বে সমাদৃত।
সমর-কেন্দ্রিক গবেষণার কাজেও খুব ব্যাঘাত ঘটেনি। নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞান, ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণার কাজ এগিয়ে চলে। ১৯৬৪ সালে পরমাণু বোমা, ১৯৬৭ সালে হাইড্রোজেন বোমা, ১৯৬৮ সালে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট তৈরি, ১৯৭০-এ কক্ষ-প্রদক্ষিণকারী উপগ্রহ ক্ষেপণ তারই নিদর্শন। ১৯৭১ সালে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য মহাকাশে একটি উপগ্রহ ক্ষেপণ করে চিন। ১৯৭০ সালে সাংহাই ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড অপটিক্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট নতুন এক ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ নির্মাণ করে, যা একটি বস্তুকে চার লক্ষ গুণ বড় করে দেখাতে সক্ষম। এ ধরনের কাজ সফলভাবে করতে গেলে দরকার বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম অবকাঠামো, আর সে-অবকাঠামো বজায় রাখতে গেলে দরকার সুনিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক তত্ত্বাবধান। স্পষ্টতই সেই অবকাঠামো এবং সেই তত্ত্বাবধান ভেঙে পড়েনি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডামাডোলে।[6]
কিন্তু একথাও ঠিক যে ক্রমে এই আন্দোলন বিপথগামী হতে থাকে। মাওয়ের বিশেষ গুণগ্রাহী এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জোরালো সমর্থক জোসেফ নিডহ্যাম ১৯৭৮-এর এপ্রিলে চিন দেখে এসে নেচার পত্রিকায় লেখেন, যে-ঘোঁট এখন এ আন্দোলন চালাচ্ছে তারা ‘মূলগতভাবে মননশীলতা-বিরোধী, এবং বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদদের প্রতি বিশেষ শত্রুভাবাপন্ন’।[7] তার দরুন বিজ্ঞান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
সুতরাং সব মিলিয়ে বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন এটাই যে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবে চিনের বিজ্ঞান-প্রযুক্তিচর্চার ক্ষতি হলেও, সেটাই এর একমাত্র দিক ছিল না। ওই অবস্থার মধ্যেও মাও-এর নীতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ফসল ফলিয়েছিল। বস্তুত তারই দৌলতে পরের দশকগুলিতে প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে চিনের বিপুল অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মাও যে-প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও সে-প্রশ্ন খাটে: কার জন্য? মাও-উত্তর চিনের বিজ্ঞান-প্রযুক্তিক্ষেত্রে উন্নয়ন অর্জিত হয়েছে অবিশ্বাস্য, ব্যাপক সংগঠিত দুর্নীতির মূল্যে, বিপ্লব-পূর্ব কালের মতোই তার চাপটা গিয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। চিন-বিশেষজ্ঞ মিনশিন পেই-এর হিসেবমতো মাও-উত্তর চিনে ঘুষ, কাটমানি, চুরি আর সরকারি তহবিলের অপচয়ের মোট অর্থমূল্য চিনের জিডিপির অন্তত তিন শতাংশ।[8] এই মূল্যে অর্জিত বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের মুনাফা-মূল্য অবশই অনেক; কিন্তু মানব-মূল্য?
[1] Jiuchen Zhang , Feklova T.Yu, Soviet scientists in Chinese institutes: A historical study of cooperation between the two academies of sciences in 1950s, Endeavour, Volume 42, Issue 1, March 2018.
[2] Tse-Tung, Mao. On The Struggle Against The “Three Evils” And The “Five Evils”. Nov 1951-Mar 1952.
[3] Meisner, Maurice. Growth of Capitalism Meant Growth of Corruption for Chinese. Los Angeles Times. July 7, 1991.
[4] কিছু কিছু অণুতে কিংবা বহু-পরমাণু সমন্বিত আয়নে অনেকগুলি কাঠামোর সমাহারে কীভাবে রাসায়নিক বন্ধন (বন্ডিং) গড়ে ওঠে তার ব্যাখ্যা।
[5] দ্রষ্টব্য হজকিন, ডরোথি। বিজ্ঞানীর বিশ্ববিচরণ। অনুবাদ: লাহিড়ী, আশীষ। অবভাস।
[6] Brock, Darryl E. ‘Science Innovation during the Cultural Revolution: Notes from the Peking Review’. Southeast Review of Asian Studies. Volume 31 (2009), pp. 226–32. Accessed on Dec 3, 2022.
[7] Needham, Joseph. 1978. Science reborn in China: Rise and fall of the anti-intellectual gang. Nature 274 (August 31): 832–34.
[8] Pei, Minxin. Corruption Threatens China’s Future. Archived 2010-04-10 at the Wayback Machine, Carnegie Endowment for International Peace, Policy Brief No. 55. October 2007. Accessed on Nov 26, 2022.
খুব তথ্যসমৃদ্ধ, ভাবার মতো প্রাঞ্জল প্রবন্ধ।