শৈলেন সরকার
আচ্ছা বাঁচা আর মরার মধ্যে তফাতটা কী বলতে পারেন? কিচ্ছু না। একেবারে কিছুই না। এটা আমাকে শিখিয়েছিল প্রদীপ। শিখিয়েছিল বলব না, বলব দেখিয়েছিল। তাহলে দেখিয়েছিলই বলি। এক হিসেবে ও-ই কিন্তু গুরু আমার। না, ও যে আমার গুরু তা প্রদীপ আর জানবে কী ভাবে? সেই বোধবুদ্ধি ছিল কোথায়। মানে ওর এক শিক্ষায় যে চোখ খুলে গিয়েছিল আমার তা জানার ক্ষমতাই ছিল না ওর।
ফিরছি রাঁচি থেকে। রাতের ট্রেন। ট্রেন ছেড়েছে ওই রাত সাড়ে নটা-দশটাতেই। ঘুম পাচ্ছে না কিছুতেই। প্রদীপ গাঁজার কথা তুলল। বলল, দুটো টান না দিতে পারলে—। না, কল্কে-ফল্কে নয়, সিগারেটে নিশ্চিত তৈরি করে নিয়েছে। বললাম, সিগারেটই খাওয়ার সুযোগ নেই, তো গাঁজা। প্রদীপ বলল, এই ট্রেনে নাকি চেকার আসেই না কখনও টিকিট দেখতে। বললাম, পুলিশ? প্রদীপের কথায়, গাঁজায় মাস্টার ওরা, আর ওই যে একবার মুখ দেখিয়ে গেছে দু-তিনজন মিলে, আর আসবে না। এ লাইনের সব কিছুই জানা ওর। রাত তখন অনেক, বারোটা-টারোটা হবে। গরমকালই, জানালা-টানালা প্রায় খোলা, মানে হাওয়া ছিল খুব। প্রদীপ বলল, বাথরুমের দিকে গেলে সুযোগ পাব ঠিক। সেখানে দেখি ট্রেনের দরজা একেবারে হাঁ-করা খোলা। দু-দুটো লোক দুদিকের খোলা দরজার কাছে শুয়ে আরামের ঘুম দিচ্ছে। প্রদীপ শুরুতেই লাথি মারল একটাকে। লোকটা যেন বুঝলই না কিছু। বাঁ-হাতটা দিয়ে যেন শরীরের ওপর বসে থাকা একটা মাছিকে সরাতে চাইল। প্রদীপ বলল, দরজার একেবারে গায়ে না বসলে কোচের ভেতর ধোঁয়া ঢুকবে, আর শালা গন্ধে গন্ধে—। কথা শেষ না করেই লোকটাকে পা দিয়ে ঠেলে একেবারে দরজার গায়ে নিয়ে গিয়ে সটান এক লাথি—। না, কোথাও কোনও আর্তনাদ ছিল না, এমনকি একস্ট্রা কোনও শব্দও নয়। বা হয়তো উঠে থাকবে কোনও কিন্তু ট্রেনের সেই ঘরঘর-ঘটঘটাং শব্দের আড়ালে তা আলাদা করে জেগেই উঠতে পারল না। বললাম, এ তুই কী করলি? কী করল বলুন তো, হাতের তালুতে আটকে রাখা গাঁজা পুরে-রাখা সিগারেটটা একবার-দুবারের চেষ্টায় ধরিয়ে ফেলল। আর দুটো টান দিয়ে বাড়িয়ে দিল আমার জন্য। ভাবুন একবার, যে শালা জীবনে একটা চড় মারেনি কাউকে সে কেমন নির্বিকারে একটা লোককে—। আমি যে আমি, আমার তখন না হলেও দুটো কেস সারা। আমার সেই দুটো কেস নিয়েই কত না টেনশান। মাঝেমধ্যে মনের মধ্যে কত দোটানা। আর এত দোটানা নিয়ে হয় কোনও কাজ? আর প্রদীপের ব্যাপারটা ভাবুন, একেবারে ক্লিয়ার কেস। পরিষ্কার মার্ডার। কোনও সাক্ষী নেই, মোটিভ নেই, আর সেই বডিই বা কোথায় পড়ে থাকবে, কবে কে তার খোঁজ করবে কে জানে? এই একটি ঘটনাই চোখ খুলে দিল আমার। মৃত্যু তার মানে নিতান্তই ফালতু একটা ব্যাপার। হ্যাঁ, বেঁচে থাকাটাও।
আর এই কথাটাই আমি রত্নাকে বুঝিয়ে উঠতে পারি না। মানে প্রদীপের বোনকে। আরে বাবা আমার বাঁচা নিয়ে তোর দুশ্চিন্তার কী আছে এত? রাতদিন কেন এত ঘ্যানর-ঘ্যানর? ঘরে ফিরতে একটু দেরি হতে না হতেই ফোন। কতদিন বলেছি, বাড়াবাড়ি করবি না। এত ভালবাসাবাসি সহ্য হয় না আমার। কম মার খায় আমার হাতে? কিল-লাথি-চড়। অথচ দেখুন, কাঁদবে না কিছুতেই। আরে বাবা চিৎকার করে কাঁদ, গালি দে আমাকে, হাতের কাছে যা পাবি—। ঘেন্না করতে পারিস না আমাকে? বলি, হারামি মাগি, তুই কিন্তু চিনিস না আমাকে, এক কোপে—। ওই মেয়ে তবু দেখুন কেমন ড্যাবড্যাবে চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে।
এতগুলি দিন একই বস্তির একই লাইনে বলতে গেলে পাশাপাশি ঘরে কাটিয়েও রত্না কিছুতেই চিনতে পারল না আমাকে। ও নাকি আমাকে না পেলে বাঁচবেই না। সুইসাইড করবে। কে বলছে কথাগুলি? না, ওর মা। কিন্তু ওর মা-ই বা জানল কীভাবে এত কথা? সে মেয়েছেলে তো কোনকালে ওর স্বামী মানে প্রদীপ আর রত্নার বাবকে ছেড়ে কোন কলমিস্ত্রির সঙ্গে—। সেদিন শেষবারের মতো প্রদীপের বডি দেখতে এল যখন, দেখি, কোথায় কলমিস্ত্রি, কোথায় কী, বেশ সাজগোজ করা ফিটফাট যেন কোনও ফ্ল্যাটবাড়ির মালিক। আর ওর মায়েরও দেখি বয়সটা আরও কমেই গেছে যেন। মানে, রত্নাকে তখন লাগছিল ছোটবোনের মতোই। যেন রত্নার মা নয়, চার-পাঁচ বছরের বড় দিদি। সেই মেয়েছেলে দেখি ডাকল আমাকে। বডি তখনও সরানো হয়নি খালপাড় থেকে। কালভার্টের নিচে সেই থামের গায়েই প্রদীপ তখনও কাত হয়ে শুয়ে। প্রদীপদের পাশের ঘরের বুবাই বলল, ডাকছে আপনাকে। সেই মেয়েছেলে বলল, তোর তো দেখি খুব নাম চারদিকে, অটোটা কে করিয়ে দিল। মা কোথায় তোর?
ভাবুন একবার সামনে যার জোয়ান ছেলেটা কানের গোড়ায় গুলি খেয়ে শুয়ে, তার মুখে—। ও হয়ে গেল— বলে উঠে যাচ্ছি খালের ঢাল বেয়ে, উনি যেন ছাড়বেনই না আমাকে, বললেন, কাল থাকবি তো, দরকারি কথা আছে তোর সঙ্গে।
বললাম, থাকতে তো হবেই, পোস্টমর্টেম হতে হতে বিকেল এরপর বডি আনা, শ্মশান—।
—ঠিক আছে, তখনই বলে নেব এক ফাঁকে। মানে আমার মেয়েকে নিয়েই। ফের কবে আসতে পারব কে জানে, আমার মেয়ে তো তোর জন্য—।
প্রদীপের বোন মানে আমার এই এখনকার বউ রত্না তখন দেখি দূর থেকে তাকিয়ে দেখছে আমাকে। না, সেদিনও কিন্তু, যদ্দূর মনে পড়ছে, কাঁদতে দেখিনি ওকে। রত্নার অবশ্য নামডাক খুব তখন। মানে আমাদের বস্তিতে। কোন এক হিরোইনের মতো নাকি দেখতে। কোন হিরোইন কে জানে?
আমার প্রথম কেসটা ছিল কিন্তু খুব সোজা। হাপিস করতে হবে একটা ফালতু লোককে। শালা তুষারদার অ্যান্টি-পার্টির হয়ে হুজ্জুতি করছে খুব। তুষারদা কিন্তু লোক চেনে। কী করে আমাকে চিনল লোকটা? কী করে বুঝল যে আমিই একমাত্র করতে পারব কাজটা, আমিই একেবারে নিঃশব্দে একটা গোটা লোককে কাউকে কিছু টের না পেতে দিয়ে—। পাক্কা একটা সপ্তা ফলো করলাম লোকটাকে। নাম জানলাম, ঘর চিনলাম। চায়ের গুমটি চালায় একটা। ঘরে দু-দুটো বাচ্চা, বউ। লোকটাকে দেখে শুরুতে মায়া হচ্ছিল খুব। দুটো দিন বসলামও ওর দোকানে। চা খেলাম। চা-সিগারেট। চৌরাস্তার ক্রসিং-এর ফুটপাথেই। যা বুঝলাম, একটু তেরিয়া গোছের মানুষ, ওই নিজে যা বুঝবে—। দোকান গুছিয়ে ফিরবে সেই রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ। ষষ্ঠীর গুমটি থেকে পাউচ নেবে দুটো। অক্ষয় তেলি লেনের সেই কালীমন্দিরের পাশে রেলিং-এর ধারে বসে সাঁটবে পাউচদুটো, এবার—। না, লোক কোথায়, আর বেশ কটা রাধাচূড়া-কৃষ্ণচূড়া গাছের জন্যই অন্ধকার খুব। এমনকি আমি যে ওর পেছন পেছন হাঁটছি তার ছায়াও নেই কোথাও। ওই পেছন থেকে একেবারে গলায় ঠেকিয়েই—। আমি যে এত ভাল মানে এত নিখুঁত— তা আমারই কিন্তু জানা ছিল না আগে। ওই যে বললাম, রাজনীতি করতে গেলে লোক চেনার গুণ লাগে। তুষারদার কথাই বলছি। এমনি এমনি কি একটা লোক এত ওপরে ওঠে?
হ্যাঁ, চায়ের গুমটির লোকটাকে নিয়ে আমার কিন্তু দোটানা ছিল। দোটানা রেখেও কাজটা ঠিক করে করতে পারায় লাভ হল খুব। টাকা তো পাওয়ার কথা ছিলই, সঙ্গে একটা পুরনো অটো। অটো, অটোর লাইন। তার মানে একটা হিল্লে হয়ে গেল আমার। ওই মার্ডার নিয়ে একটা আওয়াজ উঠল না কোথাও! তুষারদা বলল, তুই যে এত গুণী ছেলে তোকে দেখে কে বলবে। বলল, ফালতু ঝামেলায় জড়াবি না। ঠিকমতো কাজ করতে পারলে এই বস্তির ঘরে থাকতে হবে না আর তোকে।
কিন্তু রত্নাকে নিয়ে কী করি বলুন তো? কী করে বোঝাই সত্যি কথাটা। সত্যি কথাটা মানে আমার সত্যটা। আমার নেশার সত্যিটা। হ্যাঁ, চপার দিয়ে যখন একটা লোকের পেট ফাঁক করে দিচ্ছ, আর লোকটা যখন বেরিয়ে পড়তে থাকা নাড়িভুড়ি দুহাতে সাপটে—। লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে খুব ভাল লাগে আমার। কী দারুণ চেষ্টা ভাবুন লোকটার। দুহাতে ও তখন জাপটে ধরতে চাইছে কি ওর নাড়িভুড়িকেই, না কি অন্য কিছুকে? হ্যাঁ, অন্য কিছুকেই। ও তখন জাপটে ধরতে চাইছে ওর গোটা জীবনটাকেই। ও তখন দেখছে না কাউকেই। ওর চিৎকার শুনে ভাবতে পারেন ও বুঝি হেল্প চাইছে আপনার, একেবারেই না, ওই চিৎকার আসলে ওর নিজেকে জানার। ও তখন ওর নিজের গলার আওয়াজ শুনে নিশ্চিন্ত হচ্ছে, ভাবছে আমি তাহলে… আমি তাহলে এই এখনও বেঁচে, আমি তাহলে এই এখনও চিৎকার করতে পারছি, আমি তাহলে বেঁচে আছি, বেঁচে আছি এখনও। ওর চোখে তখন ওর চারপাশের পথঘাট, লোকজন বা বাবা-মা বা বউ-ছেলে কেউই নেই। আছে শুধু ওর নিজের জীবন। আর এই জীবনটাকেই জাপটে ধরে রাখতে চাইছে লোকটা। সত্যি বলতে কী, চপারের পোঁচে পেট খোলা একেবারে হাঁ-হয়ে বেরিয়ে আসছে পেটের সবকিছু, এমন একটা লোকের মৃত্যুকে দেখার মজা কিন্তু কানের গোড়ায় রিভলবার টেপার বেলা নেই। ছোট্ট একটা শব্দ, ব্যস, কিছু বোঝার আগেই এলিয়ে পড়ছে একটা লোক। মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও সে কিন্তু বলতে গেলে টেরই পেল না কিছু। চপার দিয়ে পেট খোলার মধ্যে কত হাঁকপাক দেখুন, কত চেষ্টা, কত চিৎকার, কত রক্ত। আপনি বাইরের লোক হয়েও কত অনায়াসে বুঝতে পারেন মৃত্যুটাকে। বা শরীরটা নিজের হলে তখন বুঝতে পারছেন, শেষ হয়ে আসছে, একেবারে শেষ সীমানায় পৌঁছে যাচ্ছে আপনার জীবন, কিন্তু কানের পাশে ধরে ট্রিগার চাপা করে কী বুঝবেন আপনি? মানে শরীরটা নিজের হলেও। আর নিজের শরীর না হলে কীই বা দেখবেন আপনি? নাহ্, একটা লোকের একদলা কাদার মতো করে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া কিচ্ছু দেখার মতো নেই। তার চেয়ে বরং গলায় দড়ি দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে দিতে পারলে, যাকে ঝোলাচ্ছ সে তবু কিছু বোঝার চেষ্টা করে। অন্তত মিনিট দু-তিন তো বটেই। হয়তো হাত তুলে গলার দড়িটাকে ধরার চেষ্টা থাকে, দম যখন আটকে আসছে ওই চেষ্টাটা থাকবেই। বা চোখ ঠেলে বের করে যেন দেখতে চাইবে বাড়তি কিছু, বা—। মোটকথা জীবনটাকে জাপটে ধরার চেষ্টা করতেই পারে। আমার দেখামতে আমি নিশ্চিত, করেও। একটা কথা কী বলুন তো একটা মানুষ সত্যি অর্থে ঠিক কীভাবে যে শেষ মুহূর্তটাকে বুঝতে চায়, তা হয়তো একমাত্র সে-ই জানে। আমি-আপনি বড়জোর অনুমান করতে পারি। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার পর ওই পা দুটোর ঝটপটানোর চেষ্টা দেখে বড়জোর বোঝার চেষ্টা করি কিছু।
প্রদীপের বেলা আমি যেন সেটাই জানতে চাইছিলাম। একেবারে শেষ মুহূর্তে কী চায় একটা মানুষ? যখন সে বোঝে আর একটা-দুটো মুহূর্তই মাত্র। হ্যাঁ, কানচাপা করে দানা মারলে সময় আর পাওয়া যাবে কতটুকু। কিন্তু তবু। ভাবলাম খুব কাছে থেকে একটু খেয়াল করলে কি সত্যিই বোঝা যাবে না? না, চপার দিয়ে পেট ফাঁকা করে ওই ছুটোছুটি বা দাপাদাপির দৃশ্য তৈরিতে ইচ্ছে ছিল না একটুকুও। তাছাড়া আগে থেকে তো প্ল্যান ছিলও না কিছু। ব্যাটা খালের ঢাল বেয়ে যখন নামছে, একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে যখন মালের বোতলটা দেখাচ্ছে, একটা বাইকেরই— সম্ভবত দূরের কোনও বাইকই মোড় ঘুরতে গেল, আর তার আলোতেই দেখি ওর মুখে কী হাসি! যেন ব্যাটার ফুর্তি আর ধরছে না। আর তখনই ঠিক করে ফেলি, ও কিন্তু তখনও জানে না, জানেই না, আর কয়েকটা মুহূর্ত পরেই ওর—।
উঠতে ইচ্ছে করছিল না জায়গা ছেড়ে। হাওয়া দিয়েছে বেশ। আকাশে এক ফালি চাঁদ। খালের জলেও সে চাঁদ বলতে গেলে হামা দিচ্ছে। যেন আমার দিকেই। যেন আমার দিকে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সে ব্যাটাও যেন অবাক হয়েছে খুব, ভাবছে এ আবার কী হল রে বাবা। বিড়ি ধরাতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু কোথায় বিড়ি? দেশলাই? মনে পড়ল, সে তো প্রদীপের পকেটেই থেকে গেছে। ওকেই তো কিনতে বললাম। ও নিজেই গিয়ে সেই সনাতনের ঝুপরি থেকে—। ওর ডানদিকের প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখি, নেই। মানে বিড়ি আর দেশলাই। তাহলে বাঁদিকের পকেটেই। ব্যাটা পড়েছে আবার বাঁদিক কাত হয়ে, বিড়ি আর দেশলাইয়ের জন্য ওর বডির বাঁদিকটা তার মানে চাগাতে হবে একটু। তা হোক, বিড়ির নেশা উঠেছে খুব। আর নেশা মাত্রই কী অদ্ভুত ভাব, যেন বিড়িতে একটা টান না দিতে পারলে ফাঁকা হয়ে যাবে বুকটা। ওই মার্ডারের নেশার মতোই, বিশ্বাস করুন, একবার চাড়া দিয়ে উঠলে—। ওই যে একদলা কাদামাটির মতো একটা জীবন্ত মানুষ—, ওই যে পেট বা গলায় হাত দিয়ে অবাক তাকানো—। না, প্রদীপ অবশ্য হাত দেওয়ার সুযোগ পায়নি কোথাও। মানে মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও ব্যাটা জীবন তো দূরের কথা, নিজের শরীরটাকেই ছোঁয়ার সুযোগ পায়নি কোনও।
বিড়িটা ধরাতে গিয়ে দেখি ও দেখছে আমাকে। কী হল, জ্যান্ত নাকি? বিড়িটা না ধরিয়েই হাত দিই ওর নাকে। গলার দুপাশের রগে হাত বোলাই। নাহ্। ওর ওই ফুটো হওয়া কানের কাছে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করি, কী রে, বেঁচে আছিস নাকি? সাড়া না পেয়ে ফের তাকাই ওর চোখের দিকে। দেখি চোখ যেন কেমন ম্লান হয়ে আসছে তখন। যেন দুঃখ পেয়েছে খুব। ও কি সত্যিই দুঃখ পেয়েছে না কি আমি নিজের থেকেই ভাবলাম এমন, কে জানে। বললাম, দূর, কোনও মানে হয় না কিছুর, ঠিকই দেখিয়েছিলি তুই, জীবন আর মৃত্যুর সত্যিই তফাৎ নেই কোনও। ফের দেশলাইকাঠি ঘষি। আগুনটা ওর চোখের কাছে নেব বলে ঠিক করি। কিন্তু বাতাস এক এক ধাক্কায় কাঠির আগুনটাকে একেবারে জব্দ করে দিতে থাকে, ওর চোখটাকে দেখার আর কোনও সুযোগই যেন দেবে না। অর্থাৎ বিড়ি ধরাবার জন্য আগুন জ্বালাতে হলে তোমাকে আড়াল নিতে হবে থামের।
এই প্রদীপের কথাটাই কিন্তু খুব ইচ্ছে করে বলতে, মানে প্রদীপের বোনকেই। বলতে ইচ্ছে করে, এই যে তুই রোজ আমার জন্য, এই যে রোজ দুপুর হোক কি রাত আমার জন্য জানালায়, এই যে দূর থেকে দেখামাত্রই দরজা খুলে—, আরে তোর দাদাকে আমি—। তুই কী দেখে আমাকে—। তোর সেই পালিয়ে যাওয়া মা-ই বা কোন দুঃখে আমার ঘাড়ে তোকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এত ঝুলোঝুলি করল? কতটুকু জানে তোর মা আমার সম্বন্ধে, তুইই বা জানিস কতটুকু? অমন একটা হিরোইন হিরোইন দেখতে মেয়ে আমার জন্য কেন এত আদিখ্যেতা দেখাবে? কেন? কী ইচ্ছে হয় বল তো, ইচ্ছে হয় গলা টিপে—। না, বস্তির এই ঘরে গলা টিপে ওকে মারতে গেলে সেটার তো খুন ছাড়া অন্য কোনও অর্থই থাকবে না। চারপাশের সবাই বলবে, বিয়ের পর থেকে মেয়েটাকে একদিনের জন্যও শান্তি দেয়নি গো। বলবে, রোজ রাতে সেই মদ খেয়ে বাড়ি ফেরা, রোজ মারধর—। বলবে, ফাঁসি হওয়া উচিত এই ছেলের।
আমার কিন্তু মাঝেমধ্যেই সেই লোকটির কথা মনে পরে। সেই যে রাঁচি-হাওড়ার ট্রেনে দরজার পাশে ঘুমিয়ে থাকা একটি লোক। সেই যে লাথি খেয়ে ভাবল, কী একটা পড়ল বুঝি শরীরে, সেই ঘুমের মধ্যেই মাছি তাড়ানোর মতো করে—। লোকটা ট্রেন থেকে নিচে পড়ছে যখন, বা লাইনের গায়ে ধাক্কা খাওয়ার মুহূর্তে নিশ্চিত অবাক হয়েছে। ভয় পায়নি সেই শেষ মুহূর্তে? হ্যাঁ, এক মুহূর্তের জন্য হলেও। বা চিৎকার? হয়তো সুযোগই পায়নি ভয় পাওয়ার। তার আগেই মাথা হয়তো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে—। কে খেয়াল করবে, কেউই নয়। অন্তত সেই ট্রেনের তো কারও খেয়াল করার কথাই নয়। লোকটার বাড়ির লোক হয়তো অনেক দূরে কোথাও অপেক্ষা করে করে—। কিন্তু অপেক্ষা করে করে না পেয়ে যাবে কোথায় তারা? ওর বউ হয়তো ট্রেনের হাওড়া পৌঁছানোর টাইম ধরে শেষমেশ না পেয়ে—।
ভাল কথা, প্রদীপের সেই গুলি-খাওয়া বডির কাদামাটির দলা হয়ে ঝরে পড়ার পর আমি কিন্তু অপেক্ষা করলাম অনেকক্ষণ। অপেক্ষা মানে, ওই বিড়ি খেলাম পরপর বেশ কয়েকটা। হ্যাঁ, খালের জলে সেই আকাশের মতো চাঁদটাই বারবার আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ করেই থমকে যাচ্ছে। তার মানে আমার কাছাকাছি আসার ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারছিল না কিছুতেই। একসময় সত্যিই উঠে পড়লাম। দাঁড়িয়ে দেখলাম একবার। ওই আকাশের চাঁদের আলোতে যতটুকু দেখায়। একবার মনে হল থামের ধারে এই সিমেন্টের বেদিতে বেচারা কষ্ট পাচ্ছে খুব। তার চেয়ে ঘাসপাতা বা খালের কচুরিপানা হলে বা ঠান্ডা জল বা কাদা—। ইচ্ছে হল একটা লাথি মেরে— ওই ট্রেনের লোকটাকে প্রদীপ যেমন—। হয়তো ফেলেই দিতাম, লাথি মারতে গিয়ে একেবারে শেষমুহূর্তে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখদুটো আরও ম্লান। যেন বিশাল কোনও দুঃখে ও—।
পরদিন ওর বডিটা কার চোখে প্রথম পড়ল বলুন তো? আমার। অনেক বেলা করে উঠে শুয়ে আছি, যেমন থাকি রোজ, হঠাৎ করেই মনে হল, আরে, প্রদীপের বডি নিয়ে নির্ঘাৎ হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে বাইরে। পুলিস এসে গেছে হয়তো। ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখি, কোথায় কী, চারপাশটা একেবারে আর পাঁচটা দিনের মতোই। বলা যেতে পারে পাঁচদিনের অভ্যাসমতো জয়ন্তদার চায়ের দোকানে যাব বলেই বাইরে বেরিয়েছি। আর খালের কালভার্টের নিচে ওই দূর থেকেও চোখ পড়ামাত্র দেখি, কে একজন তাকিয়ে আছে না আমার দিকে? আশ্চর্য, আমি ছাড়া আর একটা কোনও লোক দেখতে পাচ্ছে না বডিটাকে। চায়ের দোকানের জয়ন্তদাকে বললাম, কালভার্টের নিচে ওই থামের পাশে কী একটা পড়ে আছে না?
সেই মেয়েছেলে এল ফের। পরদিন বিকেলের দিকে। এল কিন্তু একেবারে টাইমমতোই। মর্গ থেকে প্রদীপের লাশ নিয়ে পৌঁছেছি সবে। ক্লাবের টাকায় ভাড়া করা সেই মিনিডোর দাঁড়িয়েছে একেবারে প্রদীপদের ঘরের সামনেই। চারপাশে ভিড়— মানে ড্রেনের পোকার মতো থিকথিক-করা মানুষ। প্রদীপের বোনটা যথারীতি কাঁদল না একটুও। হিরোইনরা সব এমনিই হয় কি না কে জানে? বডি তুলে সবাই যখন শ্মশানের দিকে যাবে বলে গুছিয়ে নিচ্ছে, সেই মেয়েছেলে মানে প্রদীপের মা বলে উঠল, মেয়ের কাছে ফোন নম্বর রেখে যাচ্ছি একটা, ফোন করবে। যাওয়ার আগে নিজের সেই মেয়ে মানে, প্রদীপের বোন রত্নাকে নিয়ে ওই খুপড়ির ঘরে ঢুকল একবার। কেন কে জানে মেয়েটির প্রতি ততক্ষণে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে আমার। বেশ দেখতে ইচ্ছে করছে, বা আমার দিকে মুখ রাখলেই কেন যেন আমাকেই দেখতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। আর সত্যিই, বডি নিয়ে সেই মিনিডোর স্টার্ট দেওয়ামাত্র সেই মেয়েছেলে বেরিয়ে এল বাইরে। ওর মেয়েও। আর বাইরে বেরিয়ে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। হ্যাঁ, আমাদের সেই লাশ-বওয়া মিনিডোর বস্তির গলি ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় না-পড়া পর্যন্ত। তাকিয়েই রইল।
মেয়েটিকে তাহলে ভয়ই দেখাতে হয়। ভয় আসলে কিন্তু মৃত্যুর কথাই। যা তুমি দেখবে চপার দিয়ে পেট ফাঁসানো বা গলার নালি ফাঁক করা পার্টির চোখে। পার্টি মানে পাবলিক। শুধু চোখে-মুখে কেন, দেখবে সেই পাবলিকের শরীরের সর্বত্র। যতক্ষণ জান থাকবে ততক্ষণ নিজের শরীরের সবকিছু দিয়ে জীবনটাকে আরও কিছুক্ষণ মানে যতক্ষণ পারা যায় জাপটে ধরে রাখতে চাইবে। সে তখন দেখতে পাচ্ছে দ্রুত একেবারে হু-হু করে জীবন তার মৃত্যুর দোরগোড়ায় মানে শেষপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। এই একবারই সে ভয় পাচ্ছে। একেবারে প্রকৃত ভয়। জীবনকে আর অনুভব না করতে পারার সম্ভাবনার ভয়। রত্না কি জীবনে ভয় পেয়েছে কোনও দিন? কোনও দিন কি মৃত্যু দাঁড়িয়েছে এসে ওর সামনে?
ওকে কিছু বলব বলেই নেশা-টেশার ধার দিয়েই যাইনি আজ। তুষারদার বাড়িতে বেশ বড় একটা কাজের বায়না ছিল। পার্টি টালিগঞ্জের। আর কথা শুরু করতে না করতেই ফোন। ওটা কি ফোন ধরার সময় কোনও? না দেখেই কাটলাম। বুঝলাম, স্বার্থ শুধু টালিগঞ্জের পার্টির নয়, দুজনারই। পার্টি বললে লিডারির, লিডারি মানে তো ক্ষমতা মানে টাকা-পয়সাই। এসব এখন একবার কেউ ঠোঁট ফাঁক করলেই বোঝা হয়ে যায় আমার। বলতে বলতেই ফের রিংটোন আমার ফোনের। তুষারদা বলল, হয় সাইলেন্সে রাখ, নয়তো ধরে নে। দেখি রত্না। বললাম, ব্যস্ত আছি খুব। কার ফোন— জানতে চাইলে তুষারদাকে নাম বললাম রত্নার। শুনে হাসল লোকটা, হেসে বলল— তাহলে তো খুব ভালবাসা আছে ওর। হিরোইনকে নিয়ে ভালই আছিস বল। ‘ভালবাসা’— ওই একটা শব্দ শুনেই গা-পিত্তি জ্বলতে থাকে। তুষারদার অর্ডারি কাজ করব কী, তখনই নেশা চেপে গেছে আমার। ওরা কথা বলছে নিজেদের মধ্যে আর আমি খেলে যাচ্ছি নিজের মনে। একেবারে নতুন কায়দা করতে হবে কোনও।
ঘরে ঢোকামাত্রই হিরোইন কী বলল বলুন তো, বলল, ওর নাকি আজ বাইরে বেরোতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার সঙ্গে। খুব আনন্দের কী একটা খবর নাকি দেবে আমায়। ওই সাজগোজ করা, ঠোঁটে লিপস্টিক মারা মেয়ের হাসিমুখ দেখে হাত নিশপিশ করে আমার। ইচ্ছে করছে কিছু একটা দিয়ে মুখটা পোড়াতে পারলে—। না আগুন নয়। আগুনে অনেক চিৎকার থাকে, অনেক হৈ-হৈ। একটা ফালতু মৃত্যু নিয়ে এত উৎপাত সহ্য হয় না আমার। বললাম, ভালবাসিস তো আমাকে খুব তাই না? ঘাড় নাড়ল রত্না। বললাম, মরতে পারবি আমার জন্য?
কী আশ্চর্য ভাবুন, এতটুকু অবাক হল না। ফের হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। যেন আমার জন্য সব কিছু করতে তৈরি ও। আমার জন্য মানে আমার ভালবাসার জন্য। বললাম, নিজের চোখে মরতে দেখেছিস কাউকে কোনও দিন? না, এমনি এমনি মৃত্যু নয়, একেবারে মেরে ফেলা। ধর কানের কাছে কিছু নিয়ে গুলি করা। বা পেটের মধ্যে চপার ঢুকিয়ে—। মেয়েটা অবাক হচ্ছে না তখনও। হয়তো ভাবছে ইয়ার্কিই। বললাম, গলায় দড়ি দিয়ে মরতে দেখেছিস কাউকে? মানে মরতে না দেখলেও মরার পর ঝুলতে দেখেছিস? না, সে সব ও দেখবে কোত্থেকে? এই সব বস্তি-টস্তিতে নিজের থেকে কে আর মরতে যাবে? বললাম, দড়ি আছে না ঘরে? কী আশ্চর্য ভাবুন, একটুও না থমকে ঘাড় নাড়ল রত্না। অর্থাৎ আছে।
—আন গিয়ে।
দেখি একেবারে বিছানার পাশেই বেশ যত্ন করে রাখা। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই। যেন একেবারে নতুন কিনে আনা। আমাদের ঘরটা ওই বস্তির ঝুপড়ি টাইপ যেমন হয় আর কি। এখানে গলায় দড়ি পরিয়ে কাউকে ঝুলিয়ে দেওয়াটা এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয়। না, আগে ওর সামনে মৃত্যুর ছবি রাখতে হবে একটা। ভয় কাকে বলে বোঝাতে হবে। আমার জন্যই এত ভালবাসা যখন তোর—। প্লাস্টিকের চেয়ারটা আনতে বললাম। চেয়ারে দাঁড়িয়ে মেঝেতে রাখা দড়িটা দিতে বললাম ওকে। দেখ একবার মৃত্যু অনেকটা কেমন। বললাম, ভালবাসিস তো আমাকে? মরতে পারবি বলছিস, তাই তো? রত্না ঘাড় নাড়ছে। যেন মৃত্যু যে কত সাধারণ ও জানে। যেন জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে কোনও তফাৎ যে নেই—। বললাম, আমি যে তোকে ঘেন্না করি তা জানিস? রত্না ঘাড় নাড়ল এবারও। বললাম, তোর এই ভালবাসা নিয়ে আদিখ্যেতা যে সহ্য হয় না আমার, জানিস? এবারও ঘাড় নাড়ল মেয়েটি। বললাম, এই দড়িতে ঝুলতে পারবি আমার জন্য? এই দ্যাখ—। বলে দড়িটার একটা প্রান্ত ফ্যানের হুকে আটকে, আর একটা প্রান্ত নিজের গলাতেই—। ভয় কাকে বলে—।
এটা আপনারা জানবেন, গলায় দড়ি দিলে কিন্তু কয়েকটা মিনিট সময় পায় মানুষ। দুটো হাত দিয়ে তখন সে প্রাণপণে নিজের গলা—, মানে হাতদুটো ওঠানোর চেষ্টা থাকে প্রবল, যেন কোনও মতে হাতদুটো ওঠাতে পারলেই, কোনও মতে গলাটা—। এ আমার দেখা। তখন সে কিন্তু নিজের গলা নয়, জড়িয়ে ধরতে চাইছে নিজের জীবনটাকেই। একেবারে শেষের কয়েকটা মুহূর্ত নিজের মতো করে নিজের জীবনটাকে আঁকড়ে—। না, আমার কিন্তু কিছুতেই আর নিজের শরীরটাকে জাপটে ধরতে ইচ্ছে করছিল না। বারবার তখন হাতদুটো জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছি, বারবার একটি মেয়েকে ছোঁয়ার জন্য, বারবার ওকে কিছু বলার জন্য—। আমার চোখ ঠিকরে বেরোতে চাইছে তখন, চোখের সবকিছু দিয়ে আমি দেখতে চাইছি তাকে, জিভ বেরিয়ে আসছে, আমি বলতে চাইছি কিছু, গলার সব জোর দিয়ে আমি—।
একেবারে শেষ মুহূর্তে মানে, আমার শরীর থেমে যাওয়ারও বেশ পরে, যখন হিরোইন মানে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রদীপের বোন আমার জীবন বা মৃত্যু নিয়ে একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, যখন আমাকে একা রেখে সে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার ফের মনে হল ট্রেনের সেই লোকটার কথা। সেই যে প্রদীপের এক লাথিতে—। আমার পায়ের নিচে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারটাও কিন্তু আমারই পায়ের ধাক্কায়—। হিরোইনকে একেবারে কিচ্ছু করতে হয়নি। সে শুধু সামনে দাঁড়িয়ে চুপচাপ একটা মৃত্যুকে দেখে গেছে।