সনৎ কর: নির্জন এককের শিল্পকলা

সঞ্জয় ঘোষ

 


চিকিৎসক, কবি, গদ্যকার

 

 

 

সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে: ভয়ে ভয়ে

তাঁর ছবির, তাঁর গ্রাফিক্সের চরিত্ররা সব যেন ভীষণ একা, তারা সব সঙ্গীহীন, এই গ্রহে তারা সবাই যেন ‘এলিনিয়েটেড’! কেন তারা এত একা, একা? খুব ছোটবেলায় সনৎ কর যখন একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে পড়তেন, তখন একবার তাঁর এক বান্ধবী একটি ছোট মেয়ের পেন্সিল হারিয়ে গেছিল। সে ভেবেছিল যে সনৎ করই সেটা নিয়েছেন, অথচ সত্যিই তিনি নেননি। কেউ বিশ্বাস করেনি সেটা, শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, সারাদিন একা হলে দাঁড়িয়ে থাকার। সবাই তাই দেখে হাসিঠাট্টা করল! সেই থেকে তিনি ‘একা’ হয়ে গেলেন। সারাজীবন সে ছবির জগতে হোক বা কাজের জগতে তিনি কাটালেন একেবারে একাকী, নিঃসঙ্গ হয়ে।

আর তাঁর ছবির প্রতিমারা সব যেন কেমন ভয়ে ভয়ে চেয়ে আছে, চারপাশের জগতকে যেন তারা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না, এক প্রগাঢ় আতঙ্ক যেন তাদের মনে ছেয়ে আছে? কেন এত ভয় তাদের? কিসের এত শঙ্কা তাদের? সনৎ করের নিজের কথাতেই শুনি ‘ওই পেন্সিল হারানো ঘটনাতে দোষ না করেও শিশুবয়সে শাস্তি পাওয়ার পর আমার কেবলই মনে হত যে সবাই আমায় ভুল বুঝবে। খুব ছোটবেলায় আমার পরের এক ভাই হঠাৎ মারা গেল। তখন মৃত্যু ব্যাপারটাও ঠিকমতো বুঝিনি। ছোটবেলায় একটা ‘এয়ারগান’ নিয়ে খেলবার সময়ে আমাদের বাড়ির এক দারোয়ানের কপালে একটা ছররা লেগে গিয়েছিল। কী ভয় পেয়েছিলাম, “সে কি মরে গেল?’’ সেই ভয় এখনও যেন মনে জেগে আছে।’ এ যেন অনেকটা নরওয়ের শিল্পী এডভার্ড মুংখের জীবনের মত, যিনি ছোট বয়সে হারিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বোন আর মাকে। সেই ভয় সারাজীবন তাঁর ছবিকে প্রভাবিত করে গেছিল। আর সেখান থেকেই উৎসারিত হয়েছিল ‘দ্য স্ক্রিম’-এর মতো আশঙ্কাময় ছবিরা!

 

ভয় হতে তব অভয় মাঝে

নিজের ছবিতে তিনি অহরহ একাকিত্ব আর ভয়ের ছবি এঁকে গেলেও তিনি কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে মিশে থাকতে চাইতেন যৌথ জীবনযাত্রার শিকড়ে। স্বাধীনতার ঠিক আগে দাঙ্গার সময়ে তিনি হয়ে যাচ্ছেন ‘ডিফেন্স পার্টির’ মেম্বার, সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে, রাত জেগে তিনি প্রতিরোধ করে যাচ্ছেন দাঙ্গার অশুভ হিংস্রতা।

আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরোবার পর থেকেই যৌথ শিল্পীশিবির করবার প্রয়াস নিচ্ছেন। একা একাই তৈরি করছেন ‘আর্টিস্ট সার্কেল’ নামের শিল্পীদল, যেখানে যোগ দিচ্ছেন অনেক তরুণ শিল্পীরা। সেইসময় নিখিল বিশ্বাসও তৈরি করেছেন ‘চিত্রাংশু’ নামের শিল্পীগ্রুপ। পরে তাঁরা দুজনে এই গ্রুপ দুটোকে মিলিয়ে দিয়ে তৈরি করলেন ‘সোসাইটি অব কনটেম্পাররি আর্টিস্ট’, যা ভারতবর্ষের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শিল্পীদল, এখনও সক্রিয়ভাবে চলছে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তিনি জহুরির চোখ দিয়ে খুঁজে বেড়িয়েছেন চারপাশের তরুণ শিল্পীদের। গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য প্রমুখ প্রতিভাবান শিল্পীদের তিনিই উদ্যোগী হয়ে নিয়ে এসেছিলেন এই গ্রুপে, যাঁরা পরে ভারতবর্ষের প্রখ্যাত শিল্পী হিসেবে নিজেদের আসন করে নেবেন। এই যে যৌথ শিল্পচর্চা তার পেছনে সনৎ করের বা তাঁর শিল্পীসঙ্গী শ্যামল দত্ত রায়দের মনে কোনও অন্য অভিলাষ ছিল না। তাঁরা শুধু চেয়েছিলেন ‘সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করব। একা কাজ করে বাঁচা যায় না। এদের কাজ দেখে ভাল লেগেছিল তাই ওদের এই গ্রুপে নিয়ে এসেছিলাম।’ ঠিক এইরকমই ভেবেছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যানগখ, আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছরের আগে, শিল্পীদের এক যৌথ খামারের কথা, যেখানে তিনি আহ্বান করেছিলেন পল গঁগ্যাকে, আত্মগর্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি চেয়েছিলেন একজন মহৎ শিল্পীর পাশে বসে নিরন্তর চিত্ররচনা করে যেতে, যদিও শেষ পর্যন্ত সেই স্বপ্ন সফল হয়নি তাঁর। সনৎ করেরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা শেষপর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছিল, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে যে গ্রুপে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে গেলেন। শুধু ভারতবর্ষ নয়, বিদেশের ইতিহাসেও এই শিল্পগ্রুপের নাম জ্বলজ্বল করে লেখা থাকবে। এইখানেই সনৎ করেদের ভবিষ্যৎ রূপকল্পের সার্থকতা।

 

ড্রিমার, লি, ইকেবানা সিরিজ……..

বাস্তবকে ছুঁয়ে ফেলত তাঁর তুলি-কলম, কিন্তু বাস্তব পেরিয়ে এক ‘প্রসারিত বাস্তবের’ প্রান্তরে যেন পৌঁছে যেত তা। স্বপ্নের জগৎ থেকে উঠে এল যেন ‘ড্রিমার’ সিরিজের সব ছবি। সেই সময়টা স্বপ্ন নিয়ে খুব চর্চা করতেন, ফ্রয়েড, ইয়ুং প্রভৃতি মনোবিদদের তত্ত্বের সঙ্গে বোঝাপড়া চলত অবিরত। স্বপ্নের মধ্যে বুঁদ হয়ে থেকে তিনি কি বাস্তব থেকে পালাতে চাইতেন? হয়তো বাস্তবের সঙ্গে লড়াইয়ের তাঁর একটা হাতিয়ার ছিল এইসব স্বপ্নছবি। তাঁর সমসাময়িক অনেক শিল্পী যেমন গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত, যোগেন চৌধুরী প্রমুখের মধ্যেও প্রভাব ফেলেছিল স্যুররেয়াল আন্দোলনের বার্তা, দালি প্রমুখের চিত্রকলা। জার্মান দার্শনিক নিৎসে বলেছিলেন, ‘কোনও শিল্পীই বাস্তবকে সহ্য করতে পারে না!’

শিক্ষকতা করবার জন্যে রোজ যখন কলাভবনে বাড়ি থেকে যেতে আসতেন রাস্তার ধারে দেখতে পেতেন অজস্র শুকনো পাতা রাস্তার দুধারে ঝরে পড়ে থাকতে। সেইসব শুকনো বিবর্ণ পাতার মধ্যে তিনি যেন অসংখ্য মানুষের সব মুখ দেখতে পেতেন। পাতাগুলো তিনি কুড়িয়ে নিয়ে এসে যত্ন করে রেখে দিতেন। তার থেকেই দেখা দিল তাঁর বিখ্যাত ‘লিফ সিরিজ’।

ইকেবানা সিরিজের কাজের উৎস ছিল মৃত্যুচিন্তা। ইকেবানা মানে ফুল সাজানো, জাপানি কথা। সেই সময়ে মৃত্যুচিন্তা তাঁকে খুব দগ্ধ করত। জাপানি এই ফুলসজ্জার মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন যেন সেই মৃত্যুকে পেরিয়ে যাওয়ার পথ।

 

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য: তৃতীয় পথের দিকে

তাঁর সমসাময়িক ভারতীয় অনেক শিল্পীর মত সনৎ করেরও লক্ষ্য ছিল ভারতীয় ও বিদেশি পদ্ধতির মাঝামাঝি একটি মিডলরোডের সন্ধান করা। কন্টেন্ট ও ফর্ম এই দুই প্রাঙ্গণেই ছিল তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষা। কালিঘাট পট নিয়ে তৈরি তাঁর ‘কালিঘাট সিরিজ’ এই ইঙ্গিতই দেয় এবং তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশ থেকেই ভারতীয় শিল্পকলা বা সংস্কৃতির জয়যাত্রা শুরু।

ভাবগত দিক থেকে তাঁর ছবি যেমন একটার পর একটা ঘাট পেরিয়ে মহত্তর পথের খোঁজ করে গেছে, পদ্ধতিগত দিকেও তাঁর ছিল গভীরতর অন্বেষণ এবং সেই খোঁজের মধ্যে মিশে থাকত ভারতীয় সত্তার প্রতিফলন। ছাপাই ছবির জন্যে যে জিঙ্ক প্লেট ব্যবহার হয় তার দাম খুব বেশি। তিনি স্বল্পমূল্যে কাজ করার জন্যে আর ছাত্রদের শেখানোর জন্যে উদ্ভাবন করে ফেললেন উড-ইন্টাগ্লিও পদ্ধতি, সেখানে জিঙ্ক প্লেটের বদলে, কাঠকে ব্যবহার করা হল মাধ্যম হিসেবে। পরে পিচবোর্ড, কার্ডকেও ব্যবহার করলেন এই পদ্ধতিতে। বিদেশিরাও এই কাজ দেখে চমৎকৃত হলেন এবং জিঙ্ক প্লেটের থেকে এর তফাৎ আদৌ ধরতে পারলেন না। শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ‘গ্রাফিক্স ডিপার্টমেন্ট’ সোমনাথ হোর আর তিনি মিলেই গড়ে তুললেন, যার খ্যাতি এখন দেশ-বিদেশ জুড়ে। ছাপাই ছবিতে তিনি ভারত-বিখ্যাত হলেও তাঁর মনের পছন্দ ছিল কিন্তু পেন্টিং। তিনি নিজেই এটা স্বীকার করেছেন। টেম্পারা বা জলরঙে তাঁর কাজের এখনও এদেশে পূর্ণ মূল্যায়ন হয়নি, তবে স্পষ্ট বোঝা যায় তাঁর এইসব সৃষ্টি ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশক হয়ে থাকবে।

 

শৈশবের মন নিয়ে

মনের গহনে তিনি বয়ে বেড়াতেন এক শিশুর সরল ও নির্ভার ভঙ্গি। প্রাজ্ঞ শিল্পী হয়েও তিনি লিখে ফেলতেন ছোটদের জন্যে অদ্ভুত সব স্বপ্নলোকের কাহিনি। শিশুর ভাষায় সেখানে যেন চলে আসত তাঁর শিল্পকলার ছায়া।

 

একজন ঋষিপ্রতিম শিল্পী

তাঁর ছিল না কোনও সেলিব্রিটিসুলভ আচরণ, ছিল না কোনও অর্থলিপ্সা, ছিল না কোনও অহমিকা বা আরোপিত ভান। রতনপল্লীতে তাঁর ছোট্ট বাসার দ্বার অবারিত ছিল সব ধরনের শিল্পপ্রেমীদের জন্যে। তাঁর ছিল না গ্যালারি-ধাওয়া করার এতটুকু ইচ্ছে, মিডিয়াকে লালন করার এতটুকু বাসনা, ছবি-নিলামের তিনি রাখতেন না এতটুকু খোঁজ।

এই যুগে সত্যিই তিনি ছিলেন এক বিরল মানুষ, এক ঋষিকল্প শিল্পী।

এই ব্যতিক্রমী মানুষের ‘একটি জীবন’ আমাদের সামনে যেন একটা স্বচ্ছ দর্পণের মত জেগে রইল। আমরা নতজানু। আমরা আভূমি প্রণত।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...