বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
The Duck and the Kangaroo
এক
গাড়ি ড্রাইভওয়েতে রেখে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছিল হীরক। গ্যারাজে না ঢুকিয়েই। মনে হয়নি গাড়ি থেকে নামার কথাও। প্রায় বারো ঘণ্টা টানা চালিয়ে এসেছে— আশি নব্বই কখনও বা একশো মাইল গতিতে। এই গতিময়তার মাঝখানে ড্রাইভারের সিটে সে ছিল স্থবির। হাত স্টিয়ারিঙে প্রায় নিশ্চল, খোলা রাস্তায় ডান পা আলগা চাপে অ্যাক্সিলেটরে। সোজা হু হু করে ছুটে চলা রাস্তায় হাত পা নাড়ানোরও প্রয়োজন নেই। অথচ মাথার মধ্যে চিন্তার ঝড় এলোপাথারি বয়ে যাচ্ছিল— সেই ঝড়ে গতিবেগের কোনও ঘোষণা ছিল না। টুকরো টুকরো হয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল হীরকের। কিন্তু সেই ইচ্ছায় জোর ছিল কি? না হলে খুব সামান্য একটু হাতের মোচরেই তো নিজেকে শেষ করে দিতে পারত। কই, করেনি তো? ভেবেই বিদ্রূপের বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণায় জায়গা নিচ্ছিল। ভয় পেলি হীরু? জানতাম। হীরক তর্জনী দিয়ে কপালের দুপাশে টিপতে থাকল, ভার হয়ে আছে কপালটা। সারা রাত ঘুম নেই। একটা রেস্ট এরিয়াতে গাড়ি থামিয়ে ঘণ্টাখানেক চোখ বুজে নিয়েছিল। কিন্তু ঘুম হয়নি। মাথার মধ্যে কত লোক হেঁটেচলে বেরিয়েছে। মাঝখানে দুবার ফোন এসেছিল চিনুর। লেখার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর চিনুর বাড়িতে আর ফিরেই যায়নি হীরক। ফোনের অন্য পারে নীলিমার অস্থির কণ্ঠস্বর। কী হল রে হীরু? তোর তো আগামীকাল যাওয়ার কথা ছিল। অথচ চিনু বলছে তুই বাড়ি ফিরে গেছিস?
কথা বলার শক্তি ছিল না হীরকের। মনের মধ্যেই তখন এত কথোপকথন, বাইরের কথাকে আসতে দেওয়ার জায়গা কই? ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়ার মত। কতদিনের কত কথা ঝাঁক বেঁধে এসেছে। পুরনো সেই কথার গায়ে শেওলা। তার রং, স্পর্শ এমনকি আয়তনও বদলে গেছে। কোনওটা জমতে জমতে পাথর। সমস্ত জীবন তাদের বয়ে বেড়ানোর অপরিসীম ক্লান্তি হীরককে চেপে ধরেছে। মনে হচ্ছিল কোনও নতুন কথাকে প্রশ্রয় দেওয়ার শ্রম শরীর নিতে পারবে না। খুব ছোট করে বলেছিল, জরুরি কাজ পড়েছে মা। যেভাবে বলল নিজের কানেও বিশ্বাস তৈরি হল না।
নীলিমার হতাশা কানের গোড়ায় আছড়ে পড়ল, একবার দেখা করে তো যেতে হয়। অনুযোগ দিলে ছেলে রাগ করবে ভেবেই তড়িঘড়ি জুড়ল, তোর কথা ভেবে সর্ষেমাছ রান্না করছিলাম আমি।
মা কি নিজেকে সবসময়েই এমন সঙ্কুচিত করে রাখে, না সেটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে? অন্যসময় হলে এই ভাবনাটা মাথায় দানা বাঁধতে পারত। এখন হীরকের সেসব ভাবার অবস্থা নেই। ভাবল মাকে পরে বুঝিয়ে বলা যাবে। পরে খাব মা, তোমরা ফেরার আগে আসব একবার।
–আসবি তো?
–হ্যাঁ, আসব। বলেই ক্লিক করে ওয়্যারলেসটা বন্ধ করে দিয়েছিল হীরক।
আজ সকালে আবার ফোন। গাড়ি চালাচ্ছিল তখন। ধরেনি। গাড়ি থেমে থাকলেও ধরত না। নিজের চিন্তার অলিগলি ধরে তার মন তখন কানামাছি খেলছিল, অন্য কোনও কথা ভাবার বা বলার সময় কোথায়? এত কিছু ভাবছে কিন্তু কী ভাবছে নিজেকে প্রশ্ন করলে কোনও সদুত্তর দিতে পারবে না। আটাত্তরের বন্যায় ওদের বাড়িতে জল ঢুকে গেছিল। সেই জলের সঙ্গে কত কিছু যে ভেসে এসে ঘরে ঢুকে যাচ্ছিল তার লেখাজোখা নেই। আলাদা করে কোনওকিছুর গোনাগুনতি ছিল না। শুধু ওদের সিঁড়ির ঘরে রাখা ক্যারমবোর্ডটা জলের উপর ভাসছিল। জল খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে যাচ্ছিল। সেটাই সব কিছু ছাপিয়ে বুক ফাটিয়েছিল। আজকেও কত কথা যে আসছে বেনোজলের তোড়ে, তবু সব ছাপিয়ে রেখার জ্বলে যাওয়া মুখটাই মনের মধ্যে দগদগে। সারাটা রাস্তা সযত্নে জমানো রেখার স্মৃতি খুঁড়ে চলেছে। বিভিন্ন ঘটনার সুতো ধরে ধরে রেখার অতি পরিচিত মুখটাকে নিজের চোখের সামনে এনে দাঁড় করানোর চেষ্টায়। কিন্তু ছোটবেলার ফ্রক পড়া রেখাও সামনে এসেছে তার চামড়া টানটান জ্যালজ্যালে মুখ নিয়ে। একটা চোখের কোটর চামরায় ঢাকা। সেই মুখ ওকে দেখে বিদ্রূপের হাসি হেসে দৌড়ে চলে গেছে। ভেবেও শিউরে উঠল আবার। হাতের পাতায় চোখ ঢেকে স্টিয়ারিঙে মাথা রাখল হীরক।
কতক্ষণ গাড়িতে এইভাবে বসেছিল খেয়াল নেই। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল এবার। সকালের বাতাস এখনও নরম। তবে হাওয়ায় শিরশিরানি ধরতে কিছু দেরি আছে। ধীর পায়ে দূরত্ব পেরিয়ে সদর দরজার দিকে এগোল। তিস্তা স্কুলে, জিনি ওর দোকানে। সেই ভাবনাটাই মনের ভরসা। চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল হীরক। ঘরে ঢুকে নিচু হয়ে জুতোর ফিতে খুলল অনেকক্ষণ ধরে। জীবনের জট খোলার নিবিষ্টতায়। মাডরুমে জুতো ছুঁড়ে লিভিংরুমে এল। তিস্তার বই, খেলার সরঞ্জাম লিভিংরুমের সোফায় ছড়ানো। কিচেনের সিঙ্কের নিচের দরজাটা খোলা, গ্যাস রেঞ্জে রাতের রান্নার তেলমশলা লেগে আছে। চিকেনের হালকা গন্ধ। জিনি কাল রান্না করেছিল। এমন নয় যে এগুলো আজ প্রথমবার দেখছে। ঘরের আনাচেকানাচে তিস্তা আর জিনিকে ছড়িয়ে থাকতে দেখে কেন হঠাৎ মনে হল সে এখানে অনুহ্য, অবান্তর। না থাকলেও ক্ষতি নেই। চিন্তাটা আনুষঙ্গিক থেকে দূরত্ব তৈরি করতে চাইল।
তবু এমন দম আটকানো ভাব লাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে এই বাড়ির ছাদ, চারটে দেওয়াল ওকে চেপে ধরবার জন্য আস্তে আস্তে গুটিয়ে আসছে। জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। ঘরে হাওয়া বড় কম।
হীরক নিজেকে কমলা সোফাটায় ছেড়ে দিল। তাদের প্রথম কেনা আসবাব। পুরনো হয়েছে, বসতেই অনেকটা ডেবে গেল নিচে। সামনের দেওয়ালের ঘড়ির কাঁটার টিকটিক করে চলা দেখতে দেখতে নিজের নিশ্বাসের গতি শান্ত করার চেষ্টা করছিল হীরক। কিন্তু কোনও ফারাক পড়ল না। কেন যেন মনে হচ্ছিল এরকম মুহূর্ত আসার কথাই ছিল। যেন সারাজীবন এই দিনটা আসার অপেক্ষাতেই সজাগ থেকেছে হীরক। ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় দৌড়ে পালাতে পালাতেও বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার মত। পালাতেও চায়, কিন্তু মনের মধ্যে একটা ইচ্ছা কেউ এসে তার পিঠে জোরে ধাপ্পা দিয়ে যাক। কিন্তু এতদিন কেউ পিছন থেকে এসে ছুঁয়ে দেয়নি। আর হীরক ছুটতেই থেকেছে। কী মূল্যহীন সে দৌড়! ছুটেছে আর ভেবেছে সময় সব ঠিক করে দেবে। ততক্ষণ সে নিজেকে ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকবে, কিছুই হয়নি এমনি ভাব করে জীবনটাকে কাটাতে থাকবে। ওভাবে হয় নাকি! পুকুরের জলে ভাসা মরা গাছের ডালের মত শুকনো হাসি জেগে উঠল ঠোঁটে।
তাছাড়া অন্য কোনও উপায় কি তার ছিল? ছিল। কিন্তু হাত বাড়িয়ে সেই সুযোগ নিইনি। নিজের কাছেই স্বীকারোক্তি করল হীরক। ওর জীবন সব কিছু মেনে নিয়ে, জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলে এগিয়ে যাওয়ার গল্প, ঠিক যেমন টিভি সিরিয়ালের। ও ভেবেছিল ভাল মানুষ হওয়া, ভাল চাওয়ার, কাছের মানুষদের জন্য ভাল করার ইচ্ছা তার ভার লাগব করে দেবে। সব সম্পর্কের প্রতিটা আশার কাছে মাথা নত করে ভেবেছে এটাই নিয়ম। অন্যে কী ভাববে, কীভাবে নেবে তার প্রতিটা পদক্ষেপ সেই কার্যকারণ মাথায় রেখেছে বিনা প্রশ্নে। ভুল। মনের ভিতর টিকটিকিটা ডেকে উঠল। নিজের ভালটাও যে ভেবেছে সেটা মনে করিয়ে দিল হীরককে। কেন, সেদিন যখন শানুর বাড়ি থেকে দৌড়ে পালিয়ে এলি, তারপর শানুর কী হল দেখেছিলি? নিজের সাফাই গাইবার সুযোগ পেল না হীরক— না হলে বলত সেদিন তো শানুই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওর বাড়িতে। আমার কী দোষ ছিল। দোষ নাই থাকল, দায়িত্ব থাকে। এরপর কতদিন শানুর কোনও খোঁজও পেলি না, একবারও ভেবেছিলি পাশে গিয়ে দাঁড়ানো যায়? মুখ হাঁ করে কথা বলতে গিয়েই থেমে যাওয়ার মতন হীরক এর উত্তরে কিছু বলল না আর। এতদিন নিজেকে বুঝিয়েছে সে তখন কত ব্যাস্ত ছিল। ক্লাস টুয়েলভ, সামনে জয়েন্ট। তখন ওর মাথা তোলার জায়গা কোথায়। নিজের ভিতরের এই কণ্ঠস্বর আজকে আর দাবিয়ে দিতে পারছে না হীরক। সারাজীবন এই শ্যাডো বক্সিং করে গেছে। রেখাকে খুঁজে বের করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি, সেই যাতনার ওজন দিনদিন বেড়েছে। শানুর সঙ্গে দেখা হলে হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হয়েছে। ভেবেছে এই বুঝি ও বলে ওঠে, তুই একবার এলি না তখন হীরু, তাহলে হয়তো আমি ভাল হয়ে যেতাম। বলেনি, কিন্তু হীরক কাঁটা হয়ে থেকেছে যেন। নিজের জীবন সাজাতে ব্যস্ত থেকেছে। বাইরে সেজেছে, অথচ ভিতরে ফোঁকলা। নিজেকে ফাঁকি দিয়ে গোটা জীবন হয় না।
ঘরের চারপাশে চোখ বুলাল হীরক। মনে হল এই ঘরের কিচ্ছু তার নয়। এর কিছুই কক্ষনও তার ছিল না, যেমন নিজের জীবনটাও নিজের ছিল না। কেন, জিনিকে কি সে ভালবাসেনি? এই কথাটা হীরক অনেক ভেবেছে। অনেক সুন্দর সময় তো কেটেছে জিনির সঙ্গে, সেটা কি ভালবাসা নয়? ভালবাসা হাতের মুঠোয় রাখা আলগা বরফের মত। চাপ দিলে গলে জল হয়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়াতে থাকে। কত আনন্দের সময় তো গেছে তাদের। সেই আনন্দের মুহূর্ত দীর্ঘায়িত করতে নিজেই ঠিক জিনির মত করে সব কিছু ভাবতে চেয়েছে। সেটাও তো ফাঁকি। নিজের নিজেকে। জিনি কি তাকে জোর করেছিল? বলেছিল আমার মতন ওঠবোস করো? বলেনি, কিন্তু দুটো মানুষের মিলে যাওয়ায় পাল্লা তো দুদিকে সমান থাকে না। সেই ফাঁকি একাকী হীরকের মনে বিদ্রূপের অট্টহাসি হয়ে ফিরে এসেছে বারংবার। আর তখনই রেখা আরও বেশি ঢুকে গেছে তাদের দুজনের মাঝখানে। বারবার মনে হয়েছে রেখা থাকলে সে যেন নিজের মত করে বিকশিত হতে পারত। রেখার কাছে তো হীরকের ভাল আর মন্দ, ক্ষমতা আর দুর্বলতার সব হদিশ ছিল। নিজের হাতের পাতার মত পড়তে পারত তাকে। ছোটবেলা থেকে দেখছে, কিছুই গোপন ছিল না। সেখানে হীরককে কিছু লুকাতে হত না, তৈরি করতে হত না কোনও বহিরঙ্গ। বদলে দিতে হত না তার পছন্দ আর অপছন্দের নিভৃত তালিকা। জিনির জন্যে নিজেকে বদলাতে বদলাতে একটা অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছিল হীরক আর ভিতরে ভিতরে লালন করছিল রেখা আর হীরককে অমলিন।
হীরক গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। একটা স্যান্ডাল পায়ে গলিয়ে দরজা খুলে ডেকে বেরিয়ে এল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঘাসে পৌঁছে গেল সোজা। লম্বা লম্বা পায়ে ঘাস পেরিয়ে ম্যাপলের ছায়ার তলা দিয়ে হাঁটা দিল। মাথা নিচু করে হাঁটতেই থাকল। হীরকের একটা হাসিখুশির নিজস্ব আকাশ ছিল। একটা পরিবারের মত পাড়া ছিল। নীল জামা আর খাকি হাফপ্যান্টের স্কুল। ঘিয়ে দেওয়াল আর সবুজ জানালা ক্লাসঘর ছিল। আর ছিল আলোয় ভরা আলুথালু বাড়ি। ছিল পঁচিশে বৈশাখের ফাংশানের আয় তবে সহচরী গান। বাড়ির পাশের এক টুকরো মাঠে ফুটবল পেটানো। বুড়িপোড়ার আলুমাখা। রোববারের লালা ঝরানো মাংসের হলুদ ঝোলে মাথা বাড়ানো আলু। কাঠি আইসক্রিম। বিকেলে ফুচকাওয়ালা। ভারহীন মাথায় একঝাঁকা চুল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এক কিশোর। সেই সবকিছু জড়িয়ে ডালপালা মেলে এক হলদে কুসুম ভালবাসা। রেখা।
হীরক অনুভব করল ওর মুখে জলের ধারা— ঘাম না কান্না বুঝতে পারল না। হাতের পিছন দিয়ে মুছতে মুছতে এগিয়ে যাচ্ছিল হীরক। মনে হচ্ছিল এক দিগন্তব্যাপী শূন্যতা ওকে গ্রাস করছে। ও জানে, প্রচণ্ডভাবে বুঝতে পারছিল সে কখনওই প্রাণভরে বাঁচেনি। নিজের মত করে, নিজের পছন্দে। শুধু সহ্য করে গেছে। মেনে গেছে সাফল্যের সমাজস্বীকৃত নিয়মগুলোও। সবাইকে ভাল রাখতে চেয়েছিল। তাদের সুখের জলছিটে গায়ে মেখে সুখ কুড়াতে চেয়েছে সারাজীবন। সবার কাছে ভাল হওয়াতেও কী অদম্য তৃপ্তি। সুখী, সফল ঠিক যেমন হলে কারও মনে কোনও প্রশ্ন থাকে না। এখন বুঝতে পারছে কী শূন্য সেই বেঁচে থাকা। আসলে, স্বীকার করতে আর দ্বিধা নেই, অস্ফুটে এবার নিজেকেই শোনাল— আসলে তুই একটা কাপুরুষ, হীরক। এবার আরও জোরে— ভীরু! কাপুরুষ! সুবিধাবাদী!
এই স্পষ্ট উচ্চারণ পাথরে ঠোক্কর খাওয়ার মত দাঁড় করিয়ে দিল হীরককে। জীবনের কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দিশাহারা লাগল। ভাবনাটার সঙ্গে ধেয়ে এল একটা প্রচণ্ড ভয়, ত্রাস। কিন্তু সেই সঙ্গে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে আসছিল, বহুদিন বাদে। সূর্য এখন অনেকটা উপরে। এতক্ষণ গাছের ছায়া দিয়ে হাঁটা হীরক খোলা পরিসরে এসে পড়েছে। মাথা তুলে সূর্যের দিকে চোখ রাখল। পুরো মুখ দিয়ে তাপ আহরণ করতে করতে। সঙ্গে সজীবতা।
রেখার সঙ্গে দেখা করবে হীরক।
আর শানুর সঙ্গে।
তার সত্তা গচ্ছিত রয়ে গেছে ওদের জিম্মায়।
বাড়িতে ফিরে তখনও লিভিংরুমে কমলা সোফায় পা ছড়িয়ে শূন্যচোখে বসেছিল হীরক। জিনি ওকে এই সময়ে বাড়িতে আশা করেনি। নিজেরও এই সময়ে ফেরার কথা নয়। তিস্তার স্কুলে হেলথ ইন্সিওরেন্সের কার্ডের কপি জমা দিতে হবে, তাই দোকানে রাধিকাকে রেখে বাড়িতে ঢুঁ মারতে এসেছিল। পায়ে সেই তাড়া নিয়ে ঢুকে হীরককে দেখে থমকে দাঁড়াল, জঙ্গলের পথে দৌড়াতে দৌড়াতে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় চমকে দাঁড়ানো হরিণের মত। হীরক চোখ তুলে জিনিকে দেখছিল, কিংবা শুধুই চেয়েছিল। কথা হারিয়ে যাওয়া লোকেরা জানে না কী বলতে পারা যায়, কিছুই বলতে পারা যায় কিনা। হীরকের চোখের দৃষ্টিহীনতা জিনির চোখ এড়ায়নি।
–তুমি? তোমার তো আগামীকাল আসার কথা ছিল। হয়তো ফেরার তাড়া ছিল কিংবা প্রশ্নটা বাড়িতে একজন আছে বলে করতে হয়, এমনি ভঙ্গিতে বলা সাদামাটা রূপরসহীন যান্ত্রিক। কয়েক বছর আগে এরকম সুযোগ হলে জিনি লাফ দিয়ে হীরকের পাশে বসে বলত— অ্যাই! তাহলে আজকে তো আর অফিসে যাচ্ছ না, আমরা কিছু করি?
হীরকের মাথায় একটা ফিরে আসা অতীত হেলমেটের মত চেপে বসে আছে। তার থেকে না বেরিয়ে বলা গলায় প্রশ্ন করল, আগে এসে ভুল করলাম?
–আমি কিন্তু সেকথা বলিনি। জানতে চাইছিলাম কোথাও কিছু হয়েছে কিনা। সেই বুঝতে চাওয়াটা কি অন্যায়?
পাশাপাশি থাকলেই একজন আরেকজনকে বুঝবে সেটা হয়তো রাইট এক্সপেক্টেশান নয়। আমরা আর পারি না, একজন আরেকজনের কথা বুঝতে। হীরকের গলার স্বরে কোনও ওঠাপড়া ছিল না। কিন্তু জিনির গলা এবার উতরাইতে গেল।
–কথা বোলো না আর হীরক। চুপ করো। চেষ্টা তো আমি কম করিনি। কিন্তু আমার শব্দগুলো তোমাকে আর খুঁজে পায় না। কী মনে হয় জানো? তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমাকে যেন নতুন করে কথা বলা শিখতে হবে। চাবুক হাওয়ায় কাটার সময়কার আওয়াজ তুলছিল জিনির মুখ থেকে বেরোনো শব্দগুলো। তোমার সঙ্গে বিছানাতেও তাই যেতে ভাল লাগে না। বহুদিন। কী করে বোঝাব, পোশাকের আড়াল সরালে তুমি আর আমার পুরুষ থাকো না। আসলে অন্য কারও। তোমার শরীরের ভাষা মিথ্যে বলতে পারে না হীরক, ও তোমার মত নিঃশব্দ থাকে না।
হীরকের চোখের সাদাটা জায়গা বাড়াচ্ছিল। আমি তোমার কাছ থেকে ভালবাসা চাইতে যাইনি জিনি।
–জানি, তুমি ভালবাসা চাও না আমার কাছে। কিন্তু তাহলে কী চাও? আশ্রয়? তুমি কি শিশু? একটা দামড়া ছেলে, যাকে আমার কোলে বসাতে হবে। যার কান্না মোছাতে হবে। অনেকদিনের না বলা কথা জমে জিনির গলার স্বরে বিতৃষ্ণা এখন সরভাজার মত পুরু। তবু তার তীব্রতা হীরককে ছুঁতে পারে না।
হীরকের কষ্ট পৌঁছাতে পারে না জিনির অন্দরমহলে।
এইভাবেই দুটো পরিচিত মানুষ অপরিচয়ের মোড়কে ঢূকে যেতে থাকে নিরন্তর।
দুই
নিজের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। যদিও এদের প্রোগ্রাম এখনও চলছে। অনামিকার জন্য ভালই। কিছু সময় রিল্যাক্স করা যায়। সব কিছু শেষ হলে আবার স্থানীয় স্পনসরদের সঙ্গে ডিনার করতে হবে। মানেই অনেক কথা বলা, ঘনঘন হাসি বিতরণ। যত পেছোয় ততই ভাল। হাত বাড়িয়ে ডানহিলের প্যাকেটটা টেনে নিল অনামিকা। ড্রেসারের উপরে পা দুটো তুলে দিয়ে চেয়ারের পিঠে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ভাবছিল হীরুদার সঙ্গে কীভাবে ডিল করবে।
এখানেও এসেছে। সামনের সারির কোণায় বসা হীরুদা চোখ এড়ায়নি ওর। ডিসিতেও এসেছিল, সল্টলেক সিটিতেও। এও জানে এই দুই জায়গাতেই হীরুদা কাছাকাছি আসার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু একবার চোখে পড়তেই ভলান্টিয়ারদের পরিষ্কার না করে দিয়েছিল। কড়া নিষেধ ছিল যেন কাছে আসতে দেওয়া না হয়। ডিসির মেন অরগানাইজার সুব্রতদা মজা করে বলেছিল, কি ব্যাপার অনামিকা, আপনার ডাইহার্ড ফ্যান মনে হচ্ছে। একবার অন্তত হ্যান্ডশেক করে দিন।
অনামিকা নাকচ করে দিয়েছে।
সুব্রতদা তখন সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিল। আপনাকে কোনওভাবে বিরক্ত করেছে নাকি? আরেকজন বাঙালিকে বিপদে ফেলতে চাই না। কিন্তু কোনও অসভ্যতা করে থাকলে আমি কপ ডাকতে পারি। আপনার সেফটি…
অনামিকা হাঁ হাঁ করে আঁতকে উঠেছে। না, না সেসবের কোনও দরকার নেই। এমনিতে নিরীহ টাইপ, আসলে আমার আগেকার চেনা।
–ও, পুরনো চেনা ধরে নায়িকার কাছে ঘুরঘুর করতে এসেছে? কতরকমের স্যাম্পল যে থাকে! এরাই এই দেশে বাঙালি নামের বদনাম।
পরের শিডিউল সল্টলেক সিটি। সেখানেও। কিন্তু ধারেকাছে আসতে দেয়নি অনামিকা। সে কি এনজয় করছে ব্যাপারটা? ঠোঁট সরু করে গোল গোল রিং উপরে ছাড়তে ছাড়তে নিজেকেই প্রশ্নটা রাখে অনামিকা। নাকি শাস্তি দিচ্ছে? মানুষ নিজের মনকেও কি পুরোপুরি পড়তে পারে? হয়তো, কিন্তু সেরকম উদ্দেশ্য ছিল না। সল্টলেক সিটিতে আসতে না দেওয়ার পর হীরুদা একটা চিরকুট পাঠিয়েছিল। লিখেছিল— আমাকে শুধু রেখার ঠিকানাটা দিয়ে দে লেখা, আমি আর বিরক্ত করতে আসব না। একটু কষ্ট যে হয়নি হীরুদার জন্য তা নয়। লোকটাকে ভাল লাগত যে তার। ছোটবেলা থেকে হীরুদা হীরুদা বলে কম লাফিয়েছে। দিদির সঙ্গে হীরুদার বিয়ে হোক মনেপ্রাণে সেও কি চায়নি? কিন্তু সেই ভালবাসার লোক দিদিকে এরকমভাবে ভুলে গেল, কাপুরুষের মত আড়ালে লুকিয়ে থাকল এতগুলো বছর! তার নিজের সদ্যকিশোরী জীবনটা যখন চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছিল, কত সন্ধের অন্ধকারে গুমড়াতে গুমড়াতে ভেবেছে হীরুদা নিশ্চয় খবর পেয়েছে। আসবে, খুব শিগগিরি তাদের পাশে দাঁড়াবে। বাবা মাকে বুঝিয়ে বন্দিনী লেখার স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেবে। দিদির সব কষ্ট নিজের করে নেবে। হীরুদাকে সেভিয়ার ভেবে দিন গুনেছে। কিশোরী মনের কী অবুঝ আশা। যখন এরকম কিছুই হল না, সেই আশাভঙ্গের বিষ তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। হয়তো সেইজন্যেই কোনও পুরুষের ভালবাসাতেই বিশ্বাস জন্মাতে পারল না কোনওদিন। সব রাগ সব বিদ্বেষ ধেয়ে গেছে হীরুদার দিকে। ছোবল না দিলে সেই বিষ যেন নামত না লেখার জীবন থেকে। প্রচণ্ড অপমান করতে ইচ্ছে হয়েছে হীরুদাকে, উগড়ে দিতে চেয়েছে সব ঘৃণা। নিউজার্সিতে যখন হঠাৎ দেখা হয়ে গেছিল সেই বোধই কাজ করেছিল। তারপর দিদির ছবিটা মুখের উপর ছুড়ে দেওয়ার পর যখন হীরুদাকে চোখের সামনে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখল, অন্ধের মত ছুটে চলে যেতে দেখল তখন বুকে বয়ে নিয়ে বেড়ানো তিক্ততার জায়গা নিয়েছিল অবসাদ। আর দেখা করতে চায়নি লেখা। হয়ে গেছে তো সব, আর কী দরকার?
কিন্তু হীরুদার এই বারবার ফিরে আসাটাও বিরক্তিকর। যা ভুলে যেতে চায়, সেটাই মনে করিয়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা। কী করবে বুঝতে পারছিল না। দিদি কি দেখা করতে চাইবে? দেখা করলে ভাল লাগবে দিদির কোনওভাবে? প্রথমে মনে হয়েছিল দিদির কাছে কথাটা তুলে পুরনো ঘা উসকে দেওয়ার কী প্রয়োজন। দিদি এখন ভাল আছে, আস্তে আস্তে জীবন থেকে নতুন করে সৌন্দর্য আহরণ করার শক্তি জড়ো করেছে। অতীতের টানে ওকে পিছনে ঘোরানোর দরকার কী! কিন্তু হীরুদা যেভাবে তাড়া করে ফিরছে, সেটাও নিতে পারছিল না আর। তাছাড়া কে জানে দিদির মনে হীরুদার জন্যে আজকেও যদি কোনও জায়গা খালি রয়ে গিয়ে থাকে! দিদিকে ফোন করতে অন্যপ্রান্তে দীর্ঘ নীরবতা। লেখা বলতে উঠেছিল, ছেড়ে দে দিদি, আমিই কোনওভাবে ম্যানেজ করে নিচ্ছি। রেখার শান্ত গলা তখন ফোনের অন্য প্রান্তে ভেসে উঠেছিল আবার। তুই ওকে আমার ঠিকানা দিয়ে দে লেখি। সব গল্পেরই একটা শেষ চ্যাপ্টার থাকা উচিত। এটা আমার আর হীরু দুজনের জন্যেই ভাল।
–ভেবে বলছিস তো? লেখা পুরো সিওর হতে চেয়েছিল। তুই নাহয় দুই-একদিন এটা নিয়ে ভাব। আমার পরের শো হতে এখনও পাঁচদিন।
কিন্তু রেখার ভাবা হয়ে গিয়েছিল। যদি সত্যিই আসতে চায়, আসুক। আমার আর কিছু ভাল-খারাপ হওয়ার নেই। তুই ঠিকানা দিয়ে দে।
দিদি কী চাইছে? এমন তো নয় দিদি এখনও হীরুদাকে ভালবাসে আর এই ঘটনায় সেটাকেই আবার উসকে দেওয়া হবে? ভেবেই কেমন শিউরে উঠেছিল লেখা। অনেক কষ্ট পেয়েছে দিদি, আবার যেন না পায়।
দিদি যখন হ্যাঁ বলেছে, দেখা করবে হীরুদার সঙ্গে। তবে ঠিকানা দেওয়ার আগে ভাল করে বাজিয়ে দেখে নেবে। নাচ শেষ হতে উইংসের ধার দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল এক ভলান্টিয়ারকে। মিনিট পনেরো বাদে যেন গ্রিনরুমে নিয়ে আসে। ভেবেছিল নাচের পোশাকটা বদলে, মেকআপ সরিয়ে হালকা হয়ে নেবে ততক্ষণে। সিগারেটের শেষ ছাইটা টপ করে আঙুলের উপর পড়তে ভাবনাসূত্র থেকে বেরিয়ে দেখল সেসবের আর সময় নেই।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় খুটখুট আওয়াজ।
বাইরে সেই ভলান্টিয়ারের ইতস্তত মুখ। আসতে পারি? আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন ইনি।
পিছনে হীরুদা। চোখ তুলে ভাল করে দেখল লেখা। প্রথম দেখা হয়েছিল তিন সপ্তাহ আগে। এখন দেখে মনে হচ্ছে যেন ঝড় বয়ে গেছে ওর উপর দিয়ে। এসো। থ্যাঙ্ক ইউ ভাই।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে ছেলেটা বেরিয়ে গেল। হীরক কী করবে বুঝতে পারছিল না। গত দুইবার লেখা কাছেও আসতে দেয়নি। আজকে আবার এই ছেলেটাকে দিয়ে ডাকিয়ে আনল। কড়া মেকআপে থাকা অনামিকার মধ্যে লেখাকে খুঁজতে চাইছিল হীরক। রেখাকেও। অনেকভাবে খুব মিল আছে ওদের চেহারায়। সেটা হীরককে আরও বেশি বিহ্বল করে দিচ্ছিল।
–বসো, দাঁড়িয়ে কেন।
–সরি লেখা, তোকে বেশ কদিন খুব বিরক্ত করছিলাম। হীরক যদি আশা করে এর উত্তরে লেখা কিছু বলবে, সেটা হল না। নিস্তব্ধতা ঝুলে রইল দুজনের মাঝখানে। হীরক চেয়ারটা টেনে বসল। আমি বেশি সময় নেব না রে। শুধু যদি রেখার ঠিকানাটা দিয়ে দিস, ব্যস। আর কিছু চাই না।
–এই মাত্র, আর কিছু নয়? ইচ্ছা না থাকলেও বুকের মধ্যে জমে থাকা অন্ধকারগুলো ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে আসছিল। কেন তার আগে শুনতে চাও না আমাদের কথা? জানতে চাও না কীভাবে কেটেছে দিদির এতগুলো বছর?
–চাই, জানতে চাই। কিন্তু বাইরে থেকে না। রেখার কষ্টের ভিতরটা জানতে চাই আমি। ওর সঙ্গে দেখা করে শুনতে চাই।
–বাঃ, বাঃ! কেয়া বাত হ্যায়! করুণা গলে গলে পড়ছে। কেন, কেন দেখা করতে চাও তুমি? জমে থাকা রাগ শ্বদন্ত বের করল আবার। নিজের বিবেকদংশন থেকে মুক্তি পেতে? ব্যস তারপর ড্যাং ড্যাং করে আবার নিজের স্বপ্নের দেশে ফিরে বউয়ের সঙ্গে হাতধরাধরি করে ডেকে বসে কফি খেতে খেতে গল্প করবে, জানো তো আমার যে সেই প্রেমিকা ছিল, ওকে এবার দেখে এলাম। ইস, অ্যাসিডে পুড়ে কী হয়ে গেছে তার চেহারা। বেচারা! নিজের অজান্তেই উত্তেজনায় মুঠো পাকাচ্ছিল লেখা।
শুনতে শুনতে হীরকের মুখে যন্ত্রণার রেখা আঁকিবুঁকি কাটছিল। নিজের ভিতরটা আড়াল করার চেষ্টায় মাথা মাটির দিকে ঝুঁকিয়ে সব মেনে নিল হীরক। তুই এরকম বলতে পারিস। আমি রেখার কাছে পৌঁছাতে পারিনি, পাশে থাকতে পারিনি যখন দরকার ছিল। আসলে সবকিছু এরকম হয়ে গেল। নিজের জীবনের উপর আমার কোনও কন্ট্রোল রইল না। বানের জলে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মত কোথা থেকে কোথায় ভেসে গেলাম। শুনেছিলি কিনা জানি না, এদেশে এসেই আমার একটা বড় অ্যাকসিডেন্ট হয়। একেবারে প্রথম দিনেই। অন্য একটা দেশে প্রথম দিনেই এরকম কিছু হলে মানুষের আত্মবিশ্বাস কীভাবে চুরচুর হয়ে যেতে পারে, নিজে সেই অবস্থায় না পড়লে বোঝা যায় না।
–তুমি কখনও আদালতে গেছ হীরুদা?
প্রশ্নের আকস্মিকতায় চমকে উঠল হীরক। না তো।
আমিও যাইনি। কিন্তু জানো তো বেশিরভাগ সিনেমাতেই কোনও না কোনওভাবে আদালতের দৃশ্য চলেই আসে। আমি ওরকম অনেক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছি। আবার অরূপ তোমার বলে একটা ছবিতে উকিলও হয়েছিলাম। সেই আইনি অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তুমি বেশ সাজিয়েগুছিয়ে নিজের স্বপক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছ। জাজের সামনে এরকম সাফাই গাইলে সাজা মকুব নিশ্চিত। কিন্তু এখানে আমি তোমার বিচার করতে বসিনি হীরুদা। কেন বলছ এইসব?
এতগুলো কথা বলে লেখার নিজেরই অবাক লাগছিল। হীরুদার সঙ্গে গল্প করার কোনও ইচ্ছা তো ওর ছিল না। তবে কি এত রাগ জমা ছিল যে লাভাস্রোতের মত বেরিয়ে আসছে? মুখ থেকে বেরোনো প্রতিটা শব্দে বিদ্রূপ ঝরে ঝরে পড়ছিল। মানুষের ভাবনা বা আবেগের প্রচণ্ডতা একটা শরীরী ভাষা তৈরি করে। পোশাকের আবরণে তার অনেকটা আড়ালে চলে যায়। লেখা এখনও নাচের পোশাকে। জরির কাজ করা গোলাপি কাঁচুলি, বুক আর পেটের অনেকটাই উন্মুক্ত। নাভির বেশ নিচ থেকে সাদা আর গোলাপি রঙের ঘন জরির বুনোটের ঘাঘরা। ড্রেসারের উপর পা তুলে দেওয়ায় হাঁটু অবধি উঠে এসেছে। মঞ্চের পোশাক বদলে নেওয়ার সময় পায়নি। লেখার আবরণহীনতা সর্বশরীর দিয়ে শীতল ঘৃণা ছড়িয়ে দিচ্ছিল ইথার তরঙ্গের মত।
হীরক থতমত খেয়ে চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। নিজেকে জড়ো করে উঠে দাঁড়াল। ঠিক বলেছিস, কী লাভ এসব বলে। আমাকে ঠিকানাটা দিয়ে দে, আমি চলে যাই।
লেখার মনে হল সে যেন তার অভিনীত সিনেমার কোনও ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যে পৌঁছে গেছে। যেখানে খলনায়ককে একবারে মেরে ফেলার নিয়ম নেই, তাহলে নাটক জমে না। কিন্তু এটা কোনও ছবির দৃশ্য নয়। লেখা কোনও নাট্যমুহূর্ত তৈরি করতে চায় না। আবার কী যে চায় সেটাও কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। হীরক কিছু বলতে চাইলে ওর প্রতিটা কথাকে কেটে টুকরো টুকরো করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে, অথচ মনের কোনও একটা অংশ কান পেতেছে শুনবে বলে। যেন শুনলে একটা ভেঙে যাওয়া বিশ্বাসকে আবার শক্ত পায়ে দাঁড় করাতে পারবে। ছটফট করতে করতে লেখাও উঠে দাঁড়াল। নিজের ব্যাগ থেকে একটা চ্যাপ্টা বোতল বের করে ঢেলে দিল গলায়। হাতের পেছনে ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা পানীয় মুছতে মুছতে হিসহিসিয়ে উঠল লেখা। দেখেছ আজকে তোমার কী ভীষণ তাড়া হীরুদা। যখন দিদি যন্ত্রণায় ছটফট করেছিল, তখন কোথায় ছিলে? কুম্ভকর্ণের ঘুম দিচ্ছিলে? লজ্জা করে না এত বছর পরে সেই দিদির সঙ্গে দেখা করার জন্য হঠাৎ এভাবে জেগে উঠতে?
–লজ্জা করে লেখা, ভীষণ লজ্জা করে। নিজেকে করুণাও করতে পারি না। অথচ আমি যে আগুননদী পার করেছি সেটাও তো মিথ্যা নয়। এই দেশে এসে প্রথম তিনটে মাস বিছানায়। টাকাপয়সা কিচ্ছু নেই, সবকিছু অন্যের দয়ায়। ক্লাস করতেও পারিনি। তবু সব ভুলে শুধু রেখার কথা ভেবেছি। ভেবেছি কিন্তু কোনও খবর পাইনি, একটাও চিঠির উত্তর আসেনি। রেখার যে কিছু হয়েছে সেটা জানতেও বছর পেরিয়ে গেছে। যখন জানলাম, তোরা আর দুর্গাপুরে নেই। কোথায় গেছিস কেউ বলতে পারল না।
–সত্যি হীরুদা? দিদির কথা এত ভাবতে তুমি? খুব চেষ্টা করেছিলে আমাদের খোঁজার? যখন জানলে তখন কেন আসতে পারলে না দিদির খোঁজে?
–কীভাবে দেশে যাওয়ার সুযোগ পেতাম বল? স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছিলাম, কোনওমতে প্যাসেজ মানি জোগাড় করে। কেমন করে যেতাম? টাকা কোথায়? প্রথমবার দেশে ফিরলাম দুবছর বাদে।
–আমরা যে তোমার জন্য অপেক্ষা করে বসেছিলাম হীরুদা। একথা বলতে চায়নি লেখা। এমনকি দিদি অপেক্ষা করেছিল কিনা সেটাও ওর জানা নেই। দিদি তো কিছু বলেনি। কক্ষনও। দিদি যেন পুরো পৃথিবীটাকে কয়েক হাত দূরে দাঁড় করিয়ে নিজের মধ্যে ডুব দিয়েছিল। কিন্তু লেখা নিজে ভীষণভাবে চেয়েছিল হীরুদা আসুক। মনে হয়েছিল ওই একজন এলে অন্তত তার বন্দিদশার অবসান হয়।
–তাহলে রেখা কেন কোনও চিঠি দিল না? আমি অপেক্ষায় ছিলাম কতদিন। একটাও চিঠি পাইনি। না কোনও খবর।
–তার মানে তোমাকে চিঠি দিলে তুমি আসবে এই ভরসা ছিল না। দুবছর বাদে এসেও তো দেখা করতে পারতে।
এই সত্যিটাই তো হীরককে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কী উত্তর দেবে এর?
নিরুত্তর হীরক লেখার মনে একটা হিংস্র আনন্দ জাগাল। কোনও সদুত্তর নেই জেনে অবসাদ। চোখটা কটকট করছিল। ব্যাগ থেকে লেন্সের কৌটোটা বের করল। ড্রেসারের সামনে এসে অভ্যস্ত আঙুলের ডগায় একটা একটা করে দুই চোখের লেন্স বের করে কৌটোয় ভাসিয়ে দিল। মিনিট তিনেক লেগে থাকবে। ফুলঝুরির মত কথারা ঝরে পড়ে নৈঃশব্দের অন্ধকার গ্রাস করেছিল ওদের।
কৌতূহল নয়, হুল ফোটানোর যন্ত্রণা নিয়ে নিস্তব্ধতা ভাঙল লেখা। বিয়ে করেছ নিশ্চয়?
–হ্যাঁ। হীরক জানে ওটাই সত্যি। এই ঘটনা অস্বীকার করার উপায় নেই।
–বাচ্চা?
–হ্যাঁ, মেয়ে।
–কত বড় হল?
–বছর আটেক।
লেখার হাসিটা কাঁচের টুকরোর মত ছিটকে ছিটকে এসে বিঁধল এবার হীরককে। তাহলে কিসের জন্য এই দুঃখের প্রহসন? আঙুলের কড় ধরে গুনতে গুনতে বলল লেখা, হিসেবমতো প্রথমবার দেশে ফিরেই দিদিকে না খুঁজে তুমি বিয়ের পিঁড়িতে বসে গেলে। খুব বাজারদর নিশ্চয় তোমার তখন? মেয়ের বাবা-মারা একেবারে হামলে পড়েছিল বোধহয়, তাদের হাত ছাড়িয়ে একটা মুখ জ্বলে যাওয়া মেয়েকে কেন খুঁজতে যাবে, তাই না? মানাতও না তোমার সুন্দর ম্যানিকিওর করা জীবনে।
কেউ যেন হীরকের গলার ভিতরটা শিরিষকাগজ দিয়ে ঘষে দিয়েছে। সেরকম ঘ্যাশঘ্যাশে গলায় অস্ফুটে বলল হীরক, মানুষ পরিস্থিতির শিকার হয়ে যায় লেখা। মনে যা করতে চায়, জীবনে সেটা করা হয়ে ওঠে না।
গলার ওঠাপড়া ভালই নিয়ন্ত্রণ করে লেখা। হাজার হোক অভিনেত্রী। হাতুড়ির নেমে আসার মত শব্দগুলোর অভিঘাত। ভীরু কাপুরুষেরাই শুধু এভাবে কথা বলে হীরুদা। আসলে তুমি দিদিকে কোনওদিন ভালবাসোনি। দিদির রূপে অন্ধ ছিলে। সেটাই যখন চলে গেল, তখন আর সেই মেয়েটার কী দাম তোমার কাছে?
মানুষ যা করে সেটাই একমাত্র সত্যি। যে কথা মনের মধ্যে জমে থাকে, ভাবনার পরতে পরতে জড়াতে থাকে নিজের মনে, তার কোনও বাস্তব নেই। কিছু করাটা ঘটনা হয়ে অতীতের পথে যাত্রা করতে পারে। বলে দেওয়া কথা জীবনের চিত্রনাট্যের অংশ হয়ে যায়। কিন্তু না বলা কথারা জমে পাহাড় হয়। সেই পাহাড়ের তলায় চাপা পড়া মানুষের মত অসহায় বোধ করছিল হীরক। পাশে গিয়ে না দাঁড়ানোটাই সত্যি। তারপর একযুগ বসে এই নিয়ে ভাবলেও কিছু বদলানো যায় না। সেই অনুশোচনাই তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে এতদিন।
–যদি বলি ভয় পেয়েছিলাম সেদিন?
–ওই হারামি বীরেন চ্যাটার্জীকে? তোমারও লাশ ফেলে দেবে সেটাই ভাবলে বুঝি?
–না, নিজেকেই। যদি রেখার এই অবস্থা সামনে থেকে দেখে সহ্য করতে না পারি? যদি আমার মধ্যে নিজের অপূর্ণতার ছায়া দেখে রেখা আরও ভেঙে পড়ে।
–এইটাই ভেবে ভেবে মাথা থেকে বের করেছ এতদিনে? খুব ধারালো ভঙ্গিতে কথা বলে লেখা। লাঠি দিয়ে মাকড়সার জাল ছিন্নভিন্ন করার মত। ওসব কিচ্ছু নয় হীরুদা। আমি বলছি তুমি কেন আসোনি। কীভাবে বিয়ে করবে অ্যাসিডে পুড়ে কুৎসিত হয়ে যাওয়া একটা মেয়েকে। সবাই যখন গোটা গোটা বউ বগলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তুমি কীভাবে এরকম আধখাওয়া জ্বলে যাওয়া চেহারাকে তোমার স্ত্রী বলে মেনে নেবে? বলতে বলতে হিংস্র হয়ে যাচ্ছিল লেখা। রাত্রে বিছানায় শুয়ে বউয়ের গালে হাত বোলাতে গিয়ে কুঁকড়ে যাওয়া চামড়া তোমার হাতে ঠেকবে, ভালবাসারা লেজ তুলে দৌড় দেবে না? বোতল থেকে আবার ঢকঢক করে গলায় ঢালল লেখা। মুখের বিকৃতিটা মনের জ্বালা না মদের ঝাঁঝ বলা মুশকিল, কিন্তু প্রতিটা শব্দে সেটা ছড়িয়ে পড়ছিল। তার চাইতে প্রেমিকার সুন্দর মুখ মনে রেখে অন্ধকার বিছানায় আত্মমৈথুন অনেক বেশি সুখের। নিরাপদ। দায়িত্বহীন।
–তোর কথাগুলো কঠিন, কিন্তু অস্বীকার করার ক্ষমতা নেই। আমি দিনের পর দিন নিজের সঙ্গে কানামাছি খেলেছি। মনের মধ্যে আমার রেখাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় আসল রেখার থেকে পালিয়ে বেরিয়েছি। কিন্তু মানুষ কত পালাবে বল? দিনে দিনে পালাবার চৌহদ্দিটা ছোট হয়ে আসে।
–আমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা তো আচমকা, একদমই হঠাৎ। দেখা না হলে কী করতে?
–সারাজীবন নিজের থেকে পালিয়ে থাকা যায় না। এভাবে বেঁচে থাকতে পারছিলাম না। কিছু একটা করতেই হত। আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম।
–তুমি ঘণ্টা করতে। তোমার মত ছেলেরা কী করতে পারে আমি খুব ভাল করে জানি। দিদি যখন তোমার জীবন থেকে মুখ লুকিয়েছে, তোমার কি ঠ্যাকা পড়েছে নিজের গুছানো সংসার উজাড় করার? বেশি হলে বউয়ের পাশে শুয়ে শুয়ে পুরনো প্রেমিকার কথা ভাবতে। কিন্তু দিদির ওই ছবি দেখার পর তোমার সে সুখ যে ঘুচে গেছে বরাবরের মত। তাই না হীরুদা? তাই না? এখন চোখ বুজলে আর তোমার লুকোনো প্রেমিকার মুখ খুঁজে পাও না, তার বদলে একটা বীভৎস ধংসস্তূপ। পালাবে কোথায় হীরকবাবু?
–মানুষ ভুল করে। শোধরানোর চেষ্টা করতে নেই?
–খুব গুছিয়ে কথা বলো তুমি হীরুদা। একসময় নিজেকে বুঝিয়েছিলে যে দিদিকে খুঁজে বের করবার তোমার কোনও দরকার নেই। এখন আবার মনে হচ্ছে দেখা না করলে তোমার রাতের ঘুম হবে না। তাই না?
লেখা যদি কোনও জবাবের প্রত্যাশা করে, সেটা পেল না।
–বলো, চুপ করে আছ কেন? আমার জানা দরকার দিদির সঙ্গে দেখা করে তুমি কী করবে? তোমার জন্য দিদির জীবনে আবার কোনও আঘাত নেমে আসুক আমি চাই না। অনেক কষ্টে এতদিন বাদে কিছুটা হলেও দিদিকে বের করেছি।
–আমি নিজেও জানি না। ওর সঙ্গে দেখা করাটা যে জরুরি সেই কথাটা বুঝি। পরিণতি জানা নেই। হয়তো রেখাকে বোঝাতে পারব আমি ভালবেসেছিলাম। তার মধ্যে কোনও ছলনা ছিল না। কাপুরুষরাও ভালবাসে। তাদের ভালবাসায় জোর কম থাকতে পারে আমার মত। কিন্তু এত বছর বাঁচিয়ে রাখার গভীরতা তো ছিল। কী জানি রেখার কাছে তারও কোনও মূল্য থাকতে পারে।
ইতস্তত করছিল লেখা। একদিন যাই করে থাক, আজকের আবেগটা হয়তো মিথ্যা নয়। এই হীরুদাকে ও চেনে। যে দিদির আঙুল কেটে গেলে নিজের হাত চেপে বসে থেকেছে। হঠাৎ গুণদীপের কথা মনে পড়ে বুকটা বেজে উঠল লেখার। নিজের ভালবাসাকে দাঁড় করিয়ে চলে গেছে, অন্যের ভালবাসা মেপে আর কী করবে লেখা। হীরুদা দেরিতে হলেও ফিরতে পারছে, তার তো ফেরবারও কোনও উপায় নেই। এই ভাবনাটা লেখাকে প্রথমবারের মত দুর্বল করে দিল। চেয়ারে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকা হীরকের কাঁধে হাত রাখল আলতো করে। নরম গলায় বলল, ঠিক আছে হীরুদা। আমি আগে দিদিকে জিজ্ঞেস করে জানি, ও দেখা করতে রাজি আছে কিনা। হ্যাঁ বললে, আমি তোমাকে ঠিকানা পাঠিয়ে দেব।
–কবে?
–হয়তো কাল। তোমার ফোন নাম্বারটা রেখে যাও। আমি জানিয়ে দেব।
একটা নিঃসঙ্গ ঘরের দরকার এখন। একটু বাদেই এখানকার লোকজন খোঁজ নিতে এসে যাবে। তার আগে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চায় অনামিকা। গোপন ক্ষততে হাত বোলানোর একটু সময়। ব্যাস্ততা গলায় বাজল এবার। তুমি এখন যাও হীরুদা। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।
[আবার আগামী সংখ্যায়]