সুবীর সরকার
১.
কবেকার কোন এক হেমন্তের হাটে হেমকান্ত দেখে ফেলেছিলেন সেই জোড়া কৈতর। আর হাটে ঢুকে পড়া মেয়েরা তাদের শরীরে নাচ নিয়ে শুরু করেছিল গান—
আরে নবরঙ্গের ময়না
ময়না না যান গৌরীপুরে রে
নাচের পর নাচ গানের পর গান চলে, চলতেই থাকে হেমন্ত জুড়ে। মাঠে মাঠে সোনার ধান।
মানুষের ঘরবাড়ি থেকে দৈনন্দিন কথাবার্তা ভাসে।
হিমে ভেজে খোলানের নিঃসঙ্গ আখা।
দূরে কোথাও আগুন জ্বলে ওঠে।
আগুন ঘিরে মানুষের ছায়া আবছায়া।
আল ও আলি দিয়ে দৌড়ে পালায় হেমন্তের ছাইবর্ণ শৃগাল।
রহস্যময় মনে হয়, মনে হতে থাকে দূরে কাছের গ্রামদেশ।
মস্ত চাঁদ ওঠে। জোড়াদিঘির জলে চাঁদ আর সুপুরি গাছের ছায়া।
কোথাও পুঁথি পড়া হয়।
আর গান জেগে ওঠে—
বাপরে বাপ কি জাড়
মাওরে মাও কি জাড়
জাড়ত কাপে দেখং এল্যা
দীন দুখীর সংসার
এভাবে জীবন সেজে ওঠে। জীবন প্রবাহিত হয়।
জন্ম আর মরণের ঘোর জাগিয়ে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন হেমকান্ত।
আর হেমন্তের মাঠে খেতে হাহাকারের মতন ছুটে যায় গান—
ওরে মানুষের দেহা
পবন গেইলে হবে মরা
২.
হেউতি ধান, পাখির পালক, শেষ হেমন্তের নদী, ধান নিয়ে ঘরে ফেরা কৃষক, নির্জন কলাগাছের পাতা— এই সব দৃশ্যের মায়া আর ম্যাজিক কেমন নিরিবিলি করে দেয়।
এই সব আসলে চিরকালীন, আবহমান।
যেভাবে জীবনের পর জীবন মানুষ বাঁচে, মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়।
পুরনো মানুষ হারিয়ে যায় এই মরপৃথিবী থেকে।
নূতন মানুষ বেঁচে থাকাটাকে ছুঁয়ে থাকে।
জন্ম জন্ম জুড়ে এ এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
ছয় নদী আর নয় ফরেস্ট জুড়ে জুড়ে গল্প নির্মিত কিংবা বিনির্মিত হতে থাকে। শিমুলগাছের শরীরে নখের আচড় রেখে আসে চিতাবাঘ।
হাতির পাল নেমে আসে উত্তরের ধানবনে।
নদীর শিথানে খুব নির্জন হয়ে বসে থাকে সেই আবহমানকালের বগা-বগি।
এই জীবন তো আদতে এক ফাঁদ।
আমরা সবাই “ফান্দে পড়িয়া কান্দি”!
আর কার্তিকের কুয়াশায় ভেসে আসে গান—
চাষার মুখত আর
নাইরে সেই গান।
জীবনের অদ্ভুত এক মায়া আছে। দূরাগত হাওয়ায় বুঝি জীবনেরই ঘ্রাণ ভেসে আসে! কত কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। গল্প হয়। মানুষের জীবন জুড়ে না ফুরোনো কত গল্প। রতিকান্ত পাইকারের গল্পে কখন বুঝি মিশে যেতে থাকে হাতি জোতদারের হলুদ খামারবাড়ি। আমি নদী পেরিয়ে, চরের পর চর পেরিয়ে হেঁটে যেতে থাকি এরাজ ধনীর জোতে। এইসব আসাযাওয়ার মাঝখানে ছায়া ফেলে জোনাকির আলো। কোথাও দোতারা বেজে ওঠে। দেহতত্ত্বের গান উঠে আসে আর ঘুরে বেড়াতে থাকে টাড়ি বাড়ি নদী উপত্যকা জুড়ে।
এভাবেই জীবন কীভাবে বুঝি উদযাপন হয়ে ওঠে!
৩.
সব হাট কি একরকম! সোমবারের হাটের ভেতর কি খুঁজে পাওয়া যাবে বুধবারের হাট! তামারহাটের রঙের সঙ্গে কি পুরোপুরি মিল থাকা সম্ভব রতিয়াদহ হাটের! ছত্রশালের হাটের পাখিদের কি দেখা মেলে পানবাড়ির কোনও এক শনিবারের হাটে!
সব হাট একরকম হয় না। সব গান একরকম হয় না।
সব গঞ্জ আর গাং একরকমের হতে পারে না।
প্রবেশ আর প্রস্থান দিয়ে এক একটি হাটপর্ব রচিত হতে থাকে। আর লোকমান পাগলার হাটে ধুলোর ঝড়সমেত ঢুকে পড়ে জোড়ামহিষ। গদাধর নদীর কোণ বা চর থেকে বাথান ভেঙে এরা বুঝি চলে এসেছে এই হাটে ভেতরে। সমস্ত হাট জুড়ে একটা হুড়াহুড়ি লেগে যায়। মানুষের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। তখন কোথায় ইয়াকুব ব্যাপারি কোথায় মহিউদ্দিন ওস্তাদ কোথায় লোকমান! ভরা হাটের কোলাহল থেকে সরে আসতে আসতে ময়কান্ত মৈশাল তখন খুঁজতে শুরু করে বাথানপালানো সেই জোড়ামহিষদের। তার হাতে দীর্ঘ পেন্টি। মাথা গামছা দিয়ে পাগড়ির মত করে বাঁধা। প্রায় তিনকুড়ির পেশিবহুল সুঠাম শরীরের পেশিগুলো একত্রিত করে ময়কান্ত তার কণ্ঠে তুলে আনেন মহিষের কণ্ঠের আকুতি। এই ডাক শুনে সেই জোড়ামহিষ কেমন থমকে দাঁড়ায়। তাদের বড় বড় চোখে কেমন মেঘের ছায়া! একটু বাদে দেখা যাবে সেই জোড়ামহিষ অদ্ভুত আহ্লাদ নিয়ে হেলেদুলে ময়কান্তর পিছনে পিছনে সেই বাথানের পথ ধরে ফেলেছে। গদাধর নদীর কোণ বা চরের খুব অন্দর থেকে ভেসে আসছে হাহাকার ভরা গানের সুর—
আরে ও মৈষের দফাদার ভাই
ডালা সাজাও ডালা সাজাও
চল মৈষের বাথানে যাই রে
ময়কান্ত তার জোড়ামহিষ নিয়ে বাথানে চলে যেতে থাকে। কিন্তু হাট ভেঙে যায়।
৪.
ইয়াকুব ব্যাপারি মহিউদ্দিন ওস্তাদ লোকমান পাগেলাকে ভুলে গিয়ে আপাতত আমরা ঢুকে পড়তেই পারি বালাজানের হাটে। গঙ্গাধরের বাতাসে নদীর বালু উড়ে আসছে হাটের মস্ত খোলের ভেতর। শরীরভর্তি বালুকণা মেখে গরুহাটির উত্তর শিথানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সাজু চোরা। না, সাজু চোর নয়। তার নাম সাজু মোহাম্মদ। হাটে হাটে গরুর দালালি করে বেড়ায়। আর “চোর চুন্নি” পালাগানে সাজু চোরের ভূমিকায় অভিনয় করে। তার শরীরের পরতে পরতে তীব্র এক নাচের ছন্দ লুকিয়ে আছে। সাজু চোরার পালা দেখার জন্য মানুষ হামলে পড়ে গানবাড়িতে। সাজু মোহাম্মদকে এখন আর কেউ চেনে না। সবাই সাজু চোরাকে একনামে চেনে। সাজু যখন নেচে নেচে শরীরে অদ্ভুত পাক দিতে দিতে গেয়ে ওঠে—
ও কি হায়রে হায়
আজি মনটায় মোর পিঠা খাবার চায়
তখন সমগ্র গানবাড়ি জুড়ে কী এক উন্মাদনা!
সাজু চোরা ছিল গানমাস্টার মঈনুদ্দিনের শিষ্য।
মঈনুদ্দিন আবার ছিল আলাউদ্দিন এমেলের সাকরেদ। সারাজীবন এই গান, এই নাচ, রাতের পর রাত গানবাড়ি নিয়েই জীবন কাটে সাজু চোরার।
গরুর দালাল সাজু চোরা গরুহাটির ভেতর দাঁড়িয়ে কী ভাবছিল! রহস্যমোড়া গানবাড়ির কথা। নাকি সওদাপাতি নিয়ে বাড়ি ফিরবার কথা! তার শরীর জুড়ে নাচের ছন্দ ক্রিয়াশীল থাকে আর হাটের অন্ত মধ্যে সাজু ছড়িয়ে দিতে থাকে গুনগুন সুরের কোনও এক গান, যা দূরাগত হওয়ার ডানায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে সমস্ত হাটের পরিসরে—
ওরে ফুলবাড়িত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিতে যামো হামরা গরুর গাড়িত চড়ি
এইভাবে পুরনো হাটপর্ব শেষ হয়ে যায়। নূতন নূতন হাটগুলোর হাট হয়ে উঠবার জন্যই হয়তো বা!
৫.
এভাবে মাঠে মাঠে খুব একা হয়ে উঠতে গিয়ে নির্জন ঘোড়াটির পিছে পিছে আমিও হাঁটি। আমার শরীরের দুলে ওঠায় খুব একা আর একক এক সঙ্গ নিঃসঙ্গতা জড়ানো পরিক্রমণ আছে।
আসলে আমরা ভেতরে ভেতরে খুব একাই।
নাচ গান বাদ্য বাজনার এই দেশ দুনিয়ায় আমাদের আস্ত এক বেঁচে থাকাটাই একাকিত্বের অদ্ভুত এক ম্যাজিক দিয়ে জড়ানো।
কোথাও একা খুব একলা এক পাখি ডেকে ওঠে তীব্র এক হাহাকার নিয়ে। সেই হাহাকারের ভেতর আমি গুঁজে দিতে থাকি সোমবারের হাট, হলুদ লাটিম আর খুব একাকিত্ব নিয়ে জেগে থাকা সীমান্ত শহরের নির্জন হাসপাতাল। আর একাকিত্বের ভেতর গান বাজে।