কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
কে কাকে কতখানি ভালোবাসে, আদৌ ভালোবাসে কিনা সেটা প্রমাণ করার খুব বেশি পরীক্ষা পৃথিবীতে নেই। যে ক’টা আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সেই ভালোবাসার লোকের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া।
কবিরাজমশাই যখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে বলে দিলেন, কানাইয়ের – যার ভালো নাম শ্রীমান কৃষ্ণকান্ত চক্রবর্তী, জন্মের পরে সাড়ে আট বছর ধরেই যে নানারকম অসুখে ভুগছে, প্রথমে বসন্ত, তারপর পীতরোগ, তারপর নিউমোনিয়া, তারপর টাইফয়েড (নাকি ম্যালেরিয়া?) — আর বেশিদিন বাঁচার আশা নেই, মেরেকেটে মাসছয়েক, আর সেই খবর যখন মুখে মুখে সারা গ্রামে চাউর হল তখন ভালোবাসার দুধজল আলাদা হয়ে গেল। প্রমাণ হয়ে গেল, কারা কানাইকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে, কারা শুধু ভালোবাসার ভান করে।
দেখা গেল বেশিরভাগ লোকেই কানাইকে ভালোবাসে। কারণ কানাইকে না ভালোবাসার কোনও কারণই নেই। কানাই কারও সঙ্গে হেসে ছাড়া কথা বলে না, কুকুরের লেজে পটকা বাঁধে না, স্কুলে যাওয়ার পথে কারও ফলের বাগানে ঢিল ছোঁড়ে না। ছুঁড়বেই বা কী করে, কানাই স্কুলে যায়ই না, সারাদিন হয় জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে নয় বাগানে ঘুরে বেড়ায়, মাঝেমাঝে শরীর দুর্বল না থাকলে পুকুরধারে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে নিতাই টুকাই বুলুর ঝাঁপাঝাঁপি দেখে। বটের ঝুরি ধরে কেমন সাঁআআ করে একেবারে মাঝপুকুরে গিয়ে পড়ে ওরা।
মাঝেমাঝে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধলে ওরা কানাইয়ের দ্বারস্থ হয়। আমি ওর থেকে বেশি দূর গেলাম না রে? কানাই ঘাটের একেবারে শেষ শুকনো সিঁড়িটায় নেমে এসে, হাঁটুতে ভর দিয়ে শরীরটা যতটা সম্ভব এগিয়ে, চোখ সরু করে সকলের ঝাঁপ পরীক্ষা করে। নিতাই ফার্স্ট, টুকাই সেকেন্ড, আর বুলু . . . লাস্ট শব্দটা কানাই পছন্দ করে না, কাজেই বুলু থার্ড। পরের দিন বুলুকে ফার্স্ট করবে, মনে করে রাখে কানাই।
কানাই মরে যাবে খবর পেয়ে নিতাই টুকাই বুলু রাতে ভাত খেল না।
মাসিপিসিরা তো কাঁদলেনই, কথায় কথায় কাঁদাই তাঁদের স্বভাব। চোখের জল আঁচল চেপে শুকিয়ে বললেন, ‘ভগবানের রাজত্বে কোনও বিচার নেই…’
কথায় কথায় কাঁদা যাঁদের বারণ, তাঁরাও থম মেরে গেলেন।রাজাউজির মারা বন্ধ হয়ে চণ্ডীমণ্ডপে খানিকক্ষণ শুধু তামাকের গুড়গুড় শোনা গেল। ধোঁয়া উড়ে গেল এদিকসেদিক। অম্বিকাচরণ মজুমদার, গ্রামের হাইস্কুলের রিটায়ার্ড হেডমাস্টারমশাই, টাকমাথা নেড়ে বললেন, “ছেলেটার মাথা খুব পরিষ্কার। সুখেনের মতো।”
কানাইয়ের একটা স্টিলের সুটকেস আর সুটকেসের ভেতর একটা কাটা ঘুড়ি, বিঘৎখানেক ন্যাতানো মাঞ্জা, চারটে লালসবুজ গুলি আর জং ধরা একখানা বল্টু ছিল। নিজের মরে যাওয়ার খবর শোনার পর কানাই সুটকেস খুলে সে সবের তলা থেকে খুব সাবধানে হলুদ, কোণা দুমড়োনো একটা ছবি বার করে আনল। পাশাপাশি দুটো মুখ। বাঁদিকের জনের চোখে মোটা চশমা, কালো গোঁফ। ডানদিকের জনের মাথায় ঘোমটা, কপালে টিপ। দুজনেই হাসি হাসি মুখে কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।
এঁদের কখনও দেখেনি কানাই, কিন্তু ও জানে এঁরা কারা। ছবির তলায় সাদা বর্ডারটুকুতে এঁদের পরিচয় কানাই নিজেই লিখে রেখেছে। ধরে ধরে, যত্ন করে, নিজের সেরা হাতের লেখায়। শ্রী সুখেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শ্রীযুক্তা অমলা চক্রবর্তী। শ্রী আর শ্রীযুক্তার মাথায় দুটো বাঁকা চাঁদও ওরই আঁকা।
খোলা সুটকেসের সামনে মেঝেতে বাবু হয়ে বসে বাবামাকে নিজের মৃত্যুসংবাদ দিল কানাই। কোনও হেলদোলই হল না। যেমন ছিলেন তেমন হাসিহাসি মুখে দুজনে কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বিরক্ত হয়ে ছবিটা আবার সুটকেসে ঢুকিয়ে রেখে, আশেপাশে কেউ আছে কি না পরীক্ষা করে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল কানাই।
নিতাইদের রান্নাঘরের পেছন দিয়ে পুরুতমশাইয়ের বাড়ির মোড় থেকে ডানদিকে বেঁকে জটিবুড়ির চাতাল পেরিয়ে পুকুরধার বরাবর হেঁটে গ্রামের একদম উত্তরে এসে পৌঁছল।
*****
একটা ভাঙাচোরা পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারে একটা ভাঙাচোরা বাড়ির আভাস। দেওয়াল থেকে অশ্বত্থচারা বেরিয়ে হাওয়ায় দুলছে। চারদিকে আগাছার ঘন জঙ্গল। কালিমাখা উল্টোনো হাঁড়ি। বিড়ির অবশিষ্টাংশ। বিড়ির পোড়া তলাটা তুলে দূরে জঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলল কানাই। বুলুর বখাটে দাদাটা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসেছিল আবার।ভুরু কুঁচকে গেল কানাইয়ের। ফুঁ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে, দু’কবজিতে ভর দিয়ে পাঁচিলের ভগ্নাবশেষের ওপরে লাফিয়ে উঠে বসল ও।
এটা কানাইদের বাড়ি। শ্রী বাবা, শ্রীযুক্তা মা এবং শ্রীমান কানাইয়ের, থুড়ি, শ্রীমান কৃষ্ণকান্ত চক্রবর্তীর বাড়ি। গত ন’বছরে এ বাড়িতে কেউ থাকেনি। কানাই কল্পনা করার চেষ্টা করল, ন’বছর আগে বাড়িটা কেমন ছিল। কানাই, কানাইয়ের বাবা মা, সবাই যদি এখন এ বাড়িতে থাকত, তাহলে বাড়িটা কেমন দেখতে হত। পাঁচিলে বসে পা দোলাতে দোলাতে কানাই মনে মনে ভাঙা দেওয়ালগুলো তুলল। ছাদের ফুটো ভরাট করল। ইটের পর ইট বসিয়ে উঁচু পাঁচিল গাঁথল।
ঠিক গেটের পাশে… এদিকওদিক তাকাল কানাই… কোনখানটা গেট ছিল এখন বোঝা অসম্ভব। আচ্ছা ধরা যাক, এই মুহূর্তে যেখানে বসে আছে তার ডানদিকে হাত পাঁচেক দূরে একটা জায়গা স্থির করল কানাই, ওইখানে একখানা আমগাছ পুঁতলে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতে আকাশ ছুঁয়ে, মোটা মোটা ডাল ছড়িয়ে দাঁড়াল মস্ত আমগাছ। ঘাড় তুলতেই ঝাঁকড়া পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে কানাইয়ের চুলে, কপালে, চোখে ঝিলমিল করে দিল।
একটা মোটা দেখে ডাল পছন্দ করে দুটো নারকেল দড়ি ঝোলাল কানাই। দড়ির খড়খড়ে, পাকানো গায়ে হাত বুলিয়ে সন্তুষ্টির ঘাড় নাড়ল। শক্তপোক্ত হয়েছে। দড়িদুটোর শেষ প্রান্তে একটা কাঠের পিঁড়ি বাঁধা। লাফিয়ে পিঁড়িটার ওপরে বসে… নাঃ, এক্কেবারে দাঁড়িয়েই পড়ল কানাই। শক্ত করে ধরল দুদিকের দড়ি। তারপর হাঁটু ভেঙে মাথা নিচু করতেই দড়ি দুলে উঠল, পিঁড়ি নড়ে উঠল, কানাই ভয় পেল না একটুও, আবার হাঁটু ভাঙল, আবার মাথা ঝোঁকাল, আরও জোরে দুলে উঠল দোলনা, উঁচু থেকে ক্রমে আরও উঁচু, আরও আরও উঁচুতে নিতাই, টুকাই, বুলুকে হার মানিয়ে আকাশের বুকে একা উড়তে থাকল কানাই।
ইচ্ছে করে না, তবু মাটিতে নেমে আসতেই হয়। সন্ধের আবছায়ায় আবার সেই পুকুর, পুরুতমশাইয়ের বাড়ি, জটিবুড়ির চাতাল আর বাগান পেরিয়ে কানাই যেই না ওর অন্য বাড়িটাতে, যেটা ওর নয়, কিন্তু যেটাতে ওকে থাকতে হয়, পা রাখতে যাবে, আকাশবাতাস কাঁপিয়ে বাজ পড়ল একখানা।
“কাকে জিজ্ঞাসা করে বাইরে গেছিলে?”
*****
গলার মালিক হলেন কানাইয়ের অতি দুরসম্পর্কের, লতায়পাতায় পিসি, বিধুমুখী দেবী। কানাইয়ের আশু মৃত্যুর খবর বিধুমুখীও পেয়েছিলেন বলাই বাহুল্য, পাড়াপড়শিদের মতো লোকমুখে নয়, খোদ কবিরাজমশাইয়ের কাছ থেকেই। খবর পেয়ে বিধুমুখীর মনোভাব কী হয়েছিল জানার আগে বিধুমুখী সম্পর্কে খানিকটা জেনে নিলে সুবিধে হবে।
গ্রামের সবথেকে বড় পাকাবাড়িতে বিধুমুখী চাকরবাকর নিয়ে থাকতেন। বিধুমুখী বিধবা এবং নিঃসন্তান ছিলেন, কিন্তু ঝাড়া হাতপা ছিলেন না। কারণ গ্রামের প্রতিটি পুরুষ, নারী, বালক, বালিকা এমনকি গরুছাগলেরও শাসনের দায়িত্ব বিধুমুখীর ছিল। একদিক থেকে দেখতে গেলে বিধুমুখী ছিলেন গ্রামের অবিসংবাদিত রাণী। রাজাগজার আমল চলে গিয়েছিল অনেকদিন, কিন্তু খাতায়কলমে গেলেও প্রজাদের রাজার প্রয়োজন অত সহজে যায় না। সকলেই শাসিত এবং শোষিত হতে চায়। বিধুমুখী গ্রামবাসীদের সে চাওয়া মিটিয়েছিলেন।
এত লোক থাকতে বিধুমুখী কেন সে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাঁর স্বামীশ্বশুরের পূর্বপুরুষেরা এককালে ওই গ্রামেরই জমিদার ছিলেন বটে, কিন্তু উত্তরাধিকার-টাধিকার নয়, শাসক হওয়ার দক্ষতা বিধুমুখীর জন্মগত ছিল।
দয়ামায়া, জীবেপ্রেম ইত্যাদি ছিল না, কিন্তু শাসন করার জন্য এসবের থেকে ঢের বেশি জরুরি গুণখানা বিধুমুখী নিয়ে জন্মেছিলেন। তাহল ন্যায়বিচারের প্রতি নিষ্ঠা। যার যতটুকু পাওয়ার কথা ততটুকুই পাচ্ছে কি না, ফাঁকি দিয়ে কেউ নিজের হকের বেশি পেয়ে যাচ্ছে কি না, এসব নিয়ে বিধুমুখীর মাথাব্যথার অন্ত ছিল না।
এতকিছুর সঙ্গে সঙ্গে বিধুমুখী ছিলেন গ্রামের স্কুলের তরুণ মাস্টারমশাইয়ের দূরসম্পর্কের দিদি। মাস্টারমশাই বেঁচে থাকতে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে বিধুমুখীর যে খুব বেশি যোগাযোগ ছিল তেমন নয়, কারণ ন্যায়বিচার নিয়ে দিদি এবং ভাইয়ের মতে বিশেষ মিলত না। যাদের চোদ্দপুরুষে কেউ পাঠশালায় পা দেয়নি, মাস্টারমশাই সে সব ছেলেপুলেকে ধরে ধরে স্কুলে নিয়ে যেতেন, মাইনে দিতে না পারলে স্কুলের পর বাড়িতে ডেকে পড়াতেন। যোগ্যতা এবং অধিকারের তোয়াক্কা না করেই। সমাজের যে একটা সুষ্ঠু সুছাঁদ নিয়ম আছে, সেটা গুলিয়ে দিতে বিধুমুখীর এই দূরসম্পর্কের ভাইটির চেষ্টার অন্ত ছিল না।
সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে ভাইয়ের স্ত্রী মরে যাওয়ার পর, এবং মাসছয়েক পর নিতান্ত অবিবেচকের মতো সাতদিনের জ্বরে ভুগে ভাইও চম্পট দেওয়ায় বিধুমুখীর সামনে একটা বিপদ উপস্থিত হল।
ছ’মাসের ভাইপো কানাই।
সবথেকে খারাপ যেটা হল, সারা গ্রামের লোক ধরেই নিল যে কানাইয়ের দায়িত্ব এবার পিসিই নেবেন। বিধুমুখী দুয়েকবার তাঁর আর কানাইয়ের মধ্যে ‘দূরসম্পর্কের’ বিশেষণটা গোঁজার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেসব কারও কানেই গেল না। বিধুমুখীর দায়িত্বপরায়ণতা, কর্তব্যবোধ, সর্বোপরি মানবিকতার প্রতি গ্রামের লোকের প্রত্যাশা এবং বিশ্বাস এমন অন্ধ ছিল যে তাঁদের তিনি হতাশ করতে পারলেন না। কানাইকে নিজের কাছে এনে রাখতে বাধ্য হলেন এবং বিনা পরিশ্রমে, স্রেফ নিজের দুর্ভাগ্যের জোরে গরিব মাস্টারের ঘর থেকে জমিদারবাড়িতে উঠে আসা এই দূরসম্পর্কের ভাইপোটিকে একটুও ভালোবাসতে পারলেন না।
বিধুমুখীদেবী যখন শুনলেন কানাই আর ছ’মাসের মধ্যে তাঁর ঘাড় থেকে নামতে চলেছে, স্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে একটা মনখারাপও মাথা তুলল।
গ্রামের লোকদের শাসন করা এক, আর কানাইকে শাসন করা আরেক। যতই হোক, গ্রামের লোক পর। এবং প্রাপ্তবয়স্ক। তাঁর ওপর এমন সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল, তিনিই যার অগতির গতি, কানাইয়ের আগে এমন কোনও মানুষকে বিধুমুখী হাতের মুঠোয় পাননি। স্বভাবতই নৈরাশ্যবাদী বিধুমুখীর সন্দেহ হল, আর কখনও পাবেন কি না।
খবরটা পেয়ে, শেষের ক’টা দিনের শাসনের আনন্দ লুটে নিতে তৎপর হলেন বিধুমুখী। সবই কানাইয়ের ভালোর জন্য, বলাই বাহুল্য। বিধুমুখী কানাইয়ের পুকুরধারে যাওয়া বন্ধ করলেন, বারান্দায় বসা বন্ধ করলেন, বিকেলবেলায় দুখানা বাতাসা দিয়ে ছোট একবাটি মুড়ি খেতে ভালোবাসত কানাই, স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে বাতাসা বাদ দিয়ে স্রেফ মুড়ি চালু রাখলেন। রান্নার বামুনঠাকরুন বহুদিনের লোক, সাহস জোগাড় করে বলল, ‘মোটে তো ছ’মাস, এখন একটু ভালোমন্দ…’ জপের মালা ঘোরাতে ঘোরাতে চোখ খুলে তাকালেন বিধুমুখী, ঠাকরুনের মুখের কথা মুখেই শুকিয়ে গেল।
*****
মরে যাওয়ার খবর পেয়ে কানাইয়ের যত না দুঃখ হল, তার থেকে অনেক বেশি দুঃখ হল এইসব বর্ধিত শাসনব্যবস্থায়। বাতাসার দুঃখ কানাই ভুলতে রাজি ছিল, কিন্তু পুকুরধারে যাওয়া বন্ধ হওয়ায়, চণ্ডীমণ্ডপে গিয়ে গম্ভীর মুখে বুড়োদের গল্প শোনা বন্ধ হওয়ায় কানাই সত্যি দুঃখ পেল।
দুঃখ ভোলার জন্য কানাই বাগানে ঘোরা শুরু করল।
বাগান না বলে জঙ্গল বলাই উচিত। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করায় বিধুমুখীর যত উৎসাহ এবং দক্ষতা ছিল, গাছপালার প্রতি তা ছিল না। পড়শিকে কড়া কথা বললে প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। কেউ কুঁকড়ে যায়, কেউ ব্যর্থ রাগে ফুঁসতে থাকে। গাছ উত্তরই দেয় না। কচাৎ করে হাত পা কেটে নিলেও চুপ করে থাকে। তারপর হয় মরে যায়, না হয় আবার সবুজ মাথা তোলে। দুঃখ পেল না রাগ করল বোঝার উপায় নেই। শাসন করে সুখ মেলে না। ক্ষান্ত দিয়ে বিধুমুখী মানুষের প্রতি মনোযোগ দিলেন আর গাছপালারা মহানন্দে বাগানের দখল নিল। আমকাঁঠালতালসুপুরি হইহই করে আকাশপানে ধাইল, বুনোফুল যেখানে সেখানে ইচ্ছেমতো ফুটল, বড় বড় গাছেদের কোমর জড়িয়ে লকলকিয়ে উঠল লতাপাতা আগাছার দল।
ওই বাগানের মধ্যে একটা গোয়ালঘর ছিল। গরুটরু একসময় ছিল হয়তো, এখন আর নেই। সেই পরিত্যক্ত গোয়ালঘরের দিকে কেউ সাপখোপের ভয়ে যেত না, কিন্তু ছ’মাস বাদে যে মরেই যাবে সাপে তার কী ভয়। একদিন গুটি গুটি গোয়ালঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল কানাই। ভাঙা পাল্লা কাৎ হয়ে তেরছা হয়ে দরজা আটকে রয়েছে, ছাদের মাঝখানের ভাঙা টালি দিয়ে টর্চের মতো রোদ এসে পড়েছে মেঝের ওপর। সেই আলোর গোলের ভেতর একটা বাদামি রঙের বল। বলটার গায়ে তুলো তুলো রোঁয়া, রোঁয়ার ডগায় সূর্যের আলো ছিটকোচ্ছে।
ভাঙা পাল্লা ডিঙিয়ে পেরিয়ে গোয়ালঘরের ভেতর পা রাখল কানাই। এগিয়ে গেল বলটার দিকে। বলটা অল্প অল্প কাঁপছে। চারটে ছোট্ট ছোট্ট থাবা, দুটো লতপতে কান, কানাইয়ের কড়ে আঙুলের সমান একটা ল্যাজ। হাত বাড়িয়ে কুকুরছানাটাকে কোলে তুলে নিল কানাই। মার্বেলের মতো দুখানা চোখ তুলে কানাইয়ের দিকে তাকাল ছানাটা, তারপর ল্যাজ নেড়ে, ভেজাভেজা কালো নাকের তলা থেকে টুকটুকে লাল, ছোট্ট, তপ্ত জিভ বার করে কানাইয়ের গাল চেটে দিল।
ছানাকে বুকে জাপটে গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে থমকাল কানাই। ডানদিকের কোণে, অন্ধকার দেওয়ালের গা ঘেঁষে ছায়াছায়া কারা বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে? একমুহূর্তের জন্য ধড়াস করে উঠল কানাইয়ের বুক। শান্তও হয়ে গেল তক্ষুণি। চিনতে পেরেছে কানাই। মানুষ নয়, গরুর জাবনা মাখার মাটির হাঁড়ি উপুড় করে রাখা।
ছানাকে ভালো করে জাপটে দরজাটার দিকে এগোতে গিয়ে আবার থামতে হল কানাইকে। জমা করা পাত্রগুলোর মধ্যে নিশ্চিত কেউ আছে। অন্ধকারটা আরও গাঢ় হয়েছে, স্রোতের মতো বইছে পাত্রগুলোর শরীর বেয়ে। সরে সরে যাচ্ছে। কানাইয়ের হাতের রোম খাড়া হল। হাঁটু দুটো কাঁপছে অল্প অল্প। বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ডটা আছাড় খাচ্ছে। চোয়াল অসাড়। চেষ্টা করে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না।প্রাণপণে কানাই মনে মনে বলে চলল, ‘আমরা কোনও দোষ করিনি ঠাকুর, আমাদের ক্ষমা কর।’ একবার বলল, দু’বার বলল, তিনবার, চারবার, বারবার বলল।
*****
কানাইয়ের আর কোনও দুঃখ রইল না। বাতাসা, পুকুরঘাট, এমনকি গ্রামের উত্তরের সেই ভাঙাবাড়ির বাগানের সেই কাল্পনিক আমগাছের কাল্পনিক দোলনার কথাও কানাই ভুলে গেল। ছানার সঙ্গে দৌড়োদৌড়ি, হুটোপুটি করে কানাইয়ের জীবনের শেষ দিনগুলো হুসহুস করে কেটে যেতে লাগল। নিজের খাবার থেকে, কখনওসখনও রান্নাঘর থেকে বামুনঠাকরুনের চোখের আড়ালে খাবার চুরি করে ছানাকে খাওয়াত কানাই। ডগায় সাদা ছোপওয়ালা বাদামি ল্যাজ নেড়ে মহোৎসাহে কানাইয়ের পেছন পেছন বাগান জুড়ে দৌড়ত ছানা। ক্লান্ত হয়ে গেলে গোয়ালঘরের দরজার ভাঙা তেরছা পাল্লায় হেলান দিয়ে বসত কানাই, ছানাও কানাইয়ের পায়ের কাছে কিংবা কোলে বসত জিভ বার করে। একদিন এইরকম বিশ্রামের সময় ছানার নরম কান মোচড়াতে মোচড়াতে ছানাকে নিজের মৃত্যুসংবাদটা দিল কানাই। ছলছল করুণ চোখদুটো কানাইয়ের চোখের ওপর স্থির হয়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর গলা বাড়িয়ে কানাইয়ের গাল চেটে ওর বুকে আরও বেশি গুটিসুটি হয়ে শুল ছানা।
এই প্রথমবার মরে যাবে বলে আফসোস হল কানাইয়ের।
ছানার খবর যে বাড়ির ভেতরে না যাওয়াই ভালো, সে বুদ্ধি কানাইয়ের ছিল। চিলেকোঠা ঘেঁটে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স জোগাড় করে এনে, তাতে নিজের নতুনপুরোনো জামাকাপড় গুঁজে ছানার বিছানার ব্যবস্থা করল কানাই।বাক্সটা গোয়ালঘরের ভেতরেই রইল। রোজ সকালে ছানাকে বাক্স থেকে বার করে নিয়ে যেত, রোজ সন্ধেয় খেলা শেষ হলে ছানাকে কোলে করে বাক্সের ভেতর পুরে রেখে যেত ও। যাওয়ার সময় ভয়ে ভয়ে তাকাত গোয়ালঘরের কোণের অন্ধকারের দিকে। কোনও কোনওদিন তিনি নিঃসাড় থাকতেন, কোনও দিন নড়ে উঠে কানাইকে নিজের উপস্থিতি জানান দিতেন। জানান দিন বা না দিন, প্রতি সন্ধেবেলা ছানাকে বাক্সের ভেতর পুরে আসার সময় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কানাই হাতজোড় করে বলে যেত, ‘ছানাকে দেখে রেখো ঠাকুর, ওর যেন কোনও ক্ষতি না হয়।’
*****
কানাইয়ের শাস্তির ব্যবস্থা করে বিধুমুখী নিশ্চিন্তে নিজের পুজোপাঠ আর পাড়াপড়শিদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, এমন সময় একদিন পুজোর ঘরে বসে জপের মালা ঘোরাতে ঘোরাতে একটা অদ্ভুত শব্দ তাঁর কানে এল। হাসির শব্দ। শব্দটার সঙ্গে বিধুমুখী পরিচিত ছিলেন, কিন্তু কেউ তাঁর সামনে কখনও হাসত না বলে শব্দটাতে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না।
বিধুমুখী উঠে এসে জানালায় দাঁড়ালেন। অগোছালো, অবিন্যস্ত বাগানে প্রথমে তাঁর কিছু চোখে পড়ল না, অবশেষে পাতার ফাঁকে ফাঁকে কানাই আর কানাইয়ের পিছু পিছু ছুটে বেড়ানো, লাফানো, গড়াগড়ি খাওয়া বাদামি রঙের কুকুরছানাটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সবথেকে বেশি স্পষ্ট হল দৃশ্যের মধ্যেকার উছলানো আনন্দটা। বিধুমুখীর মুখে কোনও ভাবান্তর হল না, কেবল জপের গতি দ্রুত হল।
*****
পরদিন সকালে অন্যদিনের মতোই ঘুম ভেঙে কানাই ছুটল প্রথম গোয়ালঘরের দিকে।কিন্তু সবকিছু অন্যদিনের মতো নয়। দরজার ভাঙা পাল্লা মাটিতে লুটোচ্ছে। ছানার বাক্স রাখা আছে দরজার পাশে। বাক্সের ভেতর কাপড়ের বিছানায় স্পষ্ট ছানার শরীরের ছাপ। ছানা নেই। গোয়ালঘরের এদিকওদিক তাকাল কানাই। প্রাণের কোনও চিহ্ন নেই। অন্ধকারটা পর্যন্ত নিঃসাড়।
বুকের ভেতর দ্রুত হাঁ করতে থাকা আতঙ্কটাকে চাপা দিতে দিতে বাগানে বেরিয়ে এল কানাই। হয়তো কানাইয়ের জন্য অপেক্ষা না করে ছানা নিজেই বেরিয়ে এসেছে বাগানে, হয়তো লুকিয়ে আছে কানাইকে চমকে দেবে বলে, হয়তো… ছানা নয়, অন্য একজন চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কানাইয়ের। সকালবেলার টাটকা শিশির তাঁর পিত্ত কফ বায়ুর ভারসাম্য মাটি করে জানা সত্ত্বেও তিনি আজ বাগানে না এসে থাকতে পারেননি।
কানাইয়ের ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে বিধুমুখী বললেন, ‘রাস্তার কুকুরবেড়ালের সঙ্গে খেলাধুলো করা এখন তোমার উচিত নয়। তাই তোমার ভালোর জন্যই…’
পিসিভাইপো একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। চশমার আড়ালে বিধুমুখীর উত্তেজনায় চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কানাই টের পেল, এই প্রথম ওর বুকের ভেতর একটা কিছু ফুলেফেঁপে উঠছে, যা দুঃখ, কষ্ট, হতাশা, আনন্দ, বিরক্তি, করুণা এসব পুরোনো চেনা অনুভূতিগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
*****
সারাদিন ঘরবন্দী হয়ে থেকে, সন্ধে নামার মুখে কানাই গোয়ালঘরের দিকে গেল। ভাঙা টালির আলোর শেষ রেশটুকু তখনও যায়নি। ফাঁকা বাক্সটার দিকে তাকাল না কানাই। ঘুরে দাঁড়াল অন্ধকারের দিকে মুখ করে।
কোনও সাড়া নেই। জমাট বাঁধা কয়লার মতো চুপ করে রয়েছে অন্ধকার। কিন্তু কানাই জানে, ওর যাঁর সঙ্গে দরকার, তিনি আছেন। আজ একটুও ভয় করল না কানাইয়ের। অন্ধকারের চোখে চোখ রেখে ঘাড় সোজা করে দাঁড়িয়ে রইল কানাই।
আজ অন্ধকারের নীরবতাও যেন বাঙ্ময়। কথা দিয়ে কথা না রাখার লজ্জায় যেন কুঁকড়ে আছে অন্ধকার।
চোখের কোণের ক্রমাগত বাড়তে থাকা জ্বলুনিটা সহ্য করতে করতে, গলার কাঁপুনি যথাসম্ভব স্থির রাখার চেষ্টা করতে করতে কানাই অন্ধকারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আর কিছু চাই না। আর কিছু চাইব না কোনওদিন।’
অন্ধকার নিরুত্তর রইল।
*****
কানাইয়ের খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ হল, মুখেচোখে কালো ছায়া পড়ল। বিধুমুখী ততদিনে ফের ন্যায়বিচারে মন দিয়েছেন তাই তিনি কানাইয়ের এইসব পরিবর্তন নজর করলেন না। বাকিরা করল। শেষের বুঝি এই শুরু, ভাবল তারা। সারাদিন ঘর থেকে না বেরোলেও সকাল আর সন্ধে নিয়ম করে গোয়ালঘরে যেত কানাই। একদিন বাগানের পথ দিয়ে শর্টকাট নিয়ে আসতে আসতে বামুনঠাকরুন দেখল, গোয়ালঘরের দরজার ঠিক ওপারে হাঁটু গেড়ে কানাই বসে আছে, মাথা ঝুঁকে আছে জড়ো হওয়া হাতের ওপর। মৃত্যুপথযাত্রী বালকের বাঁচার শেষ আকুতি বামুনঠাউরুনের বুক ভেঙে দিল।
একটু দেরিতে হলেও কানাইয়ের গোয়ালঘরে যাতায়াত বিধুমুখী নজর করলেন। তাঁর মাথায় একটাই সম্ভাবনা এল, কানাই আবার নতুন কোনও খেলার সঙ্গী জোগাড় করেছে। বিধুমুখী সেই মুহূর্তে ব্যস্ত ছিলেন, মনে মনে স্থির করলেন, আজ দিন শেষ হওয়ার আগে তিনি কানাইয়ের শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।
সারাদিনের ন্যায়বিচারের মাঝে মাঝে শাস্তিদানের প্রত্যাশা বিধুমুখীকে চনমনে রাখল। সকাল থেকে কানাইয়ের ধুম জ্বর এল, কানাই শুয়ে রইল ঘরে। উঠে বাগানে যাওয়ার শক্তিটুকু রইল না।
সন্ধেবেলা বিধুমুখী বাড়ি ফিরে এলেন। পা না ধুয়ে বারান্দায় রাখা কালিপড়া লণ্ঠনের সলতে বাড়িয়ে নিয়ে বাগান পেরিয়ে চললেন গোয়ালঘরের দিকে। দোতলায় নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে জ্বরের ঘোরে কানাই প্রলাপ বকে চলল, ‘আর কিছু চাই না, আর কিছু চাই না……’
*****
পরদিন সকালে কী রান্না হবে জিজ্ঞাসা করতে ঠাকুরঘরে গিয়ে বিধুমুখীকে দেখতে পেল না বামুনঠাকরুন। শোবার ঘরেও না পেয়ে বাড়ির বাকি সব ঘর, ছাদ ঘুরে এসে শেষে বাগানে গেল।‘সব যখন দেখা হল এটাই বা বাদ থাকে কেন’ ভেবে গোয়ালঘরের দিকে এগোল বামুনঠাকরুন। গোয়ালঘরের মেঝেতে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে একটা সাদা কাপড়ের টুকরো। আরও দু’পা এগোল বামুনঠাকরুন। ঠাকরুনের চোখ বিস্ফারিত হল। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হল। বিধুমুখীর অসাড় দেহের চারপাশ থেকে ক্রমশ উঁচু, আরও উঁচু হয়ে উঠে ঠাকরুনের চোখে চোখ ফেলে দাঁড়াল এক প্রকাণ্ড কেউটে। গোয়ালঘরের ছাদের ভাঙা টালি দিয়ে সূর্যের আলো এসে সেই কেউটের ফণায় সোনার মুকুটের মতো চকচক করতে লাগল।
*****
পাশের বাড়ির ঘোষেদের দাদু বছরের পর বছর পক্ষাঘাতে শুয়ে থেকে বাড়ির লোকেদের হাড় জ্বালাচ্ছিলেন, লোকে বলত, সেদিন সকালে বামুনঠাকরুনের চিৎকারেই তিনি অবশেষে হার্ট ফেল করে গঙ্গাযাত্রা করেছিলেন। কেউ কেউ বলত, ঠাকরুনের চিৎকারে পাড়ার সব গর্ভবতী গরুদের নাকি প্রসব হয়ে গিয়েছিল। এসব গুজব হতে পারে। লোকের বাড়িয়ে বলার ক্ষমতা সাংঘাতিক। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা যেটা বাস্তবে ঘটেছিল, সেটার কথা কেউ জানতেই পারেনি। ওই গগনবিদারী আর্তনাদের মধ্যেও, দোতলার ঘরের জানালা খোলা থাকা সত্ত্বেও, কানাই নিশ্চিন্তে, অঘোরে ঘুমিয়ে ছিল।
*****
ঘুম ভাঙতে দেখা গেল কানাইয়ের জ্বর আর নেই। ক’দিনের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেল কানাইয়ের শরীরে ব্যাধিও আর নেই। কানাই এক্কেবারে সেরে গেছে। কবিরাজ ভুল প্রমাণিত হয়ে একটুও অখুশি হলেন না। মাথা নেড়ে বললেন, ‘মানুষের প্রাণ, কে দেয় কে নেয়, কে তার খবর রাখে?’ বামুনঠাকরুনের রাঁধা মাছমাংস পিঠেপায়েস খেয়ে কানাইয়ের শরীরে বল ফিরে এল। নিয়মিত সে পুকুরে গিয়ে নিতাই, টুকাই, বুলুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করত। হেডমাস্টার অম্বিকাচরণ চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডা জলাঞ্জলি দিয়ে কানাইয়ের পড়াশোনার ভার নিলেন। গ্রামের স্কুল থেকে বৃত্তি নিয়ে পাশ করে, শহরের স্কুল, স্কুল থেকে কলেজ, ইউনিভার্সিটি পার করে শ্রী কৃষ্ণকান্ত চক্রবর্তী, আমাদের কানাই একদিন বিরাট মানুষ হল।
*****
এখন কানাই কী করে, কোথায় আছে, এতদিনে বুড়ো হয়ে মরেই গেছে কি না সে খবর কারও কাছে নেই। চণ্ডীমণ্ডপ নেই, কানাইদের ভাঙাবাড়ি আর বিধুমুখীর জমিদারবাড়ি, দুইই প্রোমোটারের গর্ভে গেছে। আগাছারা অবশেষে যুদ্ধে হার মেনেছে, জমিদারবাড়ির অগোছালো বাগান প্লট প্লট করে বিক্রি হয়ে বহুতল উঠেছে।
আশ্চর্যের মধ্যে বেঁচে গেছে শুধু ভাঙা গোয়ালঘরখানা। বেঁচেছে শুধু নয়, ফুলেফেঁপে উঠেছে। এখন সেখানে মা মনসার মার্বেল বসানো চকচকে মন্দির। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তেরা আসেন, নাগপঞ্চমীর ভিড় সামলাতে স্বেচ্ছাসেবীতে কুলোয় না, পুলিস পোস্টিং লাগে। মন্দিরের ভেতরের দেবীর সোনাবাঁধানো ফণায় ঢালা দুধ, মন্দিরের চাতাল পেরিয়ে রাস্তায় স্রোতের মতো বয়। লোকে বলে, এই স্থানে অনেক বছর আগে সত্যি সত্যি এক অতি জাগ্রত নাগমাতার বসত ছিল। মৃত্যুপথযাত্রী একটি বাচ্চা ছেলের প্রার্থনায় খুশি হয়ে তাকে নতুন জীবন দান করেছিলেন তিনি।
Saki-র ছোটগল্প SredniVashtar-এর ছায়া অবলম্বনে
বাঃ! তবে কুন্তলা, একটা জিনিস… অতিপ্রাকৃতর আকর্ষণই কি বেশি আপনার?
এটা আমাকে আরেকজনও পয়েন্ট আউট করেছেন, ক ব। অতিপ্রাকৃতর আকর্ষণ আমার আছে, কিন্তু তাই বলে সবেতে অতিপ্রাকৃতর ছিটে দিতে চাই না। এ গল্পটায় না দিলেও চলত। কিন্তু ওই আরকি, হাইন্ডসাইটে সবই বেশি স্পষ্ট। আপনার মন্তব্য পেয়ে বরাবরের মতোই খুশি হলাম, থ্যাংক ইউ।
আসলে এখানে আপনার তিনটে গল্প পড়লাম, তিনটেতেই অতিপ্রাকৃতর ছোঁয়া। এমনি আপত্তির কিছু নেই, আরও আপনার কলমের গুণে সবই পড়তে চমৎকার লাগে, কিন্তু পাঠক আবার একঘেয়ে না ফিল করে…
না না, ঠিকই করেছেন মনে করিয়ে দিয়ে, আমি খেয়াল রাখব। থ্যাংক ইউ।
আমার কিন্তু বেশ লাগলো।
ধন্যবাদ, রুখসানা।
বেশ আমারও লেগেছে রুখসানা। আমি কুন্তলার লেখার বেশ ভক্ত। আপনি পারলে ওর ননীবালা গল্পটা পড়ে দেখুন। এখানেই বেরিয়েছিল…