মৃণাল শতপথী
লেখক শিক্ষক ও গল্পকার
‘সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে…’
অনেক কথাই তো থাকে, ব্যবস্থার উপরিকাঠামোর তলার নিভৃতে কথারা চুপ করে থাকে। রোজ একটু একটু করে চোখের সামনে নিশ্চুপে একটি দেশ মরে যায়। ‘দ্য পাওয়ার অফ আ গভর্নমেন্ট লাইজ অন পিপল’স ইগনোরেন্স’-এর পরিকল্পনায় শিক্ষার প্রাণরস শুষে শুকনো খোলার মতো একটি প্রজন্মকে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে এই সময়। সত্যি বলতে কি সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাটির প্রতি কেন্দ্র, রাজ্যের কি নিদারুণ অবহেলা, বিস্ময়কর ঔদাসীন্য বুকে কাঁপন ধরিয়ে যায়।
করোনার সেই সময়টাই ধরুন। দীর্ঘ প্রায় দু-বছর স্কুলগুলি বন্ধ। খাঁ খাঁ শ্রেণিকক্ষগুলি, জানালায় মাকড়সার জাল, বেঞ্চগুলিতে পুরু ধুলোর স্তর, শেষ ক্লাসে কষে যাওয়া পাটিগণিতের গুঁড়ো চকের দাগ তখনও লেগে ব্ল্যাকবোর্ডে। সকাল থেকে বিকেল অজস্র পাখির ভিড়ে, তাদের কলকাকলিতে যেমন ভরে থাকে গাছ, স্কুল অঙ্গনগুলি রোজ মুখর থাকে সেভাবে। কেবল রৌদ্রালোকে গাছ বাঁচে না, যে গাছের ডালে পাখি এসে বসেনি, শূন্যতা মেখে থাকে তার ডালপালায়, ছালে-বাকলে। এ রাজ্যের সমতল,পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গলভূমে ছড়িয়ে হাজার হাজার স্কুল। কল্যাণকামী রাষ্ট্র ভাবনার নিরিখে নয়, বিদ্যালয়গুলি তিল তিল করে গড়ে উঠেছে মানুষের শ্রম আর আগামীর স্বপ্নে। একবেলা খাবার জুটলেও তাই দুঃস্থ পিতা হাতে ধরে সন্তানকে স্কুলে পৌঁছে দেন, দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করা শিশুটির স্বর থেমে গেলে উনুনে কাঠ ঠেলতে থাকা মা হাঁক দেয়। স্কুলগুলি রিক্ত পড়ে রইল,ভাঙা পাল্লা দিয়ে তার শ্মশানের বাতাসের মতো হাহাকার বয়ে যায়।
স্কুল বন্ধ। শহরের সচ্ছল অংশ গেল অ্যান্ড্রয়েডের অনলাইন ক্লাসে। জঙ্গল গ্রামের রাত বড় নিশুত। সেখানে টিমটিম করা জ্বলা উপজাতি অধ্যুষিত সরকারি স্কুল হীন-দরিদ্র। কেবল নামটুকু সই করতে পারা মায়ে-বাপে জন খাটতে যায়। ইসকুল-ছাড়া বাচ্চাটিকেও কাজে লাগিয়ে দেয় তারা। জিনিসপত্র আগুনছোঁয়া, সংসারে অতিরিক্ত রোজগারের আরেকজন তো হল! ছেলেটি মাঠে অন্যদের সঙ্গে আলু তুলতে যায়, মেয়েটি কচি হাতে উনুনের বিপজ্জনক আগুন ধরায়, ভাত রেঁধে রাখে। কত নাবালিকার যে বিয়ে হয়ে গেছে এই সময়টাতে। স্কুলের পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেছে। অসুখের আতঙ্কে দিনদুনিয়ার সমস্ত জরুরি কাজ সম্পাদন হয়েছে কেবল লেখাপড়া ছাড়া। শিক্ষাব্যবস্থার ভেতরের যে ভাইরাস তার কোনও এলাইজা টেস্ট নেই!
স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে অসংখ্য শিক্ষা কমিশন গঠন হয়েছে, একের পর এক শিক্ষার অধিকারের আইন, মিড ডে মিলের রমরমা, কেউ এককাঠি এগিয়ে সাইকেল ছাতা জুতো। অথচ পাল্লা দিয়ে কমেছে শিক্ষা বাজেট, বাড়তে থাকে স্কুলছুট। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে আসার পথে ১১ লক্ষেরও বেশি পড়া ছেড়ে দেয়। একটি তথ্যে দেখি, ২০০৬ সালে প্রাথমিকে ভর্তির সংখ্যা ছিল ২২ লক্ষের কাছাকাছি ২০১৬-তে তারাই যখন মাধ্যমিক দেবে, সংখ্যা নেমে গেছে ১১ লক্ষের নিচে! রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট,২০০৯ জোর দিয়েছিল শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতে। বিগত বছরগুলিতে নিয়োগ সংকোচন নীতি, বেপরোয়া বদলি নীতিতে হাজার হাজার স্কুল এক-শিক্ষক অথবা শিক্ষকশূন্য। শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী ২০১০ সাল নাগাদ জুনিয়র হাইগুলি গড়ে উঠতে থাকে। ২ কিমির মধ্যে কোনও হাইস্কুল না থাকলে এই স্কুল যাকে নিউ সেটআপ স্কুল বলা হয়, গড়ে ওঠে। কী অবস্থা স্কুলগুলির? পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে স্কুলগুলি। একটি তথ্য বলছে, উত্তর চব্বিশ পরগণার হাসনাবাদের ১৬টি উচ্চ প্রাথমিক স্কুলের পড়ুয়া সংখ্যা ১১৭ জন, প্রতিটি স্কুলে গড়ে ৭ জন! তাও ধরেবেঁধে, কাকুতি মিনতি করে পড়ুয়া আনতে হয়েছে। কোনও স্কুলে পড়ুয়াই নেই কারণ শিক্ষকই নেই। অতিথি শিক্ষক দিয়ে, প্রাথমিকের শিক্ষক তুলে এই স্কুলে পাঠিয়ে কাজ চালানোর মরিয়া চেষ্টা হয় এবং ব্যর্থ হয়। এ ছবি গোটা রাজ্যের।
পরিকাঠামোহীন চরম অব্যবস্থা। অপ্রতুল ক্লাসঘর। একটি কক্ষে সমস্ত ক্লাস চলছে কোথাও আবার স্কুলবাড়িটিই নেই! একটি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক জানাচ্ছেন, গ্রামের মন্দিরে ক্লাস নেওয়া হত। মন্দিরটির সংস্কারের সময় বাধ্য হয়ে গাছের তলায় কিছুদিন। তারপর কেউ আর এল না, স্কুলটি তুলে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীর মূল্যায়নের কোনও দিগদিশা নেই, শিক্ষকরা আদৌ ঠিকমতো পড়াচ্ছেন কিনা মাপকাঠি নেই, প্রধান শিক্ষক ব্যতিব্যস্ত চাল ডালের হিসেবে,পাশ-ফেল তুলে দেওয়া, বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতি এত জটিল আর ভ্রান্তিমূলক যে শেষ পর্যন্ত তা খাতায় কলমেই থেকে গেছে।
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির বেসামাল অবস্থায় প্রকট হয়েছে আরেক গভীর অসুখ। বিস্মিত বিচারব্যবস্থাকে হতে হচ্ছে অতি সক্রিয়। এবং বিচারপতিদের কেউ কেউ এমন মন্তব্য করছেন তাতে বোঝা যায় শিক্ষাক্ষেত্রের এই বিবিধ দৈন্যদশা সম্পর্কে তাঁরাও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নন। ৩০ জন শিক্ষার্থীর কম সংখ্যক স্কুলগুলি তুলে দিয়ে উদ্বৃত্ত শিক্ষক নিয়োগের নিদান দেওয়া হচ্ছে সঙ্কটে ভোগা স্কুলগুলিতে। সেই অনুযায়ী শিক্ষা দপ্তর নেমে পড়েছে কোমর বেঁধে। এমন ৮২০৭টি প্রাথমিক, উচ্চ-প্রাথমিক স্কুলের তালিকা প্রস্তুত সমাপ্ত। সবচেয়ে বেশি স্কুল বন্ধ হচ্ছে নদীয়া জেলায়, ১১০০, কলকাতায় ৫৩১, উত্তর চব্বিশ পরগণায় ৫৩৮, বাঁকুড়ায় ৮৮৬, বীরভূম ৩২০, দার্জিলিঙ ৪১৮, হুগলি ৩০৩, হাওড়া ২৭৩, জলপাইগুড়ি ২১৬,ঝাড়গ্রাম ৪৭৮, কালিম্পঙ ৩১২, মালদহ ১৪৬, মুর্শিদাবাদ ৩২৬। এই স্কুলগুলি থেকে উদ্ববৃত্ত শিক্ষক সংখ্যা হতে পারে ২৫০০০-২৮০০০। অর্থাৎ শিক্ষাক্ষেত্রে আগামীতে নতুন নিয়োগের কোনও সম্ভাবনা রইল না। কিন্তু এটা যদি সহজ সমাধান হত সমস্যা ছিল না। কথা হল, শেষ দশ বছরের কথা যদি ধরা যায় ছাত্রসংখ্যা কমেছে ধারাবাহিকভাবে। খোদ শিক্ষা দপ্তরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০১২ সালে মোট স্কুলের সংখ্যা ছিল ৭৪৭১৭ তা ২০২২শে এসে দাঁড়িয়েছে ৬৭৬৯৯! একটি জেলা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ১৩টি ব্লকেই স্কুল উঠে গেছে ১১৯২টি এছাড়াও অন্যান্য জেলায় আলাদা আলাদা পরিসংখ্যান রয়েছে। বিপর্যয় নেমে আসছে পাহাড়ের স্কুলগুলিতে। এমনিতেই দুর্গম ঐ এলাকায় ৩০ জন ছাত্র পাওয়াই দুষ্কর। এলাকায় জনবসতি এমনিতে কম, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যেতে অসম্ভব কষ্টসাধ্য, বর্ষায় পাহাড়ি পথ আবার অগম্য হয়ে ওঠে। ফলে এক স্কুল বন্ধ হলে অন্য দূরের স্কুলে যাবার উপায় থাকছে না। এখানেও ৭০০-এর ওপর স্কুল তুলে দেবার পরিকল্পনা সরকারের। তেমন হলে বক্সা পাহাড় হয়ে পড়বে স্কুলশূন্য। রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্টকেও মান্যতা দিচ্ছে না সরকারের এই পরিকল্পনা, যেখানে স্পষ্ট বলা আছে ১ কিমির মধ্যে একটি প্রাথমিক স্কুল থাকা বাধ্যতামূলক। ফলে প্রথমে অব্যবস্থা তৈরি করে স্কুলে ছাত্র কমাও, পরে সেই অজুহাতে স্কুলগুলি তুলে দিতে থাকো, এই ক্রনোলজিটা বোঝা দরকার। আগামীতে শিক্ষক কেবল উদ্বৃত্ত হতে থাকবেন, এমন সময় দূরে নেই যখন শিক্ষক তো আছেন কিন্তু পড়াবার জন্য কোনও স্কুল আর অবশিষ্ট নেই! বেসরকারি স্কুলের রমরমার চোখ ধাঁধানো আলোয় শিক্ষা নেবে আমাদের এক সচ্ছল অংশ, আর শিক্ষাদীক্ষাহীন, অভাব-দারিদ্র্যের অন্য আঁধারে হারিয়ে যাবে বিপুল একটি সংখ্যা।
সবটাই তো অন্ধকার নয়। একেকজন শিক্ষক স্কুল অন্ত প্রাণ হন। ছাত্রছাত্রী, স্কুল প্রাঙ্গণকে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে রাখেন। চমৎকার করে সাজান প্রতিটি ক্লাসরুম, দেয়ালে মনীষীদের বাণী, ছবিতে, রঙে, অক্ষর শেখার সহজ আর নান্দনিক উপায়, মিড-ডে মিলের সুব্যবস্থা, পরিষ্কার জলের ট্যাপ, বাথরুমে ব্লিচিং। স্কুলের মাটিতে হরেক ফুলগাছ লাগান, আলোর মতো ফুটে থাকে তারা। রকমের সবজি ফলন হয়, দ্বিপ্রাহরিক আহারে টাটকা তরিতরকারি পায় বাচ্চারা। অনেক যত্নে মাটি কোপান, জল সিঞ্চন করেন।
দুর্লভ এই পরিসরটুকুও ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
লেখাটা খুবিই ভাল। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
খুব যথার্থ ও প্রাসঙ্গিক।