কয়েকটি লেখা
কৌস্তুভ
তোমার মহাবিশ্বে প্রভু আমি প্রাণাধিক প্রিয় বিষণ্ণ কৌস্তুভ হারাইয়াছিলাম। কবে যে হারাইয়াছিলাম মনে নাই, অথচ পরিতাম… গরল পিণ্ডের মতো ভারী, সকল বাক্য ও প্রতীক অতীত, সকল নিয়তির থেকে অধিক নীলাভ সেই মণি কণ্ঠে পরিতাম। আজ আবার তাহাকে পাইলাম; দেখিলাম পক্ষী ও পত্রের সমস্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নষ্ট হইয়াছে। পত্র পীতাভ হইবার কালে ঝরিয়া যাওয়াই প্রথা, পক্ষী উড়িয়া ফিরিবে এমনই কথিত। অথচ উহাদের কেহই আজ সে নিয়ম মানিবার নহে। পত্র ক্ষণে ক্ষণে পক্ষীর শরীর ধারণ করিতেছে, পক্ষী পত্রের। পক্ষীর অশ্রু জমিয়া শিলা হইয়াছিল, উহাই কৌস্তুভ। বিষণ্ন কৌস্তুভ। এবার তাহাকে আর কণ্ঠে নহে, প্রাণে ধারণ করিব। সমুদ্র-মন্থন শেষে কৌস্তুভ মিলিয়া ছিল, উহাকে ধারণ করিবার জন্য বিপুল জলের মায়া ও আলোড়ন প্রয়োজন ছিল। তোমার মহাবিশ্বে প্রভু সেই বিষণ্ণ কৌস্তুভ ফিরিয়া পাইবার পর মন বলিতেছে পক্ষীর অশ্রু বিনা মহার্ণব নির্মিত হয় নাই… একখানি হলুদ পত্রের মতো তাহাতে ভাসিলাম। পক্ষীর অশ্রুর ভিতর ভাসিলাম…
রথ
সেই কবে থেকে শুনিতাম, সম্ভবত কৈশোরের প্রথম বিষণ্ণতার পর শুনিয়াছিলাম রথ আসিতেছে। প্রস্তরনির্মিত রথ দিগন্তের ওপার হইতে আসিতেছে; দিবসের পর দিবস গিয়াছে… বৎসরের পর বৎসর। ভীত হইয়াছি… দৃষ্টিসীমানার ভিতর রথ প্রবেশ করে নাই; শুধু তার চক্রের ধ্বনি স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতর হইয়াছে। রহস্যময় নেশার প্রহর; নিদ্রার গভীরে অস্ফুট শতদল পিষ্ট করিয়া রথের শব্দ চলিয়া গিয়াছে, তবু রথ আসে নাই। আজ সায়ংকালে সে রথের দর্শন পাইলাম, শিশুর হস্তে যেন মৃৎশকটের রশি রহিয়াছে। তাহার ভিতর কোনও আরূঢ় ব্যক্তি নাই, স্বর্ণ-রৌপ্যের শোভা নাই। সকলই শান্ত; সকলই শোভন। শুধু এক প্রস্তরভুক আলো রহিয়াছে; সে-ই নামিয়া আসিয়া রথচক্র কুরিয়া খাইতেছে। ভাবিতেছি কী ভীষণ হইবে সে প্রহর, চক্রহীন রথ তামস অরণ্যে যখন থামিয়া যাইবে। কোনও শব্দ নাই; বালকের ভীত হইবার মতো শব্দ নাই।
নৃত্য
দ্বৈমাতৃক দেশে আলো আসিতেছে, এ বিজন অরণ্যে ফুটিয়া উঠিছে রুদ্রপলাশ। আমার ভিতর প্রবেশ করিতেছে অবাক শিঞ্জা। আহা, রুদ্রপলাশ, ভাবিতেছি তুমিও কি শিহরিত হইতেছ, যেমন কাঁপিয়ে ওঠে মুকুরের সম্মুখে সদ্য-বালিকা! কেহ কোত্থাও নাই তবু ভীষণ নৃত্যের আয়োজন চলিতেছে। কেহ দেখিবে না, চরণযুগলে ক্ষত ফুটিয়া উঠিবে। হয়তো রবীন্দ্রসন্ধ্যায় জীবনে প্রথমবার ‘চণ্ডালিকা’ করিবার মতো বিশাল প্রমাদ ঘটিবে। তবু তাহা মুখ্য নহে; মুখ্য এই নৃত্য-আয়োজন। এই আলো, নেশা-সরোবর আর তারকার সঙ্গীতে আমার ভিতর ক্রমশ উত্তেজিত হইতেছে সুপ্ত নর্তক। অঙ্গনই প্রকৃত নৃত্য; অঙ্গন যেহেতু বিশাল আমার নৃত্যও তদ্রূপ হইয়া উঠিবে। তাণ্ডবনৃত্য করিব; দু-একটি পাখিই শুধু সে নৃত্য দেখিবে। কিন্তু তুমি কি জানিয়াছ রুদ্রপলাশ, সমস্ত শরীর দিয়া এই অদ্ভুত শিহরণ কেন বহিতেছে? বহিতেছে, কারণ আমার ভিতর জন্মাবধি এক অস্থির, নির্ঘুম তমস্বান পিণ্ড রহিয়াছে। তাহার সমস্ত ছিন্নপ্রায় স্নায়ু; ছিন্নভিন্ন শিকল। এ নৃত্য আসলে কীলক-অছিলা; বালা জুড়িবার আয়োজন। অযুত-বর্ষ শৃঙ্খলের মতো তামস-নিদ্রা আনয়ন…
ভ্রম
সমস্ত তিরবিদ্ধ মানুষের একই ভ্রম প্রত্যক্ষ করি। তারা প্রায় কেহই ধনুর্ধরকে দেখিতে পায় না। কেবলই মুহূর্তে দেখে ছায়াশরীরের আততায়ী বৃক্ষ-অন্তরালে লুকাইয়া পড়িল। অথচ অমোঘ তির; বিদ্ধ হওয়াই নিয়তি। তবে সেই ভ্রমটিকে আমার সকল নিয়তির মাতা মনে হয়। একে একে প্রশ্ন ছুটিয়া আসে— কে ওই ধনুর্ধর, কোন অপরাধে সে আমাকে হত্যা করিতে চায়, অজাতশত্রু হইবার কোনও পথ খোলা রহিয়াছে পৃথিবীতে! যে ভীষণ আক্রোশ সে বহন করিতেছে তাহার উৎস কোথায়… রক্ত ঝরিতে থাকে, রুধিরে ভাসিয়া যায় শুখা মৃত্তিকা। রহস্যময় বনানীর কাছে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কাঁদে অবাক প্রশ্ন; আরও লহু বহে। আরও রক্ত-অপচয় ঘটে। এ পথে মৃত্যু আসে। তিরবিদ্ধ মানুষের ভ্রম বুঝিতে পারে না এসব প্রশ্নের থেকে সামান্য দূরে নীরব সুশ্রুত ছিল; ছিল গাঢ় উপশম