পাঁচটি কবিতা
১৯৯৭
মেঘের কীই বা বোঝ তুমি?…
দেখতে পাও না রোজ সন্ধের দিকে
এক পাহাড়ের সারি এই শহরের শেষে জেগে ওঠে!…
পর পর জিপ, গাড়ি, বাসের হেল্পার চিৎকার করে বলে— সদগাঁও, নইলিং, চেম্বু… আর আমি—
‘দুটো উইন্ডো, একটা মিডল’ বলে দৌড় মারি দোরজের মোমোর দোকানে।
কয়েকটা উলের রং, একটা কাঁটার
দোকান খুঁজতে খুঁজতে দেখি পাহাড় বদলে
গিয়ে অন্যরকম সব ঝর্ণা, নদীর দেশে নেমে
এসে ডাকে— সাতমাইল, ফার্স্ট টার্ন,… আমি
মাকে তড়িঘড়ি জিপে তুলে বলি— ‘চলো আগে
ঘুরে আসি, পরে তুমি বাজারের কথা ভেবো,’
পরে…
অগোচরে মেঘ করে,…
আলো তার নিজস্ব বিস্তারে আরও এক
পাহাড়ের খেলা শুরু করে…
নববর্ষ
আশ্চর্য প্রদীপ নিভে যাচ্ছে কাল আরও আশ্চর্য দীপ জেগে উঠবে বলে আমি ফালতু হাঁটছিলাম এই ঝিমিয়ে আসা শহরে যখন জোর করে উৎসব করতে হয় তখন আর দেখছিলাম কি উদ্বেগে মানুষ ছুটছে যেন কাল সব নতুন বদলে যাবে ফলে আজই ঘর পরিষ্কার আজই ঠাকুরের সিংহাসনে জল আজই পার্টি ফেরত তুমি ছড়িয়ে এসো না কারণ ছড়ানো আমাদের পাড়ায় পাড়ায় গান চালিয়ে চিকেন আর ভাতের ব্যবস্থা হয়েছে
সমব্যথী আলো আছে জ্বলছে নিবছে থামছে না তবু হলুদ সেলফিনে জড়ানো বাকি সমস্ত কেক গোছাতে গোছাতে গোষ্ঠ বিছিয়ে দিচ্ছে চাদর যেখানে সে আর কুকুরেরা একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়বে এরপর কাছেই ওই দুতলায় একজন একা টিভি দেখছে পাশে আরেকজন জানতেই পারছে না আজ নববর্ষ ওদিকে বাজি ফাটছে চাঁদ আর সূর্য একবার মুখোমুখি হয়ে হাল্কা হেসে সরে যাচ্ছে দূরে
ভোর হচ্ছে একটা নতুন বছরের
ধন্যবাদ
যার কেউ নেই তার গাছ আছে,..
ফাঁকা মাঠের মধ্যে একলা একটা
গাছের তলায় সে বসে বসে দেখে ওই
সুবিশাল ছাতার মত আকাশের নিচে
একটা বন্ধুহীন পৃথিবীতে তার জন্য
অন্তত একটা গাছ
ইশারায় আঁচল পেতে দ্যায়…
যার জন্য কিছু নেই
তার জন্য গাছের ভাষা আছে…
যা সরব অথচ কেউ শুনতে পায় না।
গান আছে, যা ফুলের মত ফুটে মিলিয়ে যায়…
বিশ্বাস আছে, একটা সুবিরাট প্রকাণ্ড তারাজ্বলা শূন্যতার ভিতর তার শাখা-প্রশাখায় ডিম ফুটে জন্ম নেয় ডানা, যে একমাত্র অবাধ্য অঙ্গীকারে উড়ে যেতে পারে উপরে আরও আরও অনেক উপরে আর সবাইকে জানাতে পারে যে সে দেখতে পাচ্ছে নির্জন একটা মাঠে ছোট্ট একটি নির্বান্ধব মানুষকে ঘিরে কি ভয়াবহভাবে প্রসারিত হচ্ছে একটা মাত্র গাছের ছায়া, একটা বিরাট আকাশের নিচে, উদাসীন, অগোচরে,
রোজ….
বয়স
একটা সামান্য বাড়ানো বল ধরতে
পা কেঁপে ওঠে গুরু দা,
ফাঁকা ফ্ল্যাংক, একটা ডিফেন্ডার
যাকে চোখ মেরে শুইয়ে
দিতে পারতাম… আজ
সেও এসে চোখ রাঙায়…
বল কারও দাসত্ব করে না, ঘাস
তো বুঝত, মাটি… কিছু নেই…
কাঁকর আর এবড়োখেবড়ো মাঠে
ধুন্ধুমার লেগে আছে, ভয়ে ফড়িংও
বসতে পারছে না ঘাসের ডগায়…
আমিও বুঝতে পারছি না বল
কার দিকে বাড়িয়ে এগোব এরপর…
অস্তরেখা
এরপর এক অদ্ভুত বিবরণের খেলা, ধরো
একটি জোনাকি উড়ে উড়ে একটা একটা করে তারার উপরে বসে মিলিয়ে নিচ্ছে তার গভীরতা…
এক একটি সুবাস এসে এক একটি ফুলের সাথে মিশে জেনে নিতে চাইছে কতটা একাত্ম কে কার সঙ্গে আজ,… আমি বিভিন্নভাবে বুঝতে চাইছি কোন আমিত্বে প্রাণ প্রস্তাবিত ছিল,.. আলো প্রতিফলনে, হাওয়া আন্দোলনে, ধ্বনি প্রতিধ্বনির ভিতর আজ অন্বেষণে, শুধু
অন্ধকার তার বিস্তার নিয়ে স্থির…
তবে কি আমরা কেউ আমাদের ভিতরে
ছিলাম না কখনও যেভাবে অগ্নির ভিতরে উত্তাপ, শূন্যতার ভিতরে আকাশ… কে কার নির্জনে
নির্ভার নির্ভরতা নিয়ে!…
প্রতিবার অন্যের ভিতরে নিজের প্রকাশ খুঁজে
অন্য হৃদয়ে তার অভিঘাত… অন্য অনেক চোখে প্রতিচ্ছবির খোঁজ করতে করতে খুব ক্লান্ত হয়েছি
সকলেই…
বুঝিনি, আমার গৃহের ছায়া
আমারই উঠোন জুড়ে আছে…
আমার সকল ফুল
আমারই আপন করা গাছে…
বাহ!
হীরক সেনগুপ্ত