কয়েকটি কবিতা
নিষ্ক্রিয়তা
১.
যখন কিছুই লেখার থাকে না
তখনই আমার লিখতে ইচ্ছে করে
লিখতে ইচ্ছে করে এই গুমোট, ভ্যাপসা, বোবা দিনগুলোর কথা।
আগুনের মতো হাওয়া, যার কোনও প্রতিবিধান নেই
মানুষ নেই মানুষের কাছে।
জায়গায় জায়গায় পা পড়েছে দানবের
আর ছোট ছোট অসংখ্য মানুষ পুজো আনছে সেসব পায়ের জন্য।
বাজ ডাকার মতো স্বরে (লাউডস্পিকারে নয়) জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাঠরীতি, বাজারের খুঁটিনাটি দাম-দর, কে কীভাবে চলবে থামবে, বাঁচবে, বাঁচাবে।
বাঁচাবে নিজের পিঠ, বসতবাড়ির ইট চুন বালি খসে খসে, পথে যাতে বসতে না হয়
বুকের ওপরে যে পা-টি চাপানো
তার ভার ক্রমে শ্বাস বন্ধ করে দেবে
সকলেই জানে
তবুও মানুষ নিরুপায়, উত্তাপহীন
হৃদে ভালবাসা নিয়ে
মগজে হতাশা নিয়ে
পথ নেই কোনও জেনে
পথ আরও পথের হয়রানে।
২.
যা-ই লিখি তাতে আজ ঘৃণা লেখা থাকে
মানুষকে মানুষ না ভাবার প্রতি
লেগে থাকে ক্ষোভ
এই দগদগে ঘা
এই লেলিহান অপমানের আগুন
পারে না কিছুই
শুধু নিজের ভিতরে নিজে আঁচড়ে-কামড়ে আরও
বিক্ষত রক্তাক্ত করা ছাড়া
দু-টাকার জনতা আমরা
ফি ইলেকশনে প্রাণভরে
জন্মশোধ প্রতিকার আনি
তারপর মরে থাকি
কিম্বা মরে যাই
৩.
অনেকেই বলছে: পথে নামো
কিন্তু পথেই যে শয্যা পেতেছি
নিশ্চিত উপার্জনের পথ
সুরম্য পরিধান
অনায়াস বসতের পথ
এ পথে চলেছে যারা
পুরোটা জীবন
তাদের তাদের আজ
কোন আগুনের বুকে
কোন তুঙ্গ জলোচ্ছ্বাসের গহনে
ঝাঁপাতে বলো তুমি?
আমাদের পথঘাট বহু আগে বাঁধা হয়ে গেছে
বেঁচে আছি
হয়তো বাঁচব না।
ট্রেন থেকে
নওল ভোরের বাহুপাশ থেকে
অভিসারিণী রাত যেন কেঁদেকেটে ফিরে যাচ্ছে
ঝাপসা ঘাসের পৃথিবীতে, আরেকটি রাতের আলো
নিবিয়ে দিয়ে জেগে উঠছে খাটিয়ে মানুষ
দুটি শিশু অচেতন, ঘুমে
জানলা আড়াল করে ধূসর রঙের এক মালগাড়ি, যেন মহাকাল
এমন সময়ে খুব ভুলভাবে মনে হয়
মানুষের তপ্ত প্রাণিত এই পৃথিবীতে
রণ-রক্ত-সফলতা নেই
কোথাও দীনতা নেই
কোনও মানুষের ছুরি গাঁথা নেই
অন্য কারও পিঠে
আলো ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে
জাগরণক্লান্ত দেহ
আয়েস-দুরস্ত বার্থে, রিজার্ভড বগিতে
সব কালি ফিরে এনে দেয়—
আমি পারব না হতে এই মাঠ
এই নিমতিতা স্টেশনের, উদাসীন রেলের লাইন
—কয়েকজন আরও কয়েকজন
ফালি ন্যাকড়ায় গা-মাথা ঢেকে, জীবন দেখছে—
আমি পারব না হতে মানুষের মরিয়া জীবন
আমার ঘরের তাপ মেখে নিতে
জড়িয়ে জড়িয়ে নিতে আমার তুলোর শিশুদের—
এই মহা আয়োজন, অনিয়মে অপ্রাপ্তিতে গড়া,
এই নৈসর্গিক আয়ু, অভাব অসূয়া
ছেড়ে দূর আরও দূর
পালিয়ে চলেছি
ধুলিয়ান-গঙ্গা প্ল্যাটফর্মে
রেলবাবুরা মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন।
গহন
১.
পায়ে হেঁটে, টোটো চেপে, ঘুরি অলিতে গলিতে
এই হেলে পড়া পুরনো বিকেল
সাবেক পরিত্যক্ত ভাঙা কারখানা
ছায়া ছায়া ঝোপঝাড়
আর ক্রমশ আলোয় আলো হয়ে ওঠা উপকণ্ঠ পাড়া
সরু পিচপথ বেয়ে স্পর্ধিত গাড়ি ছোটে
কুকুরের পাল পিছু নেয়
আমি ডেকে বিস্কুট খাওয়াই
—নর্দমার পাঁক ঘাঁটে তারা, গরু আর হাঁসেদের সাথে
গেরস্থ জঞ্জাল জমে জীবন জানায়—
এ বিকেল, এই সন্ধে
সুখচর বাজারের এই নতুনতা
জানি, ক্রমে অভ্যেসে দাঁড়াবে
অভ্যেসে দাঁড়াবে এই ফেলে আসা, ছেড়ে আসা, হেরে আসা ইতিহাস
তবু না হারানো।
আমার শিশুরা চিনে নেবে এই
তেতে ওঠা উদগ্র নগরী
আমি চিনে নেব ওদের
যেমন রোজ
একটু একটু করে
মানুষেরা খুঁজে নেয় ঘর
ধুলোতে হাওয়াতে মিশে
চিরজীবী হব তারপর।
২.
বই খুলি
কবিতার, গল্পের, বই
ফেসবুক… সোশাল মিডিয়া
মানুষের কাছে যাই
বিছানায় নেমে আসি ফের
মানুষের হ্রেষা শুনি
টগবগ টের পাই রক্তের ভিতরে
নেচে উঠি
বাঁচার অধিক বাঁচা চাই
বই খুলি পত্রিকা ওল্টাই
কারা খুর ঠোকে মাটিতে হৃদয়ে
বিছানায় ফিরি আমি
ঘুমে
কামে
অব্যক্ততায়
৩.
‘তোমরা যা বলো তাই বলো’
ফিরে বাজে
গুনগুন গুনগুন
মনে আমার লাগে না কিছুই
বুড়ো হচ্ছি যত
যেন দেশে ফিরছি
যে দেশ আমার মধ্যে
দিনে দিনে আশ্রয় পেতেছে
কাউকে আমি চেনাতে পারিনি যেই ঘর
তারই অল্প আলোয় ছায়ায়
যে গান আমার
যেই মধু ভ্রমর গুঞ্জনে
হয়তো তুমিই সব এনেছ কখনও উপহার
সে বাঁশির সুরে আমি ঘরে ফিরতে চাই
এ হল সেই দেশ
যা থেকে কখনও আমায়
উপড়ে খুবলে নিতে পারবে না কেউ
বেলা যাবে বেলা যাবে
কেমন বিনা কারণে
আমার লাগবে না কিছু মনে।