পায়েল চট্টোপাধ্যায়
প্রিয় বিকেলবেলার বন্ধু,
আলগা, খসে পড়া খোঁপার মত একটা বিকেলে আমাদের দেখা বা না-দেখা। স্রোতের মত ছিল সময়টা। অনবরত বয়ে চলা। পেন্সিলের আঁকি-বুকি, ফেলুদার গন্ধ, এলোমেলো উড়ে বেড়ানো বইয়ের পাতা, গরম লাগা বিকেল, সব মিলিয়ে ঘাসের বুকে পা রাখার মত সময়। ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা। দুদ্দাড় করে বেরিয়ে পড়া। চটির ফটফট শব্দ, ধুলো-ধুলো বিকেল। বন্ধু এলি? সারা বিকেল জুড়ে বন্ধুত্বের ছাতিম ফুলের গন্ধ ভেসে আসতো। এই গন্ধে জ্বর আসে। যে জ্বরে মনের উত্তাপ বাড়ে। যে জ্বরে আনন্দ হয়।
সেদিন চোর-পুলিশ খেলার দিন। তোর ঝিলমিল করা ওড়নার ভেতর দিয়ে জোনাকির মত একটা চিরকুট ভেসে উঠেছে। তুই হাত মুঠো করে রেখেছিলি। তোর হাতের ভেতরের চিরকুটে বিকেলের রং মেশানো কথার ঝুড়ি। আমি কেড়ে নিতে এগিয়ে গিয়েছিলাম। মনে পড়ে তোর? তুই আটকাসনি। চিরকুটে দুটো শব্দ। “বন্ধু হবি”? আমার মনের ভেতর কাটাকুটি। এতদিন তবে কি ছিলাম? আমার ভেতরটা ভারী হয়। অনেকটা ভারী।
ওই রোগা মতো মেয়েটা আমার বিনুনি টেনে দিত রোজ। আজ যে মেয়েটা চোর হয়েছিল পেছন থেকে ধাক্কা দিয়েছিল আমায়। আমি সামনের দিকে পড়ে যাই। আমার ভিতরে সুর বাজছে। রাতের রাগ বেজে উঠছে যেন। কয়েক মাস আগেই এসেছিলি তুই এই পাড়ায়। সেখান থেকে আমাদের বিকেলের বন্ধু হয়ে ওঠা। গল্প-মাখা বিকেল। মেয়ে-বেলার ঘামে ভেজা বিকেল।
সেই বিকেলে আমার ভেতর জমা হয়ে থাকা প্রশ্ন। পাহাড়ের মত প্রশ্ন। তুই কি ইচ্ছে করে চিরকুটটা রেখেছিলি? তবে এতদিন বন্ধু ছিলাম না? নাকি আমায় বোকা বানালি?
আমার গায়ে মাঠের ধুলো। তারপর আমাদের লুকোচুরি খেলা শুরু। লুকোচুরিতে আমি চোর। সেদিন অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত আমি খুঁজেছিলাম। খেলার ফাঁকে শুধু বন্ধু খুঁজেছি।
তখন সন্ধে নামছে। এদিক সেদিক অগোছালো, অবিন্যস্ত মুহূর্তের মত ঘুরে বেড়াচ্ছিলি। কী বলছিস? তোরা লুকিয়েছিলি টগর গাছের পেছনে, আকন্দর ঝোপের আড়ালে? আমি খুঁজে পাইনি! আরো বলেছিলি, হদ্দ বোকা আমি। আমায় নিয়ে তোরা হাসছিলি সেদিন।
আর আমি! বোকা ভেবলে যাওয়া মেয়ে ধুলো মেখে এলোমেলো ছুটে বেড়াচ্ছে। আমি আসলে সেদিন দৌড়চ্ছিলাম না। একটা স্বপ্ন-ভাঙা বিকেলে তোর মিথ্যে চিরকুট হাতে বিকেল-বেলার বন্ধু খুঁজছিলাম।
সন্ধের অন্ধকার তখন আকাশ ভেঙে আমার গায়ে জড়িয়ে ধরছে। অনেকক্ষণ এলোমেলো প্রেতের মতো দৌড়ে বেরিয়েছিলাম আমি। নাহ! সেদিন আর কাউকে ধরতে পারিনি। দুঃখ-সুখের হাইফেনের মাঝে তুই দাঁড়িয়ে। সন্ধের পর সবাই যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, তুই ডাকলি, “কী রে রাগ করেছিস?” রাগ শব্দটা শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার হাত থেকে ওই দোমড়ানো মোচড়ানো চিরকুটটা নিয়ে পালকের মত উড়িয়ে দিয়েছিলি তুই। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলি। “মজা করছিলাম একটু, আমরা সত্যিই বন্ধু।” আমি কান্না থামিয়ে গলগল করে ঘামতে শুরু করেছি। আমার চারিদিকে চাপ-চাপ ধুলো। তোর কথার উত্তর দিইনি। সন্ধের আধো-অন্ধকারে এক ছুট্টে পালানোর সময় হোঁচট খেয়ে পড়েছিলাম। পায়ের কাছে জমাট বাঁধা রক্ত। তোর সঙ্গে ফিরতে হলে অবশেষে।
তারপর বিকেলগুলো কেমন যেন জোনাকি পোকার মতো হয়ে গেল। তোর-আমার, আমাদের বিকেল। একটা আস্ত মেয়েবেলার বিকেল। ঠিক যেন গল্পবেলা। চোর-পুলিশ, লুকোচুরি, লাল লাঠি। যেসব মনে পড়ে তোর? সেই স্কুল পালানোর কথা, মনে আছে তোর? আকাশে আলগা মেঘ। রোদের জামা গায়ে দেওয়া দুপুরে মেঘের পূর্বাভাস। ঝড়ের ঠিকানা।
আমরা সেদিন স্কুলে ছিলাম। শেষ ঘণ্টা বাজার আগেই সকলের চোখ এড়িয়ে দৌড়েছিলাম। এবার দুজনে। তুই-আমি। আমাদের মাঝে একটা লম্বা বন্ধুত্বের হাইফেন। যদিও আমাদের বিকেলের দৈর্ঘ্য তখন মরা পুকুর হতে শুরু করেছে। আমরা তাও সেই মরা পুকুরে ফুল ফোটানোর চেষ্টা করতাম। বন্ধুত্বের গন্ধ মাখা ফুল। সেদিন ছোট্ট পাঁচিলটা টপকে দৌড়ে পড়েছিলাম আমবাগানে। তোর কুড়নো আম বড় মিষ্টি। আমাদের তখন চটচটে হাত। ধুলোমাখা ভ্যাপসা গরমওলা বিকেলগুলো সেজে উঠতো তোর আম-মাখায়।
সেই ঝালমুড়ি পিকনিকের দিনটা তোর মনে আছে? আমাদের তখন লম্বা বিনুনি। আমরা তখন বন্ধুত্বের বাইরে খাতার-পাতার নম্বরগুলি। ঝুপঝুপ করা সন্ধ্যেতে নতুন স্কুলের তালিকা খুঁজি। আমাদের তখন লাল রংয়ের গল্প। তোকে সেদিন বড্ড হিসেবি লেগেছিল। তোর হাতের হলুদ কাগজে লেখা নতুন স্কুলের তালিকাগুলো হিংস্র চোখের মতো জেগে থাকত।
সত্যি কথা বল, সেসব পেরিয়ে যাওয়া কি খুব কঠিন ছিল? আমি জানি, তুই পেরোতে পারতিস। তোর জীবনে তখন বসন্তের রং লেগেছে। তাই আমাদের মাঝে সাপ-লুডোর সিঁড়ি। সেদিন ঝালমুড়ি পিকনিকের পর আমরা সকলে একটা নৌকোয় উঠেছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম আমাদের নৌকোর ভেতর অনেকটা জল ঢুকেছে। সেই জলে ভেসে চলেছে দু’জোড়া বিনুনি, ঋতু বদলানো বিকেল, আর অজস্র গল্প-কথা।
তারপর থেকেই ভাঙনের শুরু। শূন্য বিকেলগুলোয় মন ভাঙা একটা রাস্তা তৈরি হয়েছিল। যে পথে আমি একাই হেঁটেছিলাম। শুধু আমি। একা আমি। তোর আমার মাঝের হাইফেন তখন সরে গেছে। তবুও বিশ্বাস করতে কষ্ট হত। অন্য রাস্তাটা তুই পেলি কোথায়? হঠাৎ করে জানালি তুই কলকাতায় পড়তে যাচ্ছিস। গ্রামের মেঠো রাস্তা, সুখ-দুঃখের গল্প বলা মাঠের হাহাকার শুনতে পেয়েছিলি তুই? নাকি তোর এগিয়ে চলার পথে আমাদের বন্ধুত্বের মতো সবটাই ধুলো হয়ে মিশে গিয়েছিল। চলে যাবার দিন দেখা হয়নি আমাদের। হয়তো দেখা হওয়ার কথা ছিল না। তবুও বিকেলবেলার খেলার মাঠের ছাতিম গাছের তলায় দু’ফোঁটা চোখের জল দেখতে পেয়েছিলাম আমি। কার চোখের জল? তোর? আমার? নাকি সেই শূন্য বিকেলের!
বছর দশেক পর যখন তোকে আবার দেখেছিলাম তুই যেন স্বপ্ন-মানুষ। তোর কাঁধে একটা লোমশ, বলিষ্ঠ হাত। তোর বিয়ের কথা জানাতে এসেছিলি। আমার তোকে দেখে লুকোচুরির কথা মনে পড়ছিল। আচ্ছা ওই বলিষ্ঠ হাত কি তোকে আম-মাখা খাওয়ায়? চোর-পুলিশ খেলে তোর সঙ্গে? লুকোচুরি? আমাদের সব চিরকুটের ভেতর যে দুঃখ জমা হয়ে রয়েছে তা কি দেখতে পাস?
যাইনি তোর বিয়েতে। যাওয়ার মত কিছু ছিল না। তবে গল্প শুনেছিলাম। অনেক আলোর গল্প। সেসব আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আমি তখন আর বন্ধুত্ব করি না। ধুলো ওড়াই না।
জানিস, একটা না-মানুষ দেখা জীবনে আমি আর মানুষ খুঁজি না। সাদা ধোঁয়ার মতো করে জীবন কাটাই। নিজেকে কোথাও জমা করতে ইচ্ছে করে না। একটা অন্ধ খনির ভেতর ইচ্ছে জমা রাখি শুধু। দশটা-পাঁচটার চাকরি, ইনক্রিমেন্ট, শৃঙ্খলা, নিয়মের ভিড়ে আমি শুধু দেওয়াল দেখতে পাই। যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকানো যায় না, যে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে দুদণ্ড জিরিয়ে নেওয়া যায় না। যে দেওয়ালে শুধু মাথা কুটে মরতে হয়, তারপর অজস্র ক্ষত নিয়ে ফিরে আসতে হয়। আন্তরিকতা, সহানুভূতি, ভালোবাসা, বন্ধুত্বের চুপকথার জগত।
প্রিয় বিকেলবেলার বন্ধু, ভালো আছিস তো তুই? আলোয় আছিস নিশ্চয়ই। আমার মত বন্ধুহীন হয়ে নেই তো? তোর দেওয়াল ভেদ করে, জানালা দিয়ে আলো ঢোকে? বাতাস খেলে?
তোর কাছে যদি অনেক আলো থাকে জমিয়ে রাখবি আমার জন্য? যে আলোয় আমরা আবার মেয়েবেলার গল্প করব। আম-মাখা খাব? ঝড় দেখব, ধুলো ওড়াবো। একরাশ রঙিন ধুলো। যে ধুলোয় বন্ধুত্বের গল্প লেখা থাকবে, একটা রামধনু আকাশ থাকবে। আর থাকবে হাত ধরে বন্ধু হয়ে পথ চলার গল্প। আমার বন্ধুত্বের গল্প। তোর আমার মাঝের হাইফেনে সেদিন আমরা অনেকটা অনুভূতি ভরে নেব। আসবি তো সেই আলো নিয়ে? আমি অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু।
ইতি
তোর এলোমেলো অপরাহ্নবেলার সঙ্গী
চমৎকার লেখা।
অনবদ্য গদ্য ভঙ্গি।
হীরক সেনগুপ্ত
অপূর্ব