বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
The Duck and the Kangaroo
৩.
ফ্লাইট ডিলে ছিল। প্রোগ্রামটা হচ্ছে মনরোভিয়ায়, এল এর কাছেই। তবু এয়ারপোর্ট থেকে এক ঘণ্টার দূরত্ব। হোটেলে চেক ইন করতে বুদ্ধর আরও দেরি হল। প্রবীরদা ফোন করেছিল বার কয়েক। কী ব্যাপার বুদ্ধ? অনামিকার সঙ্গে দেখা করবে বললে, তার প্রোগ্রাম তো শেষ হয়ে গেল।
–কোনও অসুবিধা নেই প্রবীরদা। ওর সঙ্গে দেখা করতে পেলেই হবে, অনুষ্ঠান দেখাটা অত জরুরি নয়।
–সে কি কথা, সিক্রেট র্যাঁদেভু নাকি? অর্থপূর্ণ হাসি ফোনেও তার খোঁচা রেখে গেছিল।
–সেরকম কিছু নয়। আমাদের এক কমন বন্ধুর ব্যাপারে কথা বলার আছে। আমি আধঘণ্টার মধ্যে আসছি।
–ঠিক আছে। আমি ওঁকে জানিয়ে রাখছি তাহলে।
–না, না। সেসব কর না। আমাকে অনামিকা চেনেই না। জাস্ট একজন ফ্যান হিসাবে পরিচয় করিয়ে দাও, তারপর আমি যা বলার বলে নেব।
–ঠিক আছে। এসে যাও।
এইটুকুই কথা হয়েছিল। আসলে হীরকের খোঁজে আসা।
বিজু, হীরক, মণীশ এদের সঙ্গে একসময় ঘন ঘন কথা হত। অন্তত মাসে একবার তো বটেই। অথচ এখন কথা হয় না যে কত মাস। বিজুর ফোন পেয়ে নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল। একা একা জীবনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। সে কোনওভাবে পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বিজুও নিজে থেকে কোনও হেল্প চায়নি কখনও। আজ ফোন করেছে মানে নিশ্চয় খুব জরুরি কিছু। স্টুডিও থেকে বেরিয়েই বিজুকে ফোন লাগাল বুদ্ধ।
–হ্যালো হিরো! ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে উদ্ভাসিত হল বিজু। তুমি তো জ্বালিয়ে দিচ্ছ গুরু।
অনেকদিন বাদে কেউ এই ভাষায় কথা বলল বুদ্ধর সঙ্গে। প্রাণ খুলে হাসতে হাসতে বলল, দাবানল নাকি ধিকিধিকি?
–লেলিহান শিখা। দিকে দিকে তব নাম পড়েছে ছড়ায়ে। এই সেদিন একটা ম্যাগাজিনে তোর ছবি দেখলাম হাত পা নেড়ে ইন্টারভিউ দিচ্ছিস। দেখেই মনে হল কেমন চেনা চেনা লাগে যেন!
–হুম, খোঁচা মারছিস।
–না রে, ক্যাপশানটাই এমন ছিল। টেকস্মার্ট বুধা অন হিজ টেকমারট অব দ্য ফিউচার। ওঁই বুধা যে আমাদেরই বুদ্ধ, সেটা আমি গাধা কী করে বুঝব।
গলায় আত্মপ্রসাদটা চেপে কথা ঘোরালো বুদ্ধ, সিরিয়াসলি রে বিজু, আমার এত গিলটি লাগে। গত দেড়টা বছর কেমনভাবে চলে গেল, সবকিছু ঝাপসা। তোদের সঙ্গে ভাল করে কথাও হয়নি। আমাদের অ্যানুয়াল গেট টুগেদারটাও হল না।
–আমরা ভাল আছি রে বুদ্ধ। আমার মা আসছে। মার গ্রীন কার্ড হয়ে গেছে।
–আরেব্বাস! সেটা তো দারুণ খবর। তাহলে এখন এখানেই থাকবে?
–হ্যাঁ, রিটায়ার করছে। মাকে বললাম চলে আসতে। আসতে কি চায়, তবে অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। বিজুর গলার খুশিটা বুদ্ধর ভাল লাগল। দারুণ, দারুণ। মাসিমা আসার পর একবার ঘুরে যাব তোদের ওখানে। একসময় তোদের বাড়িতে কত আড্ডা দিয়েছি আর মাসিমাকে বিরক্ত করেছি। আমি, হীরু সবাই মিলে আসব ঠিক। সেটাই আমাদের নেক্সট রিইউনিয়ান হবে।
বিজুর গলাটা পাল্টে গেল ঝট করে। কণ্ঠস্বর একধাপ নিচে নাবিয়ে বলল, তোকে ফোন করেছিলাম হীরুর জন্যে।
–মানে? হীরুর কিছু হয়েছে নাকি?
–তুই কিছু জানিস না?
–না তো। কেন কী হয়েছে ওর?
–আমি আবার ভাবলাম, তোর কাছে বেশি খবর থাকবে। ছেলেরা তো প্রেমের গল্প ছেলেদের সঙ্গেই বেশি শেয়ার করে।
বিজুর গলায় চাপা শ্লেষের ছোঁয়া অগ্রাহ্য করে বুদ্ধ বলল, কী হয়েছে বল তো? আমি কিচ্ছু জানি না তো।
–আসলে জিনি ফোন করেছিল আমাকে। হীরুকে দুদিন ট্রেস করতে পারেনি। তারপর যখন খবর পেল জানা গেল, কলকাতা থেকে আসা এক বাঙালি হিরোইনের সঙ্গে জুটে অ্যামেরিকার শহরে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
–মানে? হীরকের সঙ্গে এই বর্ণনাটা যেন মিলাতে পারছিল না বুদ্ধ। কি যা তা বলছিস? হীরু ওই টাইপ নয় মোটেই। একটু ভাবুক টাইপের হয়ে গেছিল। শেষ দুয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে কেমন ছাড়া ছাড়া কথা বলার ভঙ্গি – তবে সেও ছয়মাসের ওপর হল। তুই হীরুর সঙ্গে কথা বলেছিস?
–পাইনি। রিং করে যায়, ধরে না। পরে জিনির কাছে জানলাম ও ওয়্যারলেস সঙ্গেই নিয়ে যায়নি। তাই ট্রেস করা মুশকিল হয়েছে আরও। এলএ-তে ওই নায়িকার একটা শো আছে এই শনিবার। আমার ডাউট হচ্ছে, সত্যি যদি হীরু ওর পিছনে ঘুরছে তাহলে এল এতেও আসবে। তুই একবার যেতে পারবি?
–আমাকে খবর নিতে দে। নায়িকার নাম কী?
–অনামিকা, এখনকার খুব ফেমাস অভিনেত্রী।
–ধুর, বাংলায় আর কটা ভাল সিনেমা হয়, তার আবার ফেমাস। দাঁড়া আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। কিন্তু ও যে সেই হিরোইনের সঙ্গেই গেছে, এত স্যাঙ্গুইন হচ্ছিস কী করে?
–জিনি বলল, বাবা মাকে ভাইয়ের কাছে ছাড়তে নিউ জার্সি গেছিল। সেখানে বঙ্গ সম্মেলনে হঠাৎ করে নাকি এই নায়িকা অনামিকার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। হীরু ভাল করে কিছুই নাকি বলেনি। কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া কথা থেকে জিনি আন্দাজ করেছে।
–তার মানে হীরু বাড়িতে ফিরেছিল?
–হ্যাঁ। বাড়িতে ফেরে একেবারে উদ্ভ্রান্তের মত। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রয়েট বারোঘণ্টার পথ, ভাগ্য ভাল রাস্তায় কোনও অ্যাকসিডেন্ট করেনি। ফিরে নাকি ভাল করে কোন কথা বলছিল না। ঘুমের মধ্যে রেখা রেখা বলে আর্ত চিতকার করেছে একদিন।
–দাঁড়া দাঁড়া, এই তো বললি অনামিকা না কী যেন নাম ওই হিরোইনের। এর মধ্যে রেখা আবার কোথা থেকে এল?
–ওটাই তো ধাঁধা, মেলানো যাচ্ছে না একদম। রেখা বলে একজন ছিল ওর একসময়, কিন্তু সে তো বহু বছর আগে।
–তারপর কী হল?
–ফোনে হীরুর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও ফোন নিচ্ছিল না। তিয়াসের পরীক্ষা না থাকলে আমি পরের দিনই ফ্লাই করতাম। যাই হোক, আমি আবার দুদিন বাদে ফোন করলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার জিনিকে এবার কেমন শীতল দেখলাম। শুধু বলল, হীরু আবার চলে গেছে। ওকে নাকি অনামিকার সঙ্গে দেখা করতেই হবে, খুব জরুরি কাজ।
–জিনিকে আর কিছু বলেনি?
–বলে থাকলেও জিনি আর কিছু ভাঙল না। বললাম না, কথায় কেমন একটা দূরত্ব এসে গেছে। প্রথমদিন নিজে থেকেই ফোন করেছিল, তখন একটা ব্যস্ততা ছিল। কিন্তু দুদিন বাদেই একেবারে অন্যরকম। আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। মৌমিকে বলিস একবার চেষ্টা করতে, যদি ওর কাছে মুখ খোলে। জিনি আর মৌমি সবসময়েই বিজুকে হীরক আর বুদ্ধর বন্ধু হিসাবে বেশি দেখেছে, সব কথা বলতে নাও চাইতে পারে। অন্তত বিজুর সেরকমই মনে হয়।
–ওকে। আমি হদিশ লাগাচ্ছি। যদি এলএ-তে এসে থাকে, আমি ওকে মীট করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করব।
এসে দেখছে বেশ ভিড়। মনরোভিয়া হাই স্কুলের পার্কিং গাড়িতে থইথই। বাইরে এদিক ওদিক কিছু বাংলা গুলতানি, কিন্তু বেশিরভাগ লোক ভিতরেই। প্রবীরদা একজন অর্গানাইজার, চেনা। তাকে বলা ছিল। প্রবীরদা ফোন পেয়ে গেটের কাছে চলে এসেছিল। প্রায় দুই বছর বাদে দেখা। একমুখ হাসি নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল প্রবীরদা। সব খবরই রাখি, এই কদিনেই বিজনেস ভাল দাঁড় করিয়ে দিয়েছ।
–দাঁড় করাইনি প্রবীরদা, তরী ভাসিয়েছি। এমন সমুদ্রে যা কখনও শান্ত, কখনও তুফান।
–হা, হা, হা। কথা তুমি বরাবরই ভাল বলো। কতজনের এমন সাহস হয় বলো, আমি এখানেও তোমার কথা বলি। নৌকা এগিয়ে নিয়ে চল, তুমি গোঁত খেলে আমার টাকাও ডুবে যাবে।
এসব কথায় কীভাবে উত্তর দিতে হয় এখনও শিখতে পারেনি বুদ্ধ। তার পার্টনার এলাইজা হলে বলতো, Just rock n roll dear, we are rolling on the flat earth! মার্কেটিঙের বাতেলা তার আসে না। তাছাড়া মন পড়ে আছে হীরুর সঙ্গে দেখা করার জন্য। দেঁতো হাসি হাসল। কী যে বলো প্রবীরদা, এমন কিছুই হয়নি এখনও। তোমাদের হিরোইন কি আছে না গেছে?
–আছে। এখুনি জিজ্ঞেস করে জানলাম, দরজা বন্ধ করে কার সঙ্গে কথা বলছেন উনি। বোঝোই তো নায়িকাদের ব্যাপার স্যাপার। একটু অপেক্ষা করতে হবে।
–কথা বলছে? বুদ্ধর মনে হল হীরু না হয়ে যায় না। কে, কার সঙ্গে? সেটা জানো?
–অত কিছু জানি না, চল আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। ব্যাপারটা কী? অতদূর থেকে ছুটে এসেছ, অনুষ্ঠান দেখারও ইচ্ছা নেই। বলা যায়?
হেল্প করছে, কিছু তো জানাতেই হয়। কিন্তু কতটুকু বলা যায়। চট করে ভেবে নিল বুদ্ধ। আসলে প্রবীরদা, আমার এক বন্ধু এর সঙ্গে কোনওভাবে জড়িয়ে গেছে। ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি। কলেজ জীবনের বন্ধু, যদি কোনওভাবে হেল্প করতে পারি।
–আই সি। বেশ, বেশ বন্ধুরা বিপদে বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়াবে এটাই তো চাই। এদেশে এসে আত্মীয় বল, পরিজন বলো বন্ধুরাই তো সব।
কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ বুদ্ধর চোখ আটকে গেল। হীরু না?
–হীরু! হীরু!
হীরক হনহন করে চলে যাচ্ছিল। শুনতেও পেল না।
–প্রবীরদা, আমার বন্ধু চলে যাচ্ছে। একে ধরতেই এসেছিলাম। আমার আর অনামিকার সঙ্গে দেখা করার দরকার নেই। তোমাকে পরে বলছি সব, একে একবার মিস করে গেলে মুশকিল। প্রবীরদাকে মাঝ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে উল্টোমুখে ছুটল বুদ্ধ। কিছু হয়তো মনে করল, কিন্তু কিছু করার নেই। পরে ফোন করে বুঝিয়ে দিলেই হবে।
–হীরু! হীরু! হাঁফাতে হাঁফাতে পার্কিং লটের মুখে হীরককে ধরে ফেলল। কীরে, তখন থেকে ডাকছি, কোনও সাড়া নেই! কোন দুনিয়ায় হারিয়ে গেছিলি?
হীরক থমকে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে তাকাল। দেখলেই বোঝা যায় কোনও গভীর চিন্তায় ডুবেছিল। বেরিয়ে আসতে সময় লাগল। বুদ্ধকে এখানে এভাবে আশাও করেনি। মেলাতে সময় লাগল। বুদ্ধ তুই?
–আবার কে, ভুলে গেলি নাকি? বুদ্ধ ভেবে রেখেছিল তার আসার কারণটা প্রথমেই বলবে না। পরে বলা যেতে পারে, কিন্তু শুরুতেই নয়। তুইও কি অনামিকার ফ্যান নাকি? না কি শুভব্রতর গান শুনতে এসেছিস?
–আসতে পারি না? তুইও তো এসেছিস। হীরকের কথায় সাবধানে এগোনোর চেষ্টা।
–আমি তো কাছেই। কিন্তু তুই সেই মিশিগান থেকে? আমি তোকে দেখে একদম চমকে উঠেছি। না কি অফিসের কোনও কাজ ছিল? ইচ্ছা করেই হীরকের হাতে একটা অজুহাত ধরিয়ে দিল।
–হ্যাঁ, ওই রকম। শুকনো হাসল হীরক। তুই, একা নাকি? মৌমিরা?
–আমি একাই। আসলে দোলনের স্কুলের পরীক্ষা চলছে, উইকএন্ডে পড়ার খুব চাপ।
–বড় হয়ে যাচ্ছে সবাই, চাপ শুরু হয়ে গেছে।
–আবার সেই ঘোড়দৌড় রে হীরু। মৌমিকে বুঝিয়ে পারি না। একদিকে ওরা আসেনি, ভালই হল। চল, জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে আজ। তুই আছিস তো আজ?
–আমার সকালের ফ্লাইট।
–তাহলে তো চুকে গেল। আজ সারা রাত আড্ডা, কতদিন একসঙ্গে বোতল খুলিনি। বুদ্ধ বুঝতে পারছিল হীরক মনস্থির করতে পারছে না। এতদিন বাদে দেখা, বছরের উপর। হীরকের দিক থেকে সমান উত্তাপ নেই। আসলে তার জীবনে যেমন অদল বদল হয়েছে, হীরকেরও হয়তো। হয়তো কেন, বিজু যা বলল হয়তো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। হীরকের কাঁধ নিজের পাঞ্জায় এনে ফেলল বুদ্ধ। শারীরিক ছোঁয়ায় বন্ধুত্বের উষ্ণতা অনুভব করানো।
কাজ হল।
হীরকের চোখ সজল হয়ে উঠল। দুহাতে জড়িয়ে ধরল বুদ্ধকে। খুব ভাল হল তোর সঙ্গে দেখা হয়ে। চল কোথাও বসি গিয়ে। বুদ্ধর মনে হল হীরকের শরীর যেন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, এক অস্থির কম্পন। বাইরে থেকে দেখা যায় না, কাছে এলে টের পাওয়া যায়।
–তুই কোথায় উঠেছিস হীরু?
–কোথাও উঠিনি রে। সোজা ফ্লাইট থেকে এখানে এসেছিলাম। এখন আবার এয়ারপোর্টে ফেরত যাচ্ছিলাম।
বুদ্ধ মনে করিয়ে দিল না যে একটু আগেই হীরক অফিসের কাজের কথা বলেছিল। বোঝাই যাচ্ছে শুধু অনামিকার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই এতদূর উড়ে আসা।
–তাহলে তো ভালই হল। আমি পাসাডেনায় হায়াত প্লেসে উঠেছি। আজ আমাদের চুটিয়ে আড্ডা মারার দিন। মানে রাত। তোর কটায় ফ্লাইট?
–সাড়ে ছটা।
–কেয়া বাত! আমার ফ্লাইট সকাল সাতটায়। তাহলে ঘুমের কোনও সিন নেই বস। সারা রাত মাল খাব আর সকালে একসঙ্গে এয়ারপোর্টে। জোরে হীরকের পিঠে চাপড় মারল বুদ্ধ। বেচারা খুব মুষড়ে আছে, ওকে আগে চাঙ্গা করে তোলা দরকার। মনে আছে হীরু, সেমিস্টার শেষের রাতে আমি তোদের ব্লকে রাত কাটাতে চলে আসতাম? আর সেদিন সবাই মিলে মাল খেয়ে হুল্লোড়? মাতাল ছেলেগুলো তোদের পাশের ওই পুলিশ কোয়ার্টারের দিকে কি গালাগালটাই না ছুঁড়ত! একেকটা পিস ছিল সব। কাহা গ্যায়ে ওহ দিন।
বুদ্ধ এমনি সময়ের থেকে বেশি প্রাণবন্ত আজ। ওভার দ্য বোর্ড। সেটা হীরকের নজর এড়াল না। হাত বাড়িয়ে দিল। তোকে তো কনগ্র্যাচুলেট করাই হয়নি বুদ্ধ। এত বড় একটা ভেঞ্চারে নেমেছিস, তোর তো জয়-জয়কার।
–ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকার এইটাই সুবিধা রে। অপরচুনিটি টুপটাপ করে ঝরতে থাকে। আচ্ছা, আমরা কি আলাদা গাড়িতে যাচ্ছি না একসঙ্গে?
–আমার তো রেন্টাল কার আছে, নিতেই হবে। তুই চল, আমি ফলো করছি।
হীরু কেটে পড়বে না তো? অন্তত বুদ্ধর আসার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারেনি। তবু আরেকবার সাপটে জড়াল হীরককে। আশ্বস্তের জড়ানো, বন্ধুত্বের সংযোগ। মনে হল হীরকের স্পর্শ এখন অনেক শান্ত, স্থির। কি আনন্দ যে লাগছে রে হীরু! কতদিন বাদে দেখা। আমাদের অ্যানুয়াল গ্যাদারিংটা মিস করলাম।
–তুই একা না রে। আমরা সবাই মিস করলাম। আসলে আমাদের কাটিংগুলো এদেশে এসে নিজের নিজের মত করে ডালপালা ছড়িয়েছে, কখনও বনসাই। একই গাছের কলম, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মাটিতে একেকরকম বাড়ছে।
বুদ্ধর মনে পড়ল ওর এক বন্ধুর বাবা কমলালেবুর বনসাই করেছিল টবে। কোয়া ছোট, তবু মিষ্টি ছিল। মুখে বলল, বেড়ে বলেছিস! জমবে, মাল খেতে খেতে কথা খুব জমবে আজ।
জমাতে একটু সময় লাগল। হীরক আছে, কিন্তু মাঝে মাঝেই নেই হয়ে যাচ্ছিল। বুদ্ধ মিনি বারে কী কী আছে দেখতে দেখতে মাথা ঘোরালো। কোনটা খাবি – গ্লেন না হাইল্যান্ড? ব্লেন্ডেড স্কচও আছে।
–Choice corrupts our thinking? মনে হয় তোর?
–তার মানে তুই বেছে নিতে চাস না। গ্লাসে যা ঢালা হবে সেটাই চলবে?
–জীবনটা অনেক সরল থাকে।
–অ্যামেরিকাই তো ল্যান্ড অব চয়েস। আমাদের বিজনেসটাতেও তাই। কোন ফুলের বুকে চাই? গোলাপ, ড্যাফোডিল নাকি পিটুনিয়া? অনেক রকম ফুলের গোছা না শুধুই এক রকমের? আজ মন কোন রঙ চাইছে? বুকের সঙ্গে কার্ড দেবে না চকোলেট? কিংবা দুটোই? হাওয়া হালকা করার চেষ্টায় বুদ্ধর মুখে খই ফুটছিল। চয়েস ছাড়া বিজনেস চলে না কি? এই দ্যাখ না আমরা শুরু করেছিলাম ফুল দিয়ে। গত মাসে সুইটসফরইউ সাইটের বিজনেসটা কিনে নিলাম। এর আগে অনলাইন কার্ডের একটা বিজনেস কিনেছিলাম। নিজের ভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছিল বুদ্ধ। ডিল সাইন করে ফিরছি, আমার পার্টনার এলাইজা মনে করিয়ে দিল এবার আমাদের এমপ্লয়ী সংখ্যা পাঁচশো ছাড়াল। ভাবলেই বুক কেঁপে ওঠে রে হীরু। এতগুলো লোকের জীবনের দায়িত্ব আমাদের উপর এসে গেছে।
–তাহলেই দ্যাখ জীবনটা কেমন জটিল হয়ে যায়।
অবাক হয়ে তাকাল বুদ্ধ। হীরক কি কোন ঈর্ষা থেকে বলছে এমন? সরল জীবন মানে কি গাছে উঠে বসে থাকবে আদিম পুরুষদের মত? এই উষ্মা শব্দে প্রবেশ করল। এটা কে জটিলতা কেন বলব? চ্যালেঞ্জ। বেঁচে থাকার, বড় কিছু করার। বড় মাছ ছোট মাছ খাবে আর আরও বড় হতে থাকবে। ভয় লাগে না তা নয়। এই তো সেদিন অ্যামাজন আমাদের অফার দিয়েছিল। গ্লাসে লম্বা চুমুক দিল বুদ্ধ। বিরাট অফার – ওয়ান বিলিয়ন ডলার। আমাদের যা শেয়ার আছে সারা জীবনের জন্য চিন্তা থাকে না আর। আমি, অ্যালিস দুজনেই সেদিকেই ঝুঁকছিলাম। মৌমি শুনে থেকে অবধি আমার পিছনে পড়েছিল। কি লাভ বুদ্ধ, বিক্রি করে বাচ্চাদের নিয়ে একটা নিশ্চিন্ত জীবনে পৌছে যাই চল। ওই ভাবনাটা আমাকেও ছেয়ে ফেলছিল। সত্যি তো, জীবন থেকে আমরা কি চাই? এই কথাগুলো বলতে বলতেই বুদ্ধ ভাবছিল, আচ্ছা কেন বলছি এসব কথা? আমি কি আমার কথা বলতে এসেছি আজ? না কি এই ভাবে নিজের সাফল্যের বড়াই করে ফেলছি অজান্তেই। একটু লজ্জা পেয়ে মধ্যপথে দাঁড়ি টানল বুদ্ধ।
হীরক অবশ্য সেভাবে চিন্তা করেনি। কিছুটা নিজের জীবনের পথ বেছে নেবার তুলনা মাথায় রেখে বলল, সুখী নিরুপদ্রব জীবনের হাতছানিতেও একটা অমোঘ আকর্ষণ আছে বুদ্ধ। বড় কঠিন সেই পরীক্ষা। কী করলি তোরা?
–আমাদের এলাইজা বড় কড়া চিজ। সহজে চিকেন আউট করে না। আমাদের কথা শুনে খুব আবেগপ্রবন হয়ে পড়ল। শুধু টাকার জন্য কি করছি আমরা? প্যাশন নেই? নিজেদের ভাবনায় গড়ে তোলার ইচ্ছে নেই? না কি সব রাশ ওই বেজোসের হাতে তুলে দিয়ে লাক্সারি ভিলায় অবসর জীবন কাটানোটাই আমাদের উদ্দেশ্য হবে? নিজেদের মত সব কিছু করার কি আনন্দ নেই? আছে তো। সেটা কি করে অস্বীকার করি! সেটাও তো একটা নেশার মত, পাম্পস ইওর অ্যাড্রেনালিন। মাথার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে চুলের গোড়া অবধি পৌঁছোতে চাইল বুদ্ধ।
নিষ্পলক চেয়েছিল হীরক। স্বীকার করল। এগুলো খুব কঠিন চয়েস রে বুদ্ধ। কখনও ভুল পথ নেওয়া হয়ে যায়, পরে আর বদলানো যায় না।
দ্বিধান্বিত গলায় হাসল বুদ্ধ। তুই কী বলবি! রোজ একবার করে শোনায় মৌমি। এমন নয় যে ব্যাবসা ডুবে গেলে আমরা ভিখিরি হয়ে যাবো। We will still be many times better than what we were… কিন্তু আমাদের প্রয়োজনগুলো বদলে গেছে।
বুদ্ধর বলার মধ্যে এক ধরনের ইন্সিকিউরিটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। হীরক সেটা অনুভব করেই বলল, মজা কি জানিস, সেই চয়েসগুলো না থাকলে আমরা জানতেও পারি না আমাদের ওই প্রয়োজনটা আছে। একবার ভাব জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের সামনে অনেকগুলো পথ থাকলে কী করতাম আমরা? মনে কর সকালে উঠে দাঁত মাজতে গিয়ে দেখলি সামনে কলগেট, ক্রেস্ট আর নিমের টুথপেস্ট সাজানো। তখন দাঁত মাজার মত একটা সামান্য ঘটনাও কেমন জটিল হয়ে যেত?
নিজের পছন্দের হুইস্কি ঢেলে দুটো করে বরফ ভাসিয়ে হীরকের হাতে দিল বুদ্ধ। কথার ফোকাস তার বিজনেস ভেঞ্চার থেকে সরে আসায় একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল বুদ্ধ। তার আজ এইভাবে ছুটে আসা হীরকের কথা বোঝার জন্য, নিজের টানাপোড়েনের সমাধান খোঁজার জন্য নয়। হীরকের চিন্তা স্রোতে ডুবুরির মত নামতে চাইল বরং। তোর বলা ভ্যারাইটির মধ্যে একটা আবার শুধুই মাথায়, নিমের মাজন এখানে আর কোথায় পাবি?
–মাথার মধ্যে একটা শহর, একটা দেশ, অনেকগুলো মানুষ।
–মাথার মধ্যে আরেকটা মাথা? প্রশ্নটার সঙ্গে দুটো গ্লাসের সম্মিলিত টিং শব্দ তুলে নিজেকে সোফায় এলিয়ে দিল বুদ্ধ। নিশ্চিন্ত হল যে আলাপ একটা দিকে মোড় নিয়েছে। হয়তো এটাই সূত্র। এখন শুধু উস্কে দিতে হবে। সহাবস্থান সম্ভব নয় বলছিস?
–শান্তিপূর্ণ নাও হতে পারে। গ্লাসে লম্বা এক চুমুকের সঙ্গে হীরকের মাথায় ভাবনাটা জায়গা বানাচ্ছিল।
–মনে আছে আমি, তুই আর মণীশের লাস্ট টাইম কূটকচালি? বর্তমানের একটা অতীত থাকে, কিন্তু অতীতের কোনও ভবিষ্যত নেই।
ক্রমে ছোট হয়ে আসা বরফটাকে গ্লাসের মধ্যে ঘোরাচ্ছিল হীরক। চোখ তুলে তাকাল। ম্যাগি ভাল লাগত তোর?
–যাস শালা! কোন বাঙালির বাচ্চা মায়ের হেঁসেল ছাড়ার পরপর ম্যাগি নুডলসের শরণাপন্ন হয়নি? আমার দিল্লি থাকার প্রথম তিন মাস পেটের ভিতর ম্যাগির গাছ জন্মেছিল। বুদ্ধর বলার মধ্যে কথাটাকে হালকা চালে রাখার চেষ্টা। তাহলে কথা গড়াবে সহজে।
–তার মানে বানিয়েছিস। প্যাকেট খুললেই সব একসঙ্গে জমাট বাঁধা। কিন্তু গরম জলে ছেড়ে দিলেই নুডলসগুলো আলাদা আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসে।
–তো?
–কিন্তু তখনও জড়িয়ে আছে একে অপরের সঙ্গে। অথচ একটা সম্ভাবনা আছে আলাদা আলাদা করে খুঁটে নেবার।
হীরকের চিন্তার গতি প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করছিল বুদ্ধ। গভীর মনোযোগের সঙ্গে গ্লাসে চুমুক দিল। কথা হচ্ছিল অতীত আর ভবিষ্যত নিয়ে। এর মধ্যে ম্যাগি কীভাবে এল?
–কথা তো ওইভাবেই গড়ায় বুদ্ধ। কিছু কিছু বাইরে ছিটকে আসে। বাকিরা মাথার মধ্যে ক্যাম্বিস বলের মত বাউন্স করতে থাকে।
হাওয়ায় ভাসানো দার্শনিক কথোপকথনে তার আসার উদ্দেশ্য সফল হবে না। বুদ্ধর মনে হল সোজাসুজি প্রশ্নে আসা যেতে পারে এবার। অনামিকা কি তোর সেই জট খুলে যাওয়া অতীত?
চমকে তাকাল হীরক। মানে?
–ওর জন্য এতদূর ছুটে এসেছিলি কেন হীরু? তুই কেন মঞ্জিনিকে ছেড়ে এর পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছিস?
হীরক চোখ সরু করে তাকাল এবার। আমি ছুটে বেরাচ্ছি তোকে কে বলল? জিনি? সেই জন্যেই কি তুই এখানে?
–না, জিনির সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি। কথাটা অশ্বথামা ইতি গজ টাইপের। কিন্তু বুদ্ধ এখুনি নিজের আসার উদ্দেশ্যটা মেলে ধরতে চাইল না।
–তবু কিছু তো শুনেছিস, তাই না?
–মিশিগান থেকে দেখা করার জন্য ছুটে এসেছিস তার তো জবরদস্ত কারণ থাকা দরকার। এটা অনুমান করা খুব কিছু কঠিন কি?
জোরে শ্বাস নিল হীরক। অনামিকা দুর্গাপুরের মেয়ে।
–তোর সঙ্গে কোনও আগেকার সম্পর্ক?
–না, ওর সঙ্গে নয়। অনামিকা মানে লেখা, ওর আসল নাম। আমাদের চাইতে অনেক ছোট। ওর দিদি রেখার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
–Oh my God! তুই কি চাপা রে, কোনওদিন লিক করিস নি এই নিউজটা। বলেই বুদ্ধ নিজের রাশ টানল। এতটা হালকা চালে বলার কথা নয় এটা। মঞ্জিনি জানত?
–না।
–কিন্তু হল না কেন?
আঙ্গুল দিয়ে নিজের কপাল দেখাল হীরক। গ্লাসের তলানিটুকু গলায় নামিয়ে দিয়ে মিনিবারের দিকে এগিয়ে গেল। বুদ্ধ আগে কি ঢেলেছিল সেই প্রশ্নে না গিয়ে সামনে যেটা পেল সেটাই ঢেলে নিল গ্লাসে। দুকুচি বরফ নিল। এটা কি নো স্মোকিং রুম?
–হ্যাঁ, আমি ছেড়ে দিয়েছি। চাইলে নিচে নেবে যেতে পারি।
–এটা নতুন ঢং হয়েছে হোটেলগুলোয়। আজকাল ফ্লাইটেও বন্ধ করে দিয়েছে।
–নিচে যাবি?
–থাক পরে।
হীরককে সময় দিচ্ছিল বুদ্ধ। নিজেই যখন মুখ খুলেছে, প্রশ্নবানে জর্জরিত করে লাভ নেই।
–মনে আছে বুদ্ধ এই দেশে এসেই আমার অ্যাক্সিডেন্ট? তিনমাস বিছানায় ছিলাম।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে তো। আমি তখনও এই দেশে। থাকব না যাব-র টানাপোড়েনের মধ্যে। তোকে দেখতে আসতে পারিনি।
–সেটা কিছু নয়। আমরা সবাই তখন ওইরকম অবস্থার মধ্যে দিয়েই যাচ্ছি। সেই সময় দেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগটাও অত সোজা ছিল না। চিঠিতেই খবরাখবর নেওয়া, মাঝে মাঝে ফোন। আমি বাড়িতেও জানাইনি। ঠিক সেই ভাবেই বাড়ি থেকেও আমাকে জানায়নি যে রেখার উপর অ্যাসিড অ্যাটাক হয়েছে।
–কি সাংঘাতিক? বাড়িতে জানত তোদের কথা?
–Not really! আন্দাজ করে থাকতে পারে। অন্তত পরে। এত দূরে থাকি, বাবা-মার মনে হয়েছে কোনও খারাপ খবর আমার কাছে পৌঁছে দিয়ে কোনও লাভ নেই।
–কিন্তু রেখা? ওর বাড়ির লোক? ওরা কোন খবর দেয়নি?
–উঁহু। ওরা দুর্গাপুর ছেড়েই পালিয়েছিল। কোনওভাবে রিট্যালিয়েট করেনি। নিজেদেরকে সবার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়েছিল।
–আহা, তোকে তো জানাবে। অন্তত রেখা?
–না, আমাকেও জানায়নি। রেখা আমার ছোটবেলার বন্ধু। কিন্তু আমি কোনদিন মুখ ফুটে সোজাসুজি ওকে কিছু বলিনি। যখন বললাম সেটা একেবারে আমেরিকা পাড়ি দেবার আগে। অনেকদিনের সম্পর্কের যে নিশ্চয়তা থাকে সেটা তৈরি হয়নি। অন্তত রেখা ভাবেনি-
–একটা কথা জিজ্ঞেস করব? তুই জানলে কী করতিস? No, let me rephrase. তুই তো জেনেছিলি একসময়। তারপর?
–জেনেছিলাম বছর খানেক বাদে।
–তারপর কী করলি?
–বুঝতে পারছিলাম না কী করব। ভাইকে বলেছিলাম ওরা কোথায় খোঁজ নিতে। ও কোনওভাবে কিছু খবর করতে পারল না। আমার তখন এমন অবস্থা নয় যে নিজে যাব। প্রথমেই তিনমাস নষ্ট করেছি। কীভাবে এই দেশে থাকা যায় তার সুলুক সন্ধান করছি। সবদিক দিয়ে একটা অনিশ্চয়তা ঘিরেছিল।
–আমাদের কাউকে বলিসনি একদম।
–সবারই নিজের নিজের প্রবলেম আছে, কতটুকু কাকে বলা যায়।
–বিজু জানত?
–না। অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল হীরক। জানলেই বা কী করত? আমি নিজে কী করতে পারতাম?
–তুই কী করতে পারতিস সেটা বড় কথা নয়। তুই কী করতে চাইছিলি সেটা বল?
–জানি না। দ্যাখ, দূরত্ব সম্পর্কে একটা কুয়াশা তৈরি করে। খুব কষ্ট হয়েছে ওর জন্য, আমাদের জন্য। কিন্তু সামনে থাকলে যেভাবে ফিল করতাম, সেই ইনটেনসিটি নিশ্চয় আসেনি। That’s a fact, I can’t explain otherwise. এটাও বুঝতে পারিনি কী ধরনের ভবিষ্যত গড়ে তোলা যায়। I was confused. I was wrong.
–Understand. এরকম হয়। We realize our mistakes on hindsight. তাহলে এখন কেন হীরু? এতদিন বাদে?
–এতদিন বাদে নয় বুদ্ধ। বহুদিন ধরেই এটা আমাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। রাত্রে বিছানায় শুয়ে অন্ধকারে রেখার মুখ খুঁজে বেরিয়েছি। জবাবদিহি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সেই প্রশ্নচিহ্নিত মুখের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছি। আবার কখনও রেখার মুখচ্ছবি জিগস পাজলের মত টুকরো টুকরো হয়ে পরে রয়েছে, আমি শত চেষ্টা করেও সব ঠিকঠাক জোড়া লাগাতে পারিনি। কিন্তু সেই চেষ্টায় রাতের অন্ধকার ফেটে সকাল বেরিয়ে এসেছে। Choices you make can haunt you for a lifetime.
–কিন্তু আমার ধারণা ছিল তুই আর মঞ্জিনি বেশ সুখী। বুদ্ধর গলায় এবার দ্বিধা, সে কি খুব বেশি ইন্ট্রিউড করছে? জানি তোর পার্সোনাল ব্যাপার, তবু জিজ্ঞেস করি। তুই কি ওকে ভালবাসিসনি?
–মঞ্জিনি আমাকে ভালবেসেছিল। এই স্বীকারোক্তিটা করতে ভাবতে হল না হীরকের। কিন্তু পরের ভাবনা কথায় প্রকাশ করার আগে অনেক সময় নিল। ভালবাসা ব্যাপারটা কী রে বুদ্ধ? সেটা কি নিজের সবটুকু দিয়ে দেওয়া? কিচ্ছু বাকি না রেখে? তাই যদি হয় আমার দিক থেকে কিছু বাকি রয়ে গেছিল। আমি জিনিকে নিয়ে ভাল ছিলাম, সুখী ছিলাম। কিন্তু নিজেকে নিয়ে খুশি ছিলাম না। আমি যে রেখার জন্য কিছুই করিনি সেই ভাবনা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। ভিতর থেকে গুটিয়ে গেছি।
–কিন্তু তুই তো জানতিস না, ও কোথায়? তাহলে?
–খুব খোঁজ করলে কি পেতাম না? আমি যদি দেশে ফিরে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজতাম, তাহলে? সেই প্রশ্নটাই আমাকে খোঁচা দিয়েছে সব সময়। একসময় নিজেকে শান্ত করেছি এই ভেবে যে আমার কিছু করার ছিল না। কিচ্ছু করার নেই।
–রেখাকে ভুলতে পারিসনি।
–নিজের অপারগতাকে ভুলতে পারিনি।
–কিন্তু মঞ্জিনি তোর বাস্তব আর রেখা, আই গেস, তোর সঙ্গে এক যুগ দেখা হয়নি। শুধুই স্মৃতি। তাহলে হঠাৎ কেন আবার সেই সম্পর্কটা জিইয়ে তুলছিস?
–অনামিকা মানে লেখার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হঠাৎ করেই। রেখার খোঁজ পেয়ে গেলাম। এতদিন যে কথা বলে নিজেকে নিরস্ত করেছি, সেটা আর রইল না তো? কীসের দোহাই দেব আর? এখনও দেখা না করলে নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবো। Now I have to meet Rekha, I have to face her.
–কী হবে এখন দেখা করে? What can you change? তোর একটা সংসার আছে, বউ, মেয়ে –
–আবার সেই হিসেবের কথা। এই রকম অনেক হিসেব আমি করেছিলাম দশ বছর আগে। তারপর একটা সিদ্ধান্তে এসেছিলাম। কী লাভ হল? আসলে মানুষকে নিজের কাছে জবাবদিহি করতেই হয়। নিজের কাছে ছোট হয়ে বেঁচে থাকা যায় না। এই আমি জিনিকেও কি ভালবাসতে পারি? অন্তত আমি পারি না। আমি নিজেকে ফিরে পেতে চাই বুদ্ধ।
৪
–মনে মনে এখনও সেই বাড়িতে ঘুরে বেড়াই জানো? ছেড়েছিলাম তখন কত, পনের? তারপরে কত বছর তো হয়ে গেল, ভুলতে পারিনি। এখনও আমার স্বপ্নে আসে। জানো হীরুদা?
হীরকের মনে হল কথাগুলো যেন সাবানের গোলা ছোঁড়ার মত একটা একটা করে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্বপ্ন বাড়ি এইরকম কিছু শব্দ রামধনু রঙ নিয়ে অনেকক্ষণ বাতাসে ভেসে রইল। কোলের কাছে বালিশ জড়ো করে জানালার পাশ ঘেঁষা লাভ সীটে পা গুটিয়ে বসে লেখা। জিনস আর হাতকাটা টি শার্টে খুব অনায়িকাচিত ভঙ্গি। বাইরে এখন হালকা রোদ। কাঁচের জানালা দিয়ে আসা আলোয় চোখের নীচের রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি ছায়াঘন।
ফ্লাইট ধরার জন্যে এয়ারপোর্টের দিকে বেরোনোর ঠিক আগে লেখার ফোন এসেছিল। তুমি কি ফিরে গেছ? শুনে খুব অবাক হয়েছিল হীরক। এত সকালে ফোন করেছে! লেখাও কি ওর মত ঘুমায়নি রাতে? তাছাড়া কালকেই তো দেখা হল! গত তিন সপ্তাহে দুইবার দেখা হয়েছে, লেখার ব্যাবহার হয় শীতল নয় আগুনের গরম হলকা। আর দুই জায়গায় তো দেখাই করতে চায়নি। হঠাৎ এমন কি হল যে এত নরম গলায় ফোন! তাহলে রেখা কি হ্যাঁ বলেছে? সেই জন্যে? এটাই প্রথম মাথায় এল। অন্যদিকে ক্ষণেকের নিস্তব্ধতা। তারপর লেখার কণ্ঠস্বর আবার ভেসে উঠল দূরভাষে। হ্যাঁ, দিদি দেখা করতে রাজি আছে। তুমি কি চলে গেছ? না হলে আমি ভাবছিলাম – একটু থেমে নিজেই বলে উঠেছিল, তোমার সঙ্গে তো ভালভাবে কথা হয়নি। আমি আজ ফ্রি, তুমি যদি থেকে যাও কথা বলা যাবে। একটা ইতস্তত ছিল লেখার বলায়। কিন্তু হীরকের মাথায় কোনও দ্বিতীয় চিন্তা আসেনি। পালটা প্রশ্ন করেছিল, এখনও হোটেলেই আছি। কোথায় আসব বল, আমি ফ্লাইট ক্যান্সেল করে চলে আসছি। লেখা নিজেই বরং হোটেলে আসতে চাইল। আমাকে গাড়ি করে নিয়ে যেতে পারবে? এত সকালে এঁদের বিরক্ত করতে চাই না।
রাত্রে হীরক আর বুদ্ধ ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়েছে। বাকিটা ফ্লাইটে ঘুমিয়ে নেবে ভেবেছিল। সেটা আর হবে না। তবে স্নান করে নিল হীরক। জামা কাপড় বদলানোর উপায় ছিল না, অন্তত স্নান করে আর কড়া একটা কফি খেয়ে নিজেকে তাজা করতে চাইল। বুদ্ধ ওর প্ল্যান চেঞ্জ শুনে অবাক হল, কাঁধে একটা চাপ দিয়ে বলল, ভাল থাকিস হীরু। অনেক সময় শোনার লোকেরও খুব দরকার হয়। আমাকে ফোন করতে পারিস যে কোনও সময়। মজা করেছিল হীরক – তুই তো এখন বিগ বস, অ্যাকুইজিশান আর মার্জারের দুনিয়ার লোক। সময় থাকবে এইসব ক্রন্দন কাহিনী শোনার? কথাটার মধ্যে অব্যক্ত খোঁচা ছিল। বলেই হীরকের মনে হল এটা ঠিক নয়। অকারণ। নিজের সব কাজ ছেড়ে এক কথায় দৌড়ে তো এসেছে এক রাতের জন্যে। সেই ভাবনাতেই জড়িয়ে ধরল বুদ্ধকে, Thanks for everything! বুদ্ধ হাত নেড়ে কাটিয়ে দিল, আমাদের মধ্যে এত ফর্মালিটির কী? একদিন মনীষেরও খোঁজ নিতে হবে রে। ওকে আমরা ত্যাজ্য করে দিয়েছি একদম।
বুদ্ধ বেরিয়ে গেছিল। তবে চেক আউট টাইম বারোটায়। আরও সাত আট ঘণ্টা থাকাই যায়। লেখাকে নিয়ে ওই রুমেই ফেরত এসেছিল হীরক। রাস্তায় টুকটাক কথা হয়নি তা নয়। কিন্তু বেশিটা সময় লেখা জানালার বাইরে চোখ রেখেই বসেছিল। যেন কিছু বলতে চায়, যেটা ধাবমান পৃথিবীকে না থামিয়ে বলা যাবে না।
যা বলতে চায় সেটা নিশ্চয় স্বপ্নের কথা নয়, যদিও শুরু করেছে সেখান থেকেই।
–কাল রাতে বুঝি সেই স্বপ্নই দেখলি?
–ছেঁড়া ছেঁড়া। আমার ভাল ঘুম হয়নি, ড্রিঙ্ক করে ফেলেছিলাম একটু। মাথাটাও টিপটিপ করছে এখন।
–হ্যাং ওভার আছে? কফি খাবি? হীরক উঠে পারকোলেটারে কফি বসিয়ে অন করে দিল।
লেখা স্বপ্নে ডুব দিল। হ্যাঁ, কালকেও সেই স্বপ্নটা ফেরত এল। কিন্তু এবার কেমন দেখলাম জানো বাড়িটাকে? হাসিতে টুকরো টুকরো কান্না ছড়িয়ে দিচ্ছিল লেখা। কেমনভাবে বাচ্চারা বাড়ির ছবি আঁকে, দেখেছ তো? দুদিকে চোখের মত জানালা আর মাঝখানে দরজাটা দাঁড়িয়ে আছে নাকের মত। আমি সেই দরজা দিয়ে ঢুকে গেলাম। ভিতরে সেই বাড়ি, সেই দেওয়াল যার প্রতিটা ক্ষতচিহ্ন, উঁচু নীচু, হাতের ছাপ দেখার জন্য আমাকে চোখও বুজতে হয় না। প্রতিটা চেয়ার টেবিল, বাবার ঘামে পালিশ উঠে মসৃন চকচকে হয়ে যাওয়া আরাম কেদারার হাতল সব যেন দেখতে পাচ্ছি। অথচ চলছি তো চলছি, কিছুতেই আমার আর দিদির ঘরটাতে পৌঁছাতে পারছিলাম না। লেখার চোখেমুখে পৌঁছাতে না পারার হাঁসফাঁস ভাব ফুটে উঠেছিল। ওর বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে হীরক ভাবল, এটা কি লেখার অভিনয়ের গুণ না এমনিতেই ও এইরকম এক্সপ্রেসিভ। কিংবা অনেকের মুখেই এমনি ভাব ফোটে, কিন্তু ওর চেহারার চৌম্বক আকর্ষণ প্রতিটা ওঠাপড়ায় চোখকে বেঁধে রাখছে। পৌঁছোতে পারলাম না জানো। কিছুতেই পৌঁছোতে পারি না। তার আগেই ঘুমটা আবার ভেঙ্গে যায়। বলার ভঙ্গিতে মনে হল এমন স্বপ্ন ও মাঝে মধ্যেই দেখে। কিছুক্ষণ ভেবে লেখা অস্ফুটে বলল, স্পষ্ট দেখলাম ঝিল্লি জানালা দিয়ে রোদ এসে আমাদের গায়ে জেব্রা ক্রসিং বানাচ্ছে। মনে আছে আমাদের ঝিল্লি জানালা ছিল। আমি আর দিদি গরমের বিকেলে রোদ আটাকানো বন্ধ জানালা দিয়েও বাইরেটা দেখতে পেতাম। জানো ওই ঝিল্লি জানালা দিয়ে আমি আর দিদি তোমাকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে কত হাসাহাসি করেছি। বলতে বলতে মেঘ ফাটা রোদের মত ছোটবেলার চেনা হাসিটা বেরিয়ে এলো। ঠোঁট কতটা ফাঁক করলে ভাল দেখায় সেটা ভুলে যাওয়া হাসি।
–আমাকে দেখে? কেন? কফি হয়ে গেছিল। লেখার জন্যে কফি ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করল হীরক।
–তুমি কিরকম অদ্ভুতভাবে হাঁটতে না! বাব্বা! ভুলে গেছি নাকি! রাস্তার ঢিলে লাথি মারতে মারতে যেতে। আমরা কত দেখেছি। আমাদেরও ওমনি জানালা ছিল। আজকাল আর সেরকম হয় না। তবে আমার ছোটবেলায় একাত্তরে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ হল, নাইট কারফিউ। তখন খবরের কাগজ আঠা দিয়ে জানালায় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কবাটে তার স্মৃতি চিহ্ন রয়ে গেছে।
–এখনও?
–আশ্চর্য হলেও সত্যি। দুবছর আগে বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখনো দুই এক টুকরো কাগজ লেগে ছিল।
–ওই টুকরোগুলো সারা জীবন লেগে থাকে। ভোলা যায় না।
–মানে? কিছুটা অবাক হয়েই তাকাল হীরক।
–কি জানো হীরুদা, একসময় আমার জীবনের সব জানালায় এরকম কাগজ লেগে গেছিল। সারা দিনের কারফিউ। প্রত্যেকদিনের জন্য। কফির কাপে চামচ নেড়ে চিনি গুলছিল লেখা। চামচের উপর প্রতিহিংসা নিচ্ছিল যেন, না হলে অত আওয়াজ করে নাড়ানোর কথা নয়। সে কাগজ খোলার সাধ্য আমার ছিল না তখন। রাগ এতক্ষণে দীর্ঘশ্বাস হয়ে বুকে লুকিয়েছে। বিষন্নতার ছায়ায় চোখ উপচানো কাজলা দীঘি। এই মুহূর্তে লেখার কোনও ভণিতা নেই, রাগ নেই। আপনজনের কাছে মনের ভাঁড়ার খুলে দিয়েছে। আপ্লুত লাগছিল হীরকের। কেউ যখন সমব্যাথী মনে করে বিশ্বাস করে, নিজের উপর আস্থা ফিরে পাওয়া যায়। কষ্টও হচ্ছিল। হয়তো হীরকের কিছু করার ছিল।
দুর্গাপুর ছেড়ে চলে এলাম। দিদিকে নিয়ে মা কলকাতা চলে এল মাসির বাড়ি। আমিও সঙ্গে। ওখানে থেকেই দিদির সার্জারি শুরু হল। একটা না। একের পর এক। ড. সলিল ভৌমিক, খুব বড় কসমেটিক সার্জন। বাঁ চোখটা তো গেছিল, বাঁচানো যায়নি। কিন্তু ডান চোখটা রক্ষা পায়। যদিও তার চারপাশে, নাকে, কপালে কোথায় নয়। একটার পর একটা অপারেশান হল। ছ মাসের উপর মাসির বাড়ি থেকে আমরা ফিরে এলাম। কিন্তু দুর্গাপুরে আর নয়, পানাগড়। সব শিকড় গোঁড়া থেকে উপরে নিয়ে আসা। পালিয়েই এলাম বলতে পার। লোকে জেলখানা থেকে পালায়, আমরা পালিয়ে এসে একটা জেলখানায় ঢুকে গেলাম। আমাদের নিজেদের বানানো কয়েদখানা। যেখানে কোনও আলো বাতাস খেলা বারণ হয়ে গেল। যেন জানালায় কাগজ, দরজায় খিল। যেখানে হাসা বারণ, চেঁচিয়ে কথা বলা বারণ, এমন কি প্রাণ খুলে কাঁদাও বারণ।
–কিন্তু কেন? তোরা পুলিসে খবর দিতে পারতিস।
–দিদিকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় পুলিসে এফআইআর করতে হয়েছিল। কদিন বাদে বাড়ির দরজায় বোম পড়ল। বাপি এফআইআর উইথড্র করে নিল। মা তখনই ঠিক করল দুর্গাপুর ছাড়তে হবে। কলকাতা থেকে ফিরে আমরা পানাগড়ে চলে গেলাম। দুর্গাপুরে আর আসিনি। শুনেছি বাড়ির ভাল দামও পাওয়া যায়নি।
–আমাকে কোনও খবর দিতে পারলি না?
–তুমি আসতে বুঝি? লেখার গলার বিদ্রূপ চাপা রইল না।
–কোথায় আছিস জানলে নিশ্চয় আসতাম। রেখা জানাল কোথায়?
–কীভাবে জানাবে? চিঠি লিখে? তোমার কোনও ধারণা নেই হীরুদা এরকম একটা অ্যাটাকের পর কী অবস্থা হতে পারে। দিদির মুখের দিকে তাকানো যেত না পর্যন্ত। মুখ বলে যেন কিছু ছিল না। মোম গলে পড়তে দেখেছো হীরুদা, দিদির মুখ যেন সেইরকম গলে পড়েছিল। কে তোমাকে চিঠি লিখবে? কে তোমাকে খবর দেবে তখন?
–খবর না জানলে আমি কী করে খুঁজে বের করব বল তো? বলায় সেরকম জোর ছিল না। খবর না পাওয়ার যে সান্তনা নিজেকে দিত হীরক সেটাও কেমন ফাঁকা আওয়াজের মত লাগছে।
–আচ্ছা না জানালে খুঁজে বের করা যায় না? যদি অ্যামেরিকা আসার আগে দিদির সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে যেত আর কেউ দিদির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ত, তুমি কী করতে? দিদি তোমায় না জানিয়ে লুকিয়ে বসে থাকলে, তুমি আর খোঁজ করতে না? নাকি তখনও হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে। শুধু বিয়ের সাতপাকেই রেস্পন্সিবিলিটি তৈরি হয়?
হীরকের সত্যি কিছু বলার ছিল না। নিজের কাজের পরিণতি তাকেই তো বইতে হবে। ভিতরে ভিতরে সেটাই বয়ে চলেছে। আজ লেখার কাছে শুনছে, কাল রেখার কাছে শুনবে। সেটা মেনে নিয়েই তাকে এগোতে হবে। তাই বিড়বিড় করে বলল, আচ্ছা সে ভুল না হয় আমার, কিন্তু আর কেউ পাশে এসে দাঁড়াল না?
–কার অত কলজের জোর আছে। কেউ ট্যাঁ ফোঁ করল না। আমরা পাততাড়ি গুটিয়ে পানাগড়ে বসতি বানালাম।
–পানাগড়ে কেন? কলকাতায় থেকে যেতে পারতিস।
–বাপি পানাগড় কলেজে চাকরি পেল যে।
–তারপর?
–তারপর আর কি। দিদি নিজেকে একটা ঘরে বন্ধ করে নিজের জীবনের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। বাপি জীবনটাকে হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে। মা ঠাকুরের কাছে সমর্পিত প্রাণ। আর আমি বোবা হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
খুব অবাক লাগছিল হীরকের। এইভাবে কেউ বাঁচে নাকি? কাকিমাও? মাধুরীকে যা মনে আছে হীরকের ভেঙ্গে পড়ার মহিলা উনি নন। কাকু গুলি খেয়ে পড়েছিল, তখনও মাথা ঠান্ডা রেখেছে।
–পরপর একেকটা ঘটনা মাকে যে কীভাবে ভিতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল আগে বোঝা যায়নি। কাঠের ভিতর ঘুণ ধরলে যেমন বাইরে থেকে বোঝা যায় না, তারপর একদিন ভুস করে ধসে পড়ে। ওমনি। মার সাহসে ভর করে যে ডালপালা মেলব, সেটা হল না।
–কী করলি?
–স্কুলে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনও মুক্তি ছিল না হীরুদা। তাও ক্লাস ইলেভেন থেকে বাপির কলেজে। কি নজরদারি যে চলত ভাবতে পারবে না। এমনকি কোনও ছেলের কাছ দিয়ে গেলেও বাপির কাছে খবর থাকত। আর বাড়িতে আমার হেনস্থা। দিদিকে নিয়ে কলকাতায় হাসপাতালে যাওয়াটাই তখন আমার একমাত্র বেড়ানো।
–কিছু বললি না? মুখ বুজে মেনে নিলি কেন?
–বিদ্রোহ করতে ইচ্ছা করত। কিন্তু কিছু করার উপায় ছিল না। কি বয়েস তখন আমার। জোর কোথায়!
–তাহলে?
–পালালাম। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে মাসির সাহায্যে বাড়ি ছাড়লাম। কিন্তু একাই। মাসি তার দিদিকে যমের মত ভয় করত। সাহায্য করেছে, কিন্তু চুপিচুপি। বলতে বলতে চুপ হয়ে গেছিল লেখা। অস্ফূটে বলল, কতগুলো বছর লেগে গেছিল সেই কাঁটাতারের বেড়া টপকাতে। পেরিয়ে তো এলাম। কিন্তু ক্ষতচিহ্ন আজও বয়ে বেড়াচ্ছি।
হীরক চুপ করে বসে শুনছিল। খুব ইচ্ছা করছিল লেখার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বুকে টেনে নিয়ে আদর করে দেয় সেই ছোট্ট লেখিকে। এত উচ্ছল, প্রাণবন্ত মেয়েটা কি কষ্টই না পেয়েছে। কচি এক ঘাসের চারাকে ইট চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল যেন। সেটাও কিছু কম কষ্ট নয়।
–তোমার ওপর এত রাগ কেন জানো? তার একজোড়া চোখ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে হীরকের উপর রাখল লেখা। সেই চোখে অনুযোগ আছে, কিন্তু আগেকার সেই জ্বালা লাভার মত ছড়িয়ে পড়ছে না। জীবনে ভাল কিছু হতে পারে সেই বিশ্বাসটাই হারিয়ে গেছিল। ছোট বয়সে বাপিকে গুলি খেয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকতে দেখেছি। তারপর দিদিকে। এগুলো দুর্ঘটনা। একটা শয়তানের বদমাইশি জড়িত আছে। কারও জীবনে যেন এমন কিছু না হয়। কিন্তু তুমি যে একবারও খোঁজ করতে এলে না, নিজের পথে চলে গেলে সেই আঘাতটা আমাকে অনেক বেশি বেজেছিল। তুমি যে আমাদের ছিলে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে দিদি তোমাকে নিয়ে ওর কত স্বপ্নের কথা আমাকে বলেছে। সেই ভালবাসার ওম আমার বয়ঃসন্ধিতে উত্তাপ দিয়েছে। সেই তুমি একবারও খোঁজ নিলে না আমাদের? লেখার কথায় এক অপরিসীম বিষণ্ণতার মোড়ক। গভীর কিছু হারানোর কষ্ট একটা ফাঁকা হৃদয়ের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরছিল যেন। তুমি ভালাবাসাকে অবিশ্বাস করতে শেখালে হীরুদা। আমার মনে হল মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা শুধুই স্বার্থের। প্রয়োজনের। শরীরের। ভালবাসাকে ভয় পেতে শিখলাম।
লেখার প্রতিটা কথার সঙ্গে সঙ্গে হীরক সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছিল। যে অপারগতা তাকে এতগুলো বছর কুড়ে কুড়ে খেয়েছে তা যেন দুই গুণ হয়ে ফিরে এল। লেখা বলছিল তখনও। ভালবাসা জীবনে কতবার আসতে চেয়েছে হীরুদা। আমি তাকে আঁজলা ভরে গ্রহণ করতে পারিনি। মনে হয়েছে যা আমি সত্যি হিসাবে মনে করছি, যে কোনও মুহূর্তে দেখবো তার মধ্যে অন্য স্বার্থ জড়িয়ে আছে। কিংবা এ কেবলই শারীরিক আকর্ষণ। আর কিছু নেই, কিছু থাকতে পারে না। ভালবাসা বলে কিছু হয় না।
মাথা নীচু করে বসেছিল হীরক। কী উত্তর দেবে এর!
–তবু আজ কেন ছুটে এসেছি জানো হীরুদা? উত্তর পাবে বলে এই প্রশ্ন নয়। লেখা যেন নিজেকেই এই উত্তরটা শোনাচ্ছে সেই ভাবে বলল। আমি তোমার চোখে ভালবাসা দেখেছি কাল। যে ভালবাসা পথ হারিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু এখনও রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তুমি বীরপুরুষ না কাপুরুষ তার বিচারে আমি না-ই বা গেলাম। সেই বোঝাপড়া তুমি দিদির সঙ্গে কোর। কিন্তু আমি বারবার ফিরিয়ে দেবার পরেও তুমি কোনও অপমানের তোয়াক্কা না করে এতবার করে ফিরে এলে, সেটা কোন মন্ত্রে? ভালবাসা না থাকলে হয় না। কোথাও তো কিছু আছে। কিছু থাকে। কাল তুমি চলে আসার পরে অনেক ভেবেছি জানো। যে কাঁটাতারের বেড়া আমাকে ঘিরে থাকত, অন্তত তার একটা তো টপকাতে পারলাম। তাই বা কম কি? শুধু সেইটুকুর জন্যেই আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব, হীরুদা।
–তুই স্বপ্নের কথা বলছিলি না লেখি। আমিও না অনেক হাবিজাবি স্বপ্ন দেখি।
–কী স্বপ্ন দেখো হীরুদা?
–বেশিরভাগ স্বপ্নেই আমি যেন পালাচ্ছি, চারদিকে অনেক রক্ত। কখনও ভাঙা কাঁচ, আমি পা বাঁচিয়ে যেতে পারছি না। পা কেটে যাচ্ছে। তবু পালাচ্ছি। বলতে বলতে গলার স্বর গাঢ় হয়ে এল হীরকের। বড় ভয়ানক সেই স্বপ্নগুলো লেখা।
–আমাদের ছোটবেলার স্বপ্নগুলো খুব হালকা থাকত, তাই না হীরুদা? মেঘের মত। এখনকার স্বপ্নগুলো ভারী। সীসার মত বুকে চেপে থাকে।
–বাস্তবেও যে আমি পালিয়েছি লেখা, ছুটেছি সাজানো জীবনের দিকে। এখন ইচ্ছা করে জীবনটা থেকেই পালিয়ে যেতে। থমথম করছিল হীরকের চোখমুখ। নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে থাকার যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।
–না হীরুদা। কখনও নয়। পালিয়ে গেলে হয় নাকি? জীবনের মুখোমুখি হতে হয়। কী তাস পাবো সেটা তো আমাদের হাতে নেই। যা পেলাম সেটা নিয়েই খেলতে হবে। আমি দিদিকে এত বছর ধরে সেটাই বুঝিয়েছি।
লেখাকে যত দেখছিল অবাক হচ্ছিল হীরক। টেপ ফ্রক পড়ে দিদির হাত ধরে তিড়িং তিড়িং লাফাতে লাফাতে চলেছে লেখা এই ছবিটাই যেন চোখে বেশি ভাসে। ওর আট নয় বছর বয়সে হীরক দুর্গাপুর ছেড়ে কলকাতায়। সেভাবে বেড়ে উঠতে তো দেখেনি চোখের সামনে। এই সুবিবেচক সাহসী নারীকে দেখে হীরকের মন ভরপুর হচ্ছিল। সেইটাই মুখ দিয়ে বের হয়ে এল। তুই কত বড় হয়ে গেছিস লেখি। কুমীরডাঙ্গার দুধেভাতে লেখি তো আর নেই।
ছোটরা কোনওভাবে ছোটই থেকে যায়। বিশেষত যখন তাকে বড়র আসনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তখন সে বড় নায়িকা নয়। মুখে সেই সলজ্জ হাসি টেনে লেখা বলল, বাহ্, হবো না হীরুদা । নাহলে কুমীরে টেনে নিয়ে যাবে যে। ফিল্মের লাইন তো দেখনি। সুযোগ দিলে চোখের সামনে শাড়ি টেনে খুলে নিয়ে চলে যায়।
চমকে তাকাল হীরক।
–না, না আমার জন্য ভেবো না। এখন তো বেশ নাম হয়ে গেছে। এমনকি শুরুতেও কেউ আমাকে ঘাঁটাতে সাহস পেত না। আঘাত পেয়ে পেয়ে আমার চারপাশে একটা দুর্ভেদ্য পাঁচিল বানিয়ে ফেলেছি, সেটা পেরিয়ে দুর্গে ঢুকতে গেলে অনেক কসরত করতে হয়। ভালবাসাকেও ঢোকার টিকিট দিইনি।
সেটা হীরকের থেকে বেশি আর কে জানে। জানতে ইচ্ছে করছিল রেখা কীভাবে এই সময়টা পার করেছে। খুব সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা – রেখা কেমন আছে রে?
পরিপূর্ণ চোখে মেলে তাকাল লেখা। সেই চোখের স্বচ্ছ আকাশে আড়াল করার কোনও মেঘ নেই। কেমন থাকতে পারে বলো? নিজেকে এতগুলো বছর প্রায় একটা ঘরে আটকে রেখেছে। ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া বাড়ি থেকে বেড়োয়নি। এমনকি আয়নার দিকেও তাকায়নি এতগুলো বছর। দিদির ঘরে কোনও আয়না পর্যন্ত ছিল না হীরুদা, নিজেকে এত ঘৃনা করত। She was completely ruined. She hated herself. She was so depressed. শুরুতে কয়েকবার সুইসাইড করার চেষ্টাও করেছিল।
নিজের অজান্তেই একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল হীরকের মুখ থেকে।
–বাবা সাইকিয়াট্রিস্টকেও দেখিয়েছে। দিদিকে বাঁচাল শুধু ওর গান। বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ওই গানেই ডুবিয়ে দিয়েছিল নিজেকে। কিন্তু ওটাই কি জীবন? জীবনে কি আর কিছু নেই? দিদির কি জীবন থেকে কিছু পাওয়ার ছিল না? এই ভাবনাই আমাকে তাড়া করে ফিরেছে। একদিন বাড়ির জেলখানা থেকে পালিয়েছিলাম। কিন্তু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একটু পা রাখার জায়গা পেতেই আমি বাবা মার কাছে ফিরলাম।
–এতদিন বাবা মার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না? এত বড় আঘাত কীভাবে দিলি ওদের লেখা?
–ছিল, কিন্তু দূর থেকে। বাবা বিভিন্ন কলেজে খোঁজ করতে করতে একদিন আমার খবর পেয়ে গেল। ক্লাস করে বেরিয়ে দেখি বাবা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমি ফিরিনি। আমার কোনও উপায় ছিল না হীরুদা। নিজেকে বাঁচাতে হত। তাই পালিয়েছিলাম। কলেজ শুরু করলাম, অনেক টিউশনি শুরু করলাম। মাসির কাছে খোঁজ পেতাম, কিন্তু নিজের রোজগারের কিছুটা ব্যাবস্থা হওয়ার আগে আমি বাড়িতে ঢুকিনি আর। ওরা এসে দেখা করেছে, কিন্তু আমি বাড়ি যাইনি দুই বছর। যদি আবার আটকে দেয়। বাবা মা আমাকে ক্ষমা করতে পারেনি বহুদিন। হয়তো দিদিও। কিন্তু আমাকে এটা করতেই হত। ওইভাবে নিজেকে গলা টিপে মেরে ফেলার কোনও কারণ পাইনি আমি। তাই বলে দিদিকে তো ভুলে যাইনি। দিদির এত ভাল গানের গলা। একদিন দিদিকে লুকিয়ে ওর গানের টেপ বানিয়ে আমি আমার চেনা এক মিউজিক ডাইরেক্টারকে দিলাম। দিদির অপূর্ব গলা। বরাবরই ভাল ছিল, আর এত বছর সাধনার মত গান গাইছে ভাল না হয়ে যায়? মিউজিক ডাইরেক্টার তো রাজি হল, কিন্তু দিদি নয়। ওর সাফ কথা আমি বাইরে বেরোব না। কত যে বুঝিয়েছি। আমি বুঝালাম এটা তো প্লেব্যাক দিদি, তোর মুখ কে দেখতে পাবে? কিন্তু ওর এক কথা, লোকের সামনে বেরোতে চায় না। আমি এই নিয়ে দিদির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি।
–তারপর?
–কিছুতেই শুনবে না। শেষে আমি এক এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ওদেরই এক কাউন্সেলার, কণিকা, সে নিজেও অ্যাসিড ভিক্টিম। দিদির সঙ্গে এসে কথা বলল। নিজের কাহিনি শোনাল। এভাবে লুকিয়ে জীবন কাটানোর যে কোনও কারণ নেই, এটা যে দিদির কোনও লজ্জা নয় সেটা বোঝাল। এতক্ষণে লেখার মুখে তৃপ্তির হাসি ছড়াল। It worked. দিদি গাইতে রাজী হল।
–এখন তাহলে বাড়ি থেকে বেরোয়?
–সেরকম নয়, রেকর্ডির জন্য যায়। অন্যসময় এখনও নিজের ঘরেই। এই তো ক’মাস হল, আরও ক’দিন যাক। প্রথম সিনেমায় একটা গান গেয়েছিল। খুব প্রশংসা হয়। এখন আরও বেশ কিছু অফার এসেছে।
–আর ম্যাগাজিনের ছবি?
–রাজি করানো সোজা ছিল না। ওই কণিকার কথাতেই শেষে হ্যাঁ বলল। গত ছয় মাসে অনেকটা এগিয়েছে। বাবা মাও এখন অনেক নর্মাল। আমি ওদের সঙ্গে থাকি না, আমার প্রফেশানে সেটা ডিফিকাল্ট। কিন্তু পানাগড় থেকে কলকাতায় নিয়ে এসেছি এক বছর আগে। ওরা আলাদাই থাকে, কিন্তু দেখা হয় নিয়মিত।
–তুই অনেক কিছু করেছিস লেখা, সাচ্চা মেয়ের মত কাজ করেছিস।
–আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দ কীসে হয় জানো?
–কী?
–দিদির ঘরে একটা আয়না লাগাতে পেরেছি হীরুদা। এতগুলো বছরের পরে।
[আবার আগামী সংখ্যায়]