নারীর স্বর ও গৃহকেন্দ্র— লীলা মজুমদারের বিরুদ্ধে আমাদের ঔদাসীন্যের গল্প

যশোধরা রায়চৌধুরী

 


কবি, প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

কথায় বলে পরের মুখে ঝাল খেতে নেই। আসলে নিজে না পরখ করে অন্যের কথা শুনে চলার বিপদটিই ঘটে গিয়েছিল আমার ক্ষেত্রে। কোনওদিনই উৎসাহ পাইনি নিজ উদ্যোগে লীলা মজুমদারের লেখা “বড়দের” তথা প্রাপ্তবয়স্কদের উপন্যাসগুলি পড়তে। মাকু বা হলদে পাখির পালক, টং লিং বা বাতাসবাড়ি, পদিপিসির বর্মিবাক্সের নেশায় পেয়েছিল যেখানে আমাকে, সেখানে কেন এই ঔদাসীন্য? আসলে, দীর্ঘকাল পূর্বে  আমার ও আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই  মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল কয়েকটি পূর্বধারণা। এক, লীলা মজুমদারের উপন্যাসগুলির বিষয়ভাবনায় কোনও বৈচিত্র্য নেই। দুই, সব গল্পের শেষেই নায়ক নায়িকার মিলন ও বিবাহে “উত্তরণ” থাকে। বিবাহই ছিল লীলা মজুমদারের নায়িকাদের একমাত্র গন্তব্য। তিন, কাহিনিগুলি উচ্চবিত্তীয়ের ড্রয়িং রুমে আটকে থাকে।

মোটের ওপর, কিশোরসাহিত্যিক হিসেবে লীলা যতটা নম্বর পান, বড়দের লেখক হিসেবে তিনি বিশেষ নম্বর পান না। তাঁকে লেবেলে সেঁটে দিয়েছি আমরা শিশু কিশোর সাহিত্যের। পরন্তু, গবেষকদের মতে,  তিনি নারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বিরোধীই বলা যায়। মেয়েদের বিবাহ পরিবার ও সন্তানধারণকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে বলেছেন তিনি। গৃহিণীদের রান্নাঘরের বাঁদী বানাতে চান তিনি। নারীবাদীদের চোখে তিনি মোটামুটি পাতে দেবার মত নন, প্রায় আপত্তিকর অপাঠ্য। এই বিশ্বাসের বশে জন্ম ইশতক গত ৫০ বছরে লীলার প্রাপ্তবয়স্ক উপন্যাস আমার অপঠিতই থেকে গেল।

এত দীর্ঘ সময়ের পর যখন লীলার উপন্যাসগুলো হাতে নিলাম, আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম নারীবাদী উপন্যাস, উচুদরের উপন্যাস, টেনে রাখা সুপাঠ্য উপন্যাস, যে কষ্টিপাথরেই ফেলি না কেন, লীলার লেখা পাশ করে যাচ্ছে।

আমার নারীবাদী চশমা না খুলেই তাঁকে আমার এত এত ভাল লেগে যাচ্ছে। আরও বলা ভাল, উপন্যাসগুলোকে আমার বেশ বেশি করেই নারীবাদী বলে মনে হচ্ছে। কেন?

এক, উপন্যাসগুলি নির্লজ্জভাবে নারীকেন্দ্রিক। নাম থেকেই তো মালুম। প্রতি কাহিনির কেন্দ্রে আছে একজন করে মেয়ে। শ্রীমতী, মণিমালা, মণিকুন্তলা এগুলো সরাসরিভাবে শীর্ষেই বহন করে প্রটাগনিস্ট এর নাম। চীনে লন্ঠন, নাটঘর, আয়না এবং হ্যাঁ, ঝাঁপতাল। এগুলো পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে লীলা আমাদের কাছে বড়দের লেখক হিসেবে এত এত আন্ডাররেটেড কেন!

দুই, লেখাগুলি সময়ের থেকে এগিয়ে থাকাই কি তবে কারণ? কারণ অধিকাংশ প্রোটাগনিস্ট শিক্ষিত, নিজের জোরে টাকা কামায়। যেমন কাশীতে দাদুর কাছে গান শিখে, ও নিজের তাগিদে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রেকর্ড করা, ফিল্মের গায়িকা মণিকুন্তলা। সেলফ-মেড মেয়ে। যার অতীতে একটা বৈধব্যের লুকনো ক্ষত আছে। আছে সৎ মায়ের অবিচার পাওয়ার বেদনাও। অন্যত্র আছে পিতার কাছ থেকে অপরিমিত অর্থ পাওয়া মেয়ে। চাকরি করা মেয়ে। প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত শুধু নয়, হাই সোসাইটির মেয়ে। পার্টিতে যায়, রং মিলিয়ে শিফনের শাড়ি পরে। এই অগ্রগামী সচেতন মেয়েদের বাংলা সাহিত্য তো আগে দেখেনি! এবং যে সময়ে শরৎ চন্দ্রের কলমের জয়গান চলছে, সে সময়ে মাথায় ঘোমটা দেওয়া বধূর করুণ কান্না বাদ দিয়ে অন্য কোনও বয়ান কি মেয়েকেন্দ্রিক উপন্যাসে আদৌ জলচল ছিল?

তাই কি এই উপেক্ষা? যদিও অনুরূপ লিখন আমরা পেয়েছি বাণী রায়ের কলমে। তিনিও আজকের দিনে নতুন করে পাঠ্য হচ্ছেন আমাদের।

তিন, হ্যাঁ, লেখাগুলিতে একটি কি দুটি মাসিমা -পিসিমা গোত্রীয় চরিত্র আছেই যারা সারাদিন চা বানাচ্ছেন, লুচি ভাজছেন, খেতে দিচ্ছেন, বাজার গোছাচ্ছেন, অথবা ভাঁড়ার বের করে দিচ্ছেন। অতি চেনা এই চরিত্রেরা অনেকেই আনন্দের প্রতিমূর্তি, এনার্জির উৎস। কিন্তু সবাই মোটেই পবিত্রতার প্রতিমূর্তি নয়। বরং সাদাকালোর বাইরেও ধূসর সবরকমের পরদায় আঁকা। ডিফারেন্ট শেডস অফ গ্রে। প্রতি উপন্যাসেই আছেন অভাজন, দরিদ্র, আশ্রিতা আত্মীয়ারা। ভিলেন বা কুচক্রী মন্থরা হতে হতে হননি। কারণ লীলার অত্যন্ত সহানুভূতির কলম তাঁদের চুরি করতে বা বড়লোক আত্মীয়ের থেকে টাকাকড়ি দেদার নিয়ে নিজের সংসারে, নিজের ছেলের সংসারে দিতে দেখান। আবার একইসঙ্গে তারা কর্মঠ। উদয়াস্ত কাজ করে। সকালে এক কাপ খুব বেশি করে দুধ চিনি দিয়ে চা খেয়ে, সারাদিনের জন্য লেগে পড়ে সংসার ঠেলতে। একধরনের সেবা ব্রতই তাঁদের স্থিত রাখে সংসারের কেন্দ্রে, সেবার যত্নের তথাকথিত নারীসুলভ ব্যবহারে থাকেন। এই সেবা ব্রত কিন্তু তাঁদের ওপর চাপানো হয়নি। তাঁদের স্বধর্ম বলা যায় একে।

মোদ্দা কথা, তাঁরা যে সংসারকে বাইরে থেকে এসে আগলাচ্ছেন, সে সংসারের কেন্দ্রে আছে একটি উষ্ণতাময় রান্নাঘর।

আসলে এই রান্নাঘরের সঙ্গে প্রথম বা দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদীদের প্রচন্ড সমস্যা, অস্বীকার আছে, ছিল। এবং তাঁদের অবশ্যই ধারণা, মেয়েদের ওপর এই কর্তব্যের ভার, সেবা ও যত্নের ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়, ও হয়েছে চিরকাল। যেমন, সিমোন দ্য বোভোয়া মেয়েদের রোজকার অবৈতনিক গৃহকর্মকে মনে করতেন একঘেয়ে ছুটিহীন পুরস্কারহীন। আমাদের হাত অব্দি এসে পৌঁছেছে এই ধারণা। তাই আমরা ভাবি বুদ্ধিমন্ত মেয়েরা করবে বাউন্ডুলেভাবে  সংসার। এক অর্থে তাহলে আমরাও অবমূল্যায়ণ করি সেবা যত্নকে।

সিমোনকে নিজের লেখাপড়ার কাজ করেও বাধ্যত গৃহকর্ম করতে হত, কেননা যাঁর সঙ্গে তিনি বসবাস করতেন সেই জঁ পল সার্ত্র নিজে হাতে কোনও কাজ করতে পারতেন না। সিমোনের লেখায় তাই স্বীকৃতিহীন ঘরকন্নার কাজের বাস্তব বর্ণনা পাই। “ঘরোয়া কাজ, সেই কাজের দ্বারা নারী, নিজেকে, নিজের শারীর মানস সীমাবদ্ধতাকে, অতিক্রম করে কোনও উদ্‌বর্তিতা (transcendence)-র অভিমুখী হতে তো পারেই না, বরং পুরুষের উদ্‌বর্তিতা সম্ভব হয় তার সঙ্গিনী গৃহিণীর বাধ্যতামূলক অন্তবর্তিতা (immanence)-র মূল্যে।” সিমোন একে দেখান এক বন্দিদশা হিসেবে।

সেকারণেই কি তবে, লীলার এই লেখাগুলি নারীবাদীদের কলমের খোঁচায় আস্তাকুঁড়ের দিকে যাত্রা করেছে?

অথচ, এই রান্নাঘর-সংসারের চক্রের খুঁটিনাটি যে নারীবিশ্বের কত বড় ডকুমেন্টেশন তা ভুলে যান নারীবাদীরা। সাম্প্রতিক কেয়ার এথিক্স বা সেবা নীতি-র প্রবক্তা ক্যারল গিলিগান, ভার্জিনিয়া হেল্ড, নেল নডিংস-এর বক্তব্যের সার এখানে বারবার মনে করে রাখা দরকার। পুরুষের বিশ্বকে নারী নিজে অধিকার করবে বা প্রতিস্থাপন করবে নারীর নিজস্ব প্রবণতাকে এড়িয়ে, এ কথাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে এই নীতিবাদ। নতুন এই দেখা। পুরুষ নারীর পৃথক বিশ্বকে স্বীকার করা থেকে শুরু করে তার মনোজগৎ ও তার নিজস্ব সেবার কামনাকে স্বীকৃতি দেওয়া, এই মার্কিন নারীবাদী/ মনস্তাত্ত্বিক/ শিক্ষাবিদেরা আজ কথা বলছেন পৃথিবীতে সেবার ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে। কেয়ার এথিক্স-এর দিক থেকে দেখলে লীলা মজুমদারের মাসিমারা বাস্তব শুধু না। তাঁদের নিজস্ব কেন্দ্রটি অক্ষত রেখেই তাঁরা পা রেখেছেন জীবন বৃত্তে। এজেন্সি তুলে নিয়েছেন।

রান্নাঘরকে না ভালবাসার অধিকার যদি মেয়েদের থাকে, রান্নাঘরকে ভালবাসার অধিকারও মেয়েদের আছে। রান্নাঘরের রাজনীতি এক বাস্তব বস্তু। সেই বাস্তবতাকে একভাবে দেখিয়েছেন আশাপূর্ণা। অন্যভাবে লীলা মজুমদার। সদর্থক ফিল গুড তা সর্বদা নয়। যদিও ফিলগুডের দিকে যাত্রা করে লীলার কলম প্রায়শই।

চার। “A feminist novel explores what it means to not only be a woman, but to be a woman from a certain time and place. It explores the question of identity—the stories of who we are.” পুরনো একটা সংজ্ঞা। মিলে যায় উত্তর ঔপনিবেশিক নারীবাদী যে কোনও উপন্যাসের ক্ষেত্রে। লীলার লেখার সঙ্গেও।

হতেই পারে, মহাশ্বেতা দেবীর অভিমুখ যেখানে ছিল দরিদ্র, অবহেলিত, বঞ্চিত মেয়েদের বাস্তবতা, সেখানে লীলা লিখেছিলেন শিক্ষিত মেয়েদের কথা। টাকাওয়ালা মেয়েদের কথা। কিন্তু সেও তো বাস্তব ছিল। সেই কলকাতা-হুগলির প্রেক্ষিত। সেই সমাজ। হিন্দু-ব্রাহ্ম-খ্রিষ্টান বাঙালির নানা পরত দিয়ে সাজানো সমাজ।

বস্তুত, আমাদের আগে থেকেই তৈরি বিশ্বাস, স্যালঁ কালচার বা উচ্চ বিত্তের ড্রয়িং রুম সংস্কৃতির গপ্পো উঁচুদরের সাহিত্য না। মানে যদি তলস্তয় বা মার্সেল প্রুস্ত লেখেন তবে হ্যাঁ। যদি সিলভিয়া প্লাথ বা ভার্জিনিয়া উলফ, বা ক্যাথারিন ম্যান্সফিল্ড লেখেন, তবে ঠিকাছে। কিন্তু লীলা কেন লিখবেন?

আমাদের দেশের সেই সময়ের বাস্তবে, ১০% মানুষ শহুরে আর বাকিরা কৃষিজীবী ও গ্রামবাসী। তাই শহরের কথা কিছুতেই হতে পারে না উচ্চ সাহিত্য।

লীলা মজুমদারের আঁকা শহরবাসী পুরুষ নারীদের প্রতিটি চরিত্র অসম্ভব চেনা তাদের নিখুঁত ডিটেলিং-এর ফলে। জোনাকির মন্দিরা খুব চেনা। ওই সময়ের শিক্ষিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজ। চায়ের কাপের ঠুং ঠাং, কেক বিস্কুট,  পারফিউম মুক্তো হিরে এগুলো বহিরঙ্গ রচনা করে শুধু। ভেতরে থাকে চিরন্তন মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, থাকে টানাপোড়েন। পুঙ্ক্ষাণুপুঙ্ক্ষ বিবরণ সমাজের একচক্ষু , সংকীর্ণ দৃষ্টির। ব্রাহ্ম বনাম হিন্দু বনাম খ্রিস্টান বাঙালির ভেতরের টেনশন।

কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে কেবলই উচ্চবিত্তের কথা বলা হয়েছে এমনও নয়। লীলার কলমে চূড়ান্ত স্পর্শকাতরভাবে উঠে আসে এক অর্থনৈতিকভাবে চির-বঞ্চিত মেয়ের আখ্যান। যার নিজের বলে কিছু নেই। ঝাঁপতালের অলিমাসি আমাকে এক রাত ঘুমোতে দেয়নি। এই কাহিনি অন্য কাহিনিদের মত না। কিশোর সাহিত্যেও সামাজিক অন্যায়গুলি ফুটে ওঠে। এখানেও আছে।

ঝাঁপতাল সেই অনন্য উপন্যাস, যেখানে এক মধ্যবয়সিনী নারীকে পাই। সম্পূর্ণ অর্গানিকভাবে গল্পটা গড়ে উঠেছে।  একটা উপন্যাস যেটা পরতে পরতে পেঁয়াজের খোসার মতো খুলে যায়। এবং তার কেন্দ্রে আছে অলিমাসি। রেশমের মোজার মধ্যে জমানো তার কিছু পুঁজি। সে ৭০০০ টাকা জমিয়েছে। কিন্তু তাকে খুব দ্রুত আরও হাজার তিনেক টাকা জমাতে হবে। কারণ তার স্বপ্ন নিজের একটা ছোট্ট বাড়ির। আশ্রিতের জীবন ছেড়ে সে দ্রুত সেইখানে যেতে চায়। অলিমাসির টাকা জমানোর এই উপায়টা সবসময় যে খুব সৎ তা নয়। আসলে সততা অসততার প্রশ্নগুলোই এখানে অবান্তর হয়ে যায়। কারণ অলিমাসির জীবন প্রধানত শোষিতের জীবন ।

অলিমাসির জীবন ছিন্নমূল। তার মায়ের জীবন ইতর স্বামীর উৎপীড়নে সংকুল। অলিমাসির মায়ের সোনার গয়না নিয়ে বিক্রি করে দেবে বলে তার স্বামী মানে অলিমাসির বাবা ছোট্ট অলিকে চুলের মুঠি ধরে ঝুলিয়ে ধরে মারত। এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে বাবা মায়ের সব গচ্ছিত ধন, গয়না নিয়ে নিয়েছিল। শুধু মাদুলিতে ভরা একটা গজমোতি অলিমাসি মায়ের হাত থেকে লুকিয়ে পেয়েছেন। এই লুকোনো জিনিস, লুকানো টাকা। নারীর জীবনের প্রতীক যেন। সারাক্ষণ মোজায় ভরা সামান্য পুঁজিকে এদিক ওদিক লুকোনো। বারবার তার জন্য বুক ঢিপ ঢিপ। অস্বস্তি। কি অসম্ভব চেনা।

অলিমাসির চরিত্র ধূসর। সে আশ্রয়দাত্রীর মৃত্যুর পর মৃতদেহ থেকে খুলে নেয় সোনার হার। যা কেউ কখনও খোঁজেনি। আশ্রয়যাত্রীকে সারা জীবন সেবা করার মূল্য হিসেবে অলিমাসি যা আত্মসাৎ করেছেন। সব মিলিয়ে তাঁর কোনও অনুশোচনা নেই। কিন্তু খোলামনে সে টাকাকে রাখতে পারেনি। প্রশ্ন উঠবে। এত টাকা সে কোথায় পেল। ব্যাংকে বা পোস্টাপিসে রাখতে পারেনি তাই। এই গোপনীয়তা থেকে আমার মনে আসে ডিমনিটাইজেশনের পরে চাল, গমের গামলায় বা টিনে, খবরের কাগজের গাদায় লুকনো টাকার আন্ডিলের গল্প। স্বামীর দেওয়া গৃহখরচা থেকে চাকুরিহীন মেয়েদের লুকিয়ে বাঁচানো টাকার নানা অন্ধিসন্ধিতে লুকিয়ে থাকা। যা ডিমনিটাইজেশনের পরে তাঁরা বার করে “ডিক্লেয়ার” করতে বাধ্য হয়েছিলেন স্বামীর বা ছেলের কাছে। পুরুষ-সাপেক্ষ অর্থনীতির শ্লেষাত্মক পরিণতি। মিমের পর মিম, জোকের পরে জোক, বাড়ির গৃহবধূদের লুকনো টাকার বান্ডিল নিয়ে।

জন্ম বঞ্চিত অলিমাসির সততা অসততা এ উপন্যাসে অর্থহীন। পদিপিসির বর্মিবাক্সও লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল। অলিমাসির টাকাও লুকনো। গজমোতি পায়রার ডিমের মত বড় নয়। কিন্তু চাঁদের আলোমাখানো।

একটা পুরনো বাড়ি এ উপন্যাসে পাঠককে গিলে খেতে আসে। একদা বড়লোক, এখন অবস্থা পড়ে যাওয়া বাড়ি। বাড়িটাই চরিত্র। তার একতলা দোতলা। তার কাঠের পাটায় বৃষ্টির জল পড়ে ব্যাঙের ছাতা গজানোর সৌন্দর্য।  তার খালি ঘর, জিনিসে ঠাসা। রহস্যময়। ডার্ক। অত্যন্ত গা ছমছমে। পদি পিসির বর্মী বাক্সের বিশাল পুরনো বাড়ির যে বিস্ময়-ভয়-উত্তেজনা, এখানে একটা বিশাল পুরনো বাড়ি সেখানে ডেকাডেন্ট ও ভাঙন ধরা এক সময় সমাজের প্রতীক।

অবহেলিত ও শোষিত একাধিক নারী চরিত্র এই উপন্যাসে। কেয়া নামের মেয়েও স্বামী পরিত্যক্তা আশ্রিতা। তার  চরিত্র নিয়ে সবার সন্দেহ। অলিমাসির বদলে কাহিনির নায়িকা এই কেয়াই হতে পারত। বয়সে অনেক তরুণী সে। চাকরি করে। একাধিক পুরুষ বন্ধু। অত্যন্ত খরশান, রুখে দাঁড়ান চরিত্র। কিন্তু না, অলিমাসিই ঝাঁপতালের কেন্দ্রীয় চরিত্র। আর সেজন্যেই ঝাঁপতাল অনন্য। কারণ মণিকুন্তলার মাসিমার তুলনায় এখানে অনেক বেশি কেন্দ্রীয় হয়ে তাঁর বিকাশ ও বিস্তার ঘটছে। মণিকুন্তলাতেও মাসিমা বিধবা হয়ে মাছ খান। তিনিও স্বামীর দ্বারা অত্যাচারিত ছিলেন। কিন্তু এখানে অলিমাসি হিন্দু বালবিধবা কিন্তু তাঁর রক্তাল্পতার জন্য তাকে মাংসের স্টু খাইয়ে দেয় খ্রিস্টান পরিবার। বেঁধে বেঁধে থাকে অনেক অর্থনৈতিকভাবে অসক্ষম, নিচু ছাতের পরিবার। যাদের বঞ্চনার ভেতরে আত্মসম্মান থাকে।

অলিমাসিমার আশ্রয়দাত্রী “নেপুর মা” আর নেপুর বাবা অনন্যসাধারণ বৃহৎ, জমিদারি প্যাটার্নের চরিত্র। তাঁদের চারিত্র্যগুণ, তাঁদের অনেকটা বড় দিল, একটা স্বপ্নের জগত সৃষ্টি করে অলিমাসির কাছে। কিন্তু সেখানেও কেবল এক রঙ দিয়ে লেপা নয় ব্যাপারটি। নেপুর মা, নেপুর বাবার ওপর নজর রাখার জন্য অলিমাসিকে ব্যবহার করতেন। কারণ নেপুর বাবা নেপুর মেম শিক্ষিকার প্রতি আকৃষ্ট।

প্রবল ঝাঁকুনি থাকে এখানে।

নেপু এক শক্তিহীন, সামর্থ্যহীন, সহমর্মিতাহীন, সংকীর্ণ, দুর্বল বড়লোক। অতি বাস্তব নারীচরিত্র। কাহিনির তিন নারীর ট্রায়ামভেরেটের একটি অতি জরুরি এলিমেন্ট।

আবেগ, মনস্তত্বের জগতে অলিমাসির মন যেভাবে আঁকা তা লীলার পক্ষেই সম্ভব।

“আনন্দকে কেমন লাগে ? অলিমাসিমা অবাক হয়ে আবিষ্কার করেন কাউকে কেমন লাগাটা তাঁর জীবন থেকে একেবারে বাদ পড়ে গেছে। কাউকে কেমন লাগে, মুখ ফুটে কখনও তো বলেনইনি, নিজের মনেও কখনও তলিয়ে দেখেননি।

কেমন লাগত নেপুর বাবাকে? নেপুর মাকে? নেপুর বাবা। কী রূপ, কী শক্তি, রাজার মতো চোখ ঝলসে দিতেন— ভালো-লাগা, মন্দ লাগার জায়গা রাখতেন না। তাঁকে আবার ভালো-মন্দ লাগবে, অলিমাসিমার আস্পর্ধা কতখানি?”

“ভালোবাসার হিসেব কষেছে কেয়া; কী হবে ভালোবাসা দিয়ে? মানুষকে ভালোবাসা মানেই দুঃখ পাবার ব্যবস্থা করা। অলিমাসিমাকে দুঃখ দিতে পারে এমন কেউ নেই দুনিয়াতে। সন্ধ্যাবেলা শূন্য খাবার ঘরে অলিমাসিমা একা কাঁদেন তাঁকে দুঃখ দেবার লোক নেই বলে। বর্ধমানের বাড়ি তো শুধু নিরবচ্ছিন্ন সুখ দেবে, তবে দুঃখ দেবে কে? অলিমাসিমার চোখ দিয়ে অবিরল জল পড়তে থাকে।”

অলিমাসি বর্ধমানের ফেলে আসা বাড়ির ফেলে আসা টুকরো জমিতে বাড়ি বানাবেন বলে টাকা জমাচ্ছেন। সেই জমিটি তিনি স্বপ্নে দেখেন। শয়নে জাগরণে মনশ্চক্ষে দেখেন। কিন্তু একটা কোয়েস্ট বা খোঁজের মত সে জমির অস্তিত্ব দেখে আসতে পাঠান লোককে। জমিটি, শেষ পর্যন্ত জানা যায়, অস্তিত্বহীন। নেই হয়ে গেছে। সেখানে গ্যারেজ হয়েছে। অলিমাসির স্বপ্ন ধুলিসাৎ হবেই। হবারই ছিল। তারপরেও অলিমাসির একটা সদর্থক, ইচ্ছাপুরণের মত উত্তরণ ও আছে। হিন্দি বা বাংলা ফিলগুড ছবির নিয়ম মেনে। যেভাবে শেষে নায়িকা কেয়াকেও নায়ক চরিত্রের সাথে মেলান লীলা মজুমদার। শেষ দৃশ্য সঘন প্রেমের, স্বীকৃতির। কিন্তু শেষে ফিলগুড পরিণতি দেখান হয়েছে বলে গোটা উপন্যাসের ৯৯% অস্বস্তিকর শিরশিরে বেদনাময় বাস্তবতা তো নেই হয়ে যেতে পারে না! হয় না।

গোটা উপন্যাস জুড়ে অলিমাসির বাড়ি তৈরির ফ্যান্টাসি জাগরূক থাকে। এ অনন্য।

এক অধ্যাপিকা আমাকে বললেন ‘এ রুম অফ ওয়ান্স ওন’-এর কনসেপ্ট ভার্জিনিয়ার। তার সাথে অলিমাসির এই বাড়ি বানানোর স্বপ্ন মিলে যায়।

ওদিকে, আরেক উপন্যাস, “চীনে লন্ঠন” পড়ে আমার ভার্জিনিয়া উল্ফ-এর মিসেস ড্যালোওয়ের কথা মনে আসে। এ উপন্যাসও নারী কেন্দ্রিক। মল্লিকার মিমিদি বিবাহ বিচ্ছিন্না। এবং বিবাহ সম্পর্ক বহির্ভূতভাবে বাস করেন এক অন্য পুরুষের সঙ্গে। ছকভাঙা আরেক চরিত্র। মল্লিকা যাকে ভালবাসে সেই পলাশের সঙ্গে তার বড় হয়ে ওঠা এক সাথে। বন্ধুত্বই এখানে প্রেমের ভিত্তি। বন্ধুত্বমূলক প্রেমকে জোর দিতে বার বার দেখা যাচ্ছে লীলার উপন্যাসে। তথাপি লীলা পশ্চাৎপদ বলব?

চিনে লন্ঠনে হাই সোসাইটির এক বৃদ্ধা/ প্রৌঢ়ার এই বর্ণনায় এত বাস্তবকে দেখা গেল! অতুলনীয় ভাষা, উচ্চমার্গের সাহিত্য-ই একমাত্র এটা পারে। জেন অস্টেন বা ভার্জিনিয়া উল্ফ মনে না এসে পারে?

“রাঙাদিদিমণিও এলেন; কালের গতির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন তিনি, কোনও কিছু থেকে বাদ পড়তে চান না। কী রূপ রাঙাদিদিমণির; বিরাশি বছর বয়স, তবুও রূপ আর ধরে না। তীরের মতো সোজা দেহ, বিদ্যুতের মতো দৃষ্টি। মিনামাসিমার মা। এত বয়সেও শখের আর অন্ত নেই। বসন্তকালে দার্জিলিং-এ যে আইরিশ ফুল ফোটে, সেই রকম লঘু, সেই রকম শুভ্র, একটুখানি বাতাসের দোলা লাগলে সেইরকম দুলে ওঠেন। ধারালো ছুরির মতো কথা।

‘দেখি, দেখি, তোরা একটু সর দিকিনি, রানার বউ সীমা কেমনধারা ছেলে পয়দা করেছিল দেখি।” রাঙাদিদিমণি পলাশের সামনে এসে দাঁড়ান। এককালে দীর্ঘাঙ্গী বলে খ্যাতি ছিল, এখন মাথাটি পড়ে পলাশের বুকের উপর। কী একটা সুগন্ধ পলাশের নাকে আসে, কী একটা অশান্তি পলাশের।”

আবার একটু পরে…

“আর কারো দিকে বেশিক্ষণ নজর দিলে রাঙাদিদিমণির সহ্য হয় না। বেশি বয়স হলে সুখী সুন্দরী মেয়েরা কিশোরী কুমারীদের মতো হয়ে যায়। তেমনি কথায় কথায় মান অভিমান, ছলাকলা, তেমনি একটা অনাঘ্রাত মাধুরী। তেমনি হৃদয়ের দাবি।

মল্লিকা সবুজ শিশিটা তাঁর হাতে দেয়। গালে একটা হালকা চুমো খায়। সত্যই আইরিস ফুলের মতো, শুভ্র, সুকোমল, সৌরভময়, যেন এখুনি বাতাসে উড়ে যাবে। রাঙাদিদিমণি পলাশকেও ছাড়েন না, সেও তাঁর গালে চুমো খেতে বাধ্য হয়। ঘেমে নেয়ে ওঠে  পলাশ, কান দুটি লাল হয়ে ওঠে। আগ্রায় ওদের বাড়িতে কেউ এমন প্রকাশ্যে চুমো খায় না।”

এর কিছু পরে, মল্লিকা ভাবে, রাঙাদিদিমণি এত অবান্তর কথা বলে চলেন! অনেক আগেই রাঙাদিদিমণির মরে যাওয়া উচিত ছিল।

এইভাবে, এই ভাষায়, এত শ্লেষ, এত নির্বেদ নিরাসক্তি ও ডার্ক হিউমারের ব্যবহার। লীলার লেখা আবার পড়তে হবে আমাদের। দেখতে হবে মন দিয়ে এর প্রতিটি উপাদানের জোড় খুলে খুলে নেড়েচেড়ে। কেননা, এই ক্রাফট , এই বিষয়ভাবনা, সমসময়কে নিখুঁত তুলে ধরার এই দর্পণ তৈরি, এ সহজ নয়।

আর সহজ নয়, সময়ের থেকে এগিয়ে বিবাহ বন্ধনকে নানাভাবে নেড়েচেড়ে দেখা, পরিপূর্ণ বা অপরিপূর্ণ অনেকগুলো নারীর ছবি সৃষ্টি করা। যারা আজও জীবন্ত।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অসাধারণ লেখা! বলতে কি, সমালোচনা পড়েই লীলা মজুমদারের বড়োদের লেখা পড়ে দেখার ইচ্ছে উবে গেসলো। সেটা আবার চাগিয়ে উঠলো লেখাটির অভিঘাতে। লেখিকাকে এক সামান্য পাঠকের ধন্যবাদ!

আপনার মতামত...