শুভদীপ ঘোষ
প্রাবন্ধিক, কবি ও সম্পাদক
ব্যাপারটা ক্রুশচেভের (১৮৯৪-১৯৭১) সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। ক্রুশচেভের সময় থেকে গর্বাচেভ (১৯৩১-২০২২) পর্যন্ত টাইমফ্রেমে রাশিয়ায় ঘটে গিয়েছিল নানান ধরনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। বিগত ত্রিশ বছরের সমাজতান্ত্রিক গঠন-কাঠামোর কারিগর ছিলেন যে স্তালিন(১৮৭৮-১৯৫৩) তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়। যুগোস্লাভিয়ার টিটোকে (১৮৯২-১৯৮০) সর্বসম্মতিক্রমে বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি বহিষ্কার করলেও ঐ সময়ই তাকে পুনরায় স্থান দেওয়া হয়। মাও সে তুং (১৮৯৩-১৯৭৬)-এর চিনের সঙ্গে ঘটানো হয় সম্পর্কছেদ। শান্তিপূর্ণ উপায়ে পৃথিবীব্যাপী সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্ব দেওয়া হয় এবং সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সৈন্য ঐ সময়ই অন্য দেশে প্রবেশ করে এবং থেকে যায়! এরপর এল পেরেস্ত্রৈকা ও গ্লাসনস্ত!
পেরেস্ত্রৈকার মূল বক্তব্যগুলি ছিল –
১) কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) ও ভ্লাদিমির লেনিনের (১৮৭০-১৯২৪) অনেক ধ্যানধারণা নিয়েই নতুন করে পর্যালোচনার প্রয়োজন।
২) মার্ক্স-এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক ও মানবতাবাদী সমাজতন্ত্র হিসেবে ভাবতে হবে।
৩) সমাজতন্ত্র প্রকৃত প্রস্তাবে গণতন্ত্র – অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের মানে হল নিজেদের সমৃদ্ধি।
8) আণবিক বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে সমস্তকিছুকে নতুন করে ভাবতে হবে এবং শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্বকে সীমাবদ্ধভাবে দেখতে হবে।
৫) সারা বিশ্বের আগামী ভবিষ্যৎ নিয়ে রাশিয়া ও আমেরিকাকে দায়িত্বশীলভাবে ভাবতে হবে।
৬) রমণীদের ফিরে যেতে হবে শিশুপালনে, মাতৃত্বে ও বাড়ির কাজে।
৭) গ্লাসনস্তের খোলা হাওয়ায় তরুণরা নেবে মানবিক শিক্ষা, হয়ে উঠবে স্বতন্ত্র এবং রুশ জনগণের যথেচ্ছ ধর্মাচরণ ও ইচ্ছেমত সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের অধিকার স্বীকৃত হবে।
বলাবাহুল্য, চীনে মাও সে তুং-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লব, গ্রেট-লিপ ফরোয়ার্ড ইত্যাদির পর সে সময়ে সবচেয়ে আলোড়ন তোলা ঘটনা ছিল পেরেস্ত্রৈকার ভাবনা।
স্তালিন বিরোধিতার রাস্তা পেরেস্ত্রৈকাই প্রশস্ত করে। ক্রুশচেভের আমলে কেবল টিটো পুনর্বাসন পেয়েছিলেন, গ্লাসনস্ত ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের অবস্থানকে অস্বীকার করে ট্রটস্কি-সহ জিনোভিয়েভ, কামানেভ, রাদেক এবং বুখারিনকে তাদের অপরাধ থেকে মুক্তি দিয়ে মরণোত্তর পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেয়। গ্লাসনস্তের খোলা হওয়াতেই স্তালিন চিহ্নিত হন দৈত্য হিসেবে। গুলাগের বীভৎসতাকে মনে রাখলে এবং আলেকজান্ডার সলঝেনেৎসিনের ‘গুলাগ আর্কিপিলাগ’ পড়ার মতো কলজের জোর থাকলে এই খোলা হওয়ার প্রতি আপনার প্রীতি জন্মাতে বাধ্য। আবার পুঁজিবাদী পশ্চিমী-দুনিয়া সেই সময় সবেতেই মার্কসবাদের ভূত দেখত ফলত সলঝেনেৎসিনের মতো মানুষ নোবেল পাবেন ও মার্ক্সবাদী বর্বরতার পোস্টার বয় হবেন তাতেও আশ্চর্যের কিছু নেই। অন্যদিকে বর্বরতার বিচারে পুঁজি-বিশ্বের গুরুঠাকুর আমেরিকার বর্বরতার কাহিনি লিখে শেষ করা মুশকিল। উদাহরণ হিসেবে মার্ক্সবাদের বাড়বাড়ন্তকে ঠেকানোর অজুহাতে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে সঙ্ঘঠিত দ্বিতীয় ইন্দো-চায়নার যুদ্ধে আমেরিকার জড়িয়ে যাওয়া ও অতঃপর বিশ বছরে তাদের সীমাহীন বর্বরতা কিংবা ইরাক যুদ্ধের প্রারম্ভিক সময়ে আবু ঘ্রায়িব জেলে বন্দীদের উপর সঙ্ঘঠিত নারকীয় শারীরিক মানসিক ও যৌন অত্যাচারের এবং আরও অগুনিত অত্যাচারের নথিভুক্ত দলিল ঘাটতে বসলে পাল্লা পুঁজিবাদীর দিকেই যে বেশি ঝুঁকে থাকবে তা বলা-বাহুল্য।
পেরেস্ত্রৈকা লেনিনীয় সমাজতন্ত্রকে ছটি বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করেছিল –
১) সমাজতন্ত্র হল একটা বাস্তব এবং প্রকৃত মানবতাবাদ, যেখানে মানুষই হল সব জিনিসের মধ্যে প্রকৃত বিচার্য।
২) সমাজতন্ত্র হল বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটা সূক্ষ্মতম সাফল্য যার ভিত্তি অর্থনৈতিক।
৩) সমাজতন্ত্র হল স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান প্রভৃতি ব্যবস্থার নিশ্চয়তা।
৪) সমাজতন্ত্র হল সজীব সংস্কৃতি ও নীতি।
৫) সমাজতন্ত্র খাঁটি জনগণের শাসন।
৬) সমাজতন্ত্র হল ভ্রাতৃত্ব, দেশ-সমূহের সহযোগিতা, যৌথ উদ্যোগ।
আর মার্ক্সীয় সমাজবাদ ও তার বিকাশধারার তত্ত্ব যে বৈশিষ্ট্যগুলিকে মূল বলে তা হল –
১) সমস্ত রকমের ব্যক্তি মালিকানার উৎখাত ঘটিয়ে পরিপূর্ণ জন-মালিকানা স্থাপন।
২) বেতনক্রমের সামাজিক ভিন্নতার অবলুপ্তি।
৩) শহর ও গ্রামের মধ্যে পার্থক্য ঘোচানো।
৪) কায়িক ও মানসিক শ্রমের পার্থক্যের অবলুপ্তি।
৫) নারী ও পুরুষের সামাজিক বিভাজনের অবলুপ্তি।
ফলত ধ্রুপদী মার্ক্সবাদীরা পেরেস্ত্রৈকাকৃত বৈশিষ্ট্যগুলির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন তাহলে পুঁজিবাদী দুনিয়ার দুশ্চিন্তার আর কিছু রইল না কারণ এই সমাজবাদ কোনও নতুন সমাজ, নতুন দেশ, নতুন মানুষ গড়ার কথা বলছে না! ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’র বদলে ‘মানবতাবাদী সমাজতন্ত্র’ বলে একটি অভিনব ব্যাপার গর্বাচেভ নিয়ে এসেছিলেন। ধ্রুপদী মার্ক্সবাদীরা মনে করেছিলেন মানবতাবাদ নবজাগরণের যুগের আদর্শ এবং তা সমস্ত মানুষের হিতকেই প্রধান বলে মনে করত। সেই অর্থে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের অন্তিম লক্ষ্যের সঙ্গে এর মিল থাকলেও বর্তমান সমাজে যেহেতু বৈরীমূলক শ্রেণি-দ্বন্দ্ব বিরাজমান তাই একসঙ্গে সব মানুষের ভালোর মতাদর্শ শ্রেণি-চেতনা-বিরোধী হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফলে সমাজতন্ত্রকে ‘বৈজ্ঞানিক’ বললে যে তাৎপর্য ফুটে ওঠে ‘মানবতাবাদী’ বললে অন্য মানে পরিস্ফুট হয়। গর্বাচেভের মত ছিল পেরেস্ত্রৈকা সমাজতন্ত্রকে গণতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করে। যেন সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র দুটি আলাদা ধারণা, পেরেস্ত্রৈকা দুটিকে এক করেছে। লেনিনের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াটি ছিল – স্বৈরাচার থেকে বুর্জোয়া গণতন্ত্র, বুর্জোয়া গণতন্ত্র থেকে সর্বহারার গণতন্ত্র, সর্বহারার গণতন্ত্র থেকে উবে যাওয়া! ফলে ধ্রুপদী মার্ক্সবাদীদের চোখে গর্বাচেভের গণতন্ত্র বা আরও গণতন্ত্র দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার পথ থেকে বিচ্যুত শ্রেণি ঊর্ধ্ব-মানবিকতা ও শ্রেণি-ঊর্ধ্ব গণতন্ত্র! এর অন্তরালে তারা দেখতে পেয়েছিলেন পুঁজিবাদী পশ্চিমী দুনিয়ার সাথে সমঝোতার গোপন এজেন্ডা। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের বদলে, “সমগ্র মানব সমাজের উপকারের জন্য বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিবেশ – সাম্য, শক্তি, খাদ্য, চিকিৎসা এবং অন্যান্য সমস্যার সমাধানের জন্য বিশাল বৈজ্ঞানিক ও প্রাযুক্তিক ঐশ্বর্য প্রয়োগ করা” – গর্বাচেভের বক্তব্য ছিল। তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে নিয়ে তাঁর চিন্তা ছিল সবথেকে বেশি। রাশিয়া, আমেরিকা ও পশ্চিম-ইউরোপের দেশগুলি ছিল বিশ্বের এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রশক্তি। কিন্তু মুশকিল হল সার্বিকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটাতে গেলে আগে তো পিছিয়ে থাকা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির উন্নতি ঘটাতে হবে। আর সেটা করতে গেলে তৃতীয় বিশ্ব থেকে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অপসারণ ও এতদিন ধরে অধিকৃত ঔপনিবেশিক পুঁজি ফিরিয়ে দেওয়া হবে প্রধান শর্ত। এ ব্যাপারে রাশিয়া তো বটেই, অগ্রণী ভূমিকা নিতে তিনি আহ্বান করেন – “তৃতীয় বিশ্বের সমস্যাবলীর সমাধানের সন্ধানে আমাদের সঙ্গে হাতে হাত মেলাতে আহ্বান জানাচ্ছি মার্কিন প্রশাসনকে”। একই সঙ্গে বলেন, “মোটেও চাই না যে সমাধানের জন্য কোনও প্রক্রিয়া বা এই প্রক্রিয়ার লক্ষ্য সমূহ এমন হোক যাতে পশ্চিমী দুনিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের হানি ঘটুক”! এই দুটি পরস্পরবিরোধী। ফরাসি মার্টিনিকুইর মনস্তাত্ত্বিক-দার্শনিক ফ্রান্স ফানো (১৯২৫-১৯৬১) যেমন দেখিয়েছিলেন, ঔপনিবেশিক যুগে উপনিবেশগুলি ছিল সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে কাঁচা মালের উৎস, উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে ব্যাপারটা উল্টে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু উপনিবেশগুলি সেই ব্যাপারটা তো করতে পারেইনি বরং সাম্রাজ্যবাদী বিপুল উন্নত এক প্রযুক্তি ব্যবস্থা তৈরি করে আজও কাঁচা মালের আড়ত করে রেখেছে তাদের একদা উপনিবেশগুলিকেই!
ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের মূল কথা সবাই জানে বস্তুবাদ ও দ্বন্দ্ব-তত্ত্ব। অর্থাৎ চিন্তা, ভাবনা, চৈতন্যে, উপরিকাঠামোর ভিত্তি হল বস্তু ও তার কার্যকলাপ। সবকিছুই বিষয়গত, বিষয়ীগত নয়। এই বিষয়গত ভিত্তির উপর খাড়া হয়েই বিপরীতধর্মী এক সংঘাতের ভিতর দিয়ে সবকিছু এগোতে থাকে। পেরেস্ত্রৈকা এই শ্রেণি-সংঘাত বা শ্রেণি-দ্বন্দ্বকে গ্রাহ্য করে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন সমাজব্যবস্থার সংঘাতপূর্ণ অবস্থাকে অবজেক্টিভলি না দেখে পেরেস্ত্রৈকা ধর্মগুরুদের মতো সার্বিক ভালোর আবেদন জানায়। এই মনোভাব থেকেই গর্বাচেভ বলেছিলেন, “আমাদের সকলের এই পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করার জন্য চিন্তার নতুন ধারা নির্ধারণ করতে শিখতে হবে”। ধ্রুপদী মার্ক্সবাদীদের চোখে এ হল সেই প্রচেষ্টা লেনিন যার উল্লেখ করে বলেছিলেন, “মার্ক্স-এঙ্গেলস… দর্শনের ক্ষেত্রে নির্মমভাবে ঝেঁটিয়ে বাজে, অর্থহীন, ধৃষ্ট আবোলতাবোল এবং সংখ্যাতীত নতুন ধারা আবিষ্কারের প্রচেষ্টাকে বিদায় করেছেন কারণ তারা বস্তুবাদকে উন্নত করেছেন… এবং কীভাবে এই বস্তুবাদকে সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় তা দেখিয়েছেন”। গর্বাচেভ আরও বলেছিলেন, “যে খাঁটি দেশপ্রেমিক সে সব সময় আন্তর্জাতিকতাবাদী”। এই ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি হল প্রত্যেক আন্তর্জাতিকতাবাদী নিজ নিজ দেশকে ভালবাসার অর্থে দেশপ্রেমিক হতেই পারে, কিন্তু এর বিপরীতে প্রত্যেকটি দেশপ্রেমিক কখনই সর্বদা আন্তর্জাতিকতাবাদী হতে পারে না। আন্তর্জাতিকতাবাদের মূলটিই হল দেশের গণ্ডি টপকে বেরিয়ে পড়া। ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের চোখে যেমন সর্বহারার কোনও মাতৃভূমি নেই, গোটা বিশ্ব তার জয় করার জন্য পড়ে রয়েছে। গর্বাচেভের উক্তি তাই আন্তর্জাতিকতাবাদের সারমর্মটাকেই ঘেঁটে দেয়।
রাশিয়ার বিপ্লবের পর লেনিন ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ছয় বছর। ১৯২২ সালে লেনিনের বহু বিতর্কিত ‘নেপ’ ছিল, “an economic system that would include ‘a free market and capitalism, both subject to state control,’ while socialized state enterprises would operate on ‘a profit basis.’”। ‘নেপ’ সমাজতন্ত্রের ধারার কোনও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ছিল না, ‘নেপ’ ছিল কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনুসরণ। কিন্তু বুখারিন (১৮৮৮-১৯৩৮) পর্যন্ত এর সমালোচনা করেছিলেন। পুঁজিরাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীরা ‘নেপ’-কে দেখিয়ে ভেংচি কেটে বলেছিলেন দেখো সকলে, সাম্যবাদী রাষ্ট্রের আসল চেহারা! লেনিন কিন্তু জানতেন যে কুলাক অর্থাৎ ধনী-কৃষকরা এতে উৎসাহ পাবে। যেখানে তারা কোনও সুবিধে পেত না, সেখানে তারা আবির্ভূত হবে এবং পেটি-বুর্জোয়া ও পুঁজিবাদের এতে শক্তি বৃদ্ধি হবে। কিন্তু লেনিন মনে করেছিলেন বিশেষ পরিস্থিতিতে নেওয়া এই সাময়িক ব্যবস্থা অর্থাৎ পুঁজির শক্তির ব্যবহার প্রথম বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর রাশিয়ার পিছিয়ে পরা কৃষি-নির্ভর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। ক্রুশচেভের আমলে উৎপাদন যন্ত্রগুলিকে ধনী যৌথ-খামারের হাতে তুলে দেওয়া হয়, স্বভাবতই নিয়ন্ত্রণও চলে যায় বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে। ব্রেজনেভ (১৯০৬-১৯৮২) চালু করেন ‘চুক্তি প্রথা’ ফলে চুক্তিতে লাভবান যারা তারা হয়ে উঠত প্রভাবশালী এবং ব্যক্তির সমৃদ্ধিকে ‘বোনাস প্রথা’ আরও গতিশীল করে তোলে।
পেরেস্ত্রৈকায় গৃহীত অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলি ছিল –
১) অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতির সক্রিয় উপাদান হবে বাজারদর।
২) শিল্পে ও কৃষিতে যৌথ-চুক্তি পরিবার-ভিত্তিক চুক্তি ও লিজ ব্যবস্থা চালু করা হবে।
৩) কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনা ব্যবস্থাতে শিথিলতা এনে পণ্য-অর্থনীতির গতিকে ত্বরান্বিত করা হবে।
গর্বাচেভ পেরেস্ত্রৈকার হাত ধরে জনমালিকানা ও ব্যক্তি-স্বার্থের মিশ্রণকে বললেন সবচেয়ে কার্যকরী কর্মসূচি এবং এ হল তাঁর মতে উপরে উল্লেখিত লেনিনের ‘নেপ’র পর সবচেয়ে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ! অতএব গর্বাচেভের কাছে ‘নেপ’ ছিল সমাজতন্ত্রের দীর্ঘ পর্যায় জুড়ে থাকা এক গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবী কর্মসূচি। ‘নেপ’-কে তুলে ধরে গর্বাচেভ পেরেস্ত্রৈকাকে দ্বিতীয় বৈপ্লবিক কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আবারও ধ্রুপদী মার্ক্সবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই জাতীয় পদক্ষেপ বুর্জোয়া মানসিকতায় প্রণোদনা দেয় এবং পুঁজিবাদী প্রবণতাকে সফলভাবে স্থায়িত্ব দেওয়ার চেষ্টা করে। লেনিন যখন ‘নেপ’-এর কথা ভেবেছিলেন তখন ব্যবস্থাটির স্বল্পকালীন ব্যবহারের কথা ভেবেছিলেন এবং বুর্জোয়া মানসিকতাকে দমন করে ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’কে সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়ার দিকে জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু পেরেস্ত্রৈকা নামক দ্বিতীয় বৈপ্লবিক পদক্ষেপের ঠেলায় বুর্জোয়া নামক জনগণদের উত্থান হয়ে দাঁড়িয়েছিল অপ্রতিরোধ্য এবং শ্রমিক-শ্রেণির পার্টি হয়ে গিয়েছিল জনগণের পার্টি!
উপরন্তু ধ্রুপদী মার্ক্সবাদীরা দেখতে পেয়েছিলেন পেরেস্ত্রৈকা যে গ্লাসনস্তের খোলা হওয়া খেলিয়ে দিয়েছে তাতে করে নতুন করে শুরু হয়েছে নারীর উপর সামাজিক নিপীড়ন, যুবসমাজ হয়ে পড়ছে আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার এবং বাড়তে শুরু করেছে ধর্মাচরণের আগ্রহ! গর্বাচেভ নারীদের প্রায় হিটলারের মতো ডাক দিয়েছিলেন রান্নাঘরে প্রত্যাবর্তন করার – “তাদের প্রয়োজন রয়েছে শিশু শিক্ষার কাজে এবং মা ও গৃহিণীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়”। এদিকে আবার নারীমুক্তির মার্ক্সবাদী ধারণাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরু হয় এই সময়ই। পুঁজিবাদী দেশগুলির মতো নিজেদের সামরিক গোপনকক্ষগুলি আণবিক বোমায় ভর্তি করে অর্থাৎ নিজেদের সম্পূর্ণ সুরক্ষিত করে বাকি পৃথিবীকে আণবিক যুদ্ধের জুজু দেখানো ও বিশ্বের ত্রাতার ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ পেরেস্ত্রৈকার কর্মসূচির অংশ ছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পেরেস্ত্রৈকার আরেক অভিনব চিন্তা হল ‘অভিন্ন ইউরোপের বাসভূমির’ তত্ত্ব। এশিয়ার বৃহত্তর অংশ জুড়ে আছে রাশিয়া এবং ভৌগলিক দিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহত্তর অংশ এশিয়ায় থাকা সত্ত্বেও গর্বাচেভ ‘অভিন্ন ইউরোপের বাসভূমির’ তত্ত্বে বিশাল উৎসাহী ছিলেন। আসলে ফ্রান্সের মিতেঁরের (১৯১৬-১৯৯৬) ইউরোপকে ইতিহাসের প্রধান নায়ক হয়ে ওঠার আবেদনে গর্বাচেভ আলোড়িত হয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পনেরটি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে আটটি (উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজিস্তান, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান) এশিয়ার অথচ পেরেস্ত্রৈকার দৃষ্টিতে গর্বাচেভ বলেছিলেন, “রাশিয়ার ইতিহাস মহাইউরোপের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ” এবং প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন “আমরা ইউরোপীয়”! সোভিয়েত ইউনিয়নের ছটি অঙ্গরাজ্যের অধিকাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে অস্বীকার করে রুশ জাতির মানসিকতাকেই সমগ্র রাশিয়ার মানসিকতা বলে প্রচার করা হয়েছিল। প্রাচীন রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল খ্রিস্টধর্মের দ্বারা, এটা গর্বাচেভ মনে করতেন। এবং সারা বিশ্বের মঙ্গলের জন্য যেমন রাশিয়া ও আমেরিকাকে একজায়গায় আসার আহ্বান জানানো হয়েছে, তিনি মনে করতেন ঠিক তেমনভাবেই ইউরোপ ও বাকি পৃথিবীর মঙ্গলের স্বার্থেই পূর্ব-পশ্চিম ইউরোপের মিলনের একটা পথ খুঁজে পাওয়া যাবেই! প্রকৃতপক্ষে বোঝা যায় ইউনিয়নের ভিতরে রুশ জাত্যভিমান ও আন্তর্জাতিক আঙিনায় সাদা চামড়ার শ্রেষ্ঠত্ব – এই ছিল গর্বাচেভের সুর। অর্থোডক্স খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রধান গর্বাচেভকে বলেছিলেন রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ খ্রিস্টান! গ্লাসনস্ত ধর্মকে ব্যক্তিগত জায়গায় কেবল না রেখে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমস্ত মাধ্যমগুলিকে ধর্মপ্রচারের অধিকার প্রদান করে। কমিউনিস্ট খ্রিস্টানিটি বলে একটা অদ্ভুত ব্যাপারও চালু হয়েছিল সেই সময়। যে মার্ক্স ধর্মকে আফিম বলেছিলেন, গ্লাসনস্তের ঝোড়ো হাওয়ায় সেই আফিম সেবন করেও কমিউনিস্ট থাকা যায়!
ম্যাজিনো লাইন ভেঙ্গে পড়া নাজি হলোকাস্ট ইত্যাদির ফলে স্তালিন ও রুজভেল্ট এক জায়গায় এসেছিলেন। বাকি ইতিহাস সবার জানা। প্রোপ্যাগান্ডা সিনেমা বলে একটা ব্যাপার হিটলারের আমলে চালু হয় জার্মানিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হলিউডে যত যুদ্ধের সিনেমা হয়েছে সেগুলি আমেরিকার প্রোপ্যাগান্ডার চরম। এমনকি লাদেন নিকেশ নিয়ে ক্যাথরিন বিগেলো (১৯৫১-) পরিচালিত হাল আমলের ‘জিরো ডার্ক থার্টি’(২০১২)ও প্রোপ্যাগান্ডা সিনেমা। সাহিত্যেও এই ব্যাপারটা আছে। অনেকেই মনে করেন সাহিত্যিক প্রতিভাকে স্বীকার করেও মাক্সিম গোর্কি (১৮৬৮-১৯৩৬) থেকে মিখাইল শোলাকভ(১৯০৫-১৯৮৪) প্রোপ্যাগান্ডা সাহিত্যই লিখে গেছেন। যেকোনও দেশে যেকোনও কালে এই প্রোপ্যাগান্ডা আর্ট দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে জনমত তৈরিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইন্টারেস্টিং হল দ্বিতীয় চেচনিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার পরিচালক অ্যালেক্সই বালাবানভের (১৯৫৯-২০১৩) ছবি ‘ওয়ার’(২০০২) যারা দেখেছেন তারা বুঝবেন এই ছবিটি হলিউডের পাল্টা প্রোপাগান্ডা।
একজন রাশিয়ান যোদ্ধা কিভাবে ব্রিটিশ দম্পতিকে রক্ষা করল তার হলিউড সংস্করণ। হলিউডের মতোই বীরত্বপূর্ণ ওয়ার স্পেক্টাক্যালে ভর্তি। কমিউনিজম ভেঙ্গে যাওয়ার পরের রাশিয়া অর্থাৎ নব্বইয়ের দশকের রাশিয়ার অরাজক সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা একের পর এক ছবিতে (ব্রাদার ১, ব্রাদার ২, ডেড ম্যানস ব্লাফ, কারগো ২০০ ইত্যাদি) তুলে এনেছিলেন এই বালাবানভ। বালাবানভ ছিলেন অ্যান্টি-ওয়েস্টার্ন ও জাতীয়তাবাদী মনোভাবের। স্তালিনকে ‘গডফাদার অফ ক্রাইম’ হিসেবে বিবেচনা করে একটি ছবি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই মারা যান। মার্ক্স-লেনিন-স্তালিন-এর স্বাভাবিক সম্প্রসারণ কি ক্রুশচেভ-ব্রেজনেভ-গর্বাচেভ, নাকি গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈকা স্বতন্ত্র এবং এছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না? বলাবাহুল্য এই নিয়ে বিতর্ক অমীমাংসিত। মার্ক্সবাদকে ফলিত করার প্রেরণা যেমন মার্ক্স নিজেই, কিন্তু ফলিত মার্ক্সবাদের এযাবৎ যে রূপ আমরা দেখছি তাতে তত্ত্বের থেকে বিচ্যুতি প্রচুর। তীর্থদর্শনের পরেও রবীন্দ্রনাথের শেষাবধি আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না তা ইতিহাস জানে। স্তালিনের গুলাগ গালগল্প নয়। ক্যাটিন ফরেস্ট ম্যাসাকার যে স্তালিনের এন.কে.ভি.ডি-র কুকীর্তি তা হিটলারের ঘাড়ে চাপিয়েও চাপা দেওয়া যায়নি। প্রায় বাইশ হাজার পোলিশ মিলিটারি অফিসারকে গণহত্যা করা হয় কালিনিন, খারকিভ বন্দিশালায়। কিন্তু ক্যাটিন ফরেস্টে গণকবরগুলি আবিষ্কার করে নাজি বাহিনী, তাই প্রাথমিকভাবে এটা তাদের কীর্তি বলে প্রচারিত হয়। আন্দ্রে ভাইদার বিখ্যাত ছবি ‘ক্যাটিন’(২০০৭)–এ মর্মস্পর্শীভাবে দেখানো হয়েছে গোটা ব্যাপারটা।
স্বামী জেরি যুদ্ধে গেছে কিন্তু স্ত্রী আনার কাছে তার কোনও খবর নেই। একদিন হঠাৎ জেরির ডাইরি এসে পৌছায় আনার কাছে। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা নির্দিষ্ট তারিখের পর আনা দেখে আর কিছু লেখা নেই! শূন্য বাকি পাতাগুলির দিকে আনা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ভাইদার ক্যামেরা আর আনার কাছে ফিরে আসে না। এরপর ক্যামেরার গতিপথ কালিনিন, খারকিভ বন্দিশালা থেকে ক্যাটিনের গণকবরে জেরির মৃতদেহর দিকে ধাবিত! এই মানের নির্মাণকেই বলা হয় ‘স্ট্রোক অফ এ জিনিয়াস’। হতেই হবে, ভাইদার বাবাও যে শুয়ে আছেন ঐ গণকবরে! ভাইদার ছবি এক স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। কিন্তু একটা কথা বলাই যায়, মার্ক্স-লেনিন-স্তালিন না ক্রুশচেভ-ব্রিজনেভ-গর্বাচেভ, এক অমীমাংসিত ধাঁধা। সাম্প্রতিক উগ্র-ডানপন্থী আলেক্সজান্দার দুগিন ও তাঁর চতুর্থ রাজনৈতিক তত্ত্বের উৎস কি খুঁজে পাওয়া যাবে গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈকার অন্দরে? ভাবধারায় সংগতি যে আছে তা বোধহয় অস্বীকার করা যাবে না যদিও সে এক ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
পেরেস্ত্রইকা ও মার্ক্সবাদ দারুন লাগলো। একটি যুগ সন্ধিক্ষনের ইতিহাস এবং একই সঙ্গে ইতিহাসের শিক্ষা। ধন্যবাদ।