অরুণপ্রকাশ রায়
পূর্ব প্রকাশিতের পর
অন্তিম পর্ব
চোখ বুজে একটা বিয়েবাড়ির দৃশ্য কল্পনা করুন, নাকে ভেসে আসবে পারফিউম, রান্নার ঝাঁঝালো গন্ধ (ফিশ-ফ্রাই বা মাংস), রজনীগন্ধা-গোলাপ, নতুন শাড়ির পাটভাঙা গন্ধ, বারান্দা থেকে ভেসে আসবে হালকা সিগারেটের গন্ধ, এর মধ্যে আবার বিশাল হট্টগোল… কী, না বর এসে গেছে! অনভ্যাসের শাড়িতে প্রায় হোঁচট খেতে গিয়ে সামলে নিয়ে একঝাঁক কনের সহচরী দৌড়ে যাচ্ছে বরকে রিসিভ করতে। আশ্চর্য হলেও সত্যি— ঠিক এই অ্যাম্বিয়েন্সের অনবদ্য এক ভিশুয়াল আমি পেয়েছি একটি বহু প্রাচীন সুফি কালাম-এ।
চলকে দেখো রি সখী, সব মে সময়া রি বানা, বানা বনরি কে লিয়ে কাইসা বনা আয়া রি বনা।
আয়া বনা আয়া, হরিয়ালা বনা আয়া, রাজদুলারা বনা আয়া, শেহ্জাদা বনা আয়া।
ম্যায় তো নজর কে ডর সে, না দেখি আঁখে ভর কে, মোহন মুখ পায়া, হরিয়ালা বনা আয়া
সঙ্গে এক পরিচিত বা বহুলপ্রচলিত আরাবিক যন্ত্রসঙ্গীত। এমন চমৎকার বিয়ের গান, যা “লীলাবালি লীলাবালি ভরযুবতী সই গো কি দিয়া সাজাইমু তরে”-কে স্ট্রেট সেট-এ হারাতে পারে। এ-গানের তিনটি ছোট-ছোট ক্লিপ রাখলাম, ফরিদসাব আর আমার সওয়াল-জবাবের অডিও-সমেত।
এবার বলুন তো দেখি, ধান ভাঙতে শিবের গীত গাইছি কেন? আসলে সুফি সাধকদের মৃত্যু দস্তুরমতো সেলিব্রেট করা হয়, শোকপালন না করে। একে বলা হয় উরস, বা আরাধ্যের সঙ্গে মিলনের রাত, মৌলানা রুমি-র “শাব-এ-আরুস” সাধারণত ডিসেম্বরে তুরস্কের তিথিনক্ষত্র মেনে বিরাট করে উদ্যাপন করা হয়। এ কিন্তু আমেরিকার সেপ্টেম্বরের ‘রুমি ডে’ নয়, সারা পৃথিবীর রুমিপ্রেমিকদের ঢল নামে কোনিয়ার অলিগলিতে।
কোলম্যান বার্কস রুমির কবিতার সাড়ে-সর্বনাশ করে দিয়েছেন অনুবাদ করতে গিয়ে। আমার মামাতো অগ্রজের (অধ্যাপক তীর্থঙ্কর দাশগুপ্তর) রাটগার্স-তুতো প্রতিবেশী অধ্যাপক জাবিদ মোজাদ্দেদি রুমির লেখার একেকটির নড়া ধরে দুর্দান্ত অনুবাদ করে ফেলেছেন। রুমির মাসনাভি, গজল, খণ্ডের পর খণ্ড। শুনলে অবাক হবেন, রুমি কিন্তু ফেবু ও ইনস্টাগ্রামের অতিপ্রিয় কোট ‘আউট বিয়ন্ড দ্য আইডিয়াজ অব রংডুইং অ্যান্ড রাইটডুইং, দেয়ার ইজ এ ফিল্ড, আই উইল মিট ইউ দেয়ার’ কস্মিনকালেও লেখেননি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আরেক রুমি-বিশেষজ্ঞ শ্রীযুক্ত ব্র্যাড গুচের সঙ্গে, তুরস্কের কোনিয়াতে পরিচয় করার। রংডুইং অ্যান্ড রাইটডুইং আসলে ঈমান আর কুফরের ‘কোলম্যান্স মাস্টার্ড’। একখানা জম্পেশ কোট রাখি এই পর্বে “at the end of my life, with just one breath left, if you come, I’ll sit up and sing”― Rumi.
আমি যেবার কোনিয়া গেছিলাম, হোটেল থেকে গুটিগুটি মাঝরাত্তিরে বেরিয়ে পড়ে রুমির আস্তানার জাফরিতে উঁকি মেরে নিঃশব্দে প্রার্থনা করছিলাম বিশুদ্ধ বাংলাভাষায়, বাইরে বরফ পড়ছিল পেঁজা তুলোর মতো। একটা চাপা কান্নার আওয়াজে প্রার্থনায় ব্যাঘাত ঘটল, দেখি সাদা পার্কা জ্যাকেট-জিন্স ও হাঁটুপর্যন্ত বুটপরা একটি মেয়ে আমার পাশের জানালায় মুখ রেখে নিঃসাড়ে কেঁদে চলেছে, আর মাঝে-মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছে। তার পকেটে বাজছে একটা মুঠোফোন। আমি মেয়েটির পিঠে আলতো চাপড় মেরে ফোনের দিকে ইশারা করলাম। সে ফোনটা দেখে কেটে দিয়ে বলল, “আরে আমার পুরনো বয়ফ্রেন্ড, মরতে যে কেন এখনও ফোন করে?” আমি হোটেলে ফিরে যাওয়ার রাস্তায় হাঁটছিলাম, মেয়েটি পিছু নিল, অনেকটাই স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করে আমায় শোনাল তার জীবনকাহিনি। নাম বেতুল, তুরস্কের ইজমির অঞ্চলের মেয়ে, টার্কিশ এয়ারলাইন্স-এ চাকরি করে বিমানসেবিকার। একমাসের ছুটিতে কোনিয়া বেড়াতে এসেছে, রোজ নিয়ম করে রুমির মৌলানা মিউজিয়াম-এ গিয়ে চুপটি করে বসে থাকে, বয়ফ্রেন্ড ইস্তানবুলে এক পাইলট সহকর্মীর প্রেমে পড়ে তাকে ছেড়ে বাসা ভাড়া করে দিব্যি থাকতে শুরু করেছিল, তা সেই নতুন প্রেম না টেকায় ‘আবার সে ফিরিয়া আসিতে চায়’ বেতুলের জীবনে। সুকুমার রায়ের পাগলা দাশুর কথা মনে পড়ে গেল আমার, হঠাৎ করেই। বেতুল আমার মাথায় মাথায় লম্বা, ভারী মায়াবি দুটি চোখ, একরাশ কোমর ছাপানো বাদামি চুল, ভেজা চোখের পাতা। ফরিদসাবের সাবধানবাণী মনে পড়ে গেল, “অরুণ, কিসি কো দলদল সে খেঁচ নিকলনা হো তো, হামেশা বাল পকড়কে খেঁচনা, সিনে সে লাগা কর নাহি।” আমি হাত নেড়ে মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে হোটেলের লিফট লবি থেকে সিঁড়ি চড়তে শুরু করলাম, একটু গতি বাড়িয়ে। জোন এলিয়ার একটা কবিতা মনে পড়ে গেল পাগলা দাশু ছাপিয়ে, “আজাব থা উস্কি দিলদারি কে আন্দাজ, ওহ বর্সও বাদ জব মুঝ সে মিলা হ্যায়। ভালা ম্যায় পুছতা উসসে তো ক্যায়সে কে মাতা-এ-জান (ইংরেজিতে প্রেশাস), তুমহারা নাম ক্যা হ্যায়।” ফরিদসাবের গাওয়া মৌলানা রুমির একখানি কালাম ভীষণভাবে মনে পড়ে গেল, গানটির শিরোনাম ‘হর লেহেজা’, প্রায় ছয় মিলিয়ন ভিউ নিয়ে এই গানটি প্রায় ভাইরাল হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট-এ।
আমার সুফিয়ানা সফর আমাকে একবার হোলির আগের দিনে বেনারস নিয়ে গেছিল। বন্ধুবর নবনীত রমন আমাকে বলেছিল যে, সারনাথে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানে আমাকে একটু পড়াতে হবে গোটাবিশেক ছাত্রকে, কমুনিকেশন স্কিল নিয়ে। তা আমি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না-করেই রাজি হয়ে গেছিলাম, গিয়ে দেখি ট্রেনিং হলে প্রশান্তচিত্তে বেশ কিছু বৌদ্ধ লামা বসে রয়েছেন খাতাবই হাতে। খাস সারনাথে দাঁড়িয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পড়ানোর অভিজ্ঞতা আমার মনে হয় খুবই কম লোকের হয়েছে। আমি শুরু করেছিলাম একটি ছোট্ট অ্যাক্টিভিটি দিয়ে, হাতের তালুতে হাত ঘষে, সকলে মিলে তুড়ি বাজিয়ে, উরুতে চাপড় মেরে, চাপড়ের গতি বাড়িয়ে-কমিয়ে চমৎকার বৃষ্টি নামানো যায় ঘরের মধ্যে, মানে টিপটিপ থেকে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ বেমালুম নকল করা যায়। হঠাৎ দেখি সবার মুখে এক ঐশ্বরিক হাসি, বন্ধ চোখে ভারী তৃপ্তি, ঘরের মধ্যে বৃষ্টি নামিয়ে। সেদিন নবনীতের দুই ফটোগ্রাফার বন্ধু ম্যাডেলিন ব্লেক আর জেন স্কিনার লামাদের সঙ্গে “রেইন এক্সারসাইজ” করে এতটাই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে, আজও কথা হলে মনে করিয়ে দেন সেদিনের কথা।
পরের দিন ছিল হোলি, নবনীতের আর্টিস্ট’স রেসিডেন্সিতে আমরা কজন অর্গানিক রং দিয়ে প্রবল দোল খেলেছিলাম। সঙ্গে বেশ উঁচুদরের ঠান্ডাইয়ের শরবত, সিদ্ধি ঘুঁটে। আমি এক গেলাস খেয়ে বুঝতে পেরেছিলাম যে এ গুরুতর মাল, আর খেলেই বিপত্তি। ম্যাডেলিন তিন গেলাস বীরদর্পে মেরে দিয়ে একটা ভারী সুন্দর মাটির মূর্তি অসাবধানে ভেঙে ফেলাতে, বাকিরা তার বিচার চায়। আমি পরমানন্দে একটা পেল্লায় বোস মিউজিক সিস্টেম-এ ফিল্মি গান বাজিয়ে ডিজের দায়িত্ব পালন করছিলাম, হঠাৎ ম্যাডেলিন বললেন ওঁর একজন উকিল দরকার। নবনীত বসেছিল জজের আসনে, মানে সিমেন্টের একটা লম্বামতন বেঞ্চিতে। ওকে অন্যমনস্ক দেখে ওর পোষা রামপুর হাউন্ড বাদল সমানে গুজিয়া আর পাকোড়া খেয়ে চলেছিল নির্বিবাদে, আমি থালাটা সন্তর্পণে সরিয়ে নিই। ঠিক কী যুক্তি পেশ করেছিলাম সেদিন ম্যাডেলিনকে গণ-বাসনমাজার হাত থেকে বাঁচাতে, তা আজ আর মনে নেই বছরপাঁচেক পরে। বিচার হয়ে যাওয়ার পরে আমি স্পিকারে বাজিয়ে দিয়েছিলাম নুসরতের “আজ রং হ্যায় রি মা রং হ্যায় রি, মেরে মাহবুব কে ঘর রং হ্যায় রি।” বাহাউদ্দিন কাওয়ালের ইউটিউবের লিঙ্ক রইল এখানে।
ফিরে আসা যাক তুরস্কের কোনিয়াতে। ইস্তানবুল শহরের ইস্তিকলাল স্ট্রিটে সম্প্রতি একটি বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ যায় কিছু নিরীহ মানুষের, হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে খবরে। এই রাস্তায় আমি বহুবার হেঁটে বেড়িয়েছি ২০১৭ সালে, ট্রাফিক সিগন্যালের বোতাম নিজেহাতে টিপে দিয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা যায় তুরস্কের এই শহরটিতে। আমি সুযোগ বুঝে লাল ও সবুজ বোতাম টিপে অনেক পথচারীর যাতায়াতে সাহায্য করে বিনিময়ে সৌজন্যমূলক বহু মুচকি হাসি উপহার পেয়েছি হাঁটতে বেরিয়ে।
যেদিন রাত্তিরে আমার কোনিয়ার মৌলানা মিউজিয়ামে বেতুল-এর সঙ্গে আলাপ হয়, ঠিক তারপর দিন হোটেলের কফিশপে প্রাতঃরাশ করতে দিয়ে আবারও দেখা হয় মেয়েটির সঙ্গে। হাতে একটি প্লেট, তাতে দুটি ক্রয়সঁ এবং এক পেল্লায় মগভর্তি কালো-কফি। আমার পেয়ালা-পিরিচেও সেই একই গল্প। হোটেলের বাগানের দিকের একটি বেতের চেয়ার-টেবিলে বসে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল আমাকে বেতুল। আমি তড়িঘড়ি অন্য কোণের একটি টেবিলে আস্তানা গেড়ে বসার চেষ্টা করাতে, ভুরু কুঁচকে উঠে চলে আসে আমার টেবিলে। নিজের বাতুলতায় আমি একটু লজ্জা পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ডিম খাবে?’ ঘাড়টা একপাশে হেলানোয় অগত্যা আমি দুখানা ডবল ডিমের ওমলেট একটা প্লেটে করে নিয়ে আসি দুজনের জন্য। অনর্গল বলে চলেছে মেয়েটি, তার ঘটনাবহুল জীবনের কথা। আমি মাঝেমধ্যে একটা দুটো প্রশ্ন করে গভীর মনঃসংযোগে শুনে চলেছি। কথায় কথায় চলে এল ব্র্যাড গুচের লেখা “রুমিস সিক্রেট” বইটির কথা। একটি অধ্যায়ে রয়েছে এই গানটির উল্লেখ,
Har lehza ba shakal aan but-e-ayyaar baraamad
Dil burd-o-nihaan shud
Har dam ba libaas-e-deegar aan yaar baraamad
Gah peer-o-javaan shudKhud kooza-o, khud koozaagar-o, khud gil-e-kooza
Khud rind-e-subu kash
Khud bar sar-e-aan kooza khareedaar baraamad
Bishkast-o ravaan shudNai nai ke hamin bood ke mi aamad-o mi raft
Har qarn ke deedum
Ta aaqbat aan shakl-e-arab vaar baraamad
Daara-e-jahaan shudRumi sukhane kufr na guftast na goyad
Munkir nashvedash
Kaafir buvad aan kas ke ba inkaar baraamad
Mardood-e-jahaan shud
আমি নিজের ফোনে ইউটিউব খুলে গানটা শুনিয়ে দিলাম বেতুলকে, সঙ্গে খালি গলায় গুনগুন করতে করতে। চমক ভাঙতে দেখি, মাথাটা একপাশে হেলিয়ে গালটা নিজের বামহাতের উপর রেখে নিষ্পলক হয়ে শুনে চলেছে সে, বোধহয় রুমি, বা, ফরিদসাব বা আমাকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল, হাঁটাপথেই থাকা একটি কিউরিওর দোকানে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলাম, বেতুল একবার আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে পরিপূর্ণ চোখে একবার আমার দিকে তাকাল। আমি ওর কপালে ঠোঁট রেখে মাথার চুলগুলো একবার এলোমেলো করে দিয়ে, এগিয়ে গেলাম মৌলানা মিউজেসির রাস্তার দিকে, হোটেলের লবি পার করে।
এ সফর যে সুফিয়ানা। এক জায়গায় স্থিত হওয়া যে বারণ আমার। আগের একটি পর্বে আমার ফকিরপুরে পাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আমার পাঠকদের। মাস ছয়েক হল হিমাচলের মানালির কাছের একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম সিমসা-য় আমার আস্তানা। একটি পুরনো স্পিকার এ যখন-তখন বেজে ওঠে খুসরো, বা বুল্লে শাহ বা রুমির কলাম, একটি কাঠের বাড়িতে। রুমির সময়কার ক্যারাভানসেরাই-তে যেমন অতিথি-অভ্যগতরা এসে উঠতেন, ঠিক তেমনি আমার পাহাড়ি বৈঠকখানা সরগরম হয়ে থাকে সদ্য পরিচয় হওয়া অতিথিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায়।
জোন এলিয়ার একটি বিখ্যাত শায়রি দিয়ে এ-যাত্রা শেষ করি,
উও যে না আনেওয়ালা হ্যায় না, উসসে হামকো মতলব থা।
আনেওয়ালো সে ক্যা মতলব, আতে হ্যায়-আতে হোঙ্গে।
ভাল থাকবেন সকলে। ছোট্ট এ পৃথিবী… ঘুরতে-ঘুরতে আবার কখনও দেখা হয়ে যাবে কোনও দরগাহ বা সরাইয়ে…
সমাপ্ত