ইন্দ্রনীল মজুমদার
গদ্যকার, প্রাবন্ধিক
কেউ বললেন না সন্দীপ 'উজ্জ্বল উদ্ধার' নামে কত বড় একটা ধারাবাহিক সঙ্কলনের কাজ করে গিয়েছেন। ঘোষণা ছিল "এটি নিয়মিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা। সাধারণভাবে প্রবন্ধই প্রকাশ পায়। দুষ্প্রাপ্য কবিতাগ্রন্থ অথবা মূল্যবান অথচ উপেক্ষিত গল্পও পুনর্মুদ্রিত হয়। কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রে সংরক্ষিত ও সংগৃহীত উপাদানই এই কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।"
পতাকা হাতে তুলে একাকী মানুষ বুক চিতিয়ে ছুটে যাচ্ছে সুসজ্জিত সশস্ত্র এক সৈন্যসমাবেশের সামনে, কুরোশাওয়ার ছবি ‘কাগেমুশা’র সেই দৃশ্য, সন্দীপ দত্তের চলে যাওয়া এটা মনে করিয়ে দিল। কোনও প্রতিষ্ঠান, খ্যাতি, আত্মপ্রচারের তোয়াক্কা না করে শুধু লিটল ম্যাগাজিনের জন্য যিনি নিজের সর্বস্ব সমর্পণ করেছিলেন। আমাদের প্রজন্মের যারা— যারা কবিতা লিখেছে, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে লাইন দিতে রাত জেগেছে, বাদল সরকারের পিছনে দাঁড়িয়েছে, গান শুনেছে আর ছোট পত্রিকা প্রেস থেকে এনেই বুক ভরে গন্ধ নিয়েছে— তারা দেখেছে এটা প্রতি বছর বইমেলার সেই জটলাজটিল লিটল ম্যাগ কর্নারে। দেখেছে এক পাগল মাথায় কাগজের টুপি পড়ে, বুকে লিটল ম্যাগাজিনের পোস্টার সেঁটে ঘুরছেন। আবার কখনও সেই লিটল ম্যাগ চাঁদোয়ার নিচে একফালি টেবিলে সাজিয়ে বসেছেন নিজের সঞ্চয়। চেনার দরকার নেই। সব পত্রিকা সম্পাদকই জানতেন তিনিই সন্দীপ, জেহাদি আর ছোট পত্রিকার সৈনিক। এটাই চলেছে বছরের পর বছর। এক কপি পত্রিকা তাঁকে দিতেই হবে। তিনি রাখবেন সযত্নে, শিশুর মতো। এই ২৩ সালের মেলাতেও গরমের দুপুরে দেখেছি করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ড দিয়ে পা টেনে টেনে ঢুকছেন। হাতের ব্যাগ কাগজ নিজে নিয়ে তাঁকে বলেছিলাম কেন এলেন এইভাবে। ম্লান হেসেছিলেন সেই একক যোদ্ধা, বেজে উঠছিল বাসের হর্ন। তিনি আমার চেয়ে বয়সে একটু ছোট। মনে হল আমার শরীর যদি ওঁকে দিতে পারতাম! বাবরের প্রার্থনা যে সত্যি হতে পারে না তা আর একবার প্রমাণ হল সেদিন হাসপাতালে।
কত কী চাইতে পারতেন, পেতে পারতেন। কোনও দাবিই করেননি। বইমেলা ২৩-এ সন্দীপ দত্ত একা পা টেনে টেনে ৯ নং গেট দিয়ে ঢুকছেন সঙ্গহীন, ভিতরে গিল্ডের সাজানো অডিটোরিয়ামে ভাষণ, সম্বর্ধনা, আলো আর আলো। কিন্তু সন্দীপ দত্ত কি কেবলই লিটল ম্যাগের সংগ্রাহক, ১৯৭৮ সালে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা? তার চেয়েও কি অনেক বড় ছিল না এক নিঃসঙ্গ, নির্লোভ মানুষের চার দশক ধরে একা পথ চলা? কেউ কি সত্যি ছিলেন তাঁর পাশে? তাঁর চাওয়া তো খুব বেশি ছিল না। শুধু কেউ চাইলে টক করে ভুলে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া কোনও পত্রিকার তিরিশ বছর আগের চমকপ্রদ কোনও সংখ্যা নামিয়ে দেওয়া। তাতেই খুশি। পৃথিবীর আর কোনও লাইব্রেরি এটা করে? জাতীয়?
এটাই শেষ নয়।
প্রখর স্মৃতি ছিল। কোন সালে কোন কবি কোন লেখক কোন পত্রিকায় লিখেছেন তা বলে দিতে পারতেন হাতেনাতে। আর জানতেন কোন পত্রিকার কবে জন্ম, কবে মৃত্যু, সম্পাদক কে। সংগ্রাহককে জানতে হয় তিনি কী সংগ্রহ করছেন, কিসের কী দাম। কেউ বললেন না সন্দীপ ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ নামে কত বড় একটা ধারাবাহিক সঙ্কলনের কাজ করে গিয়েছেন। প্রতিবার বইমেলায় আমি অন্তত তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি ওই সঙ্কলনটিরই খোঁজে। ঘোষণা ছিল “এটি নিয়মিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা। সাধারণভাবে প্রবন্ধই প্রকাশ পায়। দুষ্প্রাপ্য কবিতাগ্রন্থ অথবা মূল্যবান অথচ উপেক্ষিত গল্পও পুনর্মুদ্রিত হয়। কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রে সংরক্ষিত ও সংগৃহীত উপাদানই এই কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।” আমার সংগ্রহে বেশ কটি আছে। তার মধ্যে ৩৭ নং শিল্পকলা সংখ্যাটি একটা বিস্ময়। দেখুন প্রচ্ছদ।
নন্দলাল বসু প্রসঙ্গে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মশাইয়ের লেখাটি আমায় নতুন করে ভাবিয়েছিল। আশ্চর্য এই যে এঁরাই ছিলেন তখনকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। লেখাটি তুলে আনা হয়েছিল গোপাল হালদার ও মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পরিচয়’ ৩৩ বর্ষ ৭ সংখ্যা মাঘ ১৩৭০ (জানুয়ারি ১৯৬৪) থেকে। হামদি বে-র লেখার সূত্র দেওয়া আছে, প্রশান্ত দাঁ ও জয়ন্ত রায় সম্পাদিত ‘ক্ষণিকা’ ২ বর্ষ ৪ সংখ্যা ১৩৭৮ (১৯৭১)। বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের সাক্ষাৎকার দুটি অঞ্জন সেন সম্পাদিত গাঙ্গেয়পত্র, মাঘ ১৩৮৫ (জানুয়ারি ১৯৭৯) থেকে। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের ‘গগনেন্দ্রনাথ’ এক কালস্পর্শী লেখা। সূত্র পরিচয় (অক্টোবর ১৯৬৪)। সুধা বসুর লেখাটি অন্বিষ্ট, মে ১৯৭১ সংখ্যার। এই ছিল সঙ্কলনের গুণমান। ৪০ পাতা, দাম ২০ টাকা। পিছনে লেখা আছে, “প্রকাশ্যে চুরি করুন অনন্ত পত্রিকার সম্ভার”।
এর ঠিক আগে যেগুলি প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলি সব নিঃশেষিত হয়ে যায়। তালিকাটা এই রকম।
আর কিছু বলতে মন চাইছে না। উৎপলকুমার বসু হলে বলতেন,
এখন তোমার মুখ চামচের মতন উজ্জ্বল।
তোমার বিনষ্ট মুখে রুধিরের বিসম্বাদী ডৌল
টলায় নাবিক, পণ্য, কফি, কস্তুরী, গন্ধক,
নাকছাবিটির হীরা— এত বস্তুগত সবই!