বিজেপি-বিরোধী জোটকে এককাট্টা করতে এখন একজন জেপি-কে দরকার ছিল

প্রশান্ত ভট্টাচার্য

 


সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

ভোটের লড়াইয়ে বিজেপিকে হারাতে না-পারলে স্বৈরশাসন থেকে নিস্তার নেই! তাই রাজনৈতিক মহলে আলোচনার বিষয়, আদৌ বিরোধীদের জোট হওয়া সম্ভব কি না

 

দরকারে তিনি সরে দাঁড়াতে রাজি, তবু বিরোধী জোট হোক। তাঁর সাংসদপদ খারিজের পরে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে জোটবদ্ধ হওয়ার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছে, তার ওপর নজর রেখেই রাহুল গান্ধি এমন কথা বলেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তিনি মনে করেন, দেশবাসীর কাছে গিয়ে আদানি-কাণ্ডের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। মল্লিকার্জুন খড়গের বাড়িতে ১৭টি বিরোধীদলের বৈঠকে রাহুলের দাবি, বিজেপি ভয় পেয়েছে, এটাই সুযোগ ২০২৪-এর যুদ্ধে জেতার।

রাহুল তো বললেন। কিন্তু, তা কি আদৌ হবে? ভোটপণ্ডিত প্রশান্ত কিশোর কদিন আগেই দাবি করেছেন, বিরোধী দলগুলোর মধ্যে যে মতাদর্শগত ফারাক, তাতে সার্বিক বিরোধী ঐক্য সম্ভব নয়। তার ওপর বিজেপি শিবিরের হাতে হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদ আর উন্নয়নের তাস আছে। এই তিনটি ইস্যুই বিজেপিকে টিকিয়ে রেখেছে। ভোটকুশলীর দাওয়াই, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এই তিনটির মধ্যে যে কোনও দুটি বিষয়ের মোকাবিলা করতে হবে বিরোধীদের, আর, তা করতে হবে জোটবদ্ধভাবে। অন্যথায় বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবেন না বিরোধীরা।

আমি পিকে-র বক্তব্যর সঙ্গে ১০০ শতাংশ সহমত হয়েই আর একটু সংযোজন করতে চাই। আমার মনে হয়, এই তিনটি ইস্যু ছাড়াও, বিজেপির আরও দুটি স্তম্ভ আছে। তার একটি হলেন নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। এই মানুষটি অক্লেশে অসত্য বলতে পারেন আর অসাধারণ নাটকীয়তার সঙ্গে তা উপস্থাপনা করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে তিনি অনন্য। বেশভূষা ও ক্রুরতার  রসায়নে তিনি এক অবতারে রূপান্তরিত হয়েছেন। তাই ভক্তরা, যাঁদের বেশিরভাগই সর্বার্থে সাধারণ মানুষ, তাঁর সব কথা গেলেন। হজম না-হলেও গেলেন। বিজেপি-র আরেকটি স্তম্ভ মিডিয়া। ভারতের আর কোনও শাসক এভাবে মিডিয়াকে কবজা করতে পারেনি। বিজেপি-বিরোধী শক্তির প্রায় সব কর্মসূচি সম্পর্কে এই মিডিয়াগুলো অদ্ভুত উদাসীন থাকতে পারে। এমন একটা ভাব করে, যেন, বিজেপি ছাড়া আর কোনও রাজনৈতিক দল ভূ-ভারতে নেই। অতি সম্প্রতি একটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমের কনক্লেভে মোদি ‘হেডমাস্টারের মতো’ জ্ঞান দিয়ে এলেন, কী নিয়ে খবর করলে টিআরপি বাড়বে। সেই মিডিয়া হাউজের কর্তারা তা অনুগত প্রজার মতো মেনেও নিলেন।

আমার বিবেচনায়, এই পাঁচটি ইস্যুর মধ্যে উন্নয়নের ‘গল্প’ আর জাতীয়তাবাদের মোড়ক নিয়ে ভারী কসরতের দরকার। জাতীয়তাবাদ খায় না মাথায় দেয়, বেশিরভাগ মানুষই তা বোঝেন না। সেটার মোকাবিলা করার সেরা উপায় আঞ্চলিক ইস্যুগুলো ও বঞ্চনার কথা বারবার করে সামনে তুলে আনা। আর উন্নয়নের নামে যে ঢাক পেটানো হচ্ছে তা যে অন্তঃসারশূন্য, তা তো আমজনতা প্রতিদিন হেঁশেল ঠেলতে গিয়েই বুঝতে পারেন। হিন্দুত্ব নিয়ে অযথা ঘাঁটাঘাঁটি করলে সুবিধা হবে না। নরম হিন্দুত্ব দিয়ে উগ্র হিন্দুত্বের মোকাবিলা করা যায় না, বরং ঝোঁক দেখা দেয় উগ্রতাতেই। মোদির ক্যারিশমার সঙ্গেও পাল্লা দেওয়া যাবে না। আর মিডিয়া মূলত পুঁজিনির্ভর, এবং নানান ছক্কাপাঞ্জা করে তাদের টিঁকে থাকতে হয়, ফলে গোদি মিডিয়াকে দিয়ে আপাতত গণতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল করানো যাবে না।

এই অবস্থায় বিরোধীদের একটাই কাজ করার আছে। তা হল, নিজেদের মধ্যে ন্যূনতম সামান্যতার ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে তোলা। সে ডাক ইতিমধ্যেই দিয়েছেন রাহুল গান্ধি। গত মঙ্গলবার বিরোধী দলগুলোর যে বৈঠক হয়েছে, সেখান কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে বলেছেন, “সমমনোভাবাপন্ন কোনও দলের নীতি বা আদর্শ ক্ষুণ্ণ হয়, এমন মন্তব্য থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে।” রাজনৈতিক মহলের ধারণা, সাভারকর নিয়ে রাহুল গান্ধি যে মন্তব্য করেছিলেন, সেটা উদ্ধব ও শিবসৈনিকদের আঘাত দিয়েছে বুঝতে পেরেই এই অবস্থানের কথা বলেন খড়গে। আমরা জানি, শরদ পাওয়ারের পরামর্শে রাহুলও উদ্ধব ঠাকরেকে ফোন করে বলেন, “আমাদের যুদ্ধ প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে, সাভারকরের বিরুদ্ধ নয়।” রাহুল প্রকাশ্যেও এই বিবৃতি দেন, ফলে সহজ হয়েছে বিরোধী জোটে উদ্ধবকে রাখা।

এখন, কৌশলগত দিক থেকে এই মনোভাব কার্যকর হতে পারে, কিন্তু আরও এক বছর এই মনোভাব অটুট রেখে ভোটযুদ্ধে নামাটা কি সম্ভব? এটা তো ঘটনা যে, ভোটের লড়াইয়ে বিজেপিকে হারাতে না-পারলে স্বৈরশাসন থেকে নিস্তার নেই! রাজনৈতিক মহলে আলোচনার বিষয়, আদৌ বিরোধীদের জোট হওয়া সম্ভব কি না। কয়েকটি রাজ্যে সম্ভব হলেও বেশিরভাগ রাজ্যে বিরোধীদের সার্বিক জোট হবেই না বলে মনে হয়। যেমন ধরা যাক, ত্রিপুরা। এখানে বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের সঙ্গে তৃণমূল না-থাকায় বিজেপি ফের ক্ষমতায় এসে গেল। এবার বিধানসভা ফলের নিরিখে তৃণমূল যদি লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী না-ও দেয়, কংগ্রেস কি সিপিআইএমকে দুটি আসনেই লড়তে ছেড়ে দেবে? বা বৃহত্তর স্বার্থে জোট করার জন্য উভয় দল একটি করে আসনে প্রার্থী দেবে? একই রেফারেন্স ফ্রেমে আমরা দিল্লিকেও রাখতে পারি। সেখানে কি আম আদমি পার্টি সাতটি আসনের মধ্যে কংগ্রেসকে একটিও ছেড়ে দেবে? যদিও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে এই দুই দল একটি আসনও জেতেনি। তবু হাত যে ঝাড়ুর হাত ধরবে, তেমন সম্ভাবনা কম বলেই ধরে নেওয়া যায়। পঞ্জাব ও হরিয়ানায় কংগ্রেস কিছুটা বলার মতো জায়গায় আছে, কিন্তু সেখানেও কি আপ ও কংগ্রেস জোট করে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে লড়াই করবে? অথচ মোদি ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালাতে হলে সেটাই পরিস্থিতির দাবি। এবং, গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডও এমনটাই দাবি করে। কিন্তু সেটা হবে কি না, তা-ই আপাতত লাখ টাকার প্রশ্ন।

কেরলকে বিবেচনা করতে হবে অন্য আরেক দিক থেকে। এই রাজ্যে বিজেপি এখনও লোকসভায় খাতা খুলতে পারেনি। ফলে বাম ও কংগ্রেসে লড়াই হলেও বিরোধী শিবিরের সাংসদ সংখ্যায় কোনও প্রভাব পড়বে না। তবে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে এলডিএফ ও ইউডিএফের লড়াইয়ের মধ্যে বিধানসভায় বিজেপি খাতা খুলে ফেলেছিল, একুশে আর পারেনি। সাংসদ সংখ্যার ভিত্তিতে দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে বিরোধী শিবিরের নির্ণায়ক শক্তি সমাজবাদী পার্টি। এর মধ্যেই অখিলেশ যাদব ইঙ্গিত দিয়েছেন, খাস রায়বরেলি ও অমেঠিতে তাঁরা এবার প্রার্থী দিতে পারেন। যদিও অখিলেশের এই ইঙ্গিত রাহুলকে সংসদ থেকে অপসারণ করার আগে। এখন যদি অখিলেশ ও তাঁর জোটসঙ্গীরা উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসকে দুটি বা তিনটি আসন ছেড়ে দিয়ে ভোটযুদ্ধে নামেন, কংগ্রেস কি তা মেনে নেবে? বিহারের অবস্থা বিরোধীজোটের ক্ষেত্রে তুলনায় কিছুটা ভাল, কেননা, সেখানে মহাগঠবন্ধন প্রক্রিয়ায় বিজেপিকে আগেও ঠেকানো গিয়েছে। নীতীশকুমার যদি ফের কোনও চাল না-দেন, এই রাজ্যে এনডিএ তেমন সুবিধা করতে পারবে না।

আর পশ্চিমবঙ্গ? এখানে ২০১৯-এ বিজেপি অসাধারণ ফল করেছে। এবারও তারা অনেকটাই ঘর গুছিয়ে নিয়েছে। রাজ্য-রাজনীতির প্রধান দল তৃণমূল কংগ্রেস গত রবিবার পর্যন্ত কংগ্রেসের ডাকা বিরোধীদের বৈঠকে যায়নি। এবার ঠেকায় পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলার মাটিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস বা বামদের সূচ্যগ্র জমিও ছাড়তে নারাজ। বাম-কংগ্রেস শিবিরের মনোভাবও তাই। বিশেষ করে সাগরদিঘিতে বৃহত্তর ঐক্যে সাফল্য পাওয়ার পর, অধীর চৌধুরী কিছুতেই মমতার সঙ্গে যাবেন না। আর বামেরা তো তৃণমূলের জাতশত্রু। তারাও চাইবে, ত্রিপুরার মতো বাংলাতেও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে। এছাড়া নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে যেভাবে তৃণমূল লবেজান হয়ে রয়েছে, তাতে বাম-কংগ্রেস এখন অলআউট খেলা থেকে সরে এলে আখেরে লাভ হবে বিজেপি-র। তবে অধীরের উদ্দেশ্য বাম-কংগ্রেস জোটের পাশে আন্ডারকারেন্ট বিজেপিকে নিয়ে সাগরদিঘির মডেলে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল বিনাশ। ফলে এই অধীর চৌধুরীকে কংগ্রেস সামলাতে পারবে না বলেই মনে হয়। আর রাজ্যে বিজেপি ভাল ফল করলে অধীরের কিছু হারাবার নেই। ওয়াকিবহাল মহল মনে করে, ২০১৯-এ দিলীপ ঘোষের মদতে জয়লাভ করে অধীরের বিজেপি-তে যোগ দেওয়া একরকম পাকা হয়ে গিয়েছিল। সে খবর সনিয়া গান্ধির কাছে পৌঁছে যেতেই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বহরমপুরের সাংসদকে লোকসভার নেতার পদ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয় কংগ্রেস।

ইদানীং মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, এই বিচিত্র অঙ্ক, সমন্বয় ও আঞ্চলিক বিন্যাসের ভেতর দিয়ে সার্বিক এবং মোটের ওপর গ্রহণযোগ্য একটা জোট গড়ার জন্য বিরোধীদের এখন একজন জেপি-র দরকার ছিল। জেপি বলতে কেউ আবার ভুল করে নড্ডা সাহেবের কথা ভেবে বসবেন না। আমি বলছি ভারতীয় রাজনীতির আদি ও অকৃত্রিম জেপি— জয়প্রকাশ নারায়ণের কথা। তাঁর মতো একজনকে আজ বড় প্রয়োজন ছিল, যিনি অন্তত একবার সাপে-নেউলে সম্পর্ক ভুলিয়ে সমস্ত বিরোধীপক্ষকে এক ছাতার তলায় এনে ফ্যাসিবাদের গ্রাস থেকে দেশকে সামাল দিতে পারবেন। মনে রাখতে হবে, তিনি ভোটযুদ্ধে প্রফুল্ল সেন ও জ্যোতি বসুকে একমঞ্চে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। ডামাডোলের এই বাজারে তেমন কেউ বিরোধীদের পাশে থাকলে পাশা পালটে যেত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...