আধারের সঙ্গে প্যান কার্ড সংযোগ না হলে কি প্যান কার্ড সত্যিই বাতিল হতে পারে?

সুমন সেনগুপ্ত

 



প্রাবন্ধিক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার

 

 

 

 

আধারের তথ্যভাণ্ডার আজ অবধি পরীক্ষা করা হয়নি। বহু মানুষের একাধিক আধার আছে, বহু মানুষের ভুয়ো আধার আছে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এই কথা, তাহলে আধারের সঙ্গে প্যান সংযোগ করানোটাই তো ভয়ের।

 

আপাতত অনেকেই হয়তো হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন, যাক বাবা প্যান–আধার সংযোগের তারিখ আরও তিন মাস পিছিয়ে গেছে বলে। বেশিরভাগ মিডিয়া দেখাচ্ছে এই তারিখ পেছোনোর খবর, অথচ কোনও গণমাধ্যম কিন্তু এই প্রশ্নটা করছে না, এই প্যান-আধার সংযোগের জরিমানা বাবদ কেন সরকার ১০০০ টাকা করে নিচ্ছে? আসলে আজকের সময়ের গণমাধ্যমগুলোর এটাই সমস্যা, তাঁরা সঠিক প্রশ্নটা তুলে ধরে না। প্রাক্তন আমলা, কান্নান গোপিনাথন, একটা কথা বলেছিলেন একটি বিতর্কের সময়ে, নোটবন্দির সময়ে বলা হয়েছিল, যে কালো টাকা উদ্ধার করতে হবে, তাই আমাদের টাকা বদল করে নতুন টাকা ব্যবহার করতে হবে। সমস্ত গণমাধ্যম, তখন এই নোটবন্দি প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলা শুরু করল, অথচ আমাদের কাছে একটা মৌলিক প্রশ্ন সামনে আনা হল না, ‘কালো টাকা’ কী? ঠিক একইরকমভাবে, নাগরিকত্ব বিলের সময়ে বলা হল, বেশ কিছু নাগরিকের নাগরিকত্ব থাকবে না। আমরা কিন্তু প্রশ্ন করলাম না, বেনাগরিক কারা? কীভাবে প্রমাণিত হবে, একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব? তাহলে কি রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী কোনও কাগজ না থাকলেই, কোনও একজন ব্যক্তিকে বেনাগরিক, ঘোষণা করে দেওয়া যাবে? আজকেও যে আধার-প্যান সংযোগের বিতর্ক চলছে, সেখানেও একটা মৌলিক প্রশ্ন করা দরকার, কোনও একজন নাগরিক, যদি তাঁর প্যান এবং ভোটার কার্ড, প্রাথমিক পরিচয়পত্র হিসেবে দেখিয়ে আধার পান, তাহলে কোন যুক্তিতে সেই প্যান-আধার সংযুক্ত না হলে, প্যানকার্ডটি বাতিল হয়ে যাবে?

সেইজন্যেই আমাদের জানা দরকার প্যান কার্ড/ভোটার কার্ড কী?

একজন ভারতীয় নাগরিক, যিনি চাকরি বা ব্যবসা করেন, তাঁর একটি প্যান কার্ড থাকার কথা। তিনি তাঁর প্যান কার্ডের নম্বর দেখিয়ে, ইনকাম ট্যাক্স দিয়ে থাকেন। সেই প্যান কার্ডে, তাঁর ছবি আছে, নিজের স্বাক্ষর আছে, আর আছে জন্মতারিখ। সুতরাং প্যান কার্ড, তাঁর জন্মতারিখের শংসাপত্রও বটে। আঠারো বছর বয়স হওয়ার সময়ে, সেই ব্যক্তিটির একটি ভোটার কার্ড তৈরি হয়। সেই ভোটার কার্ডে, তাঁর ছবি, জন্ম তারিখ এবং বাসস্থান কোথায়, তা উল্লিখিত থাকে, সুতরাং তা, তাঁর বাসস্থানের শংসাপত্রও বটে। একজন ব্যক্তি নাগরিকের এই দুটিই প্রাথমিক পরিচয়পত্র। একটি ভোটার কার্ড দেখিয়ে যদি কোনও ব্যক্তি ভারতের কোনও নির্বাচনে অংশ নেন, তিনি তাহলে একজন ভারতীয় বৈধ নাগরিক।

এই পরিচয়পত্র দেখিয়ে, একজন ব্যক্তিকে বলা হল আধার করতে, আধার নাকি একজন ব্যক্তিকে চেনার উপায়। যতদিন আধার ছিল না, ততদিন কি রাষ্ট্র কিংবা সরকার কোনও একজন মানুষকে চিনতে পারত না? তাহলে কেন এই আধারের কথা বলা হচ্ছে এখন? ২০০৯ সালে যখন কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার ছিল, তখন বলা হয়েছিল, যে যাঁদের কোনও পরিচয়পত্র নেই, তাঁদের একটি পরিচয়পত্র হবে। সেই সময়ে হিসেব করে দেখা গিয়েছিল, দেশের জনসংখ্যার মাত্র ০.০৩ শতাংশ মানুষের আধার তৈরি করলেই এই কাজটার সমাধান হবে। যে সময়ে কেন্দ্রের এই আধার প্রকল্প আনা হয়েছিল, তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি তখন বলেছিলেন, এই আধারের কোনও মানেই নেই। কিন্তু তারপরে, ২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদি দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তারপরে সেই তিনিই ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন, গ্যাসের সংযোগ থেকে শুরু করে, সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধারকে যুক্ত করার প্রকল্প হাতে নেন। তা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলাও হয়। দীর্ঘদিন শুনানির পরে, আদালত রায় দেয়, একমাত্র সরকারি পরিষেবা পেতে গেলেই আধার বাধ্যতামূলক, অন্য কোনও কিছুর সঙ্গে আধার সংযোগ না করলেও চলবে। তা সত্ত্বেও ভোটার কার্ড, প্যান কার্ডের সঙ্গে আধার সংযোগ করানোর কথা এখন বলা হচ্ছে কেন? শুধু তাই নয়, এই সংযোগের জন্য, এক হাজার টাকা দিতে হবে। না হলে প্যান কার্ড বাতিল হয়ে যাবে। ওদিকে নির্বাচন কমিশন ও ভোটার কার্ডের সঙ্গে সংযোগ করার কথা বলছে। কিন্তু কখনও কি আমরা ভেবে দেখেছি, সরকারের এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে আধার সংযোগের উদ্দেশ্য কী? এই একবার ফোন, একবার প্যান কার্ড, একবার ড্রাইভিং লাইসেন্স, একবার ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট, একবার ভোটার কার্ডের সঙ্গে আধার সংযোগ করার জন্য দৌড়তে দৌড়তে আপনি ক্লান্ত হয়ে মারা গেলে, আপনার পরের প্রজন্ম এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে আরও দ্রুততার সঙ্গে, সেটাই কি সরকার চায়? তাঁরা কি চায়, আপনি, আমি সারাদিন এই সংযুক্তিকরণ করার পিছনে দৌড়ে যাই, যাতে অন্য কোনও কিছুর দিকে আমাদের নজর না যায়, না কি আরও কিছু উদ্দেশ্য আছে? আসলে আমাদের রাষ্ট্র এবং সরকার এখন আমাদের জন্মের আগে থেকেই আমাদের গতিবিধি থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু নজরে রাখার প্রক্রিয়া চালু করেছে। জন্মানো মাত্রই রাষ্ট্র একটি শিশুর হাতের ছাপ এবং শরীরের অন্যান্য অংশের যাবতীয় ছবি তুলে, তার জন্য একটি, ‘বাল আধার’ তৈরি করিয়ে নিতে বলে, যাতে প্রথম দিন থেকে মৃত্যু অবধি একজন মানুষের ৩৬০ ডিগ্রি অবয়ব তৈরি করা যায়। মৃত্যুর সময়েও সেই আধারকে সে প্রায় বাধ্যতামূলক বানিয়ে ফেলেছে। তারপরে কিছুদিন পর সেই ‘বাল আধার’ থেকে সাধারণ আধার তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তারপর চালু হয় এই কার্ডের সঙ্গে সংযোগ করতে হবে, না হলে এই পরিষেবা বন্ধ হবে সংক্রান্ত সরকারি নিদান।

যখন সরকারের তরফে বলা হয়, আধারের সঙ্গে প্যান কিংবা ভোটার কার্ডের সংযোগ না করলে, সরকারি পরিষেবা বন্ধ হবে, তখন যদি কোনও নাগরিক এর যৌক্তিকতার প্রশ্ন করেন, তাহলে কি তা অনায্য? প্রাথমিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে যে আধার পাওয়া গেছে, সেই আধারের সঙ্গে প্যান কিংবা ভোটার কার্ডের সংযুক্তি না করলে, কেন একজনের প্রাথমিক পরিচয়পত্র বাতিল হবে— সরকারের কাছে কি এর কোনও উত্তর আছে? আসলে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সরকারের ঘরে একটা তথ্যভাণ্ডার তৈরি হয়, তারা জানতে পারে, কারা সরকারি কী কী সুবিধা পাচ্ছে। তারা আরও বুঝতে পারে, যে এই সরকারি সুবিধা সহজেই বন্ধ করে দেওয়া যাবে, যদি আধারকে অচল করে দেওয়া যায়। সরকারের কাছে একজন মানুষ যখন একটি সংখ্যায় পরিণত হয়, তখন সে তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়, যেহেতু আধার একটি সংখ্যা, তাই যদি বোঝা যায়, এই সংখ্যাটি সরকারের জন্য অসুবিধাজনক, তাহলে সেই সংখ্যাকে অচল করে দিলেই সরকারের অনেক কাজ সহজ হয়ে যায়। যদি একটু খবর নেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, অসমে বহু মানুষের আধার অচল করে রাখা আছে, ফলে তাঁরা সরকারি যেকোনও পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যাঁদের নাম নাগরিকপঞ্জিতে নেই, সেই ১৯ লক্ষের একটা বড় অংশের মানুষের আধার কাজ করে না, কারণ সরকার থেকে তা নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। আসলে সরকার চায়, সমস্ত নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে, সবাইকে নজরে রাখতে, তাই তার কাছে, আধার হচ্ছে একটি বড় অস্ত্র, যা দিয়ে সে এই কাজটি করতে পারে।

আর একটা কথা, ভারতে এই মুহূর্তে প্রায় ৬৮ কোটি প্যান কার্ড আছে। যাঁরা ইনকাম ট্যাক্স দিয়ে থাকেন, তার বাইরেও বহু মানুষ আছেন। সংখ্যাটা হিসেব করলে ৪০ কোটির কম নয়। তাঁর ৫০ শতাংশের সঙ্গে যদি আধার সংযোগ করতে হাজার টাকা দিতে হয়, তাহলে কত টাকা সরকারের ঘরে ওঠে? সেই টাকা কোন খাতে খরচ হবে? নাকি সেটাও আদানিকে বাঁচাতে ব্যবহার করা হবে? এই বিষয়টা কি দুর্নীতি নয়? যাঁরা সকাল থেকে বিকেল অবধি দুর্নীতির জন্য ঘুমাতে পারেন না, তাঁরা এটাকে দুর্নীতি মনে করেন না? নাকি এটা কেন্দ্রীয় সরকারি দুর্নীতি, তাই তা দেখতে নেই? যাঁরা তৃণমূল এবং অন্যান্য দলের দুর্নীতি নিয়ে সরব, তাঁরা কেন একটি সরকারি দুর্নীতি বা লুঠ দেখেও দেখছেন না? রাজনৈতিক দলেরাই বা এই বিষয়ে কেন আন্দোলন করছেন না, তা তাঁরাই বলতে পারবেন। অথচ বহু সাধারণ মানুষের কাছে এটা কিন্তু একটা জ্বলন্ত সমস্যা। কোনও মানুষ যদি প্যান করতে যান, তাঁর আধার লাগবে। যদি কেউ বলেন তিনি আধার করাবেন, তাহলে তাঁর প্যান কিংবা ভোটার কার্ড লাগবে— এ তো সেই গোলগোল করে ঘোরা। ডিম আগে না মুরগি, আগের মতো। কিন্তু মানুষ কবে বুঝতে পারবে, যে তাদের বোকা বানানো হচ্ছে এই করে, এবং তা একদিন দুদিন নয়, রোজ? অনেকে ভয়ে, এই আধার এবং প্যান কার্ডের সংযোগ করানোর জন্য ছুটছেন, কিন্তু এই সংযুক্তিকরণের জন্য ছোটাছুটির কি কোনও অন্ত আছে? যে আধার নিজেই একটি স্বেচ্ছামূলক প্রকল্প, তার সঙ্গে একটি প্রাথমিক পরিচয়পত্রের সংযোগ করার যৌক্তিকতা নিয়ে যদি সাধারণ মানুষ প্রশ্ন না করে, তাহলে কে করবে?

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা নিয়েও কথা বলা জরুরি। আধারের তথ্যভাণ্ডার আজ অবধি পরীক্ষা করা হয়নি। বহু মানুষের একাধিক আধার আছে, বহু মানুষের ভুয়ো আধার আছে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন এই কথা, তাহলে আধারের সঙ্গে প্যান সংযোগ করানোটাই তো ভয়ের। বহু আধারে দেখা যাবে, একজনের বায়োমেট্রিক্সের সঙ্গে অন্যজনের নাম সংযুক্ত হয়ে আছে, তাহলে এখন যদি আধারের সঙ্গে প্যান কার্ড সংযুক্ত করানো হয়, তাহলে প্যানগুলোও যে অন্য মানুষের বায়োমেট্রিক্সের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায়?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...