অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর
৫-৬ এপ্রিলে দিল্লির কৃষক-শ্রমিক সমাবেশের জনবিস্ফোরণের কারণ কী? তিনটি শব্দেই বোধহয় সেই কারণগুলিকে বুঝিয়ে দেওয়া চলে। এই সমাবেশে আসা সাধারণ খেটে খাওয়া জনতার প্রধান তিনটি দাবি হল— সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য ও আত্মসম্মান
লড়াই শেষ নয়। লড়াই সবে শুরু। ৫ এপ্রিল, ২০২৩— দিল্লির রামলীলা ময়দানে ঐতিহাসিক কৃষক-শ্রমিক সমাবেশের পর বিষয়টাকে এইভাবেই দেখা উচিত। মোদি-সরকারের ইতিহাসে বারংবার এই কৃষক-শ্রমিক ঐক্যের কারণেই সরকারের হৃৎকম্প দেখা দিয়েছে। এবারেও তার অন্যথা হল না। গত প্রায় ছয় মাস ধরে দেশের প্রধান তিনটি কৃষক-শ্রমিক সংগঠন, যথাক্রমে সারা ভারত কিসান সভা, সিটু ও খেতমজুর সংগঠনের পক্ষ থেকে আহ্বান করা এই সমাবেশের দেশব্যাপী প্রস্তুতি চলেছে। এরই অঙ্গ হিসেবে মহারাষ্ট্রে আয়োজিত হয়েছে কৃষক লং মার্চ, মুম্বাই অবধি যে পদযাত্রা পৌঁছানোর আগেই মহারাষ্ট্র সরকার তড়িঘড়ি সেই কৃষকদের স্থানীয় দাবিগুলিকে মেনে নিতেও বাধ্য হয়েছে। ৪০০টিরও বেশি জেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ। যেমনটা ৫ এপ্রিলের ঐতিহাসিক সমাবেশে অংশ নেওয়া বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ক বলছিলেন, “আদানির সাপেক্ষে আর ছোট-কৃষক বড়-কৃষক ভেদাভেদটাই বর্তমান থাকছে না। সেই কারণেই কৃষক আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ অবধি ছোট-বড়-মাঝারি সব ধরনের কৃষক পরিবার থেকে আসা মানুষেরাই নিজেদের হকের দাবিতে এই আন্দোলনে সামিল হচ্ছেন। তাঁদের সকলেরই যে সাধারণ শত্রু পুঁজিবাদ ও সেই পুঁজিবাদের ধারক ও বাহকেরাই, এই সরল সত্য তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।” এই সমাবেশের দাবিসনদ থেকেই তা পরিষ্কার। মজদুরেরা দাবি করেছেন নূন্যতম ২৬,০০০ টাকা মাসিক বেতন ও অবসর-পরবর্তীতে অন্ততপক্ষে ১০,০০০ টাকা মাসিক পেনশনের নিশ্চয়তা। কৃষক-শ্রমিক-জনতা দাবি করেছেন সমস্ত ফসলের জন্য স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুসারে নিশ্চিত সহায়ক মূল্য, ইলেক্ট্রিসিটি (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২০-র সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, ও বিতর্কিত চারটি লেবার কোড বাতিল। এই সমস্ত দাবিতে লালঝড়ের সাক্ষী থাকল দিল্লির ঐতিহাসিক রামলীলা ময়দান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কৃষক প্রতিনিধিরা দাবি তুললেন, সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য ও আত্মসম্মানের। নির্বিচারে তিল তিল গড়ে ওঠা একাধিক সমস্ত জাতীয় সম্পত্তিকে বন্ধু শিল্পপতিদের কাছে অস্বাভাবিক কম দামে বিক্রি করে দিয়ে যে অর্থনৈতিক আত্মহত্যার পথে হাঁটছে মোদি সরকার, এই সমাবেশ থেকে তার বিরুদ্ধেও আওয়াজ তোলা হয়। লক্ষাধিক মানুষের এই সমাবেশ থেকে আজ দেওয়াললিখন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের জনতা এই সরকার ও তার সমস্ত দেশবিরোধী, জনস্বার্থ-বিরোধী নীতিকেই আমূলে প্রত্যাখ্যান করছে।
সমাবেশের এই জনবিস্ফোরণের পিছনে কারণ কী? তিনটি শব্দেই বোধহয় সেই কারণগুলিকে বুঝিয়ে দেওয়া চলে। এই সমাবেশে আসা সাধারণ খেটে খাওয়া জনতার প্রধান তিনটি দাবি হল— সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য ও আত্মসম্মান। স্রেফ এই তিনটি বিষয়েরই নিশ্চিতকরণ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ে যে লাগামছাড়া বেসরকারিকরণের হিড়িক দেখা যাচ্ছে, তাতে করে সাধারণ দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত অথবা প্রান্তিক মানুষদেরই ওপর চাপটা আসছে বেশি। বাদ যাচ্ছে না মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চ-মধ্যবিত্তেরাও। তাঁদের হেঁশেলে টান পড়লেও, পিঠে চাপ না পড়ার কারণে হয়তোবা তাঁরা এখনও রাস্তায় নেমে এসে দাঁড়াননি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট (ও অর্থনৈতিকভাবে দিশাহীন) এই সরকারের রাজত্ব যদি চলতেই থাকে, তাহলে যে আরও বড় বিপদ পরবর্তীতে অপেক্ষা করছে তা বলাই যায়। কৃষি-বিলগুলির সেই ভয়ানক চরিত্রগুলিকে স্মরণ করতে পারেন? যেখানে বলা হয়েছিল বিরাট পুঁজিপতিদের সঙ্গে চুক্তি-চাষের সময় কোনও আইনি বিবাদ ঘটলে পরে ভারতীয় আইনব্যবস্থার কোনও আদালতে তার বিচার হবে না। স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট ‘সব পক্ষে’র বক্তব্য বিবেচনা করে নিজের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন। অথবা যেখানে ঘোষণা করা হয়েছিল, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের আর কোনও দায়িত্ব থাকবে না। কালোবাজারির প্রতি যা ছিল কার্যত খোলা সার্টিফিকেট। বেসরকারিকরণের এই ধাক্কাতে, সমাবেশে আসা কৃষক পরিবারের সদস্যেরা তাই সরাসরিই জিজ্ঞেস করেছেন, “এই অবস্থায় আমরা আমাদের সন্তানেদের পাঠাব কোথায়? কীভাবেই বা তাদের সুস্থ শরীরে মানুষ করব?” সমাবেশ থেকে প্রত্যেক সুস্থ সমাজের প্রয়োজনে যে ন্যূনতম দাবিগুলি উঠে আসা উচিত, একটা দেশ, জাতি বা সমাজের, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য, কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন, এই সমাবেশ সেগুলিরই কথা বলেছে।
সরকার ভয় পেয়েছে, আর ভয় পেয়েছে বলেই নানান কায়দাতে মানুষের নজর এই সমাবেশ থেকে ঘোরানোর চেষ্টা করেছে। কতগুলো তারিখ স্মরণ করিয়ে দিই চলুন। ৩০ মার্চ, ২০২৩; ৫ ও ৬ এপ্রিল ২০২৩। ৫ এপ্রিল ছিল মহতী কৃষকসমাবেশের আহ্বান। ৩০ মার্চ ও ৬ এপ্রিল ছিল যথাক্রমে রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীর উদযাপন। আলাদা করে বাংলার রাজনীতির কথা বলব না। কিন্তু ৩০ মার্চ ও তার পরবর্তীতে যেভাবে দেশব্যাপী ধর্মীয় জিগির তোলা হল, একাধিক জায়গাতে হিংসাত্মক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল, ও তারও পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মেরুকরণের রাজনীতিরই আবারও একবার নগ্ন প্রকাশ ঘটল— ওয়াকিবহাল মহলের মনে এই প্রশ্ন জাগতে বাধ্য যে, এই সময়েই বিশেষ করে এমন ইস্যুগুলিকে সামনে নিয়ে আসা কি তাহলে কৃষক-শ্রমিক সমাবেশের থেকে জনসাধারণের নজর ঘোরানোর প্রয়োজনেই? এখানেই শেষ নয়, গোটা মার্চ মাস জুড়েই প্রায় পঞ্জাব ও সংলগ্ন অঞ্চলে এক উগ্রবাদী নেতাকে ঘিরে তুলকালাম কাণ্ড চলতে থাকল। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের রাজনীতিতেও যার প্রভাব পড়ল। এখন আর ততখানিও হইচই দেখা যাচ্ছে না। এনসিইআরটিরও মনে হল হঠাৎ, ঠিক এই সময়েতেই সিলেবাস থেকে মুঘল সাম্রাজ্যকে বাদ দেওয়া প্রয়োজন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিবাদে, ৪৮ ঘণ্টা না কাটতেই সেই সিদ্ধান্তও প্রত্যাহার করা হল। অর্থাৎ কিনা গা-গরম, বাজার গরম, (অথবা পড়ুন, বিক্রি-হয়ে-যাওয়া মিডিয়া-গরম)-এর প্রয়োজনে যেমন সমস্ত বিষয়গুলিকেই সচরাচর বাজারে ছাড়া হয়ে থাকে, তার সবকটিই এই মার্চের শেষ আর এপ্রিলের গোড়ায় ঘটে যেতে পারল। কৃষক সমাবেশের মিডিয়া কভারেজ নিয়ে তাহলে কি সরকারের মনে এতখানিই ভয়ের উদ্রেক ঘটেছিল বলে মনে হচ্ছে? সরকারি মদতপুষ্ট সংবাদমাধ্যম, যার মধ্যে সদ্য আদানি-গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি হওয়া একটি সংস্থাও রয়েছে, তাদের রিপোর্টাজ অনুসারে এই কৃষক-সমাবেশে শয়ে-শয়ে মানুষের জমায়েত হয়েছিল। সমান্তরাল স্বাধীন মিডিয়ার তরফে কিন্তু হাজার হাজার কিসান-মজদুর, খেটে খাওয়া মানুষের জমায়েতের কথাই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের বক্তব্য অনুসারে সারা দেশ থেকে লক্ষাধিক কৃষক, মজুর, শ্রমিক ও খেতমজুর এই সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। সমাবেশের আগেই সমমনস্ক বুদ্ধিজীবী, শিল্পীরাও তাঁদের মতো করে এই সমাবেশের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। সব মিলিয়ে এক বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য-বোধেরই সামাজিক প্রকাশ পরোক্ষে হলেও উঠে আসতে শুরু করে।
রাহুল গান্ধির ভারত জোড়ো যাত্রা, তার পরবর্তীতে রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ— এই দুটি ঘটনার প্রেক্ষিতে একদিকে যেমন বৃহত্তর মোদি-বিরোধী জোটের সলতে পাকানো শুরু হতে পেরেছে, অন্যদিকে বামপন্থী সংগঠনগুলির তরফে দেশব্যাপী এই কৃষক-শ্রমিক-মজুর ও প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষকে ক্রমাগত রাজনৈতিকভাবে ফ্যাসিস্ট-ক্যাপিটালিস্টদের বিরুদ্ধে একত্রকরণের এমন যে সমস্ত প্রচেষ্টা সমান্তরালভাবে জারি রয়েছে— এই বিষয়গুলির মাধ্যমেই মোদি সরকারের অশনি-সঙ্কেত ঘোষিত হতে বাধ্য।
আর যারা এখনও মোদী সরকারের ‘অচ্ছে দিন’ অথবা রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিসংখ্যান বিষয়ক কমিটিতে ভারতের অন্তর্ভুক্তির মতো বিষয়গুলিকে নিয়ে উদ্বাহু হয়ে নৃত্যে মেতে রয়েছেন, তাঁদেরই জন্য তিনটি বিশেষ পরিসংখ্যান এই নিবন্ধের শেষটুকুতে দেওয়া রইল:
- দেশের অর্ধেকেরও বেশি কৃষিজীবী পরিবার বর্তমানে ঋণগ্রস্ত, এবং পরিবারপিছু সেই ঋণের গড় পরিমাণ ৭৫,০০০টাকা।
- মোদি-শাসনের গত আটবছরে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়েছে।
- ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল অবধি অন্ততপক্ষে ১,১২,০০০ খেতমজুর আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
এই না হলে আর ‘অচ্ছে দিন’! ৫ এপ্রিলের সমাবেশ তাই শেষ নয়, লড়াই শুরুর আহ্বান মাত্র।