ঊর্মি রহমান
সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো মানুষ বিরল। তাঁর চলে যাওয়াটা তাই মেনে নিতে আমাদের এত কষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের তাঁকে আরও অনেকদিন দরকার ছিল
বেশ কিছুদিন ধরে শুনছিলাম, ডঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আমাদের প্রিয় জাফরভাই খুব অসুস্থ। ভেবেছিলাম তিনি উঠে দাঁড়াবেন। এত অদম্য যাঁর প্রাণশক্তি, তিনি হার মানবেন না। কিন্তু আমাদের সমস্ত অনুমান, প্রার্থনা, শুভকামনা সবকিছুকে মিথ্যা প্রমাণিত করে তিনি শেষপর্যন্ত চলে গেলেন। এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক, সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, আজীবন দেশের কথা ভেবে গেছেন, দেশের সাধারণ মানুষের কথা ভেবে গেছেন। তিনি যখন ইংল্যান্ড-এ এফআরসিএস করছিলেন, তখন মুক্তিযুদ্ধেরও সূচনা হয়। তিনি তাঁর লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। ভারতের আগরতলায় একটি ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলায় অংশ নেন। তাঁর উদ্যোগে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবীমা চালু হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওষুধের বাজারে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ছিল। দেশে বাজারে কয়েক হাজার ধরনের ওষুধ ছিল, যা বিদেশ থেকে আমদানি করা হত। জাফরভাইয়ের উদ্যোগে দেশে ওষুধনীতি প্রবর্তন করা হয়। দেশেই ওষুধ তৈরি শুরু হয়। তাঁর তৈরি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় সাধারণ মানুষের। তিনি দেশে স্বাধীনতা পুরস্কার পান। র্যামন ম্যাগসাইসাই-সহ নানা দেশ থেকে একাধিক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সরল একজন মানুষ। শুনেছিলাম বিদেশে থাকতে একসময় তিনি বিলাসী জীবন যাপন করেছেন। পরে সব ছেড়ে দেন। সাধারণ পোশাক পরতেন। আড়ম্বরহীন জীবন কাটাতেন। তাঁকে যারা চিনত না, তারা বুঝতেও পারত না তিনি এত বড় একটি সংগঠনের প্রধান এবং তাঁর নেতৃত্বে এতসব কর্মকাণ্ড চলে। শুনেছি কোনও অনুষ্ঠানে গেলেও নিঃশব্দে পেছনে গিয়ে বসতেন। উদ্যোক্তারা ছুটে এলে বলতেন, তিনি সেখানেই ভাল আছেন।
তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ, যতদূর মনে পড়ে, সত্তর দশকের শেষভাগে। আমি সত্তর দশকের প্রথমভাগে, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে সাংবাদিকতায় ঢুকেছিলাম। তখন গোটা বাংলাদেশে আমরা সাতটি মেয়ে ছিলাম এই পেশায়। সেই সময় কলকাতা থেকে বিশিষ্ট সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ ঢাকায় গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে জানিয়েছিলেন কলকাতায় তখনও কোনও মেয়ে সাংবাদিকতায় পা রাখেনি। বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’-য় আমি যেতাম। লেখালেখি করতাম। পরে সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী আমাকে দিয়ে কিছু প্রচ্ছদকাহিনি করালেন এবং নিয়মিত টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সমালোচনা লিখতে বললেন। আমি তখন বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটে কর্মরত। তখন অফিসের কাজ সেরে আমি বিচিত্রা-য় যেতাম। জাফরভাইয়ের সঙ্গে শাহাদতভাই সহ প্রায় সবারই সখ্য ছিল। আমার সঙ্গেও তখনই আলাপ। প্রেস ইন্সটিটিউটে দীর্ঘদিন কাজ করার পর আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। সেই সময় জাফরভাই একদিন আমার ফ্ল্যাটে এলেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগ দিতে অনুরোধ করলেন। তাঁর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা ছিল। তার ওপর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মতো সংগঠনে কাজ করার সুযোগ পাওয়াটা তখন ভাগ্য মনে হয়েছিল। আমার চাকরি দরকার ছিল। তখন আমি সিঙ্গল মা, শিশুপুত্রকে নিয়ে একাই থাকি। রাজি হয়ে গেলাম। তাঁর গোটা কাজকর্ম ঢাকার অদূরে সাভার এলাকায় ছিল। কিন্তু জাফরভাই বললেন, আমাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রচারণা শাখার দায়িত্ব নিতে হবে আর সেই অফিসে হবে ঢাকায়। সেটির নাম দেওয়া হল গণপ্রচারণ। আমি মূল দায়িত্বে থাকলেও আমার তিনজন উপদেষ্টা থাকবেন— বিচিত্রা-র সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, বিচিত্রা-র সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ এবং বিশিষ্ট শিল্পী রফিকুন্নবী, ‘টোকাই’ নামের একটি বিজ্ঞ পথশিশুর স্রষ্টা, তিনি রনবী নামেই বেশি পরিচিত।
কাজ শুরু করলাম। উপদেষ্টারা খুব সাহায্য করেছেন৷ বিশেষ করে নবীভাই। কাজটা আমার কাছে নতুন ছিল। এ পর্যন্ত শুধু সাংবাদিকতা করেছি, লেখালেখি করেছি। নবীভাই প্রায়ই আসতেন। কাজটা আমার কাছে নতুন ছিল। বিচিত্রা থেকে রাজারবাগে আমার অফিস খুব দূরে ছিল না। সেটা একটা ছোট একতলা বাড়ি ছিল, সামনে বাগান। বাড়ির মালিক বিখ্যাত সাহিত্যিক শওকত ওসমান। তাঁর বাড়িটা পেছনে৷ তাঁর এক পুত্র জানেসার ওসমান আমাদের সঙ্গে কিছু কাজ করেছে। যেসব কাজ গণপ্রচারণ থেকে করা হয়েছে, তাতে উপদেষ্টাদের সবারই উদ্ভাবনী চিন্তা-ভাবনা ছিল। তবে নবীভাইয়ের অবদান ছিল অনেক। আর কিছু ক্ষেত্রে জাফরভাইও পরামর্শ দিয়েছেন, তবে নবীভাইয়ের প্রতি তাঁরও অনেকটা আস্থা ছিল। সেই সময় ওরাল স্যালাইনের ক্যাম্পেইন চলছিল। তাতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র/গণপ্রচারণ অংশ নেয়। বিজ্ঞাপন আকারে সংবাদপত্রে প্রকাশিত ক্যাম্পেইনে বলা হত, কীভাবে বাড়িতে তৈরি ওরাল স্যালাইন শিশুদের জীবনরক্ষা করতে পারে। একটি শিশুর ছবি দরকার ছিল, আমার পুত্র রূপক ছিল হাতের কাছে। তার ছবি দেওয়া হল। জাফরভাইকে এসবই জানানো হত, তিনি কখনও এসব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতেন না। নবীভাইয়ের প্রতি তাঁর গভীর আস্থা ছিল। কিছু কাজ আমরা বাইরে থেকেও পেতাম। বাংলাদেশের বিখ্যাত দোকান আড়ং রাজশাহী সিল্কের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র করার কথা বলে। জাফরভাই ও নবীভাই রাজি হলেন। কাজটা মূলত নবীভাইয়ের তত্ত্বাবধানে হবে৷ জানেসার ক্যামেরার কাজ করবে। তাঁরা দুজন টেকনিশিয়ানদের একটি ছোট দল নিয়ে রাজশাহী গেলেন। সেই কাজটাও প্রশংসিত হয়েছিল। এ ধরনের আরও কাজ ছিল। আর যে কাজটির জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে লোকে দীর্ঘদিন মনে রেখেছিল, সেটা হল সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ-র আঁকা ছবি দিয়ে একটি ক্যালেন্ডার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ সাতজনই ছিলেন, যাঁদের মৃত্যু বেদনাবহ ও একইসঙ্গে আমাদের গৌরবান্বিত করেছিল, আজও করে। তাঁদের মধ্যে বিমানবাহিনির অফিসার যেমন ছিলেন, তেমনি হাবিলদারও ছিলেন। সেই ক্যালেন্ডারের কথা বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন মনে রেখেছে৷
সেই সময় জাফরভাই বিশাল করে একটি সম্মেলন করলেন, যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসেছিলেন৷ ভারত থেকে এক সাংবাদিক এসেছিল, সেবন্তি নাইনান। বাংলার বাইরে মানুষ হওয়া বাঙালি। দিল্লিনিবাসী। জাফরভাই আমাকে বললেন, “আপনি তো একা থাকেন। সেবন্তি কি আপনার সঙ্গে কয়েকদিন থাকতে পারে? ও বাংলাদেশের ওপর আরও কিছু রিপোর্ট করতে চায়।” আমার রাজি না হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। সেবন্তির সঙ্গে সেই বন্ধুত্ব আজও অটুট আছে।
আমার অফিস ছিল ঢাকায়, কিন্তু গণস্বাস্থ্যের বাকি সমস্তই ছিল সাভারে। সেখানে আমাকে কাজে যেতে হত। আমি মিনিবাস ধরে যেতাম। কখনও কখনও সেখানে থেকে যেতাম, সেই সময় রূপককে নিয়েই যেতাম। জাফরভাই আমাদেরকে ক্যান্টিনে খাওয়াতেন। লক্ষ করতাম, তিনি খুব টক খেতে ভালবাসেন৷ পরে একবার তাঁকে ও উপদেষ্টাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করলাম৷ শাহাদতভাই বললেন, “তুমি টক কিছু রান্না কোরো। জাফরভাই টক খেতে খুব ভালবাসেন। জাফরভাইয়ের মধ্যে একটা শিশুসুলভ সারল্য ছিল। তিনি নারীকর্মীদের খুব মূল্য দিতেন৷ সেই সময় গণস্বাস্থ্যের ট্রাক চালাত একটি মেয়ে। প্রচুর মেয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ করত। তারা মেশিনও চালাত আবার মাঠে নেমে ফসলও ফলাত।
একটি ঘটনা দিয়ে আমি আমার কথা শেষ করব। সেটা না ঘটলে জাফরভাইকে পুরোপুরি চেনা হত না। আগেই বলেছি আমি তখন একক মা (সিঙ্গল মাদার) ছিলাম। আমার ছেলের বয়স তিন বছর। ওকে বাড়িতে আয়ার কাছে রেখে কাজে যেতাম। সারাক্ষণ ওর জন্য দুশ্চিন্তা হত। একবার সেই আয়া দুম করে কাজ ছেড়ে দিল। আমি জাফরভাইকে বললাম, “আমার ছুটি দরকার।” তিনি কাজপাগল মানুষ। জানতে চাইলেন কেন ছুটি দরকার। তাঁকে বললাম, বাচ্চার আয়া কাজ ছেড়ে দিয়েছে, বাচ্চাকে কোথায় রেখে আসব? তিনি এক মুহূর্ত দেরি না করে বললেন, “রেখে আসবেন কেন? ওকে নিয়ে আসবেন। এখানে এত খোলা জায়গা! মালী আছে। দারোয়ান আছে। ওরা ওকে দেখতে পারবে৷” আমি সেটাই করেছিলাম এবং দুমাস রূপককে নিয়ে অফিস করেছি। পরে জাফরভাইয়ের সঙ্গে আমার মতের অমিল হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে, যা আজও অটুট আছে।
তাঁর মতো মানুষ বিরল। তাঁর চলে যাওয়াটা তাই মেনে নিতে আমাদের এত কষ্ট হচ্ছে। আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে তাঁর মতো মানুষ আমি আর দেখিনি৷ বাংলাদেশের তাঁকে আরও অনেকদিন দরকার ছিল৷ তাঁর চলে যাওয়াটা তাই আমাদের সবার কাছে বেদনাবহ ও অপূরণীয়। তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই৷