কুন্তল মুখোপাধ্যায়
পেশায় রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুন্তল মুখোপাধ্যায় নাট্যদল সংলাপ কলকাতার নাট্যকার, পরিচালক ও নির্দেশক।
ব্যুৎপত্তিগতভাবে দেখলে, আপন বিশ্বাস সূত্রে কোনও কাজ, বিশ্বাস ও মতাদর্শের প্রতি নিষ্ঠা ভরে সময় দেওয়া এবং নিবিষ্ট থাকাকে বলে দায়বদ্ধতা। নাট্যশিল্পী, অভিনেতা দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে নিজের কাজের জায়গায় বরাবর এই ভাবনায় নিবিষ্ট থাকতে চেয়েছেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ও নাট্যকর্মের প্রবাহমানতায় কখনও তিনি সমসাময়িক সমাজকে সরিয়ে রাখতে চাননি। ধর্ম, রাজনীতি, প্রশাসনিক বিচারকার্য, নন্দনতত্ত্ব, শিল্পচর্চা প্রভৃতির উৎস এবং তার বস্তুবাদী যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যায় যে সামাজিক রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেই বিষয়ের প্রতিই ছিল দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিগূঢ় বিশ্বাস।
তাঁর নাট্যজীবন শুরুর সময় থেকেই তিনি শিল্পের সামাজিক দায় বিষয়ে সচেতন ছিলেন। সাধারণ মানুষের সমদৃষ্টিতে তিনি শিল্পকে বিচার করতেন। স্বাধীনতা উত্তর নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, শ্রমজীবী মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি তাঁর নাট্য চয়ন, নাট্য অভিনয়, নাট্য সৃজন সম্পূর্ণ করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি তিনি অর্জন করেছেন তার পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে। যখন তিনি অমৃতবাজার-যুগান্তর পত্রিকায় হিসাব পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তখনও তিনি প্রগতিশীল বাম কর্মচারী ইউনিয়নের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। নীলকণ্ঠ সেনগুপ্তের সঙ্গে তাঁর প্রথম দিকের অভিনয়ে ‘কিংকিং’, ‘পরবর্তী বিমান আক্রমণ’ এবং ‘দানসাগর’-এ তিনি সফল হয়েছিলেন, এই কারণেই যে, আর্থিক সামাজিক সুবিধাভোগী মানুষদের প্রতি, নিম্নবর্গের মানুষদের সামাজিক ঘৃণাকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। আবার দেবাশিস মজুমদারের সঙ্গে ‘অমিতাক্ষর’ নাট্য অভিনয় ও পরিচালনায় একজন অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীর অসফল মনোবাসনাকে নিরুচ্চার প্রতিবাদে স্ফুরিত করেছেন। বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় গিরিশ্চন্দ্রের ‘বলিদান’ নাটকে অনুচ্চকিত অভিনয়ে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার হতাশা, স্বপ্নভঙ্গকে যেভাবে রূপায়িত করেছেন, বা অসিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘নীলাম নীলাম’ নাটকে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক আচার আচরণ ও প্রাত্যহিক অভ্যাসকে যেভাবে স্বাভাবিক স্বরক্ষেপণে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তা দেখে বোঝা যায় বস্তুবাদী সমাজ বিবর্তনের রূপরেখা তাঁর ভাবনায় স্পষ্ট। নিজের দল সংস্তবের ‘ধূনিস্তম্ভ’ বা ‘তুষাগ্নি’ প্রযোজনায় প্রত্যয় হয় নিছক জনপ্রিয়তার তুলনায় চিন্তাশীল ইতিহাসমনস্ক নাট্যভাবনাতেই তিনি অভ্যস্ত।
দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাট্যভাবনা ও অভিনয় উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার যুগলবন্দীতে, যার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ ‘মুষ্ঠিযোগ’, ‘ভূতনাথ’ নাটকদ্বয়ে। কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ব্যবসায়িক পেশাদারী মঞ্চে ও গ্রুপ থিয়েটারি কাঠামোয় ‘প্রাণতপস্যা’, ‘ছাড়িগঙ্গা’, ‘তৃতীয় অঙ্ক’, ‘অতএব’ প্রভৃতি নাটকে তাঁর অভিনয় সমসাময়িক সামাজিক বাস্তবতাকে কখনওই অস্বীকার করেনি। কলকাতা নাট্যকেন্দ্র প্রযোজিত ‘গ্যালিলেওর জীবন’, গান্ধার প্রযোজনা ‘কুমারসম্ভব’, সংস্তব প্রযোজিত ‘অভিমুখ’, ‘মনশ্চক্ষু’, সমবেত প্রয়াস নিবেদিত ‘গাজী সাহেবের কিসসা’ এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রযোজিত ‘দুঃসময়’ প্রভৃতি নাটকে তিনি সংবেদনশীল মানবিক অভিনয়ের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে চন্দন সেনের নাটক ‘স্পর্ধাবর্ণ’-এর নাট্য চয়ন, বপন ও সৃজনে এই সময়ের নিম্নমেধাপ্রধান সমাজ, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক অবনমনের যে প্রতিরূপ তিনি মঞ্চাভিনয়ে প্রতিষ্ঠা করেন, তার তুলনা একান্তই বিরল।
কর্মজীবনে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিভাগে অধ্যাপকরূপে ছাত্রদের কাছে পাঠ্যবিষয় ও আঙ্গিককে তিনি সহজ সাবলীলভাবে উপস্থাপিত করেছেন। নাট্যকর্মশালায় স্তানিশ্লাভকির অভিনয় পদ্ধতি, দানচেঙ্কো, ভার্তাঙ্গভ প্রমুখের মঞ্চবিজ্ঞানের অনায়াস আলাপ আলোচনা ছাত্রমহলে তাঁর নাট্যমনস্কতার গভীর প্রভাব ফেলেছে।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের সূচনালগ্ন থেকে মিথ্যাভাষণ, অসত্যবাচন, যুক্তিহীন স্তুতি ও ভজনাভিত্তিক যে উত্তরসত্য সমাজ মানুষের সুস্থ বৌদ্ধিক, অনুভূতিকেন্দ্রিক আত্মিক জীবনচর্চার পথ রুদ্ধ করেছে, সে বিষয়ে তিনি উদাসীন ছিলেন না। সচেতনভাবেই বিকল্প সংস্কৃতির খোঁজে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সহমতের আত্মজনদের নিয়ে তৈরি করেছিলেন সংস্কৃতি সমন্বয়। আজ তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে আমরা অনুভব করি অশিল্পীসুলভ আত্মগরিমা, আত্মাভিমান এবং মানুষের সঙ্গে থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার মানসিকতা আমাদের ত্যাগ করতে হবে। সমন্বয়, সমন্বয় এবং সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের বিকল্প সংস্কৃতির খোঁজে আগুয়ান হতে হবে।
দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুচ্চারিত কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে যেন আমরা বলতে পারি,
“হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ, সবে থাকি একসাথ।”