অশোক মুখোপাধ্যায়
প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার-কর্মী, সেসটাস-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক
আজ খুব জোরের সঙ্গে বলা দরকার, কারও কোনও ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুভূতি সামাজিক স্বার্থ, সমাজপ্রগতির সত্যের চাইতে বড় নয়, বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্তত হওয়া উচিত নয়। গত একশো বছরে অনেক ফাঁকি দিয়েছি আমরা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে আমরা তফাত করতে শিখিনি, অক্ষয়কুমার দত্ত আর অরবিন্দ ঘোষের মধ্যে আমরা এতকাল পার্থক্য কোথায় বুঝতে পারিনি। সেই পার্থক্য বোঝার জায়গা থেকে শুরু করলে তখনই একমাত্র পরিষ্কার হবে যে ধর্মাচ্ছন্ন আমজনগণের প্রতি সহানুভূতি আর ধর্মানুভূতির প্রতি দুর্বলতা বা ধৃতরাষ্ট্রপনা ঠিক এক জিনিস নয়
রামনবমীর আগে পরে আরএসএস ও বিজেপি-র আমন্ত্রিত অবাঙালি অতিথিদের সহযোগে নানা জায়গায় হুজ্জুতির ঠিক একদিন পরেই বহরমপুরের বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক চন্দ্রপ্রকাশ সরকারের উপর রাজ্য সরকারের পুলিশের পুলিশগিরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবার দেখছি ধর্মানুভূতির প্রশ্ন বেশ চেগে উঠেছে। সামাজিক মাধ্যমে রাম হনুমান নিয়ে নাস্তিক নিরীশ্বরবাদী যুক্তিবাদীদের বিভিন্ন পোস্টে যে সমস্ত বয়ান রাখা হচ্ছে তাতে শুধু বিজেপি আরএসএস বা ধর্মান্ধ মৌলবাদীদেরই আক্রমণ করা হচ্ছে এমন নয়, সাধারণ নিরীহ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মানুভূতিতেও নাকি আঘাত পড়ছে। ফলে অনেকেই আমাদের মতো গায়ে পড়া মার্কসবাদী বস্তুবাদী যুক্তিবাদীদের উদ্দেশে নানারকম সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলতে চাইছেন, এইভাবে নাকি ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না, বা উচিত নয়। আমাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আমাদের ভাবনাকে সাধারণ জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। এবংবিধ।
ঘটনাচক্রে, আমি এই জাতীয় মতামতের সঙ্গে একেবারেই একমত নই। আমার অবস্থান এই প্রশ্নে স্পষ্ট করে রাখতে চাই বলেই এখানে একটু সবিস্তারে কিছু কথা বলতে চেষ্টা করব। মেনে নেবেন কিনা, সে ভার পাঠকের।
প্রথমেই বলি, যাঁরা এই পরামর্শ দিচ্ছেন, তাঁরা সম্ভবত ধরে নেন, আমাদের কোনও আবেগ অনুভূতি নেই। শুধু ধর্মভীরুদেরই আবেগ অনুভূতি আছে। অথচ তথ্য সত্য যুক্তি কার্যকারণ বিজ্ঞান ইতিহাস জ্ঞানচর্চাও যে এক গভীর ও ব্যাপক আবেগের বিষয়, নিছক গ্রন্থপাঠ ও সন্দর্ভ লেখনের যান্ত্রিক ছাঁচে ঢালা কর্মসূচি নয়, একথা হয়ত তাঁরা মনে রাখেন না। সমাজে যখন একদল উন্মত্ত লোকের হিংস্র দাপাদাপিতে শান্তি, বহুত্ববাদ, মতভেদ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিক বিচার, উদারতা, মানবতা, সহনশীলতা, ইত্যাদি আক্রান্ত হয়, এবং সেইসব সহিংস উন্মাদনা রোধে সরকারি নিষ্ক্রিয়তা আমাদের চুপচাপ বসে বসে দেখতে হয়, কিছুই করার থাকে না, সেও যে আমাদের জ্ঞানানুভূতিতে এক বিশাল মাপের আঘাত হিসাবে নেমে আসে, সেই বিষয়টা অনেকের মাথা থেকে বুঝি উবে যায়।
দ্বিতীয়ত, যাঁদের কাছে ধর্মটা নিতান্তই নিজস্ব ধীরস্থিরভাবে ভক্তি নিবেদনের ও আত্মসমর্পণের জায়গা, বিশেষ করে যাঁরা রামাশ্রয়ী বৈষ্ণব, তাঁদেরও তো রামনবমীতে এই ভক্তিহীন উন্মত্ত সশস্ত্র মুসলিমবিদ্বেষজাত হিংস্রতায় আহত বোধ করার কথা। এতে যে তাঁদের ধর্মের এবং আরাধ্য সত্তার সম্পর্কে সমাজের আনাচেকানাচে নানা বিরূপ কথা ওঠার অবকাশ তৈরি হয়, তা নিয়েও তো তাঁদের তীব্রভাবে অসন্তুষ্ট ও মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ার কথা। কিন্তু কেউ দেখেছেন কি, কোনও শান্তিপ্রিয় ভক্তিবাদী ব্যক্তি বা ধর্মীয় সংস্থা (এমনকি, যত মত তত পথের প্রবক্তা মিশন) কোনও থানায় পুলিশের কাছে গিয়ে রামনবমীর উন্মত্ততা নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন যে এতে তাঁদের অনুসৃত ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে? আমার জানায় এরকম একটা ঘটনাও নেই। শুধু এবছরই নয়, কস্মিনকালেও নেই। অর্থাৎ, ধর্মের এই তথাকথিত অনুভূতিটা এমন যে ধর্মান্ধদের হাতে ধর্মীয় সংস্কৃতির এইরকম চূড়ান্ততম বিকৃতিতে তা আহত হয় না, কিন্তু যুক্তিবাদী বস্তুবাদীদের সামান্য টুস্কিতেই তাতে বেজায় রক্তক্ষরণ হতে থাকে!
তৃতীয়ত, তাঁদের অনেকেই ইতিহাসের সেই সব ঘটনার কথাও ভুলে যান, যখন উনিশ শতকে আমাদের দেশের যুক্তিবাদী সমাজ সংস্কারকরা— রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্রমুখ— বিভিন্ন অ্যাজেন্ডায় দীর্ঘপ্রচলিত ধর্মানুমোদিত দেশাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন, তাতে অনেকেরই ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছিল। বেশ ঠকাস করেই। বিহারীলাল সরকার সুবলচন্দ্র মিত্র মহাশয়রা বিদ্যাসাগরের জীবনী লিখতে বসে সেই কথা যথেষ্ট আক্ষেপের সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছিলেন। যারা হিন্দুদের উচ্চবর্ণের সমাজাংশে সতীদাহকে সহমরণ আখ্যা দিয়ে বিধবা নারীহত্যাকে জায়েজ বলে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল, তারাও এই ধর্মানুভূতির কথাই বলেছিল। বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের ফলেও নাকি সেই ফিনফিনে অনুভূতি খুব মনোকষ্ট পেয়েছিল। এখন রামমোহন বা বিদ্যাসাগররা যদি সেই অনুভূতিকে সম্মান করে তাঁদের কাজ থেকে পিছিয়ে যেতেন আজ আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম— ভেবে দেখা দরকার।
কাজী নজরুল ইসলামের বিভিন্ন কবিতার বিরুদ্ধেও মুসলিম ধর্মান্ধরা এককালে কম খোঁচাখুঁচি করেনি, কাফের বলে কম নিন্দামন্দ করেনি। তাঁর কবিতায় হিন্দু দেবদেবীর নাম, হিন্দু পৌরাণিক অনুষঙ্গের উল্লেখ থাকার “অপরাধে”। তারাও সেদিন তাদের ইসলামিক ধর্মানুভূতিতে ক্ষত সৃষ্টির কথাই বলেছিল। তাই বলে থাকে। সেদিন যদি ভয়ে বা দ্বিধায় বিদ্রোহী কবিসত্তা পিছিয়ে যেতেন, বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সঙ্গীত এক বিশাল মাপের মৌলিক প্রতিভা সম্পদ থেকে বঞ্চিত হত।
সুতরাং আজ খুব জোরের সঙ্গে বলা দরকার, কারও কোনও ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুভূতি সামাজিক স্বার্থ, সমাজপ্রগতির সত্যের চাইতে বড় নয়, বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্তত হওয়া উচিত নয়। অংশের চেয়ে সমগ্র বড়। দেশের বা রাজ্যের সাবালক ধর্মানুরাগী নাগরিকদের পক্ষে এইটুকু উপলব্ধি কাম্য বলে মনে হয়।
সমালোচনা করবেন করুন। তাই বলে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করবেন? কার্টুন আঁকবেন? মিম বানাবেন? কদাচ নয়। উচিত নয়। এরকমও একটা তর্ক উঠে আসছে এখন। আসে। দুতিন বছর আগে ফ্রান্সে শার্লি এবদো কার্টুন কাণ্ডে মুসলিম মৌলবাদীরা যখন সহিংস হামলা চালিয়ে কিছু পত্রপত্রিকার লেখক সম্পাদক কার্টুনিস্টকে হত্যা করেছিল, তখনও উঠেছিল। তসলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশ থেকে, এমনকি কলকাতা থেকেও, বিতাড়নের সময় এই অনুভূতিই কার্যত সরকারি বিবেক হয়ে উঠেছিল।
রাম হনুমান কাণ্ডেও আপত্তি আসে সেই অনুভূতির মই বেয়ে।
অর্থাৎ, ভাবখানা হচ্ছে, আমরা হচ্ছি বিশুদ্ধ ধর্মান্ধ, এবং আবহমান কাল ধরে এরকমই থাকব, আমরা পুজো দিতে পারি, নামাজি কাতারে গিয়ে ওঠাবসা করতে জানি, গির্জায় ঢুকে ফাদারের কথা শুনে বুঝি বা না বুঝি বুকে ক্রশ আঁকতে পারি। কিন্তু আমরা কার্টুনের জবাব কার্টুনে দিতে পারি না, কারণ আমাদের মধ্যে সেই ধরনের আধুনিক শিল্পকলাবোধ গড়ে ওঠেনি; আমরা ঈশ্বর বিরোধী মনু-শরিয়ত বিরোধী প্রবন্ধের জবাব প্রবন্ধ লিখে দিতে জানি না, কেননা, আমাদের সেই শিক্ষা এবং সেইমতো শিক্ষা লাভ হয়নি; আমরা হাস্যরসের মোকাবিলা হাস্যরসের আঙিনায় গিয়ে করতে পারি না, কেননা, আমাদের মনের শাহবাগে সেই উদ্দাম উদারতা প্রশস্ততা স্ফূরিত হওয়ার সুযোগই পায়নি।
সুতরাং তোমরা আমাদের চেতনার এই গ্রীষ্মকালীন কুয়োর জলতল সীমানায় নেমে এসে যা বলতে হয় বলো, যা লিখতে চাও লেখো। আমরা মানা করব না।
যাঁদের এতগুলো না-ভাব রয়েছে, তাঁদের কাছে আমার একটাই বিনম্র পরামর্শ, আপনারা অনতিবিলম্বে এই সীমাবদ্ধতাগুলি কাটিয়ে উঠুন। বাকি জনসমাজকে আপনাদের স্তরে না নামিয়ে না এনে বাকিদের শ্রেয়তর স্তরে নিজেরা উঠে আসার চেষ্টা শুরু করুন। দেখবেন, সেই প্রসারিত জীবন অনেক ভাল এবং মধুমাখা মনে হবে। ধর্মান্ধতার পঙ্ক থেকে সভ্য জীবনের উদ্যান অনেক স্বচ্ছন্দ বিচরণ যোগ্য বলে বোধ হবে।
অনুভূতির খেলার ধরন
অশিক্ষিত ধর্মান্ধরা ইতিহাসকে বিকৃত করে, এমনকি ধর্মগ্রন্থকেও বিকৃত করে পাঠ-উদ্ধার করতে দ্বিধা করে না। তখন তারা তাদের অনুভূতি নামক নড়বড়ে যন্ত্রটিকে আলমারির উঁচু তাকে তুলে রাখে। কিন্তু আপনি যদি ইতিহাস থেকে, পৌরাণিক সাহিত্য থেকে এমন সব তথ্য (হ্যাঁ, তথ্য, গল্প নয়) তুলে আনেন, যাতে তারা ধর্ম সম্পর্কে যা কিছু বলে বা দাবি জানায়, তা মিথ্যা এবং ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়, অমনি তাদের অনুভূতি নামক যন্ত্র খাড়া হয়ে ওঠে, আলমারি থেকে নেমে এসে হাতে হাতে ঘুরতে থাকে।
এ এক বিচিত্র যন্ত্র।
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার কৃত্তিবাসি রামায়ণ থেকে হনুমানের যে সব কাণ্ড উদ্ধার করেছেন, সে সব তো কয়েকশো বছর ধরেই সেখানে লেখা আছে। তাতে আজ অবধি কোনও রামভক্তিবাদী ধর্মপ্রাণের অনুভূতি আহত হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এমনকি আজকালের রামভক্ত নামক আজব মসজিদ ধ্বংসক নবজাতক বাঙালি ভাজপায়িতদেরও অনুভূতি দিব্যি ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু যেই না সরকারবাবু সেখান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখালেন, ব্যাপারটা আসলে কেমন, হনুমানের কীর্তিকলাপ আসলে টোটেমি কারবার ছাড়া আর কিছুই নয়, যতই তাকে দেবতা বলে ভাবা হোক, আদতে সে কোনও এককালের ব্রাহ্মণ্যবর্গের ঘৃণার পাত্র ওবিসি গ্রুপের সদস্য বই কেউ নয়, যদিও কাহিনির ঘটনা চক্রে সে রামভক্ত হয়ে পড়েছিল, যা কিছু সে করে বা দেখায় তা এক বিশেষ কালের বিশেষ মানুষের কারবার ছাড়া কিছু না, ব্যস, অমনি কিছু ভকতের অনুভূতিতে ধস নেমে গেল।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যে হনুমান জাম্বুবান সম্বন্ধীয় ব্যাপারস্যাপারকে টোটেম দিয়ে ব্যাখ্যা করে গেছেন, সে তো এই হনুগোষ্ঠী জানে না। কেননা, জানবেই যদি, তারা হনুগোষ্ঠীতে যাবেই বা কেন? না জেনে, যে কোনও সংশ্লিষ্ট জরুরি বিষয়ে না জেনেই লাফালাফি করা এবং তার মধ্যে দিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টি করাই তাদের দায়িত্ব কর্তব্য এবং শেষমেশ রোজগারের ভাল উপায়।
পশ্চিমবাংলার সাইবার পুলিশও কি এসব জানে?
না।
জানার বা খবর নেওয়ার চেষ্টা করে?
না। ব্যক্তিগতভাবে দু-চারজন পুলিশকর্মী বা অফিসার যদি বা আগ্রহী হয়েও থাকেন, সিস্টেম হিসাবে এসব না জানা এবং খবর না রাখাই সাধারণ দস্তুর। জানলে অনেক কিছুই করা যায় না। বা যা করে চলেছে তার উল্টোটা করতে হয়। যে বা যারা অভিযোগ নিয়ে এসেছিল, তাদের কৃত্তিবাসি রামায়ণের বই এনে দেখাতে বলার দরকার হয়, কোথায় কী বিকৃতি করা হয়েছে। দেখাতে না পারলে (পারার কথাই নয়) উলটে একজন বিশিষ্ট লোককে হেনস্থা করা এবং পুলিশের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য অভিযোগকারীকেই গারদে রাত্রিবাস করানোর আমন্ত্রণ জানানো এবং গ্রহণ করানোর ব্যবস্থা করা পুলিশের আইনি কর্তব্য হয়ে পড়ে। সেটা কি ভাল দেখায়? হাজার হোক হনুভক্ত বলে কথা! সামনেই পঞ্চায়েত ভোট।
মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এতে অসন্তুষ্ট হবেন না?
সারাজীবনের সাহিত্যকৃতীর জন্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মাননীয় পুলিশমন্ত্রী কি এইসব মহাকাব্যিক বিষয়ে ওয়াকিবহাল? ঘটনা ঘটার পরেও কি খবরাখবর নিয়েছেন? কর্মরত পুলিশের আধিকারিককে এত বড় একটা অন্যায় কাজ করার জন্য তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় ধমকধামক দিয়েছেন?
না।
কেননা, পুলিশ যে যে-কোনও ফালতু অভিযোগে একজন বামমনস্ক যুক্তিবাদী অ-হনু লেখককে গারদে ঢুকিয়ে দিতে পারে, এতে তিনি মনে মনে খুশিই হন। সরকারি গদির দাপট ব্যক্ত হয় বলে। গণতন্ত্র মানবাধিকার— ইত্যাকার ফালতু শব্দগুলি তাঁকে কখনওই পীড়া দেয় না। ওগুলো রাজ্যশাসনের আঁকেবাঁকে মুছতে মুছতেই তিনি এগিয়ে চলেছেন।
আসলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই যেটা খেয়াল করেন না, তা হল, ভারতের সমগ্র পুলিশবাহিনি— কেন্দ্র বা রাজ্য, সাধারণ বা আধাসামরিক, যেখানকারই হোক, আর যেমনই হোক— ভেতরে ভেতরে সম্পূর্ণ সঙ্ঘ-মানসিকতা সম্পন্ন। আর সেটা কেবল আজকে নয়। সেই কংগ্রেসি আমল থেকেই। তারা প্রবল মুসলিমবিদ্বেষী, ভয়ঙ্কর নারীবিদ্বেষী এবং ভয়ানক দলিতবিদ্বেষী। এই তিন বর্গের যে কেউ ভারতবর্ষের যে কোনও থানায় গেলেই, বিশেষ করে কোনও অপরাধের শিকার হয়ে প্রতিকার চাইতে গেলেই, তা হাড়ে হাড়ে টের পান। কংগ্রেস সিপিএম হয়ে টিএমসি— কেউ এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের কোনও রকম সামান্যতম চেষ্টাও করেনি। এখন বিজেপি যখন সর্বতোপায়ে তথাকথিত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অর্থে রাজ্যের সীমিত কর্তৃত্বও ভেঙে কেন্দ্রীয় সরকারের পুলিশিব্যবস্থার অধীনে সমস্ত রাজ্যগুলিকে নিয়ে আসতে চাইছে, বিএসএফ-এর কার্যকর এলাকা বাড়িয়ে দিয়েছে, এনআইএ-র হাতে যে কোনও রাজ্যে যখন খুশি যে কোনও মামলা তুলে নেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে, এবং সেই সংস্থাও বিজেপি-র হুকুমবরদার হয়েই চমৎকারভাবে কাজ করে চলেছে, সেই অবস্থায় রাজ্য পুলিশের কাছে এনআইএ-র অলিখিত গাইডলাইন অধিকতর গ্রাহ্য। যদি না উপর থেকে, নবান্নর আরামকক্ষ থেকে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা হয়।
সেই চেষ্টা যে জারি হয়নি, হাওড়া হুগলি জেলায় রামনবমীর হুজ্জুতিতেই মালুম হয়ে গেল। কোনও মিছিল যে অস্ত্র নিয়ে বেরোতে পারবে না, এবং মসজিদের দিকে যেতে পারবে না, আইন না মানলে যে মিছিল আটকে দেওয়া হবে, এরকম একটা নির্দেশিকা কঠোরভাবে জারি করা হল না। ফলে মিছিল করার সময় অশান্তি না হওয়া পর্যন্ত পুলিশের ভূমিকা হয়ে রইল অমিত শাহের বাহিনির মতো।
এপিডিআর হাজরা মোড়ে বা রাজাবাজারে একটা সভা করতে গেলেই পুলিশ এসে ঘিরে ধরে, সভা করতে দেয় না, ধরে নিয়ে লালবাজারে বসিয়ে রাখে এবং নানারকম বুজরুকি কেস দেওয়ার ভয় দেখায়। তারাই কিন্তু এক জায়গাতেও রামনবমীর মিছিল নিয়ন্ত্রণ করা বা মসজিদের অভিমুখে যাওয়া ঠেকাতে পারল না, বা ঠেকাল না। গত কয়েক বছর ধরেই করছে না।
আমি অবশ্যই এই ব্যর্থতাকে সচেতনভাবে বিজেপি-র সঙ্গে টিএমসি-র রাজনৈতিক যোগসাজশ বলে মনে করি না। কেননা, তাতে এই মুহূর্তে টিএমসি-র নির্বাচনে কোনও ফায়দা নেই। বরং তার ক্ষতিই হবে। বিজেপি যত তার ফাঁস শক্ত করবে, ততই সাবধান না হলে ভোটে বিপরীত ফল ঘটবে। আমি একে রাজ্য প্রশাসনের স্ব-আরোপিত ব্যর্থতা বলেই চিহ্নিত করতে চাই। রাজ্যের হাতে যে ক্ষমতা এখনও অবশিষ্ট আছে তাকে সঠিক সময়ে ঠিকমতো ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এমনকি প্রয়োজনে হাইকোর্ট থেকে একটা আগাম আদেশ বের করে আনা যেত।
শুধু ধর্মীয় অনুভূতি নামক ফালতু যন্ত্রটাকে পাত্তা না দিলেই এটা সম্ভব ছিল। অথবা ধর্মানুভূতির পাশাপাশি সভ্যতানুভূতির প্রশ্নকে সমান গুরুত্ব দিলেও।
কিংবা ভোটের অঙ্কে হিন্দু ভোট মুসলমান ভোট কিসে কোনদিকে যাবে— এই জটিল ভগ্নাংশের অঙ্ক না কষলেও হয়ত কিছু কাজের কাজ হত।
বিরোধী শক্তির দায়িত্ব
আলোচ্য সমস্যাটির আরও একটা দিক আছে। যা নিয়ে প্রায়শ প্রশ্ন ওঠে এবং সেই প্রশ্নের সামনে পড়লে আমরা অনেকেই বেশ অস্বস্তি বোধ করি। একজন নাস্তিক নিরীশ্বরবাদী যুক্তিবাদী বামপন্থী বা মার্কসবাদী যখন পরিবারে সমাজে আরও দশজনের সঙ্গে মেলামেশা করবেন, তাঁরা ধর্মসাপেক্ষে নিজেদের অবস্থান কতটা প্রকাশ করবেন, বা প্রকাশ্যভাবে চর্চা করবেন? অথবা, করতে চাইলে কীভাবে করবেন?
এই জায়গায় এসে আমরা যে অনুভূতির সামনে পড়ে যাই, সেগুলি ঠিক আগে যে আলোচনা করেছি তার মতো নয়। প্রতারণামূলক বা অভিসন্ধিমূলক নয়। কোনও গোপন রাজনীতির অ্যাজেন্ডাভুক্ত নয়।
ধরা যাক, বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো বা সরস্বতীপুজো হচ্ছে। আমার মা খুব ধার্মিক মানুষ। লক্ষ্মী বা সরস্বতীতে তাঁর অচলা ভক্তি। তিনি ভোটে দাঁড়াবেন না, বা তাঁর এই ভক্তিকে তিনি কোনও সরঞ্জাম বিক্রির সহ-পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করবেন না। তাঁর ইচ্ছা যে লক্ষ্মীপুজোর শেষে পুরুতঠাকুর যে শান্তিবারি ছেটাবে (অথঃ সকলের কল্যাণ কামনায়), আমি আমার মাথাটাও যেন তখন বাড়িয়ে রাখি, সরিয়ে না নিই। কিংবা, সরস্বতীর অঞ্জলিতে আমি যেন থাকি। অবশ্যই খালি পেটে। আমি যদি এই শান্তিবারি না নিই, বা সরস্বতীতে অঞ্জলি না দিই, মা খুব দুঃখ পাবেন।
আমার এক্ষেত্রে কী কর্তব্য?
আমার পরামর্শ হল, যদি নিজের মধ্যে বিশ্বাসসংক্রান্ত কোনও দুর্বলতা না থাকে, যদি আমার মতাদর্শগত অবস্থান স্পষ্ট থাকে, তাহলে এই সব অনুষ্ঠান থেকে সোচ্চারে সরে থাকা। ভয়ে ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো করে নয়। বাড়িতেই থাকতে হবে, পাঁচজনের সঙ্গে মিলেমিশে গল্পগুজবও করতে হবে। কিন্তু সেই ধর্মীয় উপচারে কোনওভাবেই অংশ নেব না। মা বাবা স্বামী কিংবা স্ত্রী (কিংবা অন্য কেউ) দুঃখ পেলেও না। পারলে বোঝাতে হবে। আমি যা বিশ্বাস করি না, তা পালন করলে যে আরও বড় অন্যায় এবং অকল্যাণ হয়, তা দু-চার কথায় বলতে হবে। হয়ত একাধিকবার। বারংবার। বক্তৃতা দেওয়া বা ক্লাস নেওয়ার মতো করে নয়। অতি সাধারণ সংলাপে। বাবামায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ের স্বাভাবিক বচনবিনিময়ের প্রকরণে। স্বামীস্ত্রীর পারস্পরিক দাম্পত্য সংলাপের আঙ্গিকে।
বিষয়টা সহজ নয়। এটা কেউ একদিনে নাও পারতে পারেন। কিন্তু তাঁকে এইভাবে কথা বলতে এবং আচরণ করতে শিখতে হবে। যাঁরা তাঁকে যুক্তিবাদের বা মার্কসবাদের পাঠ দিচ্ছেন তাঁদের থেকে বারবার জেনেবুঝে নিয়ে। আবার সেই শিক্ষাদাতাদেরও শেখাতে হবে। ধৈর্য ধরে, উদাহরণ তৈরি করে করে। এভাবেই সমাজ পরিবেশ বদলায়। এগোয়।
বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি পিতৃভক্তির কত গল্প আমরা শুনে এসেছি। সেই তিনিও তাঁর বাবা-মায়ের বিরুদ্ধাচরণ করেই ছেলের বিধবাবিবাহের আয়োজন করেছিলেন। নানা কারণে একটা সময় থেকে সমস্ত পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তবুও নিজের জায়গা থেকে তিনি নড়েননি।
আমরা তারপরে আরও দেড়শো বছর পেরিয়ে এসেছি। সমাজ সামান্য হলেও এগিয়েছে। সেই বিদ্যাসাগর অক্ষয় দত্তদের সৌজন্যেই। এখন নিজের বিশ্বাসের জায়গায় আচরণে অনড় থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পর্ক খারাপ হয় না। ব্যক্তিগতভাবে আমি অন্তত দাবি করতে পারি, আমার ক্ষেত্রে হয়নি। আমার বাড়িতে হয়নি। পরিবার আত্মীয়স্বজনের কারও সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ বা তিক্ততা হয়নি। আমি যেসব জায়গায় সামাজিক রাজনৈতিক কাজ করেছি, সেখানেও হয়নি। অত্যন্ত প্রিয় স্নেহভাজন আত্মীয়দের মধ্যে কারও কিছু অনুরোধ স্রেফ আপন বিশ্বাসের কারণে রাখতে পারিনি, তাতেও তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কে সৌহার্দ্যে এতটকু চিড় ধরেনি। ধরার কথা নয়। ধরলে সমাজ এগোত না। স্থবির হয়ে থাকত।
আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার একটা ছোট কাহিনি বললে আশা করি কেউ কিছু মনে করবেন না।
১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার শেষে লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষে আমাকে পুরুলিয়া জেলার সাওতালডির কাছে কয়েকটা গ্রামে দলের প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে যেতে হয়েছিল। এসটিটিপি আবাসন এবং পাশের খান ছয়েক মৌজা নিয়ে ছিল আমার কর্ম এলাকা। আবাসন এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির খান চারেক বাড়িতে ঘুরে ঘুরে আমার অস্থায়ী আস্তানা। সবাই খবর রাখেন কিনা জানি না, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একমাত্র পুরুলিয়া জেলাতেই জাতপাতের সমস্যা সবচাইতে প্রকট। সেখানে এক “ব্রাহ্মণ” বাড়িতে আমি একজন “নিম্নবর্ণ”-ভুক্ত কমরেড (সুধীর মাহাতো)-কে নিয়ে দুপুরে খেতে গেছি। খাওয়ার শেষে দেখি, সুধীর তার থালা হাতে উঠে পড়ল এবং বাইরের দিকে যাচ্ছে। দেখাদেখি আমিও আমার থালাটা তুলে নিলাম।
বাড়ির একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য আমাকে বললেন, “করেন কি করেন কি, আপনাকে থালা ধুয়ে দিতে হবে না। বৌমা তুলে নেবে।” বৌমাটি থালা নিতে এগিয়ে এসেছেন।
আমি তখনও ওখানকার সমস্ত রীতিনীতি ভাল করে জানতাম না। বললাম, “সুধীর যে নিয়ে গেল?”
ভদ্রলোক বললেন, “এ আমাদের গাঁয়ে-ঘরের রীতি। আপনি বুঝবেন না। আপনি ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেইল্যা বটে। তাই আপনাকে ধুইতে হবেক নাই।”
আমি তখন ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছি। নাছোড়বান্দা হয়ে বললাম, “আমাদের কলকাতারও কিছু রীতিনীতি আছে। আমরা একসঙ্গে খেলে একসঙ্গে যে যার থালা ধুয়ে রাখি।”
বৌমাটি বুদ্ধিমান। তিনি আমার গোঁড়ামি দেখে মুচকি হেসে প্রথমে সুধীরের থালাটি নিয়ে নিলেন। তারপর আমারটাও। আমরা দুজনেই হাতমুখ ধুয়ে খানিকক্ষণ খাটিয়ায় বিশ্রাম করে বিকেলের দিকে বেরিয়ে এলাম।
সুধীর রাস্তায় এসে বলল, “আপনি কী করলেন জানেন? ওই বৌদিকে এখন এই ঠান্ডার মৌসমে আর একবার পুকুরে গিয়ে ডুব দিতে হবে।”
আমি হতাশার ভঙ্গি করলাম, “খুব দুঃখের সেটা। কিন্তু ব্যাপারটা আমি মানতে পারছিলাম না।”
সুধীর বলল, “আজ সন্ধ্যার মধ্যেই চারদিকে খবরটা প্রচার হয়ে যাবে। ভোটের সময় কাজটা আপনি ভাল করলেন না।”
আমি ওকে জানালাম, একটা ভোটেই আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আমরা আরও সুযোগ পাব।
ঘটনা হল, সত্যিই অনেক দূর দূর গ্রামে খবরটা চলে গিয়েছিল। এবং প্রভাব খুব ভাল পড়েছিল। মুখে মুখে কথাটা এইভাবে ঘুরেছিল: কলকাতার এক কমরেড এসে আমাদের এতকালের রীতিরেওয়াজ একেবারে ওলটপালট করে দিয়েছে।
এরকমই হওয়ার কথা। কম বা বেশি।
ঠিক এই কারণেই শবরিমালা মন্দিরে নারীর প্রবেশাধিকার নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সদর্থক রায়ের পর কেরলে বিজয়ন সরকার তাকে যখন রূপায়ণের চেষ্টা করেছিল, জনবিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি নিয়েও, অনেকের সন্দেহ সংশয় উপেক্ষা করেই আমি তার পক্ষে দাঁড়িয়ে লিখেছিলাম।
তথাপি অনেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভয় পাচ্ছেন।
সেই কারণটা এবার বুঝতে হবে।
এই জায়গায় এসে উপরে যাঁদের শেখানোর কথা বললাম, তাঁদের দায়িত্বের বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবে।
অনেকে পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনকালে মার্কসবাদী ক্যাডারদের ধর্মীয় প্রচারে উৎসাহদানের কথা বলে থাকেন। পাড়ায় পাড়ায় দুর্গাপূজা কালীপূজায় অংশগ্রহণের কথা তুলে থাকেন। কলকাতা থেকে তসলিমা নাসরিন বিতাড়নে বা তসলিমার “দ্বিখণ্ডিত” উপন্যাস নিষিদ্ধকরণে মুসলিম উগ্র মৌলবাদীদের সঙ্গে নগ্ন আপসের কথা বলে থাকেন। যেন তার থেকেই এই রাজ্যে ধর্মীয় উন্মাদনার বাড়বাড়ন্ত হয়েছে।
ঘটনাগুলি ভুল না হলেও বছরের অঙ্কটায় এবং ভূগোলে মারাত্মক ভুল রয়েছে। সমস্যাটা আদৌ ৩৪ বছরের নয়, কমপক্ষে একশো বছরের। আর এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা নয়, সারা ভারতের। আমার অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত দু-চারটে ঘটনার কথা তুলে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করা যাক।
১৯৮০-র দশকের শেষদিকে আমি তখন উত্তরভারতে রাজনৈতিক কাজকর্ম করছি। পাঞ্জাবে থাকার সময়ে একদিন সকালে পাতিয়ালা জেলার একজন সিপিআই নেতার বাড়িতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছি। তিনি জেলা কমিটির সদস্য। বাড়ির কেউ একজন আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে বসতে বলে জানালেন, কমরেড এখন পুজো করছেন। আধা ঘন্টা ইন্তেজার করতে হবে। কিছু যেন মনে না করি। কী আর করি। চেয়ারে বসে একটা পাঞ্জাবি খবরের কাগজ টেনে নিয়ে অক্ষরগুলো চেনার চেষ্টায় মন দিলাম।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে তিনি দেখা দিলেন এবং আন্তরিক লজ্জিতভাবে বললেন, বুরা না মানিয়ে, সবেরে পূজাপাঠ মেঁ মেরা কুছ ওয়ক্ত বীত জাতি হ্যায়। এরপর আমি তার সঙ্গে যে আলোচনা জুড়ে দিই সেটা এখানে আমার বক্তব্য হিসাবে একটু পরেই বলছি। পাঠকদের আপাতত এই ছবিটা শুধু মনে রাখতে বলছি— একজন মার্কসবাদে বিশ্বাসী কমিউনিস্ট কর্মী, একজন জেলা কমিটির সদস্য, প্রতিদিন সকালে পূজা-অর্চনায় ঘন্টাখানেক ব্যয় করে থাকেন। মানে, সেইকালে থাকতেন। আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস, এরকম প্রজাতির কমিউনিস্ট নেতারা একালেও পুজোয় (এবং ক্ষেত্রান্তরে, নামাজে) বেশ সহৃদয়ভাবেই অংশগ্রহণ করে থাকেন।
আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, ধর্ম তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে দল কোনও হস্তক্ষেপ করে না। তিনিও দলের মতাদর্শের সঙ্গে এর কোনও বিরোধ আছে বলে মনে করেন না। পূজাপাঠ দেশজ পারিবারিক ঐতিহ্যের ব্যাপার। এগুলো রক্ষা করেই কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
কমরেড হরকিসেন সিং সুরজিৎ। ছাত্রজীবন থেকে একজন যথার্থ লড়াকু সৈনিক হিসাবেই ধাপে ধাপে উপরে উঠে এসেছেন, অবশেষে একদিন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছেন। সর্বোচ্চ পদে আসীন মানে হল সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা। তাঁকে দেখেই দলের সাধারণ কর্মীরা শিখবে, আমজনগণ অনুপ্রেরণা পাবে। সেই তাঁকে দেখেছি (এবং আমার ধারণা, আরও অনেকেই দেখেছেন— সামনে থেকে কিংবা ছবিতে), তিনি আমৃত্যু মাথায় পাগড়ি পরে দাড়ি রেখে শিখ সেজেই রইলেন। সব ঝেড়ে ফেলে ধর্ম মানি না, ঈশ্বর নেই এরকম একটা সাংস্কৃতিক ভাবমূর্তি নিজের সত্তায় জুড়তে পারলেন না।
দু-একজনকে ওখানে আমি এই ব্যাপারে যখন প্রশ্ন করেছি, এমন কেন, তাঁরা বলেছেন, এমন সাজসজ্জা না হলে নাকি কমিউনিস্টরা আমজনতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
সত্যিই কি তাই?
আমি যে সময়ে পাঞ্জাবে ঘুরেছি, তখন থিতিয়ে এলেও খালিস্তানি জঙ্গি আন্দোলনের রেশ ধিকিধিকি জ্বলছে। সেই অবস্থাতেও প্রচুর সংখ্যায় শিখ যুবককে দেখেছি লম্বা চুল দাড়ি কেটে ফেলতে, মাইকেলি দাড়ি রেখে রাস্তায় ঘাটে প্রকাশ্যে ঘুরতে। শিখধর্মের পাঁচ ক-এর সঙ্গেও তাঁরা তদ্দিনে আড়ি পাতিয়ে ফেলেছেন। সেই সময় ধর্মীয় বাহিরাঙ্গিক উপচার ফেলে দিলে তাঁদের থেকে সুরজিৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেন? মনে হয় না। বরং সেই ঝেড়ে ফেলার আন্দোলন আরও শক্তিশালী হতে পারত।
কমরেড মাও সে-তুং বলেছিলেন, কমিউনিস্ট নেতারা হবেন রেলগাড়ির ইঞ্জিনের মতো। তাঁরা সামনে থেকেই সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবেন। মাও তো বোধহয় জানতেই পারেননি, তাঁর এই কথা বলার অন্তত একশো বছর আগেই ভারতের মাটিতে উনিশ শতকে এক ঈশ্বরচন্দ্র, একজন অক্ষয় দত্ত, একজন জ্যোতিরাও ফুলে— এই ইঞ্জিনের ভূমিকা পালন করে গিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতারা সেই উদাহরণগুলি দেখেও আদর্শগত সংগ্রামে ইঞ্জিন হতে শিখলেন না।
কমরেড ইয়াকুব পৈলান। এসইউসিআই দলের দ্বিতীয় প্রজন্মের পলিটব্যুরোর সদস্য। তিনিও ক্ষেতমজুর পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। দলের একেবারে নিম্নতম স্তর থেকে আপন যোগ্যতায় সর্বোচ্চ স্তরের নেতৃত্বে পৌঁছানো, শ্রেণিসংগ্রামের আগুনে পোড়খাওয়া একজন সর্বত্যাগী বিপ্লবী। মৃত্যুর আগে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করে গিয়েছিলেন। এই দলের সদস্যদের মধ্যে নেতা এবং কর্মীদের মধ্যে নাস্তিক্যবাদের প্রতি দায়বদ্ধতা একটা সময় পর্যন্ত অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোর তুলনায় অনেক বেশি ছিল। পৈলানের মৃত্যুর পর দেখলাম, এখানেও ঘুণ ধরেছে। দেহ দান তো হলই না, উলটে হাসপাতাল থেকে কলকাতার পার্টি অফিস ঘুরিয়ে গ্রামের বাড়িতে মরদেহ নিয়ে গিয়ে (যে বাড়ির সঙ্গে তিনি অন্তত সত্তর বছর কোনও সংস্রবই রাখেননি) বেশ হইহই করে ইসলামি কায়দায় জানাজা করে দাফন করা হল।
এর জন্য অবশ্য কমরেড পৈলানকে দায়ী করা চলে না। দায়ী হলেন দলের বর্তমান জীবিত নেতারা। যাঁরা একজন সহকর্মীর শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে দিলেন না। ধর্মীয় সংস্কারের সঙ্গে আপস করে দলে লোক ধরে রাখার জন্য।
এইভাবেই ধর্মের ধৃ ধাতু কিংবা religare শুধু আমজনতাকে নয়, কমিউনিস্ট কর্মীদেরও বেশ ভালমতো ধারণ করবে বলে আঁকড়ে ধরেছে।
কিন্তু কথা হল, নেতারা মার্কসবাদের শিক্ষাগুলো ভুলে গেলেন মানে হল কর্মীরাও আর অন্যরকম কিছু শিখতে পারলেন না। তারও মানে হল, জনগণের মধ্যে সেইসব শিক্ষার ফোটনকণাগুলি কোনওদিন পৌঁছলই না! যাঁদের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সামাজিক কর্মযজ্ঞে ইঞ্জিন হওয়ার কথা ছিল, তাঁরা বাইশ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো সেই মেইল ট্রেনের একেবারে পেছনে ভিআইপি সেলুনকারে বসে রইলেন। আর মাঝে মাঝে মার্কস আর লেনিনের কিছু সুপরিচিত কথা কেটেকুটে নিয়ে উচ্চারণ করে গেলেন।
পুরো কথাগুলি তাঁদের আর কখনওই মনে পড়ল না।
এই অবস্থায় যদি দেশে ধর্মোন্মাদনা বেড়ে গিয়ে থাকে, এমনকি পশ্চিমবঙ্গ বা কেরলেও, সেটা কি খুব অস্বাভাবিক?
ধর্ম প্রসঙ্গে মার্কসবাদ: পুনরুচ্চারণ
ধর্মের প্রতি বহু কাল ধরেই— শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই— মার্কসবাদী প্রবক্তারা, কমিউনিস্ট পার্টিগুলির অধিকাংশই বেশ নমনীয় হয়ে উঠেছে। ভারত পাকিস্তান মায়ানমার শ্রীলঙ্কা কিংবা বাংলাদেশের মতো পশ্চাদপদ দেশগুলির ক্ষেত্রে এইকথা আরও বেশি করে সত্য। ধর্মের নামে মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা অবশ্যই সরব ও সক্রিয়, কিন্তু সেটা তাঁরা এমনভাবে করেন যেন ধর্মীয় চিন্তার গায়ে সামান্য আঁচড় বা আঁচও না লাগে। ধর্মের এক আদি কল্পিত কল্যাণময় রূপের সঙ্গে তাঁরা বর্তমান বিকৃতির তুলনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই ব্যাপারেও কয়েকটা কথা বলা দরকার।
প্রথমেই জানা দরকার, এই প্রবণতার শুরু কোত্থেকে এবং কবে থেকে।
আমি যত দূর জানি, এর সূত্রপাত হয়েছিল ব্রিটিশ মার্কসবাদী প্রতিভাবান লেখক ও বিশ্লেষক, স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারের সপক্ষে হিটলার সমর্থিত ফ্রাঙ্কোর স্বৈরাচারী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহিদ, ক্রিস্টফার কডওয়েল (১৯০৭-৩৭)-এর ১৯৪৮ সালে (মরণোত্তর) প্রকাশিত Further Studies in a Dying Culture গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের এক আলোচনা[1] থেকে। এটা পড়লে দেখা যাবে, কার্ল মার্কসের ১৮৪৩-৪৪ সালে হেগেলের একটি বইয়ের সমালোচনামূলক লেখা থেকে ধর্ম সম্পর্কে কিছু কথা চয়ন করে তুলে আনা হয়েছে এমনভাবে যেন, এটাই ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের বক্তব্য। কিন্তু এটা মার্কসের মার্কসবাদী বয়ান কিনা, কডওয়েল নিজে এবং পরবর্তীকালে অন্যান্যরা প্রায় কেউ বিবেচনা করে দেখেননি।
ভাল করে খেয়াল করলে বোঝা যাবে, বাস্তবে মার্কস তখনও মার্কসবাদী মার্কস হননি। তিনি তখন সদ্য হেগেলের ভাববাদী দর্শনের সর্বব্যাপক আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হয়ে ফয়ারবাখের বস্তুবাদের গদ্য আবহে মুগ্ধ। বন্ধুবান্ধবদের তিনি চিঠিপত্রে ফয়ারবাখ পড়তে বলছেন। জার্মান ভাষায় ফয়ারবাখের নামের আক্ষরিক অর্থ তুলে ধরে লোকজনকে বলছেন, “And there is no other road for you toward truth and freedom than this ‘stream of fire’ (Feuer-bach). Feuerbach is the purgatory of our time.”[2] তিনি ফয়ারবাখকে অনুরোধ করছেন, শেলিং-এর ভাববাদী দর্শনের বিরুদ্ধে কিছু লেখার জন্য। এই বলে যে “জার্মানিতে আপনিই বর্তমানে এই কাজের একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি।” ইত্যাদি।[3]
ফয়ারবাখ যখন বলছেন, “Religion is the sleep of the human spirit”[4], মার্কস একটা অনুচ্ছেদ শেষ করছেন এই বাক্য দিয়ে: “It is the opium of the people”! সাদৃশ্য বা অনুসরণ অত্যন্ত স্পষ্ট।
হ্যাঁ, একথা ঠিক, তখনও মার্কস সম্ভবত নিজের অজান্তেই তাঁর এই নতুন গুরু “বহ্নিস্রোত”-কে ছাড়িয়ে সামনের অভিমুখে আরও দু-চার পা ফেলেছেন, প্রথম গুরু হেগেলের শিক্ষানুযায়ী ধর্মকে ইতিহাস সমাজ রাষ্ট্রের সঙ্গে একত্রে রেখে বিচার শুরু করেছেন, শোষিত নিপীড়িত মানুষ কেন ধর্মকে অবলম্বন করে, সেইদিকে নজর দিয়েছেন। তার ভিত্তিতেই এমন কিছু মূল্যবান কথা তিনি লিখেছেন যেগুলো আধুনিক মার্কসবাদীরা সাগ্রহে উল্লেখ করে থাকেন। এটা না দেখে যে এইসব বয়ানের কোথাও শ্রেণি, শ্রেণিবিভেদ, শ্রেণিশোষণ ও শাসনের কথাগুলি তখনও ঢোকেনি। রাষ্ট্র শাসনযন্ত্র হিসাবে প্রতিভাত হলেও তখনও তা তাঁর কাছে শ্রেণি-শাসনযন্ত্র নয়।
আবার ধর্মের মধ্যে আমজনগণের যে (মিথ্যা) আশ্বাস ও আশ্রয় মেলে, তাকে ভিত্তি করেই ফয়ারবাখ পরে তাঁর অগ্নিশিখাকে কার্যত নির্বাপিত করে এক “সম্প্রীতির ধর্ম” (Religion of Love) তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যাকে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাঁর ফয়ারবাখ সম্পর্কিত রচনায় সমর্থন করা তো দূরের কথা, কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিলেন— যাকেও মার্কসের মার্কসবাদী বক্তব্যেরই অনুরণন বলে ধরা উচিত। ফয়ারবাখ লাতিনে religion শব্দের মূল religare যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ to bind দেখিয়ে বলেছিলেন, আমাদেরও এখন সেই অনুযায়ী মানুষে মানুষে প্রীতির সম্পর্ক ধরে রাখার উপযোগী এক মানবধর্ম চালু করতে হবে। এঙ্গেল্স এই ব্যুৎপত্তি ধরে বিচারেরও সমালোচনা করেছিলেন। ভারতেও একদল চিন্তাশীল ব্যক্তি ধর্মের সংস্কৃত “ধৃ”-ধাতু উল্লেখ করে বলে থাকেন, ধর্ম হচ্ছে তাই যা মানবিক সম্পর্ককে ধারণ করে। এই সব ব্যাকরণগত প্রকরণ দিয়ে ধর্মের ইতিহাসে ভূমিকার কিছুই বোঝা যায় না।
আর সেই কারণেই এঙ্গেল্স এক সময় ইউরোপের মার্কসবাদী কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, সতেরো ও আঠেরো শতকের ইং-ফরাসি যুক্তিবাদী বস্তুবাদীদের ধর্মের সমালোচনামূলক রচনাগুলি নতুন করে ছাপিয়ে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে প্রচারে আনা দরকার। যে পরামর্শ কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনও বলশেভিক দলের সভ্যদের কাছে পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।
লেনিন কীভাবে দেখেছিলেন ধর্মসংক্রান্ত বিষয়কে?
তাঁর তিনটে প্রবন্ধ আছে এই বিষয়ে, যা আজকালকার জগজ্জোড়াজালের দুনিয়ায় যে কেউ যখন ইচ্ছে দেখে এবং পড়ে নিতে পারেন। তাতে তিনি সমস্যাটিকে দুদিক থেকে দেখেছেন: একটা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নীতি বা রাষ্ট্রের কাছে দাবি হিসাবে; অপরটি হল দলের অভ্যন্তরীণ নীতি হিসাবে।
রাষ্ট্রের কাছে কমিউনিস্টদের দাবি (এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে তাদের অন্যতম কর্তব্য) হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করা, যার অর্থ হচ্ছে নিম্নরূপ:
ক. সমস্ত নাগরিকের ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা, ধর্মবিশ্বাস পালনের অধিকার সুনিশ্চিত করা;
খ. বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী নাস্তিকদের সমান অধিকার প্রদান; এবং
গ. সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্ত ক্ষেত্রকে (আইন, আদালত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন, কলকারখানা, ইত্যাদি) ধর্মমুক্ত রাখা।
একটা কমিউনিস্ট পার্টিও কি দলের অভ্যন্তরে এই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে চলবে? যে যার ধর্মবিশ্বাস রক্ষা ও পালন করে দলের সদস্য হতে পারবে?
না।
কমরেড লেনিনের স্পষ্ট উত্তর, পার্টির কর্মসূচি অনুযায়ী মার্কসবাদকে গ্রহণ করার পূর্বশর্ত হিসাবে প্রতিটি কমিউনিস্ট কর্মীকে অবশ্যই নিরীশ্বরবাদী হতে হবে। এই প্রশ্নে কোনওরকম আপস করা চলবে না।
ম্যাক্সিম গোর্কি ও আনাতলি লুনাচার্স্কির মতো কোনও কোনও বলশেভিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী যখন মানবধর্ম, ঈশ্বরবর্জিত ধর্ম ইত্যাদি নাম দিয়ে এক ধরনের বিশুদ্ধ ধর্মমত প্রচার করে যাচ্ছিলেন, লেনিন তাঁদের বিরোধিতা করেছিলেন। লুনাচার্স্কিকে সরাসরি, গোর্কির ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে। দুজনের সম্পর্কেই গেওর্গি প্লেখানভ যে তীক্ষ্ণ ও সবিস্তার সমালোচনা করেছিলেন তাঁর On the So-called Religious Seekings in Russia (১৯০৯) শীর্ষক প্রবন্ধগুচ্ছে, লেনিন তাকেও প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
সেই প্রবন্ধে প্লেখানভ চমৎকারভাবে দেখিয়েছিলেন, ধর্মকে যে নামেই ডাকি, যেভাবেই উপস্থাপন করি, শেষপর্যন্ত তা সাধারণ মানুষ শুধু নয়, কমিউনিস্ট কর্মীদেরও মনকে বস্তুবাদের বিরুদ্ধে ও ঈশ্বরভজনার দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। নানারকম শব্দের খেলায় বিভ্রান্ত করে। যার প্রতিক্রিয়ায় সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা ও কর্ম ভুল দিশায় মগ্ন হতে বাধ্য। দুঃখের বিষয় আমাদের কালের মার্কসবাদী কর্মীরা অনেকেই (নেটে সহজলভ্য) প্লেখানভের এই মূল্যবান প্রবন্ধটির পাঠরসে নিজেদের বঞ্চিত রেখেছেন।
আরও কাছ থেকে
এবার কমরেড লেনিনের দুটি রচনা থেকে একটু বিস্তারিত উদ্ধৃতি সহযোগে ধর্মীয় অনুভূতির সংবেদনশীলতায় মার্ক্সীয় প্রত্যুত্তর কেমন হবে দেখা যাক।
পূর্বোল্লিখিত রচনায় প্লেখানভ ধর্মের সমাজতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক সমস্যাটির ভাল আলোচনা করেছিলেন। ধর্মের তত্ত্বগত সমস্যা বুঝতে যে শুধু ধার্মিকদের নয়, মার্কসবাদীদেরও বিভ্রান্তি কাজ করছিল তাও চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন। জনৈক ধার্মিক রুশ বুদ্ধিজীবী যখন তদানীন্তন রাশিয়ার নিরীশ্বরবাদীদের সম্পর্কে বলেন যে “Our intelligentsia show a startling ignorance of religious matters. … On the question of religion, our intelligentsia have not yet emerged from adolescence, they have not yet thought seriously about religion”, প্লেখানভ তাঁর সঙ্গে একমত হলেন। সেই সঙ্গে যোগ করলেন, “What Mr. Bulgakov says is the truth, but not the whole truth. He has forgotten to add that ignorance in religious matters is displayed in our country not only by those who profess atheism, but also by those who engage in one way or another in ‘god-seeking’ and ‘god-building’. Our ‘god-seekers’ and ‘god-builders’, too, have not as yet thought seriously of religion,…”
কিন্তু সেই প্রবন্ধগুচ্ছে ধর্মের প্রভাব কাটাতে রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের কাজ কী হবে সে ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেননি। স্বভাবতই সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন কমরেড লেনিন।
১৯০৫ সালে লিখিত “সমাজতন্ত্র ও ধর্ম” প্রবন্ধটিতে তিনি বুঝতে-ইচ্ছুকদের-বোঝার-মতো করেই লেখেন:
ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে ঘোষণা করা উচিত। এই উক্তিতেই সাধারণত ধর্ম সম্পর্কে সমাজতন্ত্রীদের মনোভঙ্গি অভিব্যক্ত। কিন্তু কোনও রূপ বিভ্রান্তির সম্ভাবনা পরিহার করার জন্য এই সব শব্দাবলির অর্থ সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হওয়া দরকার। রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষিতেই আমরা ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে বিবেচনার দাবি করছি। তাই বলে আমাদের দলের ক্ষেত্রে আমরা ধর্মকে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার বলে বিচার করতে পারি না। ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রের কোনও গরজ থাকা চলবে না এবং ধর্মীয় সংস্থাসমূহের রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত হওয়া চলবে না। যে কোনও ধর্মে বিশ্বাস অথবা কোনও ধর্মই না মানায় (অর্থাৎ, নাস্তিক হওয়ায়— যেমন প্রতিটি সমাজতন্ত্রী) সকলেই থাকবে সম্পূর্ণ স্বাধীন। ধর্মবিশ্বাসের জন্য নাগরিকদের অধিকারে কোনও প্রকারের বৈষম্য কোনও ক্রমেই সহ্য করা হবে না। এমনকি সরকারি নথিপত্রে যে কোনও নাগরিকের ধর্মের উল্লেখমাত্রও প্রশ্নাতীতভাবে বর্জিত হবে। … গির্জা ও রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ— এই হল আধুনিক রাষ্ট্র ও আধুনিক গির্জার কাছে সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারিয়েতের দাবি।
অথচ তাঁর মতে,
যেখানে সমাজতান্ত্রিক প্রলেতারিয়েতের পার্টির কথা উঠছে সেখানে ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। আমাদের পার্টি হল শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির জন্য শ্রেণিসচেতন আগুয়ান যোদ্ধাদের বাহিনি। ধর্মবিশ্বাসের আকারে শ্রেণিচেতনার অভাব, অজ্ঞতা কিংবা তমসাচ্ছন্ন মতবাদ সম্বন্ধে এমন বাহিনি নির্বিকার থাকতে পারে না, বা থাকা উচিত নয়। … আর আমাদের পক্ষে মতাদর্শগত সংগ্রাম কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। এটা গোটা পার্টির ব্যাপার, সমগ্র প্রলেতারিয়েতের ব্যাপার।
দলের নেতাকর্মীদের অবস্থানের বিষয়টাকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেওয়ার পর এবার লেনিন ঢুকছেন কারখানার শ্রমিক ও জনগণের অন্যান্য অংশের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে দলের ভূমিকা কী হবে সেই প্রশ্নে:
তাই যদি হয়, তাহলে আমরা আমাদের কর্মসূচিতে নিজেদের নাস্তিক বলে ঘোষণা করছি না কেন? খ্রিস্টান বা ঈশ্বরবিশ্বাসীদের কেন আমাদের দলে যোগদান করায় নিষেধাজ্ঞা জারি করছি না?
… [কারণ] আমাদের কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক এবং বস্তুবাদী বিশ্ববীক্ষার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং ধর্মীয় কুহেলিকার সত্যকার ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক মূলের ব্যাখ্যাও আমাদের কর্মসূচি ব্যাখ্যার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের প্রচারে নাস্তিক্যবাদের প্রচারও আবশ্যক। … সম্ভবত একদা জার্মান সমাজতন্ত্রীদের উদ্দেশে এঙ্গেল্সের প্রদত্ত উপদেশ এখন আমাদের অনুসরণ করতে হবে, অর্থাৎ, অষ্টাদশ শতাব্দের ফরাসি জ্ঞানপ্রচারক ও নাস্তিকদের সাহিত্যের অনুবাদ করে প্রচার।
কিন্তু কোনও অবস্থাতেই আমরা বুর্জোয়া র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটদের প্রদর্শিত কায়দায় ধর্মীয় প্রশ্নকে বিমূর্ত ভাববাদী পদ্ধতিতে শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কহীন বুদ্ধিজীবীসুলভ উপস্থাপনার বিভ্রান্তিতে পা দেব না। শ্রমিক জনগণের অন্তহীন শোষণ ও যন্ত্রণা যে সমাজের ভিত্তি, সেখানে বিশুদ্ধ প্রচারের মাধ্যমে ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণের প্রত্যাশা বুদ্ধিহীনতার নামান্তর। … পুঁজিবাদের তামস শক্তির বিরুদ্ধে স্বীয় সংগ্রামের মাধ্যমে চেতনালাভ ব্যাতীত হাজার একটা পুস্তিকা ছাপিয়ে প্রচার করে প্রলেতারিয়েতকে আলোকপ্রাপ্ত করা সম্ভব নয়। পরলোকে স্বর্গ সম্পর্কে সর্বহারাদের মতৈক্য অপেক্ষা পৃথিবীতে স্বর্গ সৃষ্টির জন্য নির্যাতিত শ্রেণির এই সত্যকারের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ঐক্য আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।[5]
১৯০৯ সালে লেনিন আবার একটি প্রবন্ধ লেখেন। আলোচ্য দ্বিতীয় প্রবন্ধটির শিরোনামই হচ্ছে “ধর্ম প্রসঙ্গে শ্রমিকশ্রেণির দলের মনোভাবনা”! নামেই মালুম, লেনিন এই লেখায় একেবারে খোলাখুলি কাজের কথাটা পরিষ্কার করে দলের নেতা কর্মী সদস্যদের কাছে তুলে ধরতে চান:
Social-Democracy bases its whole world-outlook on scientific socialism, i. e., Marxism. The philosophical basis of Marxism, as Marx and Engels repeatedly declared, is dialectical materialism, which has fully taken over the historical traditions of eighteenth-century materialism in France and of Feuerbach (first half of the nineteenth century) in Germany—a materialism which is absolutely atheistic and positively hostile to all religion. … Marxism has always regarded all modern religions and churches, and each and every religious organisation, as instruments of bourgeois reaction that serve to defend exploitation and to befuddle the working class.[6]
লেনিনের এই আলোচনাগুলি অত্যন্ত সুন্দর ও শক্তিশালী বয়ান এবং আজও আমাদের কাছে পথনির্দেশক ভূমিকা পালন করতে পারে।
এযাবত বিশ্বের অধিকাংশ কমিউনিস্ট দলগুলি লেনিনের ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ক মন্তব্যগুলিকেই গ্রহণ ও প্রচার করেছে। আর ধর্মের প্রশ্ন নিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের শিবিরে উগ্র নাস্তিক্যপনার বিরুদ্ধে বলা লেনিনের পরামর্শটিকে বেশ আপ্যায়ন করেই মনেও রেখেছে এবং চর্চাও করেছে। বাকি সমস্ত বক্তব্যই তারা হয় অগ্রাহ্য করেছে, অথবা, কীভাবে কার্যকর করবে, বুঝতেই পারেনি। কিন্তু এখন প্রতিক্রিয়ার যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবীর বুকে, তাতে আর না বুঝলে চলবে না। এই প্রতিক্রিয়াকে সামাল দিতে হলে সাহস করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
এর জন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে তাদের দলীয় এবং বিভিন্ন গণ সংগঠনের মাধ্যমে মার্কসবাদের পাশাপাশি বিজ্ঞান ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এমনভাবে নিয়ে যেতে হবে এবং প্রচার করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ধ্যানধারণা, জাতপাত ও নানারকম কুসংস্কারের ভিত দুর্বল হতে থাকে এবং যুক্তিতর্ক করে তথ্য ও সত্য গ্রহণ করার মতো মানসিকতা তৈরি হতে থাকে। এটা হচ্ছে কিনা দেখে এবং সমীক্ষা করে প্রচারের কৌশলে ক্রমাগত উন্নতিসাধন করতে হবে।
সকলেই জানেন, ঘরের জিনিসপত্রের গায়ে লেগে থাকা পুরনো জমাট বেঁধে থাকা ময়লা নিছক শুষ্ক ঘষাঘষি করে ঠিকঠাক সাফ করা যায় না, জলে ভিজিয়ে নরম করে সাবান দিয়ে ভাল করে বারংবার ঘষতে হয়। ঠিক একইভাবে গণমানুষের মগজে দীর্ঘদিন ধরে আসর জমিয়ে থাকা কুসংস্কার বা বিভ্রান্তিগুলিও শুধুমাত্র শুকনো কথায় আর উপর থেকে উপদেশ ও নির্দেশের দ্বারা উন্মূল করা যায় না, যুক্তিবাদী ও বস্তুবাদী চিন্তার ভিত্তিতে নানা তথ্য ও বিশ্লেষণ তুলে ধরে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের চিন্তা করার প্যাটার্নকে, ভাবনার তরিকাকে, পালটে দিতে হয়।
কাজটা কঠিন, কিন্তু সাধ্যাতীত নয়, যদি সাধনায় কোনও ফাঁক না থাকে।
বামপন্থী দলগুলি যদি এই দায়িত্ব অনুভব করতে পারে, তাহলে এখন থেকে তাদের একটা কাজের পরিকল্পনা করতে হবে। পশ্চিমবাংলা থেকেই শুরু করে ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাজ্যে সেই প্রক্রিয়া ছড়িয়ে দিতে হবে।
হোলির সময় পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠনের সদস্যরা কিছু কিছু হিন্দু ও শিখ মহল্লায় তিন-চার দিন দিবারাত্রি চারদিকে ঘুরে ঘুরে টহল দেয়, যাতে রং খেলার সময় মৌলবাদীরা বিরক্ত করতে বা বাধা দিতে না পারে। এই সব খবর আমাদের দেশের গণমাধ্যমে সচরাচর আসে না। এক আধবার কোনও ফুটো দিয়ে চুঁইয়ে চলে আসে। তার মানে এই নয়, আপনি যে বছর খবরটা পেলেন শুধু সে বছরই ওঁরা এমনটা করেছেন। ঘটনাটা ঘটে চলেছে বছরের পর বছর।
এই উদাহরণ সামনে রেখে আমাদেরও সমস্ত বামপন্থী দলের ছাত্রযুব কর্মীদের নিয়ে রেড ভলান্টিয়ার্স-এর অনুরূপ একটা যৌথ বাহিনি তৈরি করা হোক। সেই বাহিনির সদস্যরা মুসলিম প্রতিবেশী এলাকায় যেসব জায়গায় বিজেপি দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগানোর চেষ্টা চালায় সেই সব এলাকায় পাহারা দেবে। প্রচার করবে। বিপন্ন পরিবারকে সাহায্যের আশ্বাস দেবে। মন্দিরের সামনে গরুর মাংস বা মসজিদের সামনে শুয়োরের মাংস পড়ে আছে (আরএসএস-এর পুরনো খেলা) জানলেই সেখানে উপস্থিত হয়ে সংশ্লিষ্ট জনতাকে বোঝাবে, উত্তেজনা প্রশমিত করবে, ইত্যাদি।
একইভাবে রাম নবমীর সময় তারা মসজিদের আশপাশের এলাকাকে এমনভাবে পাহারা দেবে যাতে কোনও রামালু মিছিল সেদিকে যেতে না পারে।
এরকম ঘটনা দুচারটে জায়গায় করে ফেলতে পারলেও (আজকের দিনের ই-নেটওয়ার্কের সৌজন্যে) তার যে বিপুল প্রচার হবে, তাতে বিজেপি গ্যাংস্টারদের একটা বড় পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বানচাল করে দেওয়া যাবে।
এই শক্তি এখনও বামপন্থীদের আছে। শক্তির ব্যবহার হলে তা টিকে থাকবে শুধু নয়, লামার্কীয় ফরমুলায় বৃদ্ধিও পাবে। কিন্তু দীর্ঘ অব্যবহারে আর কতদিন থাকবে বলা মুশকিল!
গত একশো বছরে অনেক ফাঁকি দিয়েছি আমরা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে আমরা মার্কসবাদীরাও বেশিরভাগ তফাত করতে শিখিনি, অক্ষয়কুমার দত্ত আর অরবিন্দ ঘোষের মধ্যে আমরা এতকাল পার্থক্য কোথায় বুঝতে পারিনি। সেই পার্থক্য বোঝার জায়গা থেকে শুরু করলে আমরা হয়ত অচিরেই লেনিনের কথাগুলিও বুঝতে সমর্থ হব। তখনই একমাত্র পরিষ্কার হবে যে ধর্মাচ্ছন্ন আমজনগণের প্রতি সহানুভূতি আর ধর্মানুভূতির প্রতি দুর্বলতা বা ধৃতরাষ্ট্রপনা ঠিক এক জিনিস নয়। আর তখন নিজেদের কর্তব্য বুঝে নিতে অসুবিধা হবে না।
আরও একবার মাও সে-তুং-কে স্মরণ করে বলি— Cure the disease to save the patient!
বিজেপি-অসুখ থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতেই হবে।
[1] Caudwell, Christopher. The Breath of Discontent: A Study in Bourgeois Religion: Further Studies in a Dying Culture.
[2] Cited, Thrower, James. Marxist-Leninist Scientific Atheism and the Study of Religion and Atheism in the USSR. Mouton Publisher. Berlin, 1982. p.10.
[3] Cited, Plekhanov, G. End Note 8: Fundamental Problems of Marxism.
[4] Cited, Plekhanov, G. End Note 120: On the So-called Religious Seekings in Russia.
[5] Lenin, V. I. Socialism and Religion.
[6] Lenin, V. I. The Attitude of Workers’ Party to Religion.